Alapon

পৃথিবী : এক প্রলয়ঙ্করী দোলনার নাম...



'তিনিই তো সৃষ্টি করেছেন, যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বানিয়েছেন দোলনা স্বরূপ এবং তৈরি করে দিয়েছেন রাস্তা। যাতে তোমাদের গন্তব্য-স্থলের পথ খুঁজে পাও'। সূরা আয-যুখরফ-১০

একটি শিশু দোলনায় খুবই আরামের সাথে ঘুমায়। আমরা যারা বড় হয়েছি তার দোলনার আরামের কথা মনে করতে পারিনা, তবে শিশুদের মুখোয়ব দেখে বুঝতে পারি, তারা আরাম পায় এবং নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে! দোলনায় কোন ধাক্কা, কম্পন, নাড়াচাড়া, হঠাৎ থেমে যাওয়া কিংবা উল্টে যাওয়ার ঘটনা ঘটেনা। যার কারণে ভীতি-হীন নিদ্রা শিশুরা উপভোগ করে। পৃথিবী সম্পর্কে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের দেড় হাজার পূর্বে পৃথিবীর চলাচল টাকে আল্লাহ দোলনার সাথে উপমা দিয়েছেন। তখন এর বেশী উপমা দিলে মানুষ হয়ত বুঝত না। অথচ তখনও বিশ্বজগত নিয়ে মানুষ কিছু জানতা না!

আকল দিয়ে নির্লিপ্ত মানুষ, পৃথিবীকে দোলনার মতই দেখতে পায়। মানুষের জ্ঞান বাড়ার সাথে সাথে পৃথিবীর ঘূর্ণন, গতি ও দূরত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে বিবেকবান ও সতর্ক মানুষও পৃথিবীকে দোলনার সাথে সামঞ্জস্যতা দেখে। মানুষের মাঝে যারা গভীর জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তারা দেখতে পায় পৃথিবী নিছক কোন দোলনা নয়, এ এক ভয়ানক দোলায়মান গোলক! যার মাঝে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ আতঙ্ক। কাজের হিসেবে এই দোলনার অদৃশ্য রসির টানে যদি সেকেণ্ড পরিমাণ সময়ের হের-ফের হয়, তাহলে মুহূর্তেই সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে! নিচের বিশ্লেষণে দেখুন আল্লাহ কি ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যেই তার সৃষ্টিকে নিরাপদ রেখেছেন, করেছেন সাবলীল! এই নিরাপত্তা পেয়ে, কেউ আছে ঘুমিয়ে, কেউ মত্ত তামাসায়, আবার কেউবা মগ্ন কৃতজ্ঞতায়।

রকেটের গতি যদি সেকেণ্ডে ৮ কিমি (কিলো-মিটার) বেশী হয় তাহলে সেটি মর্ধ্যাকর্ষণ শক্তির ক্ষেত্র ভেদ করে, মহাকাশে যেতে পারে। হচ্ছেও তাই। সেক্ষেত্রে পৃথিবী তার বিশাল দেহ নিয়ে আরো বেশী ক্ষিপ্ততায় সেকেণ্ডে ৩০ কিমি গতিতে ছুটে চলছে লক্ষ বছর ধরে! রকেটের গতি ঘণ্টায় প্রায় ২৯ হাজার কিমি আর পৃথিবী ঘণ্টায় ১ লক্ষ ৮ হাজার কিমি গতি নিয়ে সূর্যের চারিদিকে প্রতিনিয়ত পরিভ্রমণ করছে! প্লিজ, একটু গভীর মনোনিবেশ করুন! এই ভয়ানক গতি নিয়ে পৃথিবী শুধু সূর্যের চারিদিকেই ঘুরছে না, সাথে সাথে অবিকল ঘূর্ণায়মান লাটিমের মত প্রচণ্ড গতিতে ঘণ্টায় ১৬০০ কিলি বেগে নিজ কেন্দ্রের উপরও ঘুরে চলছে! কল্পনার শক্তি দিয়ে একটু চিন্তা করুন কোন্‌ ঘূর্ণনের চক্করে আমরা বাস করছি! মানুষের মধ্যে যারা বীর, তারা তো কয়েক চক্করেই মাথা ঘুরিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে!

আরেকটু বাহিরে গেলে দেখবেন, সৌর জগতের পুরো পরিবার নিয়ে সূর্য নিজের গ্যালাক্সিতে ঘুরছে, প্রতি সেকেন্ডে ২০০ কিলো মিটার বেগে! সে এক ভয়ানক কর্মযজ্ঞ। মানুষের চিন্তা ও ধী শক্তি দিয়ে এই চক্করের এক মিনিটের হিসেব কষা সম্ভব নয়! তবে কল্পনা শক্তি দিয়ে যদি ভাবা হয়, তাহলে অন্তত এতটুকু বুঝা যাবে, এক সেকেন্ডের জন্য যদি কোথাও কোন কিছু থেমে যায়; তাহলে ভয়াবহ গোলযোগে মানুষ 'মা' বলে চিৎকার করার মত সময় ও সুযোগ পাবে না। মুহূর্তেই সব কিছুই ধুলোর ন্যায় মহাকাশে উড়তে থাকবে।

আল্লাহ বলেছেন, 'পৃথিবীকে মানুষের জন্য বড় অনুগ্রহ করেই, দোলনার মত বানিয়েছেন এবং তার বুকে রাস্তা করে দিয়েছেন'! এটা বুঝার জন্য নিজের চিন্তাকে এদিকে একটু গভীরে ধাবিত করুন। ক্ষুদ্র পিঁপড়াকে গোলাকার বলের উপরে নিশ্চয়ই হাটতে দেখেছেন! বিশ্বাস করবেন আমরা অবিকল পিপড়ার মত, পৃথিবীর বুকে উল্টো পা লাগিয়ে মাথাকে নিচের দিকে লটকিয়ে হাঁটছি, দৌড়াচ্ছি, ঘুমাচ্ছি আর দুনিয়ার অঘটন ঘটাচ্ছি! যুদ্ধ-বিগ্রহ, লুণ্ঠনে ব্যস্ত হয়ে গর্ব, অহঙ্কার আর দাম্ভিকতায় হেটে চলছি!

কিসের উপর হাঁটছি, তাতে কখনও কান লাগিয়ে শুনেছি? পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, যার প্রবল ঝাঁকুনি মানুষের জীবন কিংবা নিদ্রাকে ব্যাহত করেনা! এই পৃথিবীর পেট ভরেই আছে আগুন দিয়ে! এতই ভয়ঙ্কর যে, ধাতব বস্তুও তো থোরাই, পাথরও লাভায় পরিণত হয়। সে আগুনের দূরত্ব, কোথাও দশ মাইল, কোথাও পাঁচ কিংবা কোথাও মাত্র দশ গজ! কোথাও পাকা ফোড়ার মত ভূপৃষ্ঠের চামড়া গলে ভয়ঙ্কর শব্দে উতলে উঠে আগুনের লাভা! ভিসুভিয়াসের মত ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে আছড়ে পড়ে ভূতলে! বিরান করে হাজারো মাইলের জনপদ! কখনও ভেবে দেখেছি কি! যে সাধের বাড়ী করেছি, বাগান বানিয়েছি তার একশ মিটার নিচেই লুকিয়ে আছে এই অনলের কুণ্ড! না! অকৃতজ্ঞ মানুষ এভাবে ভাবতে অভ্যস্ত নয়, ভাবতে চায় না! সে মৃত্যুর কথা স্মরণ করতেই আগ্রহী নয়, অথচ এটাই বাস্তবতা।

মানুষ অকৃতজ্ঞ হলেও, আল্লাহ তার বান্দাদের ভালবাসেন, তিনি তাদের সচল রাখতে তাদের জন্য এই ভয়ানক অগ্নিগোলকের উপরে বানিয়েছেন চলাচলের জন্য রাস্তা।
ভূ-পৃষ্ঠে পাহাড়ের মাঝে রয়েছে অগণিত গিরিপথ। সেই পাহাড়ের আকৃতিও ভিন্ন, ধরণ ভিন্ন এবং তাতে উৎপন্ন পণ্যরাজিও ভিন্নতা আছে। পাহাড়ি ও সমতল ভূমি অঞ্চলে রয়েছে নদীর মাধ্যমে পানির পথ। এগুলো একটি অন্যটির মত অবিকল নয়। এখানেও রয়েছে হাজারো ভিন্নতার উপাদান। আবার ভূ-ভাগকে নানা রকমের পার্থক্য সূচক চিহ্ন রেখে দিয়েছেন, যাতে করে মানুষ বৈপরীত্য পার্থক্য করতে পারে। এই বৈপরীত্যের কারণে মানুষ এসব সহজে মনে রাখতে পারে। আল্লাহ বলেছেন, এসব মানুষের কল্যাণের জন্যই এভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাদের চলাচলের সুবিধার্থে এভাবে স্থাপন, সৃজন করেছেন।

যদি পাহাড়গুলোর মাঝে কোন ফাঁক না থাকত তাহলে মানবজাতি এক অঞ্চলে আবদ্ধ হয়ে থাকত। নদী-সাগরের বিশালতা না থাকলে মানুষ ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক এক এলাকাতে বসতি করে থাকতে বাধ্য হত। বর্তমানে এক হাত জায়গার জন্যও ভাতৃ-ঘাতী লড়াইয়ে পিতার বংশ নিমেষে ধ্বংস হয় কিন্তু যিনি এসব এমনিতেই দিয়ে দিয়েছেন, তার জন্য কতটুকুই বা ভাবি!

মাথার উপরে জগতের গতিময়তা, পায়ের নীচে বিস্ফোরণ আর আগুনের ভয়াবহতা নিয়ে যে মানুষ নিশ্চিন্তে দোলনায় ঘুমায়! তারা কার করুণায় নিজেদের এতটা নিরাপদ মনে করছে! তিনি যদি কিঞ্চিত গোস্বা কিংবা সামান্য বিরক্তি অনুভব করেন। তাহলে মুহূর্তেই মানবজাতি সহ সকল সৃষ্টিকুল ধূলিতে পরিণত হতে পারে। আমরা তার এমন বদান্যতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ থেকে দূরে, বহুদূরে।

আল্লাহ নিজেই বলেছেন মানুষের চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞ তিনি আর কাউকে পান নাই। আবার সেই মানুষদেরই তিনি উৎসাহ দিয়ে বুঝিয়েছেন, 'আমার সৃষ্টি নৈপুণ্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা-গবেষণা করো! সেখানে শুধু শিখা আর শিক্ষার উপকরণই রয়েছে, যাতে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান মানুষের জন্য রয়েছে নিদর্শন। এই চিন্তা ভাবনাকে তিনি তার গোলামীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন! তাই আসুন মগজ আর মেধাকে শানিত করে এটাকে কাজে লাগাই। চিন্তা ও গবেষণা করি এবং আল্লাহ অগণিত করুণা নিয়ে ভাবি। তবেই মানুষ হিসেবে বিচরণ করতে পারা সার্থক হবে। নতুবা বিবেক ও বোধশক্তিহীন অন্য দশটি ইতর প্রাণীর ন্যায়, মানুষের জীবনও ইতর প্রাণীর জীবন হিসেবেই গণ্য হবে।

- Nazrul Tipu

পঠিত : ৩২৫ বার

মন্তব্য: ০