Alapon

জাল-যইফ হাদিসের প্রচার যেভাবে ইসলামের ক্ষতি করছে...



বর্তমানে একটি কথা বহুল প্রচলিত আছে যে, দাজ্জালের অধিকাংশ অনুসারী নাকি হবে নারী। নারীদেরকে নাকি শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার পরেও তারা দাজ্জালকে অনুসরণ করতে বের হয়ে যাবে!

এই কথাটা অনেক বক্তাকেও বিভিন্ন মাহফিলে জোর গলায় প্রচার করতে দেখা যায়।
নারীদের নিয়ে একপেশে ও চরম অবমাননাকর এরূপ কথাবার্তা যেখানে তাদেরকে গৃহপালিত পশুর মতো বেঁধে রাখার উপমা এসেছে, ইসলাম কি আদৌ এটা বলে?
যে হাদিসের বরাত দিয়ে এই বক্তব্য প্রচার করা হয় সেটা হলো মুসনাদে আহমদের ৫৩৫৩ নম্বর হাদিস।

এই হাদিসের সনদ:

আহমদ ইবনে আব্দুল মালেক--> মুহাম্মদ ইবনে সালামাহ--> মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক--> মুহাম্মদ ইবনে তালহা--> সালিম ইবনে আব্দুল্লাহ--> আবদুল্লাহ ইবনে ওমর
এই সনদে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক একজন চরম বিতর্কিত রাবি।

বহু মুহাদ্দিস ইমাম তাকে কাজ্জাব (মিথ্যুক) বলেছেন, অনেকে যইফ (দূর্বল) বলেছেন।
مالك بن أنس : دجال من الدجاجلة، نحن نفيناه عن المدينة
ইমাম মালেক এই মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক সম্পর্কে বলেন:
সে দাজ্জালদের (মহামিথ্যুকদের) মধ্যে শ্রেষ্ঠ দাজ্জাল (মহামিথ্যুক), আমরা তাকে মদিনা থেকে বিতাড়িত করেছিলাম।
يحيى بن سعيد القطان : كذاب
ইমাম ইয়াহিয়া ইবনে সাইদ তার সম্পর্কে বলেন: মিথ্যুক
وهيب بن خالد : كذبه
ইমাম ওয়াহিব ইবনে খালিদ বলেন: সে মিথ্যচার করতো
سليمان بن مهران الأعمش : كذاب
ইমাম সুলাইমান আল আমাশ তার ব্যাপারে বলেন: মিথ্যুক
سليمان بن طرخان التيمي : كذبه
ইমাম সুলাইমান আত তাইমি বলেন: সে মিথ্যাচার করতো
أبو حاتم الرازي : ليس عندي في الحديث بالقوي ضعيف الحديث
ইমাম আবু হাতেম আর রাজি বলেন: আমার নিকট সে হাদিসের ক্ষেত্রে শক্তিশালী নয়, যইফুল হাদিস (হাদিসের ক্ষেত্রে দুর্বল)
أحمد بن شعيب النسائي : ليس بالقوي
ইমাম নাসায়ি বলেন: সে শক্তিশালী নয়
الدارقطني: لا يحتج به
ইমাম দারাকুতনি বলেন: তার দ্বারা দলিল পেশ করা যাবে না
أحمد بن حنبل : ليس بحجة
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেন: সে দলিলযোগ্য নয়
কেউ কেউ প্রশংসাসূচক মন্তব্য করলেও অধিকাংশ ইমামগণ মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের ওপর কঠোর সমালোচনা ও ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন।

আমার নিকট মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের এককভাবে বর্ণিত হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়।
এরপরেও কেউ যদি তাকে গ্রহণযোগ্য মনে করতে চায়, তবুও এই হাদিসটি যইফ হাদিস।
কারণ, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক মুদাল্লিস রাবি।

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি তাকে মুদাল্লিস রাবি বলেছেন। সে দুর্বল এবং অজ্ঞাত রাবিদের থেকে তাদলিস করতো।
সূত্র: তাকরিবুত তাহজিব, রাবি নম্বর: ৫৭২৫
তাবাকাতুল মুদাল্লিসিন, ৪/১৬৫

ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেন, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক প্রচুর তাদলিসকারী। সে যদি আখবারানা বা সামিতু, হাদ্দাসানি দ্বারা হাদিস বর্ণনা করে তাহলেই শুধু তার হাদিস হাসান পর্যায়ে পৌঁছাবে‌।
সূত্র: আল জারহ ওয়াত তাদিল, খণ্ড: ৭, পৃষ্ঠা: ১৯৪
أبو بكر البيهقي : روايته ضعيفة إذا لم يبين سماعه فيها
ইমাম বায়হাকি বলেন, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের হাদিস যইফ হবে যদি সে তাসরিহুস সামা না করে।

অর্থাৎ, যদি হাদ্দাসানা, হাদ্দাসানি, সামিতু, আখবারানা, আখবারানি ইত্যাদি শব্দ দ্বারা হাদিস বর্ণনা না‌ করে।

উসুলে হাদিসের প্রতিষ্ঠিত সর্বসম্মত একটি উসুল হলো, হাদিসের সনদে মুদাল্লিস রাবি থাকলে এবং সেই রাবি 'আন' শব্দে হাদিস বর্ণনা করলে সেই হাদিস গ্রহণযোগ্য নয়।
মুদাল্লিস রাবির হাদিস তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন সে হাদ্দাসানা, হাদ্দাসানি, সামিতু, আখবারানা, আখবারানি ইত্যাদি শব্দ দ্বারা হাদিস বর্ণনা করবে।
আলোচ্য হাদিসের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটেছে।

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক 'আন' শব্দে মুহাম্মদ ইবনে তালহা থেকে হাদিস বর্ণনা করেছে।
তাই, এই হাদিসটি গ্রহণযোগ্য নয়, যইফ।
মুসনাদে আহমদের তাহকিককারী মুহাদ্দিস শাইখ শুয়াইব আরনাউত এই হাদিসের ব্যাপারে লিখেছেন,
إسناده ضعيف، فيه محمد بن إسحاق وهو مدلس وقد عنعن
এই হাদিসের সনদ যইফ (দুর্বল)। সনদে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক আছে যে মুদাল্লিস রাবি এবং 'আন' শব্দে বর্ণনা করেছে।

সূত্র: তাহকিক মুসনাদে আহমদ,
মুয়াসসাসাতুর রিসালা, খণ্ড: ৯, পৃষ্ঠা: ২৫৫
তাই, জাল-যইফ হাদিস প্রচারের মাধ্যমে ইসলামকে নারীবিদ্বেষী ধর্মরূপে তুলে ধরা থেকে বিরত থাকুন।

-জুম্মা খান

পঠিত : ৩৬৬ বার

মন্তব্য: ০