Alapon

হালাল স্পষ্ট, হারাম স্পষ্ট, তাহলে সংশয় কোথায়...?



সংশয়পূর্ণ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদিসকে অনেকেই ভুল বোঝেন। অনেকেই একে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে মানুষকে সবকিছু বিসর্জন দিয়ে সন্ন্যাসবাদের পথ গ্রহণ করার আহ্বান করে, এবং একে জাস্টিফাই করার প্রয়াস পায়। আজকে আমরা এই হাদিসটির সঠিক ব্যাখ্যা উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ্‌।

নবিজি এরশাদ করেছেন :
إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ، والْحَرَامَ بَيِّنٌ، وبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ فَقَدِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ، وعِرْضِهِ، ومَنْ وقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وقَعَ فِي الْحَرَامِ
“নিশ্চয়ই হালাল স্পষ্ট। হারামও স্পষ্ট। এই দুয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহপূর্ণ বিষয় যার বিধান অধিকাংশ মানুষই জানেনা। এমতাবস্থায় কেউ যদি সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকে, তবে সে নিজের ধর্ম ও মানসম্মানকে দায়মুক্ত থাকতে পারবে। কিন্তু যদি সে সংশয়পূর্ণ বিষয়ে লিপ্ত হয়, তবে সে হারামে লিপ্ত হয়ে যাবে।”

কয়েকটি পয়েন্টে স্পষ্ট থাকা প্রয়োজন।

এই হাদিসটি দ্বীনী জ্ঞানে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা সেসব মানুষের ব্যাপারে যাদের দ্বীন নিয়ে পর্যাপ্ত পড়াশোনা নেই। যার কারণে বিভিন্ন বিষয়ে তারা সংশয়ে ভোগে।
নামায, রোযা, হজ, যাকাত, মদ, জুয়া, ব্যাভিচারের মত বিষয়গুলোকেই এই হাদিসে স্পষ্ট হালাল ও স্পষ্ট হারাম বলা হয়েছে। কেননা এই বিষয়গুলো নিয়ে মুসলিম সমাজে এত বেশি আলোচনা হয় যে, এগুলো মালুম বিদ দরুরাহ-তে পরিণত হয়।

সংশয়ে ভোগা লেম্যানের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হল রিস্ক না নেয়া। যেমন: চিংড়ি খাওয়া জায়েয নাকি নাজায়েয? হানাফিদের অনেকে বলে নাজায়েয। অন্যরা বলে জায়েয। ওলি ছাড়া বিয়ে হবে কিনা? একাধিক মত আছে। এই জাতীয় বিষয়ে সাধারণ মানুষের প্রতি গাইডলাইন হল নিরাপদ মতটি ফলো করা অর্থাৎ ওলির অনুমতি নিয়ে বিয়ে করা যাতে বিয়ে শুদ্ধ হল কি হল না এই নিয়ে কোন সংশয় না থাকে।

কোন নির্দিষ্ট বিধানের হুকুম কী হবে তা নিয়ে এই হাদিসে আলোচনা করা হয় নি। তাই যারা এই হাদিসকে শরিয়তের কোন মাসআলাতে হুকুম কী হবে তা ঠিক করতে ব্যবহার করে তারা নিতান্তই অবুঝ।

একজন মুজতাহিদ আলেম যিনি কোন একটি নির্দিষ্ট মাসআলার উপর পাঁচ হুকুমের (ফরয, মুস্তাহাব, মুবাহ, মাকরুহ, হারাম) কোন একটি হুকুম দিবেন, তার জন্য দিক-নির্দেশনা এই হাদিসে নেই।

বরং শরিয়তের হুকুম জানার মূলনীতিজ্ঞাপক হাদিসটি হল:
ما أحل الله في كتابه فهو حلال ، وما حرم فهو حرام ، وما سكت عنه فهو عافية ، فاقبلوا من الله العافية ، فإن الله لم يكن نسيا ، ثم تلا هذه الآية ( وما كان ربك نسيا )
“আল্লাহ তাঁর পবিত্রগ্রন্থে যা হালাল করেছেন, তাই হালাল। যাকিছু তিনি হারাম ঘোষণা করেছেন, তাই হারাম। আর যেসব বিষয়ে মৌনতা গ্রহণ করেছেন, সেগুলো হল আফিয়াত (মাফ, ছাড়, দায়মুক্তি)। তোমরা আল্লাহর তরফ থেকে প্রদত্ত এই আফিয়াতকে কবুল করে নাও। কেননা আল্লাহ জেনেশুনেই চুপ থেকেছেন, ভুলে গিয়ে নয়। অতঃপর নবি এই আয়াত পাঠ করেন وما كان ربك نسيا ‘আপনার রব ভুলে যাওয়ার নন।’”

আবু সা’লাবার বর্ণনায় হাদিসটি ভিন্ন শব্দে উদ্ধৃত হয়েছে
إن الله فرض فرائض فلا تضيعوها وحد حدودا فلا تعتدوها وحرم أشياء فلا تنتهكوها وسكت عن أشياء رحمة لكم من غير نسيان فلا تبحثوا عنه
“আল্লাহ যা যা ফরয করেছেন সেগুলো নষ্ট কোরো না। সীমারেখা টেনে দিয়েছেন, সেগুলো অতিক্রম কোরো না। যেসব বিষয় হারাম ঘোষণা করেছেন, তার বিরুদ্ধাচার কোরো না। অনেক বিষয়ে তিনি চুপ থেকেছেন বিস্মৃতি থেকে নয়, বরং তোমাদের প্রতি দয়ামায়া করে। এসব বিষয় নিয়ে তোমরা ঘাটাঘাটি কোরো না।”

এই হাদিসটি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, যেসব বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর নবির পক্ষ থেকে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা নেই, সেসব বিষয় সাধারণভাবে মুবাহ। আর এটি কাওয়ায়েদে ফিকহের একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যাকে ফুকাহারা এভাবে বলেন الأصل في الأشياء الإباحة “সকল বিষয়ের আদি হুকুম হচ্ছে — বৈধতা।”

ইমাম ইবনে রজব আল হাম্বলি রহিমাহুল্লাহ তার “জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম” গ্রন্থে বলেছেন,
وَقَوْلُهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ فَقَدِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ، وَقَعَ فِي الْحَرَامِ» قَسَّمَ النَّاسَ فِي الْأُمُورِ الْمُشْتَبِهَةِ إِلَى قِسْمَيْنِ، وَهَذَا إِنَّمَا هُوَ بِالنِّسْبَةِ إِلَى مَنْ هِيَ مُشْتَبِهَةٌ عَلَيْهِ، وَهُوَ مِمَّنْ لَا يَعْلَمُهَا، فَأَمَّا مَنْ كَانَ عَالِمًا بِهَا، وَاتَّبَعَ مَا دَلَّهُ عِلْمُهُ عَلَيْهَا، فَلِذَلِكَ قِسْمٌ ثَالِثٌ، لَمْ يَذْكُرْهُ لِظُهُورِ حُكْمِهِ، فَإِنَّ هَذَا الْقِسْمَ أَفْضَلُ الْأَقْسَامِ الثَّلَاثَةِ، لِأَنَّهُ عَلِمَ حُكْمَ اللَّهِ فِي هَذِهِ الْأُمُورِ الْمُشْتَبِهَةِ عَلَى النَّاسِ، وَاتَّبَعَ عِلْمَهُ فِي ذَلِكَ
“যে সন্দেহপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকে সে নিজের ধর্ম ও মানসম্মানের ব্যাপারে দায়মুক্ত থাকে। আর যে সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে লিপ্ত হয়, সে হারামে লিপ্ত হবে।” নবির এই বক্তব্যে সন্দেহময় বিষয়ে মানুষকে তিন ভাগ করা হয়েছে। একে সন্দেহময় বলা হচ্ছে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যাদের কাছে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, জানাশোনা না থাকায়। কিন্তু যে বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, এবং তার জ্ঞান যা বলে তার অনুসরণ করে, তবে এমন ব্যক্তি তৃতীয় প্রকারের অন্তর্ভূক্ত। তার হুকুম কী হবে তা সুস্পষ্ট হওয়ায় হাদিসে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয় নি। তো এই তিন শ্রেণীর মানুষের মাঝে এই শ্রেণীই সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ যেসব বিষয়ে মানুষ সন্দেহে থাকে, সেসব বিষয়ে আল্লাহর হুকুম তার জানা থাকে এবং সে এসব ক্ষেত্রে তার ইলমের অনুসরণ করে।

. وَأَمَّا مَنْ لَمْ يَعْلَمْهُ حُكْمُ اللَّهِ فِيهَا، فَهُمْ قِسْمَانِ: أَحَدُهُمَا مَنْ يَتَّقِي هَذِهِ الشُّبُهَاتِ، لِاشْتِبَاهِهَا عَلَيْهِ، فَهَذَا قَدِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ.
এখন যাদের ইলম নেই বলে তারা এসব বিষয়ে আল্লাহর হুকুম জানে না, তারা দুই শ্রেণীর।
প্রথম শ্রেণী এই সন্দেহযুক্ত বিষয়গুলো এড়িয়ে চলে, কারণ তার মনে সন্দেহ বিদ্যমান আছে। এই ব্যক্তি নিজের ধর্ম ও মানসম্মানের ব্যাপারে দায়মুক্ত থাকে।

الْقِسْمُ الثَّانِي: مَنْ يَقَعُ فِي الشُّبُهَاتِ مَعَ كَوْنِهَا مُشْتَبِهَةً عِنْدَهُ، فَأَمَّا مَنْ أَتَى شَيْئًا مِمَّا يَظُنُّهُ النَّاسُ شُبْهَةً، لِعِلْمِهِ بِأَنَّهُ حَلَالٌ فِي نَفْسِ الْأَمْرِ، فَلَا حَرَجَ عَلَيْهِ مِنَ اللَّهِ فِي ذَلِكَ، لَكِنْ إِذَا خَشِيَ مِنْ طَعْنِ النَّاسِ عَلَيْهِ بِذَلِكَ، كَانَ تَرْكُهَا حِينَئِذٍ اسْتِبْرَاءً لِعِرْضِهِ، فَيَكُونُ حَسَنًا
দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষের মনে সন্দেহ থাকা সত্তেও তারা এসব সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হয়। তবে মানুষ যেসব বিষয়কে সংশয়পূর্ণ বিষয় বলে ভাবে, সেসব বিষয় বাস্তবে যে হালাল এটা জানা থাকায় যদি কেউ এতে লিপ্ত হয়, তবে আল্লাহর তরফ থেকে তার জন্য কোন সমস্যা নেই। তবে মানুষের সমালোচনার শিকার হবার আশংকা তার রয়েছে। তাই মানসম্মান রক্ষার্থে এটা করা থেকে বিরত থাকা সমীচীন হতে পারে।

আর যদি কেউ এসব বিষয়কে হালাল বলে বিশ্বাস করে, বৈধ ইজতিহাদ কিংবা বৈধ তাকলিদের মাধ্যমে, কিন্তু তার এই বিশ্বাস ভুল হয়, তবে তার বিধানও আগের জনের মত।
وَإِنْ أَتَى ذَلِكَ لِاعْتِقَادِهِ أَنَّهُ حَلَالٌ، إِمَّا بِاجْتِهَادٍ سَائِغٍ، أَوْ تَقْلِيدٍ سَائِغٍ، وَكَانَ مُخْطِئًا فِي اعْتِقَادِهِ، فَحُكْمُهُ حُكْمُ الَّذِي قَبْلَهُ، فَإِنْ كَانَ الِاجْتِهَادُ ضَعِيفًا، أَوِ التَّقْلِيدُ غَيْرُ سَائِغٍ، وَإِنَّمَا حَمَلَ عَلَيْهِ مُجَرَّدُ اتِّبَاعِ الْهَوَى، فَحُكْمُهُ حُكْمُ مَنْ أَتَاهُ مَعَ اشْتِبَاهِهِ عَلَيْهِ، وَالَّذِي يَأْتِي الشُّبُهَاتِ مَعَ اشْتِبَاهِهَا عَلَيْهِ، قَدْ أَخْبَرَ عَنْهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ
অপরদিকে যে দূর্বল ইজতিহাদ কিংবা অগ্রহণযোগ্য তাকলিদের আশ্রয় নিয়ে থাকে, এবং নিছক খায়েশের অনুসরণ করাই তার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে তার বিধান হচ্ছে সেই ব্যক্তির মত যে সন্দেহ থাকা সত্তেও সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে লিপ্ত হয়। আর যে ব্যক্তি সন্দিহান হয়েও সংশয়পূর্ণ বিষয়ে লিপ্ত হয়, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়েছেন যে, সে হারামে লিপ্ত হয়েছে।”

সুত্র : জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম, তাহকিক — আরনাউত, পৃষ্ঠা ২০৩-২০৫।

- শেখ সাদী

পঠিত : ৭৪৫ বার

মন্তব্য: ০