Alapon

দায়িত্ববান এক নওজোয়ানের গল্প!



ক).
তিনি একজন টগবগে যুবক মানুষ। শরীরে রয়েছে যার ভরপুর যৌবন। রয়েছে যৌবনের সকল তেজ ও ক্ষমতা, শক্তি ও সামর্থ্য, আবেগ ও উদ্দীপনা, উচ্ছ্বাস ও আমেজ; একেবারে সব কিছুই রয়েছে তার মধ্যে!
সদ্যই এই টগবগে যুবক বিয়ে করেছেন। বিয়ে করেছেন ভালো কথা, কিন্তু কাকে বিয়ে করেছেন তিনি? স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে যেহেতু একজন টগবগে নওজোয়ান; সেহেতু কোনো গর্জিয়াস সুন্দরী ও রূপবতী একজন কুমারীকে বিয়ে করেছেন। কিন্তু না, তিনি বিয়ে করেছেন তারচেয়ে বড়ো একজন বিধবা নারীকে। হ্যাঁ, সত্যিই তাই! এই বিয়ে কিন্তু তিনি কোনো লোভে বা চাপে পড়ে করেননি। স্রেফ মন থেকেই করেছেন। যে নারীকে তিনি তার জীবনসঙ্গীনী হিসেবে নির্ধারণ করেছেন, সে নারীর প্রতি তথা জীবনসঙ্গীনীর প্রতি রয়েছে তার অবারিত ভালোবাসা এবং সুদৃঢ় দায়িত্ব সচেতনতা।
একবারের ঘটনা, জিহাদের মতো কঠিন ইবাদতের পরপরই তিনি খুব দ্রুতই ছুটে চলছিলেন তার বাড়ির দিকে। স্ত্রীর কাছে। এতো দ্রুততম সময়ে বাড়ি ফিরে যেতে দেখে আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন,
'তুমি এতো তাড়াতাড়ি করছো যে! জবাবে তিনি বললেন ইয়া রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি নতুন বিয়ে করেছি!
দেখুন, মানুষ তার কর্মক্ষেত্র থেকে, অফিস থেকে কখন দ্রুততার সাথে ঘরে ফিরতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে? কখন কেউ কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে আসতে উউদগ্রীব হয়ে যায়? কখন বাসায় ফিরে আসতে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ে?
০১. হয়তো বাহিরে আপনি অসুস্থ হয়ে থাকলে।
০২. নয়তো বাসার কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা কোনো বিপদের সম্মুখীন হলে।
০৩ . কিংবা আপনার ভেতর যদি স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতা বা ভাইবোন তথা পরিবারের সদস্যদের জন্য অনেক বেশি মায়া ও ভালোবাসা কাজ করে, তখন।
তাহলে বুঝা গেলো যে, স্ত্রী পূর্ব বিবাহিতা বিধবা হলেও তিনি স্ত্রীকে যথেষ্ট পরিমাণ ভালোবাসতেন। ছিলেন স্ত্রীর প্রতি যথেষ্ট পরিমাণ কেয়ারিং। সেজন্যেই স্ত্রীকে সময় দিতে এতো তাড়াতাড়ি করছিলেন তিনি।
আমরা তো বলেছি যে, তিনি কোনো লোভ-চাপ বা প্রলোভনে পড়ে উক্ত নারীকে বিয়ে করেননি। এই যুবক কেন একজন বিধবা নারীকে বিয়ে করলেন তা আল্লাহর রাসুলের সাথে তার কৃত সংলাপের মধ্যেই ফুটে ওঠে। তিনি রাসুলে করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সে সংলাপেই তা স্পষ্ট করে জানান দেন।
আল্লাহর রাসুলের প্রশ্নের উত্তরে যখন তিনি বলেছিলেন আমি নতুন বিয়ে করেছি, তখনই আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন যে, তুমি কি কুমারী মেয়েকেই বিয়ে করেছো নাকি অ-কুমারী মেয়েকে? তিনি জবাব দিয়েছেন;
ইয়া রাসুলুল্লাহ ﷺ, আমি বিয়ে করেছি একজন বিধবা নারীকে।
রাসুল ﷺ পুনরায় তাকে প্রশ্নজুড়ে দিলেন যে, তুমি কীজন্য একজন কুমারী মেয়েকে বিয়ে করলে না, যার সাথে তুমি খেলা-কৌতুক করতে এবং সেও তোমার সাথে খেলা-কৌতুক করতো? তুমি কি কুমারী মেয়ের খেলা-কৌতুক উপভোগ করতে চাও না? তুমি কি চাওনা তোমার বয়সী কুমারী মেয়েকে বিয়ে করে তাকে নিয়ে হাসি, ঠাট্টা, দৌড়-ঝাঁপ এবং পরম এক ভালোবাসায় জীবন পার করতে?
তখন তিনি বলেন,
হে আল্লাহর রাসুল ﷺ আমার পিতা উহুদে শাহাদাতের সরাব পান করেছেন, এবং আমার ওপর রেখে গিয়েছেন আমার ছোটো ছোটো বোনদের দায়িত্ব। আমি তাদেরই মতো ( অল্প বয়সী কুমারী) কাউকে বিয়ে করতে চাইনি। আমার প্রয়োজন ছিলো কোনো পরিণত মহিলার। যে মহিলা তাদের চিরুনী করে দিতে পারে, বেনী বাঁধতে পারে এবং কাপড় সেলাই করে পরিয়ে দিতে পারে।
উল্লেখ্য ওনার এই স্ত্রীর নাম সুহাইলা বিনতু মাসউদ। তিনি বনু জুফার গোত্রের কন্যা ও আল্লাহর রাসুলের সাহাবিয়্যা ছিলেন। এবং এ-ও শোনা যায় যে, এই নারীরও ছিলো ছোটো ছোটো অনেকগুলো ভাইবোন। সবাইকে রেখে ওই বিধবা নারীরও বাবা মারা যান। এখন, এ থেকে আমরা এই সীদ্ধান্তেও আসতে পারি যে, তাদের প্রতি খেয়াল রাখার নিয়তেই যুবকটি সেই মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন।
এই যে মহান সাহাবিটি, তিনি কে? কী তার পরিচয়? তিনি হলেন আল্লাহর রাসুল ﷺ-এর বিখ্যাত সাহাবি জারির ইবনু আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু! তিনি হলেন একজন শহীদ পিতার গর্বিত সন্তান। তিনি পিতার করে যাওয়া ওসীয়তগুলোও অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে সচেষ্ট ছিলেন।
মূলত উহুদের পূর্বরাতে জাবিরের পিতা ’আবদুল্লাহ তাকে ডেকে বললেন,
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাহাবিদের মধ্যে যারা প্রথম দিকে শহীদ হবে, আমি নিজেকে তাঁদের কাতারেই দেখতে চাই। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পরে একমাত্র তুমি ছাড়া অধিকতর প্রিয় আর কাউকে আমি রেখে যাচ্ছিনে। আমার কিছু ঋণ আছে, তুমি তা পরিশোধ করে দেবে। আর আমি তোমাকে তোমার বোনদের সাথে ভালো আচরণের উপদেশ দিচ্ছি।
অতঃপর রাত কাটে, প্রভাত হাসে। সেই আলোকিত প্রভাতে জাবিরের পিতা মুজাহিদদের সাথে বের হলেন জিহাদের ময়দানে। বীরবিক্রমে সিংহ গর্জনে তিনি যুদ্ধ করতে লাগলেন। একপর্যায়ে এই বীর মুজাহিদকে আক্রমণ করে বসে সুফইয়ান ইবন ’আবদি শামস আস-সুলামি নামক এক কাফির ।সেই আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে ঢলে পড়লেন তিনি শাহাদাতের কোলে। পাণ করলেন শাহাদাতের অমীয় সুধা! হলেন উহুদের প্রথম শহীদ।
বাবা শহীদ হয়ে গেলেন। বোনদের দায়িত্ব এসে পড়লো জাবিরের কাধে। তিনি যে এমন দায়িত্ব নিজ কাধে নিলেন, সে দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে নিজে বিয়ে করলেন, তখন কি তিনি অঢেল অর্থ সম্পদের মালিক ছিলেন কিংবা ধনকুবের ছিলেন? না!! ছিলেন নিতান্তই একজন গরীব মানুষ। উক্ত সাহাবি যে পরিবারে বিয়ে করেছেন, আমরা তার মুখ থেকেই জেনেছি যে, সে পরিবার এবং সে নারীকে তিনি ভালোভাবে দেখেশুনে খোঁজ খবর নিয়েই বিয়ে করেছেন। বিয়ের পরেও তিনি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন।
খ).
এই যে আমাদের আলোচিত সোনালি সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকের একজন সৈনিক জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর মতো মানুষেরাও বিয়ে করে, আমরাও করি। তাদের বিয়ের নমুনা দেখুন আর আমাদেরটাও দেখুন! তারা অযথা ফ্যান্টাসির তুলনায় বাস্তবতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বেশি। তারা ধনকুবের না হয়েও স্ত্রী, সংসার, সন্তান এবং ভাইবোন নিয়ে সুখের সাথে জীবন পার করে দিতে পারতেন। আর এখন আমাদের লক্ষ-কোটি টাকা না হলে, বড়ো বড়ো কোম্পানির জব না করলে বিয়েই করতে পারিনা। যাদের ওরকম অঢেল টাকা নেই তারা আবার লোনের বোঝা মাথায় নিয়ে তবেই বিয়ের পীড়িতে বসে বা বসতে হয়। সমাজের বাস্তবতাই যে এমন!
আবার বিয়ের জন্য কনে খুঁজতে গিয়ে দেখি মেয়েটাকে হলিউড কিংবা বলিউডের নায়িকাদের মতো লাগছে কিনা, তার চেহারা কতোটা স্মার্ট, তাকে দেখতে কতোটা হ্যান্ডসাম আর সুশ্রী লাগছে, তার ফিগার কেমন, হাসি কেমন, হাটা কেমন, চুলগুলো কোমর অবধি লম্বা কিনা, তার পরিবার কেমন, বাবা কিংবা ভাইয়েরা প্রতিষ্ঠিত কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি...
এভাবে কনে খুঁজতে খুঁজতেও হয়রান হয়রান হয়ে যাই। তবুও দিনশেষে প্রত্যাশিত পাত্রী মেলেনা। স্মার্ট বয়ের জন্য গর্জিয়াস সুন্দরী জোগাড় হয় না।
এভাবে দিন যেতেই থাকে৷ যেতেই থাকে। বয়স বেড়ে যায়। চুল পেকে যায়। বিরাট একটা ভুড়িওয়ালা হয়ে যায়। হয়ে যায় অঢেল টাকাও। একপর্যায়ে শত শত পাত্রী দেখার পরে গিয়ে ইয়া বড়ো ভুড়িওয়ালা কাকুর জন্য একজন রূপসী রাজকন্যা ঠিকই জুটে যায়। কিন্তু তার ভেতর বেশিরভাগ সময়ই থাকেনা দ্বিনধারিতা-ধার্মিকতা, থাকেনা দায়িত্বশীলতা ও দায়িত্বসচেতনতা, থাকেনা মায়াবী মন আর ভালোবাসাময় অন্তরও! অনুপস্থিত থাকে সাংসারিক গুণাবলিও।
কারণ, সে নিজেই এমন একজন মানুষকে প্রাধান্য দেয়নি, যিনি দ্বিনদার। খোঁজেনি এমন একজন জীবনসঙ্গী, যিনি মুহসিনা। সারাজীবন খুঁজে বেড়িয়েছে হলিউড বলিউডের নায়িকাদের কপি। খুঁজেছে এমন নারীকে, যাকে দিয়ে সমাজে একটা প্রভাব তৈরি করা যায়, যাকে শো-অফ করে মানুষের বাহবা আর প্রশংসা কুড়ানো যায়। যার পিকচার ফেসবুক-ইনস্ট্র‍্যাগ্রামে আপলোড করে লাইক-কমেন্ট আর শেয়ারের বন্যা বইয়ে দেয়া যায় !
আবার অন্যদিকে টাকার গরম প্রদর্শন করতে, নিজেকে উঁচুজাতের মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে ঘরোয়া গায়ে হুলুদকে ক্লাব কিংবা রেস্টুরেন্ট ভাড়া করে সেখানে আয়োজন। নামি-দামি পার্লার থেকে বহু কৃত্রিম সাজ-সজ্জা, উভয় পক্ষেই হলুদ রঙের পাঞ্জাবি-শাড়িসহ হিন্দি গান। সে গানের তালে তালে যুবক-যুবতীদের উন্মাদ নাচ! যা চলে গভীর রজনী অবধি! এরপর বিয়ের কার্ড, বাহারি রকমের খাবার-দাবার, প্রি ওয়েডিং, ওয়েডিং, পোষ্ট-ওয়েডিং ফটোগ্রাফি, দামি পোশাক, গয়না, গেট ধরা, হাত-ধোয়া বখশিশ, কাবিন ইত্যাদি তো আছেই।
জগতের কাছে নিজেদেরকে কিউট কাপল হিসেবে উপস্থাপন করে দেখিয়ে দিতে ক্লাসিক্যাল পরিবেশে বৌ-ভাত, বাসর রাতসহ ইত্যাদি সবকিছুর হরেকরকম স্টাইলে পোজ দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড! এভাবে হানিমুন, জন্মদিন, ম্যারেজ এনিভার্সারি, এরপর মাঝেমধ্যে সারপ্রাইজ গিফট হিসেবে বিদেশে হানিমুন, বিখ্যাত নামকরা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া, কিংবা কখনো কখনো হাটু গেড়ে বসছি, একে অন্যকে ফুল দিচ্ছি কিংবা নিচ্ছি; সেই দেওয়া নেওয়া সারপ্রাইজ গিপ্টের ছবি চাচাতো-মামাতো-খালাতো কিংবা ফুফাতো ভাইদের দ্বারা তুলে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে জমানাকে দেখাচ্ছি আমরা কত্ত কিউট কাপল। আবার কিছুদিন পরে বউ প্রেগন্যান্ট হয়। সেই প্রেগন্যান্টের ছবিটাকেও ভাইরাল করি। ফেসবুকে পোস্ট করি....
এরকম করে কিছুদিন গেলো শো-অফ করে। হুট করেই কিছু একটা নিয়ে, বা সমাধানযোগ্য কোনো সাধারণ কোনো সমস্যা নিয়ে কথা-কাটাকাটি, ঝগড়া, মনোমালিন্য। সে মনোমালিন্য থেকে ডিভোর্স! হ্যাঁ, এভাবেই চলছে। যেভাবে পাল্লা দিয়ে শো-অফ চলছে, সেভাবেই তরতর করে ডিভোর্স রেট বাড়ছে। সম্পর্কগুলো যেনো হয়ে ওঠছে শুকনো ও নীরস। সবকিছুই চলছে কৃত্রিমতার ওপর। এমন মানুষদের কৃত্রিম শো-অফ দেখে আবার অন্য আরেক গ্রুপ ভীষণ হতাশা আর হীনমন্যতায় ভোগে! ভাবে —হায়, তারা কত্তো সুখে আছে, আনন্দে আছে। কী অনাবিল সুন্দর সম্পর্ক তাদের, কী আশ্চর্যরকম কেয়ারিং অমুকের হাজব্যান্ড বা অমুকের ওয়াইফ! শুধু আমার ভাগ্যই খারাপ!!
এ থেকে শুরু হয় নিজেদের সুন্দর আর ঘোচানো সংসারটাতে ঝামেলা, পাশের মানুষটির প্রতি সৃষ্টি হয় মনে এক অন্যরকম অশ্রদ্ধা। একপর্যায়ে গিয়ে তাতে তৈরি হয় ভাঙন! অথচ এই মানুষগুলো বুঝতে চেষ্টা করে না যে, মধুময় সম্পর্ক, কেয়ারিং পার্টনার শুধু শো-অফ-এর মাধ্যমে তৈরি হয় না। মধুময় সম্পর্ক আর কেয়ারিং পার্টনারিশপ সৃষ্টি হয় ভালোবাসার তীব্রতায়। ভালোবাসতে টাকা লাগে না। মধুময় সম্পর্ক সৃষ্টি করতে, একটুখানি কেয়ারিং পার্টনার হতে অঢেল অর্থ সম্পদ প্রয়োজন হয় না। সাথের মানুষটির আজকে মন খারাপ কেন, আজকে সে কেন এতো নিশ্চল বা নির্বিকার, সকালের নাস্তা হলো কিনা, দুপুরে একটু বিশ্রাম নেবার সুযোগ হলো কিনা, কাজের চাপ সামাল দিতে পারছে কিনা, শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছে কেন; এসব টুকটাক বিষয় জানতে কিংবা এসবে নজর রাখতে টাকা লাগে না। লাগে একটি মায়াবী মন। একটি যত্নশীল ও পরিশুদ্ধ অন্তর।
একটা কথা হলো যে, আজকের মানুষগুলো এটা বুঝতে চেষ্টা করে না যে, এই যে সোশ্যাল মিডিয়া, এখানে সবাই তার সবচেয়ে বেশি সুন্দর জিনিসটা-ই প্রদর্শন করে। তাই এই শো-অফটাই সব না। যদি টাকার গরম আর শো-অফেই সব হয়ে যেতো তাহলে কয়দিন পরপর এই টাইপের মানুষদের সম্পর্ক নষ্ট হতো না। ডিভোর্স রেট হু হু করে বাড়তো না। তাই সবকিছু সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে শো-অফ করতে হয় না। যার কারণে অনেকেই সবকিছু এখানে এসে প্রদর্শন করে না। শো-অফ করে না।
বলছিলাম সম্পর্ক টিকে থাকে মায়া ও ভালোবাসার তীব্রতায়। আসলেই তাই। যার ভেতর যতো বেশি মায়া আছে, আছে নিখুঁত ও নিখাঁদ ভালোবাসা, সে ততো বেশি সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল। সে ততোধিক শক্ত করে প্রিয় মানুষটাকে আজীবন কাছে কাছে রেখে দিতে চায়। তার কল্যাণ চায়। চায় তার মঙ্গল।
একটা বিষয় প্রশ্ন আসতে পারে, তা হলো ভালোবাসা কী? আমি মনে করি ভালোবাসা হচ্ছে একটুখানি আন্তরিকতা, একটি নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যেস। পাশের মানুষটির টুকিটাকি বিষয়য়েরও খোঁজ খবর নেয়ার অভ্যেস, সুখে দুখে, শান্তিতে কিংবা ক্লান্তিতে, হতাশাতে কিংবা আশাতে কাধে হাত রাখার অভ্যেস, কৃত্রিমতাহীনভাবে বুকে টেনে জড়িয়ে ভরসা দেয়ার অভ্যেস। তাহারাত থেকে তাহাজ্জুদে তার জন্য কল্যাণ কামনা করার অভ্যেস, আল্লাহর কাছে দুহাত পেতে দু'আ করার অভ্যেস। একের ভেতর দুই, দুই থেকে অনেক করার অভ্যেস! সবচেয়ে ভালো অভ্যেস হচ্ছে প্রিয়জনের জন্য দু'আ করার অভ্যেসে অভ্যস্ত হওয়া। যার স্ত্রী বা স্বামী তার সঙীর জন্য অসীম আল্লাহর কাছে দু'আ করে, তারচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান তাবত দুনিয়ায় আর কে হতে পারে? এমন একজন মানুষকে জীবনে পাবার চাইতে বড়ো সাফল্য জগতে আর কী হতে পারে? এইজন্য বাছাই করতে জানতে হয়। শুধু চোখ ধাধানো রূপ-রঙ দেখে, জাগতিক সাফল্যের সম্ভার কিংবা অঢেল অর্থ সম্পদ দেখে পাগল হয়ে গেলে হয়তো এই সাফল্যের অধরাই থেকে যাবে। একজন সচেতন মানুষ, একজন দায়িত্ববান পুরুষ এই সাফল্য ধরতে পারে। সে হাতছাড়া করে না এমন সাফল্য। এজন্য বিয়ে কারার আগে একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে তৈরি হতে হয়।
যাইহোক, আমাদের আলোচিত বিখ্যাত সাহাবি জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যেমন দায়িত্ববান মানুষ ছিলেন তেমনি পেয়েছেন তার স্ত্রীরও। আমরা রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস থেকে জানতে পারি যে, জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর স্ত্রী স্বয়ং আল্লাহর রাসুলের কাছে নিজ স্বামীর জন্য দু'আ চাইতেন। একবারের ঘটনা, নবি করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাবিরের ঘরে গেলেন। দাওয়াত দিয়েছেন তিনি। তো যখন রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় নিবেন তার ঘর থেকে, তখন অন্দর মহল থেকে তার স্ত্রীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো প্রিয় নবির কানে। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনতে পেলেন যে, তার স্ত্রী বলছেন যে,
"ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার ও আমার স্বামীর জন্য দু’আ করুন।
এটা শুনে তাতক্ষণাত তিনি তাদের জন্য দু'আ করলেন। বললেন : হে আল্লাহ, তাদের সকলের ওপর রহমত বর্ষণ করুন।
গ)
এই যে জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, কীভাবে তাঁর ভেতরে এতোটা দায়িত্বসচেতনতা সৃষ্টি হলো? যার জন্যে তিনি তাঁর ছোটো ছোটো বোনদের প্রতি এতোটা দায়িত্বশীলসূলভ আচরণ করলেন? পিতার করে যাওয়া নাসীহাকে তিনি পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করলেন? একজন নওজোয়ান হয়ে, যুবক মানুষ হয়ে কীভাবে একজন পূর্ব বিবাহিতা বিধবা ও তাঁরচেয়ে বড়ো নারীকে বিয়ে করেছেন? আজকে আমরা নওজোয়ানরা কি পারবো একজন বিধবা নারীকে, কিংবা পূর্বে বিবাহিতা কোনো নারীকে বিয়ে করতে? যে নারী আরো নিজের চেয়েও বড়ো। পারলেও কয়জন পারবো? এবং যারা শিক্ষিতশ্রেণির যুবক তাঁরাও কি খুব সহজেই পারবো? এবং সেই স্ত্রীর প্রতিও কি অনেক বেশি কেয়ারিং হতে পারবো? একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যুবক পারবে অবশ্যই, তবে সংখ্যাটা খুব বেশি বা মোটামুটি মানের সন্তোষজনক হবে না। তবে যারা পারবে তারা এতো কিছু মেনটেইন করে যে পারবে, তা অবশ্যই সঠিক নয়। অথচ আসহাবে রাসুলগণ পেরেছেন। পেরেছেন জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। পেরেছেন বলেই তাঁদের দ্বারা এই পৃথিবীকে পরিবর্তন করা সম্ভব হয়েছে।


//দায়িত্ববান এক নওজোয়ানের গল্প!//
~রেদওয়ান রাওয়াহা
#বদলে_যাওয়া_বদলে_দেওয়া : পর্ব-১১

পঠিত : ৮২৩ বার

মন্তব্য: ০