Alapon

মিসওয়াক, একটি ভুল ধারণা এবং কিছু বিস্ময়...



সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসে ঝা চকচকে রাস্তাঘাট, অত্যাধুনিক স্থাপনা, ব্রান্ড নিউ গাড়ি, সুদৃশ্য মসজিদ, চমৎকার আইন শৃঙ্খলা ইত্যাদি দেখে সবার মতো আমিও মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু এগুলোর বাইরেও আরো কিছু জিনিস আমাকে দারুণ ভাবে মুগ্ধ করেছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হলো গণশৌচাগার এবং অন্যটি এখানের কিছু স্থানীয় উদ্ভিদ। আমার মতে পৃথিবীর যে দেশের গণশৌচাগার যতো স্বাস্থ্য সন্মত, সে দেশ ততো বেশি উন্নত! গণশৌচাগার (পাবলিক টয়লেট) সমন্ধে অন্য একদিন বলবো, আজ একটি উদ্ভিদ নিয়ে বলি...

লাখো বা হাজার নয়, মাত্র শ'খানেক প্রজাতির স্থানীয় উদ্ভিদ জন্মে এই দেশটিতে। এদের সবগুলোই স্বাভাবিক ভাবে তাপ সহনীয় এবং কম পানি পেয়ে প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে।

একদিন আল আইন শহরের একটি ভিলার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ভিলার সামনের সীমানা দেওয়ালের এক কোণ জুড়ে বাইরে ছড়িয়ে আছে ঘন সবুজ একটি গাছ, দেখে চোখ জুড়ানোর মতোই। আরবরা তাদের বাড়ী রাস্তা পার্ক সাজাতে স্থানীয় গাছকে গুরুত্ব দেয় বেশী, তবে বিদেশি বিভিন্ন ফল ফুল ও বাহারি গাছপালাও লাগিয়ে থাকে। একটি গাছ দেখলাম- অনেকটা লতানো ধরণের কাঁটা বিহীন এবং পাতাগুলো মেহেদী পাতার মতো তবে কিছুটা লম্বা এবং পুরো। ছোট ছোট থোকায় লাল-কালো ফল ধরে আছে। ফলগুলো মটর দানার চেয়েও ছোট, গোল মরিচের সমান (ছবিতে দেখুন)। আমি জানি যে উজ্জ্বল লাল ফলে এসিড থাকে, তাই একটি ছিড়ে ভয়ে ভয়ে মুখে দিলাম।

ওহ্....পুরো মুখে নিমিষেই যেন আগুন লেগে গেল! নিজের চেহারাটা ঐ সময় দেখতে পেলে ভালো হতো! পাতা এবং বাকলের গন্ধটা ঝাঁঝাল কিন্তু একটু মিষ্ট ভাব আছে।
স্বাদ টা কেমন? বলছি মশাই, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের কাছে প্রথমবার গেলে মুখের ভেতর দু’ফোটা তরল ঔষধ ছাড়ার সাথে সাথে যেমন হয় ঠিক তেমনি!

তারপর অনেক চেষ্টা করেছি গাছটির পরিচয় জানতে। এখানে কোন বোটানিক্যাল গার্ডেন বা বোটানিক্যাল লাইব্রেরি নেই তাই জানা সহজ হয়নি। এই গাছটি যত্রতত্র জন্মালেও অনেকেই বাড়ীর শোভাবর্ধক হিসেবে এবং মরুর ধূলা ঝড় প্রতিরোধে খেত খামার ও পার্কের চারদিকে লাগিয়ে থাকে।

অবশেষে দীর্ঘদিন পর এই তো গতকাল (৩-২-২০) পেয়েছি তার পরিচয়!
গাছের নাম বা বৈজ্ঞানিক নাম -সালভেদরা
পারসিকা (Salvadora Persica)
স্থানীয় (আরবি) নামঃ আরা'ক (أراك)
জেনাস- সালভেদরা।

এই গাছের শিকড় থেকেই মূলত মেসওয়াক তৈরি হয় অর্থাৎ বাজারে জায়তুনের ডাল বলে যে মেসওয়াক বিক্রি হয় সেগুলো আসলে এই সালভেদরা পারসিকার শিকড় কেটে টুকরো করে বিক্রি করা হয়। জায়তুন গাছের ডাল থেকে মেসওয়াক তৈরি হয়-এটা ভুল কথা। ইংরেজিতে এটাকে টুথব্রাশ ট্রি ও বলে।

আজ মনেপড়ে গেল, বছর দুয়েক আগে একটি নির্মাণ এলাকায় কয়েকজন শ্রমিককে আমি দেখেছিলাম তারা বুলডোজারে দিয়ে উপড়ানো একটি গাছের শিকড় কেটে কেটে থলেতে ভরে নিচ্ছিলো কেন!

এই গাছের রয়েছে অতি চমৎকার কতোগুলো গুণাগুণ, সেগুলো একটু পরে বলছি। আসুন তার আগে মিসওয়াক সমন্ধে একটু জেনে নেই।

মেসওয়াক মানে হলো দাঁত মাজা, তবে সুনির্দিষ্ট ভাবে এই গাছের শিকড় বা ডাল দিয়ে দাঁত মাজাকে মেসওয়াক বলে এবং এই গাছের শিকড় ও ডালই মেসওয়াক। তবে মেসওয়াক হিসেবে শিকড় ই উত্তম কেননা তাতে রয়েছে প্রাকৃতিক নরম ব্রেসল এবং ডেন্টাল ফ্লশ, ডালার চেয়ে বেশি।

তাছাড়া অন্যান্য গাছের ডাল বা শিকড় দিয়ে দাঁত মাজা গেলেও তাতে মিসওয়াকের উপকারিতা ও মর্যাদা অর্জিত হয়না। তবে দাঁত পরিষ্কার অর্থে সমান অর্থ বহন করে। আমাদের এলাকায় সিফটি গাছের শাখা, নিমের শাখা, আমপাতা, পেঁয়ারা পাতা, খেজুর ডালাও মিসওয়াক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

চিকিৎকদের মতে মানুষের যতো রোগ হয় তার বেশিরভাগ রোগই হয় মুখের মাধ্যমে। আমার মতে মুখের দূর্গন্ধ গু'য়ের গন্ধের চেয়েও বিশ্রী!

বিশেষ করে নামাজে দাঁড়ালে পাশের জনের মুখ থেকে যদি দূর্গন্ধ বের হয় আমার তখন মারাত্মক বিরক্তি লাগে। অন্য অবস্থায় হলে অন্তত এদিক সেদিক একটু সরা যায়। আর এ কারণে হাদিসে এসেছে-
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাঃ বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রসূন বা পেঁয়াজ খায় সে যেন আমাদের থেকে দূরে থাকে অথবা বলেছেন, সে যেন আমাদের মসজিদ থেকে দূরে থাকে আর নিজ ঘরে বসে থাকে।’ (বুখারি, হাদিস : ৮৫৫)।

অর্থাৎ নবী সঃ মুখের দূর্গন্ধ দূর করার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আর সেজন্য অবশ্যই দাঁত মাজতে হবে। তখন তো উন্নত টুথপেষ্ট ও ব্রাশ কিছুই ছিলনা, তাহলে উপায়? উপায় ও তিনি বলে দিয়ে গেছেন- মেসওয়াক!

এবার দেখি এই মেসওয়াক গাছে কি আছে? এই মেসওয়াক গাছে রয়েছে বর্তমানের উন্নত মানের যে কোন টুথপেষ্টে যা যা উপাদান থাকে তার সব গুলোই! জি, এগুলো আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণিত এবং এ বিষয়ে অন্তত ৫০ টি পিএইচডি গবেষণা আছে। এই গাছের শিকড় চিবালে এক ধরনের চুইংগাম নির্গত হয় যা দাঁতের প্লাক জমা রোধ করে, রক্তপাত বন্ধ করে, জিনজিভাল ইনডিসিস (মাড়ির প্রদাহ) রোধ করতে পারে। যারা ডায়াবেটিস মেলিটাস এবং রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট (কিডনি গ্রাফটিং) রোগি তাদের মুখের মেমব্রেনের জন্য খুবই উপকারী এই মেসওয়াক।

এটাতে আছে সিলিকা -যা দাঁত ঝকঝকে রাখে। এক ধরনের রেজিন আছে যা দাঁতের এনামেল ঠিক রাখে। এছাড়া রয়েছে দাঁত ও মুখের জন্য উপকারী কতোগুলো উপাদান - Lauric acid, Myristic acid, Palmitic acid, Polysaccharide, Lignin (5 types), Syringin, Liriodendrin, Sitosterol, Glucopuranoside, Quercetin, Benzyl derivatives, Flavonoida rutin ইত্যাদি!

রয়েছে- এন্টিভাইরাল এক্টিভিটি যেটা HSV-1 এবং ডেন্টাল ক্যারিজ রোধে (ক্ষয়রোধ) সহায়তা করে। এবং রয়েছে ক্লোরিন যা দাঁতের গোড়ায় জমা হওয়া tartar (পাথর) গলিয়ে/ ক্ষয় করে দূর করে। এসব বিষয় বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়ায় পৃথিবীর কোন দন্ত চিকিৎসকই মেসওয়াক করা নিয়ে দ্বিমত করেননা, বরং পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

গাছটি লবণ সহনীয় এবং মরু অঞ্চলে ভালো জন্মায় বলে এর শিকড়ে থাকে প্রাকৃতিক লবণ এবং সিলিকা। নতুন শিকড় চিবালে লবণ অনুভূত হয় এবং বালির মতো দানাদানা সিলিকা বের হয়, যা অন্য গাছের হয়না।

এই ফলের বীজ থেকে তৈরি হয় এ্যাসেনসিয়াল অয়েল (বিশেষ তেল) যা ব্যবহৃত হয় বাত ব্যথার জন্য এবং অতি উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়। ফল শুকিয়ে আরবরা তাদের বিশেষ রান্নায় ব্যবহার করে। বড় ছাগল আস্ত ঝলসানোর সময় এর গুড়ো ছিটিয়ে দেয়।

অনেক কথা হলো, এবার একটি হাদিস দিয়ে শেষ করি, মেসওয়াক নিয়ে হাদিস!
হযরত আবু উমামা বাহেলী রাঃ থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাঃ বলেছেন, যখনই জিবরাঈল আঃ আমার নিকট আসতেন, তখনই আমাকে মেসওয়াক করার জন্য আদেশ দিতেন। আমার ভয় হতে লাগলো যে, মেসওয়াক করতে করতে আমি আমার মুখের সম্মুখ দিক ক্ষয় করে দিব। (মেশকাত শরীফ- ১/৪৫)

এবং রাসূল সাঃ মিসওয়াকের গুরুত্ব বোঝাতে যেয়ে বলেন, “যদি উম্মতের কষ্ট ও অসুবিধার কথা চিন্তা না করতাম, তাহলে প্রত্যেক নামাজের সময় মেসওয়াক তাদের ওপর ফরজ করে দিতাম।” (মুসলিম শরীফ- ১/১২৮)।

উল্লেখ্য যে, নবী সঃ এর জন্মের সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্ব থেকেই আরব ও আফ্রিকার মানুষ এই আরা'ক গাছের শিকড় ও ডাল দিয়ে দাঁত মেজে আসছে। তবে নবী সঃ আরা'ক গাছ ও মেসওয়াক করাকে 'ওরাল কেয়ার' পর্যায়ে এবং ধর্মীয় ভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন ফলে অনেক অমুসলিম এটাকে ইসলামিক সংস্কৃতি হিসেবে বর্জন করেছে। তবে ইউএইতে দেখেছি অনেক অমুসলিমরাও মিসওয়াক করে।

আশাকরি, বীজ নিয়ে এসে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিবো এই গাছ...ইনশাআল্লাহ।\

- Masud Alam

পঠিত : ৯২৩ বার

মন্তব্য: ০