Alapon

ইউক্রেন- রাশিয়া দ্বন্দ্বের কারণ কি?



ইউক্রেন- রাশিয়া দ্বন্দ্বের কারণ কি?
চলমান রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধাবস্থা এখন সারা বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ফেব্রুয়ারি ২০২২ এর মাঝামাঝিতে ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়া ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। ইউক্রেনের সীমান্তে ১ লাখ রাশিয়ান সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছে, আক্রমণের জন্য সকল প্রকার যুদ্ধ সরঞ্জাম এনে প্রস্তুত করেছে, এন্টিব্যালাস্টিক মিসাইল (S400) সিস্টেম প্রস্তুত করেছে এবং সর্বশেষ আজ এনেছে মেডিকেল সরঞ্জাম, বিপুল পরিমাণ রক্তের ব্যাগ ইত্যাদি। দৃশ্যত যুদ্ধের জন্য শতভাগ প্রস্তুত রাশিয়া। কিন্তু রাশিয়া কেন ইউক্রেন আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়েছে?
আসুন, অতি সংক্ষেপে সে কারণগুলো এবং সংক্ষিপ্ত কিছু ইতিহাস জেনে নেই-
১) ১৯১৭ সালের ২৩ জুন স্বাধীন ইউক্রেন দেশটি 'ইউক্রেন পিপলস রিপাবলিক' নাম নিয়ে সোভিয়েত সোসালিষ্ট রাশিয়ার সাথে যুক্ত হয়। এর আগে শত শত বছর ধরে পোল্যান্ড ও অন্যান্য সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে শাসিত হয়েছে।
২) ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া ১৫ টি স্বাধীন দেশে বিভক্ত হয়ে যায়। সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইউক্রেন রাশিয়ার অংশ ছিল।
৩) ১৯৯১ সালের পর থেকে ইউক্রেন আবারো স্বাধীন দেশ হিসেবে নতুন যাত্রা শুরু করে। কিন্তু প্রশাসনে দূর্নীতি, রাজনৈতিক মতভেদ, সরকারের স্বেচ্ছাচারিতায় নানানরকম অভ্যন্তারিণ সমস্যা তৈরি হতে থাকে। ফলে ইউরোপের সবচেয়ে দূর্নীতিগ্রস্থ দেশে পরিণত হয়।
৪) ইউক্রেনের জনসংখ্যা ৪ কোটি ১৫ লাখ প্রায়। এই জনসংখ্যার ১৮% ই রাশিয়ান। দেশটির পূর্ব দিকের রাশিয়ান সীমান্তবর্তী দুটি প্রদেশের (Luhansk এবং Donetsk) শতকরা ৮৭ ভাগ মানুষ এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ রাশিয়াপন্থী। তারা চায় ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সাথে যুক্ত হতে।
৫) ইউক্রেনের একমাত্র স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হলো (ছিল) দক্ষিণ-পূর্বাংশের ক্রাইমিয়া (Crimea)। ক্রাইমিয়ার অধিকাংশ জনগণ রাশিয়াপন্থী। ২০১৪ সালে রাশিয়া এক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ক্রাইমিয়া দখল করে রাশিয়ার মানচিত্রে যুক্ত করে নেয়। দখল করার পর সেখানে এক গণভোটের আয়োজন করে, যাতে অধিকাংশ ভোটার রাশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষে ভোট দেয়। তবে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলো এই গণভোটের বৈধতা দেয়নি এবং ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়নি।
৬) ইউক্রেনের প্রায় একতৃতীয়াংশ (যা পূর্বাঞ্চলের অংশ) অঞ্চলে রাশিয়া সম্পূর্ণভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সেখানে রাশিয়ান- ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, শিক্ষা, উৎসব, ঐতিহ্য, ধর্ম বিশ্বাস (খ্রীস্টান) ইত্যাদিতে সুস্পষ্ট রাশিয়ান প্রভাব রয়েছে।
৭) ইউক্রেনের বিভিন্ন সরকার গুলো দূর্নীতির পাশাপাশি বিরোধী দল নিধনে ব্যস্ত থেকেছে সব সময়। বিরোধী দলের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের গ্রেফতার, সমর্থকদের গ্রেফতার, গুম- হত্যা, তাদের সমাবেশ নিষিদ্ধ এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। ফলে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গুলো সবসময় এই বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।
৮) ইউক্রেনের সরকার গুলো জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করেছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত করেছে, সাংবাদিক লেখক ও যুবনেতৃত্বকে জেল- গুম- হত্যার মাধ্যমে দমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের উদ্বেগ রয়েছে।
৯) ৭ ও ৮ নং এর কারণে সমগ্র ইউক্রেনে রাশিয়াপন্থী মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্যেও দুটি সীমারেখা তৈরি হয়েছে। একদল এন্টি-রাশিয়ান এবং অন্যদল প্রো- রাশিয়ান। ফলে বিভিন্ন সময়ে পার্লামেন্ট অধিবেশনে রক্তাক্ত মারামারি বেঁধে যায়। (ইউটিউবে অনেক ভিডিও রয়েছে)
১০) ২০১৩ সালে ইউক্রেন আরো একবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এখানে তাদেরকে শর্ত দেওয়া হয় যে- ইউক্রেনকে প্রমাণ করতে হবে যে এটা একটি গণতান্ত্রিক দেশ এবং জনগণ স্বাধীন ভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে পারে। ইউক্রেন এই শর্ত মানার জন্য EU'র সাথে একটি চুক্তি করতে সন্মত হয় কিন্তু রাশিয়ার চাপে তা করতে পারেনি। কেননা রাশিয়া ঘোষণা দেয় যে- EU তে যুক্ত হলে রাশিয়া সব রকমের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে এবং করেও ফেলে! ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৭০ ভাগই রাশিয়ার সাথে। এর সাথে তবে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাবও দেয়। প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়াঙ্কোভিচ সে প্রস্তাব মেনে নেয় ফলে ইউক্রেনের জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। নতুন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরশেঙ্কো ২০১৪ সালে EU তে যোগ দেওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এতে ব্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করে ক্রাইমিয়া দখল করে নেয়।
১১) ইউক্রেন বহুদিন ধরে NATO 'র সদস্যপদ লাভের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু ৭,৮ ও ৯ নং এর কারণে তাদেরকে ন্যাটোর সদস্য করা হয়না। তাদেরকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে যথেষ্ট উন্নতি করতে হবে বলে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। NATO- North Atlantic Treaty Organizations হলো ৩০ টি দেশের একটি সামরিক জোট যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো- "আমরা একে অন্যের উপর কখনোই সামরিক হামলা করবোনা এবং আমাদের যেকোন একটি দেশের উপর জোটের বাইরের কেউ হামলা করলে সবাই সেটাকে নিজেদের উপর হামলা বলে বিবেচনা করবো এবং সবাই একসাথে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবো"। (ন্যাটোর অধিকাংশ সদস্য ইউরোপের হলেও এতে আছে আমেরিকা, কানাডা ও তুর্কি)
১২) যেহেতু ইউক্রেন ন্যাটো জোটের সদস্য হতে পারেনি সুতরাং রাশিয়া আক্রমণ করলে কেউই ইউক্রেনের হয়ে সরাসরি রাশিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ করতে আসবেনা। তবে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। (আসলে অস্ত্র বিক্রি করবে)।
১৩) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্লাদিমির পুতিন স্পষ্ট জানিয়েছেন যে- ইউক্রেন অবশ্যই রাশিয়ার অংশ। কয়েকদিন আগে তিনি বলেছেন- সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে রাশিয়া থেকে ইউক্রেনের বেরিয়ে যাওয়া ছিল একটি 'হৃদয়বিদারক' ঘটনা, আমরা কখনোই এটা ভুলবো না। অর্থাৎ রাশিয়ার এই যুদ্ধের স্পষ্ট কারণ হলো- ইউক্রেন দখল করে নেওয়া, অন্তত পক্ষে পূর্বাঞ্চলের দুটি প্রদেশ- লুহানস্ক ও দোনেস্ক কব্জা করা। আর এটা রাশিয়ার জন্য খুবই সহজ ব্যাপার, কেননা একে তো তারা সামরিক শক্তিতে ইউক্রেনের চেয়ে অনেক অনেক গুণ এগিয়ে তার উপর ঐ অঞ্চলের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতাদের অধিকাংশ রাশিয়ার পক্ষে।
১৪) ইউক্রেনের উপর হামলা না করতে রাশিয়ার উপর বিভিন্ন চাপ আসার প্রেক্ষিতে ব্লাদিমির পুতিন অবশ্য ইউক্রেনকে 'চমৎকার' একটি প্রস্তাব দিয়েছে। সেটা হলো- রাশিয়া খুবই কম দামে ইউক্রেনে গ্যাস সরবরাহ করবে এবং অন্যান্য অনেক বাণিজ্যিক সুবিধা দিবে কিন্তু শর্ত হলো ঐ দুই প্রদেশে রাশিয়ান প্রভাব নিয়ে ইউক্রেন কোন মাথা ঘামাতে পারবেনা!
..... যাহোক ব্লাদিমির পুতিনের উছিলা গুলো "মন্দ" না!
[দার্শনিক মাও সু দং এর মতে- যে রাষ্ট্রে 'গণতন্ত্র' নিজে পেরেশানিতে থাকে এবং দেশের জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার সেন্ট হেলেনা দ্বীপে পালিয়ে বেড়ায় সেখানে বিদেশি শক্তির কালো থাবা আসবেই। ]
ছবিঃ - ১ম ছবিতে ইউক্রেনের মানচিত্রের নিচের লাল অংশ রাশিয়ার দখলকৃত ক্রাইমিয়া এবং উপরের লাল দুটি প্রদেশ বর্তমান রাশিয়ান লক্ষ্য। ২য় ছবিতে সবুজ অংশে রাশিয়ান ভাষার প্রভাব এবং হলুদ অংশে ইউক্রেনিয়ান ভাষার প্রভাব বুঝানো হয়েছে।
ধন্যবাদ
মাসুদ আলম
২৯-০১-২০২২

পঠিত : ৪৯৬ বার

মন্তব্য: ০