Alapon

ইসলামি আন্দোলন : পরিভাষার কথা* ~উসতায ইউসুফ আল কারযাভী



ইখওয়ান সদস্যদের লেখালিখি ও সাহিত্যের মাধ্যমে মিশরে ‘আল-হারাকাতুল ইসলামিয়্যাহ’ (ইসলামি আন্দোলন) পরিভাষাটি খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে এবং সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। তেমনিভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে এ পরিভাষা ছড়িয়ে পড়ে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যদের লেখালিখি ও সাহিত্যের মধ্যেমে। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা হলেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রহ.। তাঁরা ‘আল-হারাকাতুল ইসলামিয়্যাহ’-কে আরবি হরফে লেখা উর্দুতে বলে ‘তেহরিকে ইসলামি’।
ইখওয়ানের দাওয়াতি কর্মসূচির পূর্বে (সাইয়েদ জামাল উদ্দিন আফগানি ও ইমাম মুহাম্মদ আবদুহুর সময়কালে) ইসলামি আন্দোলনের পরিভাষা ছিল ‘আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া’ বা ‘ইসলামি জোট’। এ বিষয়টি জানা যায় জামাল উদ্দিন আফগানি ও মুহাম্মদ আবদুহু রহ.-এর প্রবন্ধ-সংকলন ‘আল-উরওয়াতুল উসকা’ থেকে। এছাড়াও শায়খ আবদুহুর ছাত্র রশিদ রিদার প্রবন্ধমালায়ও এ সম্পর্কে আলোচনা আছে।
.
উভয় পরিভাষাই স্ব স্ব যুগের অবস্থাকে ধারণ করেছে, নিজেদের সময়ের চিত্র তুলে ধরেছে। ‘আল-উরওয়াতুল উসকা’র সময়কালে দাওয়াতের বিষয় ও উদ্দেশ্য ছিল ‘জামউল উম্মাহ’ তথা উম্মাহর সংহতি ও ঐক্য। ঔপনিবেশিক শক্তি এসে যখন খিলাফত ধ্বংস করে দিয়ে মুসলিম উম্মাহর একতাকে শতধা বিভক্ত করে দিলো, তখন দাওয়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, এই ঔপনিবেশবাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একতাবদ্ধ হয়ে থাকার প্রচেষ্টা-- বিচ্ছিন্নতার বিপদ থেকে উম্মাহকে রক্ষা করা। তাই তখন ইসলামি আন্দোলনের পরিভাষা ছিল ‘আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া’।
.
আর উসতায হাসানুল বান্না রহ.-এর সময়ে দাওয়াতের প্রয়োজন ভিন্নতা পেল। এই সময়ে দাওয়াতের বিষয় এবং দাওয়াতের উদ্দেশ্য হয়ে গেল ‘তাহরিকুল উম্মাহ’ তথা উম্মাহর জাগরণ। তাই ইমাম বান্না রহ. নতুন পরিভাষা ‘আল-হারাকাতুল ইসলামিয়্যাহ’ (ইসলামি আন্দোলন) নিয়ে নতুন মিশনে নামেন।
.
উম্মাহর চিন্তা ও মননে ইমাম বান্না জাগরণ সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের জাগিয়ে তুলেছেন; ফলে তারা অনুধাবন করতে পারছে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে। তিনি তাদের হৃদয়কে জাগ্রত করেছেন; ফলে তারা নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। তিনি তাদের ইচ্ছেশক্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন; ফলে তারা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছে। তিনি তাদের হাতকে জাগিয়ে তুলেছেন; ফলে তাদের হাত হয়ে উঠেছে কর্মমুখর। “উম্মাহর ঐক্য ও সংঘবদ্ধতাই এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।”
.
‘আল-হারাকাতুল ইসলামিয়্যাহ’ পরিভাষাটি প্রকাশিত হয় এমন এক সময়ে, যখন আরব ও বিভিন্ন মুসলিম দেশে আরেকটি পরিভাষা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। তা হলো ‘আল-হারাকাতুল ওয়াতানিয়্যাহ’ (স্বদেশী আন্দোলন) বা ‘আল-হারাকাতুল কওমিয়্যাহ’ (জাতীয়তাবাদ)। যা মুসলিম উম্মাহকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।
.
তখন ‘ইসলামি আন্দোলন’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে মূলত এই জাতীয়তাবাদকে নির্মূল করার জন্য। স্বদেশী আন্দোলন বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী নেতারা ইসলামি আন্দোলনের প্রচণ্ড বিরোধিতা করে। এই সংস্কার-আন্দোলনের দাঈদেরও বিরোধিতা করে তারা। তারা সবাই ছিল পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল। পাশ্চাত্য দর্শন ও সভ্যতা ছিল তাদের চিন্তা-দর্শনের মূল উৎস। তা ছিল তাদের কাছে মূল্যবান, অনুপ্রেরণাস্থল এবং প্রধান অবলম্বন।
.
তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস যারা পড়েছে এবং এর জন্ম ও বিকাশ সম্পর্কে যাদের জানাশোনা আছে, তাদের কাছে আমার উপরোক্ত আলোচনা অস্পষ্ট হওয়ার কথা নয়। এই জাতীয়তাবাদের জন্ম তুরস্কে-- উসমানি সাম্রাজ্যে। এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আরব ও ইসলামের ভয়ংকর শত্রু। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা গঠন করে ‘আল-ইত্তিহাদু ওয়াত-তারাক্কি’ সংঘ। আর এই সংঘের পরিসমাপ্তি ঘটে খিলাফতের দুর্গ ধ্বংস করে-- যে খিলাফত ইসলামের পতাকাতলে মুসলিম উম্মাহকে সমবেত রাখার প্রতিনিধিত্ব করেছিল।
.
তেমনি উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, প্রথম আরব জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের সূচনার বিষয়টিও। ইহুদি সংঘ ফ্রি-ম্যাসনের সাথে এই সংগঠনের ছিল গোপন আঁতাত এবং এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিত মূলত অমুসলিমরাই।
.
এমন সঙ্গীন ও সংকট মুহূর্তেই জন্ম লাভ করে ‘আল-হারাকাতুল ইসলামিয়্যাহ’ (ইসলামি আন্দোলন) পরিভাষাটি। তারপর সেটি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত লেখকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের লেখায় এ পরিভাষা স্থান করে নিল। ক্রমান্বয়ে তা অন্যদের রচনায়ও স্থান পেতে লাগল। ধীরে ধীরে তা স্বতন্ত্র চিন্তা হিসেবে স্বীকৃত হলো। তখন এই আন্দোলনের দিকে সম্পৃক্ত করে বলা হতে লাগল-- ‘আল-ফিকরুল হারাকি’ (চিন্তার আন্দোলন), ‘আল-দাওয়াতুল হারাকাতিয়্যাহ’ (দাওয়াতের আন্দোলন), ‘আত-তারবিয়্যাতুল হারাকাতিয়্যাহ’ (তারবিয়াতি আন্দোলন), ‘আল-আজহারমালুল হারাকি’ (আন্দোলনের কর্মসূচি)। এভাবে এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে আরও নানান পরিভাষা তৈরি হলো।

ইসলামি আন্দোলন : পরিভাষার কথা*
~উসতায ইউসুফ আল কারযাভী

পঠিত : ৪৫৩ বার

মন্তব্য: ০