Alapon

দ্বীনি ও দুনিয়াবি পড়াশোনা ব্যালেন্স...



যেসব দ্বীনি ভাই-বোনেরা একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি দ্বীনি লাইনেও পড়াশোনা করছেন তাদের প্রায়ই একটা অনুযোগ মিশ্রিত আবদার করতে শুনি, "অনেক পড়া জমে গেছে, সামনে পরীক্ষা। আপুরা/ভাইয়েরা আমার জন্যে দু'আ করবেন।"

গত এক সেমিস্টারের প্রায় চারটা মাস ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটির ৫টা থিওরি কোর্স ও ৩টা ল্যাব কোর্স একইসঙ্গে ইসলামিক অনলাইন ইউনিভার্সিটির (আই ও ইউ) ৩টা থিওরি কোর্স ও ১টা ননক্রেডিট কোর্স সামাল দিতে গিয়ে বেশ কিছু জিনিস শিখেছি।

দ্বীনি ভাই-বোনদের উপকারে আসতে পারে এই নিয়তে ছোট পরিসরে সেই উপলব্ধির টুকিটাকি নিচে তুলে ধরছিঃ—

১. তাওয়াক্কুল ‘আলাল্লাহ

“এত পড়া! এত কম সময়ে কীভাবে শেষ হবে?! কোনটা রেখে কী পড়ব”, ভেবে ভেবেই আরো বেশি সময় নষ্ট করি নি, এমন ধীরস্থির মানুষ আমাদের মধ্যে খুব কমই আছে।

পড়ার স্তুপ দেখে ভয় পেয়ে পাথর হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু মূর্তির মত বসে টেনশন করতে থাকলে পড়া শেষ তো হবেই না, উলটো বিষণ্ণতার ঢেউ এসে গিলে ফেলবে।

এই ক্ষেত্রে আমার মতে সবচেয়ে সহজ উপায় হলো আল্লাহর উপর ভরসা করা। এভাবে চিন্তা করতে পারেন, আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টির জন্যেই আমি এত কষ্ট করছি, তিনি নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করবেন। আমার সমস্ত কাজ সহজ করে দিবেন ইন শা আল্লাহ। এরপর “হাসবিয়াল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়া আলাইহি তাওয়াক্‌কাল্‌তু ওয়া হুয়া রব্বুল আরশিল আজিম” পড়ে আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে পড়তে বসুন, দেখবেন টেনশন কোন দিক দিয়ে পালিয়েছে টেরও পাবেন না!

২. প্ল্যানিং

“কোনটা রেখে কোনটা পড়ি” এই দুঃশ্চিন্তা কমানোর কার্যকরী উপায় হলো প্ল্যানিং। প্রতিদিন কোন পড়া কতটুকু পড়লে পরীক্ষার আগে নিজেকে পথহারা পথিক মনে হবে না, সেটা আগেই ঠিক করে নিন। প্ল্যানিংয়ের ক্ষেত্রে আমি মূলত যে ধাপগুলো অনুসরণ করি তা হলো, প্রথমেই ক্যালেন্ডারে সমস্ত পরীক্ষার শিডিউল দাগিয়ে নেওয়া। আমাদের ভার্সিটিতে বারো মাসে তেরো পার্বণের মত পরীক্ষা লেগেই থাকে তাই ক্যালেন্ডারে আগে থেকেই দাগানো থাকলে কোনদিন পরীক্ষার পড়া পড়তে হবে, কোনদিন আই ও ইউ এর পড়া আগাতে পারব এটা প্ল্যান করতে সহজ হয়। এরপর প্রতিটা কোর্সের কোর্স আউটলাইন দেখে ধারনা করে একটা মোটামুটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেলুন কোন কোর্সের জন্যে সপ্তাহে কতটুকু সময় দিবেন, কখন দিবেন। এই সবকিছু প্ল্যান করতে প্ল্যানার ব্যবহার করতে পারেন, কিংবা কোনো অ্যাপ, যেমন Notion ব্যবহার করতে পারেন।

৩. পড়ার পাহাড় বানাবেন না

পড়া জমিয়ে জমিয়ে বিশালাকৃতির পাহাড় বানানো বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই একটা অতি প্রিয় কাজ। কিন্তু যখন থেকেই আপনি একাডেমিক পড়ার পাশাপাশি ইল্মে দ্বীন শিক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, তখন থেকেই পড়া জমিয়ে রাখাকে নিজের মাথায় গুলি করার সমতূল্য ভাবতে হবে। কারন দিনশেষে অন্যরা পড়া কভার দিতে পারলেও আপনাকে হিমশিম খেতে হবে, কেননা আপনার পড়ার পরিমান দ্বিগুণ।

অনেকেই আমরা যে ভুলটা করি, দ্বীনি সাব্জেক্টগুলো এতই ইন্টারেস্টিং লাগে যে একাডেমিক ধারার তেতো সাব্জেক্টগুলোকে ভুলে গিয়ে এগুলোর দিকে অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে ফেলি। আমি নিজে এই ভুল করে ধরা খেয়েছি। পরে দেখা গেছিল এমন অবস্থা, পরেরদিন আমার একইসঙ্গে ইলেক্ট্রিকাল মিড, ম্যাথ সিটি, ফিক্বহ মিড দিতে হবে, ফিক্বহ পারলেও আমার রিভিশন শেষ হয় নি, এদিকে ইলেক্ট্রিকাল মিডের সিলেবাস পুরো নতুন। তাই সময় থাকতেই, ব্যালেন্স করুন।

৪. ডিস্ট্র‍্যাকশন এলিমিনেইট করুন

পড়া জমিয়ে রাখতে আমাদের নফসের পাশাপাশি যে জিনিসটা আমাদের অত্যন্ত সাহায্য করে, তা হলো ‘ডিস্ট্র্যাকশন’। আপনি আগ্রহ নিয়ে পড়তে বসেছেন, ভাবছেন, “আজকে পড়ে উল্টায় ফেলব। আচ্ছা, তার আগে একটু ফোনটা চেক করে নেই।“ ব্যস, কাজ সেরেছে। ফোনে আপনি এমন ডুবে গেলেন, যখন হুঁশ ফিরল, উপলব্ধি করলেন আপনি দুই ঘন্টা অপচয় করে বসে আছেন। এই অনুতাপে আপনার আর পড়তেও ইচ্ছে করছে না এখন।

পড়তে বসার আগে তাই ফোনটাকে হাতের নাগালের বাইরে কোথাও রেখে দিন, বা লুকিয়ে রাখুন। আমি মাঝে মাঝে যেটা করতাম, আমার বান্ধবীদের বলে রাখতাম আমাকে আগামী ৪ ঘন্টায় একবারও অনলাইনে দেখলে যেন বকা দিয়ে পড়তে পাঠিয়ে দেয়। এছাড়া ডিস্ট্র‍্যাকশন এলিমিনেইট করার কিছু অ্যাপ যেমন Forest ব্যবহার করে দেখতে পারেন।

৫. ক্লাস লেকচারগুলোকে গুরুত্ব দিন

ভার্সিটির ক্লাস লেকচার হোক কিংবা দ্বীনি দরস, দুটোতেই মনোযোগী হোন। ক্লাসে কী পড়ানো হবে আগে থেকে জানা থাকলে সম্ভব হলে প্রত্যেক ক্লাসের আগে একবার রিভিউ করে যান, তাহলে ক্লাসে পড়া বুঝতে সহজ হবে। ক্লাসেই পড়া বুঝে গেলে ‘পরে ইউটিউব দেখে বুঝতে হবে’- মাথার উপর থেকে এই বাড়তি বোঝা নেমে যাবে। কিছু কিছু ক্লাসে দেখা যায় প্রচুর ঘুম পায়। এই ক্ষেত্রে যেটা করতে পারেন, নোট নেওয়া। আপনি একটা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে সহজে ঘুম পাবে না, আর লেকচারার পরীক্ষার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পয়েন্ট বা সাজেশন দিলে সেটাও মিস করবেন না ইন শা আল্লাহ।

৬. ভোরে উঠা

ভোরে উঠার সুফল নিয়ে এত পরিমাণে লেখালেখি হয় যে আমি এই বিষয়ে নতুন করে আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করছি না। ফজরের পরে মুনাফিকের নিশ্বাসমুক্ত শীতল বাতাস এমনিতেই মন ভালো করে দেয়। তখন এমনিতেই একটা মোটিভেশন কাজ করে, পড়তে ভালো লাগে। এই অভ্যাসটা গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।

৭. গুনাহ থেকে বিরত থাকা

এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটা আমি আমার উস্তাদজীর কাছে শিখেছি। ইলম অর্জনের পূর্বশর্ত আপনার নিয়ত পরিশুদ্ধ করা, নিশ্চিত করুন আপনি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই জ্ঞানার্জন করছেন।

ইমাম শাফেয়ীর একটি পংক্তি উল্লেখ করা হয়- আমি ওকীর নিকট অভিযোগ করলাম আমার মুখস্তশক্তির দুর্বলতার। তিনি আমাকে গুনাহ পরিহার করার পরামর্শ দিলেন এবং বললেন:

আল্লাহর ইলম হচ্ছে- নূর; আল্লাহর নূর গুনাহগারকে দেয়া হয় না। খতীব আল-জামে নামক গ্রন্থে (২/৩৮৭) ইয়াইয়া বিন ইয়াহইয়া থেকে বর্ণনা করেন যে, এক লোক মালেক বিন আনাসকে বললেন: হে আবু আব্দুল্লাহ! মুখস্তশক্তি বাড়ানোর কোন কিছু আছে কি?

তিনি বলেন: যদি কোন কিছু থাকে তাহলে সেটা হল: গুনাহ পরিত্যাগ করা। যখন কোন মানুষ গুনাহ করে তখন এ গুনাহটি তাকে ঘিরে রাখে এবং গুনাহর ফলে তাকে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা পেয়ে বসে। সে গুনাহর কারণে তার চিন্তাধারা মশগুল হয়ে থাকে। এভাবে এ দুশ্চিন্তা তার অনুভূতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে থাকে এবং তাকে অনেক কল্যাণকর কাজ থেকে দূরে রাখে। এর মধ্যে মুখস্তশক্তি অন্যতম।

৮. দু’আ

কোনো কঠিন বিষয় পড়ার আগে এই দু’আটা পড়তে পারেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اللهُمَّ لا سَهْلَ إلا مَا جَعَلتَهُ سَهْلا وَ أنتَ تَجْعَلُ الحزْنَ إذا شِئْتَ سَهْلا

অর্থঃ-ইয়া আল্লাহ, কোনো বিষয় সহজ নয়। হ্যাঁ, যাকে তুমি সহজ করে দাও, যখন তুমি চাও তখন তুমি মুশকিলকে সহজ করে দাও।

[ইবনে হিব্বান: হাদিস নং-৯৭৪]

- বিনতে মোস্তফা

পঠিত : ৬৮৩ বার

মন্তব্য: ০