Alapon

লুকিয়ে বিয়ে আর পারিবারিক বিয়েয় পার্থক্য কী?



লুকিয়ে বিয়ে আর পারিবারিক বিয়েয় পার্থক্য কী?
লুকিয়ে বিয়ে দুইজনে ঝটপট সেরে ফেলে। গয়নাগাটি তো দূরকি বাত, অনেকে শাড়ি-শেরওয়ানিও যোগাড় করে না বা করতে পারে না।
আর পারিবারিক বিয়ে হলো, দুই পক্ষে বিশাল ঢাকঢোল পেটানো হবে। ধারাবাহিকভাবে খালু, চাচা, ছোট আপুরা রাগ করে বেঁকে থাকবে। পাত্র লিপস্টিক একটা কম নিলেও তার চৌদ্ধগোষ্ঠী উদ্ধার হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
পালিয়ে বিয়ে করলে বলে, তারা দুজন পরস্পরকে ভালোবাসে। নিজেদের ভালোর জন্যই বিয়ে করে নিয়েছে।
আর পারিবারিক বিয়ে? বিয়ের সাতদিন আগ থেকে নানান রকম অনুষ্ঠান শুরু হয়। ঘরের দুয়ার থেকে রাস্তার মাথা পর্যন্ত লাইটিং না হলে মানিজ্জত পাংচার হয়ে যায়। পাত্রের ব্যাপারে সারাক্ষণ বদচিন্তা, সে তো মেয়েকে সুখে রাখবে না! সাজানি এত কম কেন, কৃপণ বংশ নাকি? মেয়ের বাড়ি থেকে টয়লেটের বদনি থেকে শুরু করে সবকিছু আসতে হবে। প্রতি সিজনে পিঠা, মিষ্টি, খাসি ইত্যাদি 'উপহার' আসতে থাকতে হবে। কোনোবার একটু কম হলেই হলো, বাড়ি বাড়ি রটে যাবে, 'অমুকের খেশি ভালো পড়ে নাই'। আরও কত কী!
আমার ধারণা, আলেম কি জাহেল, হাজারটার মধ্যে একটা বিয়ের বিবরণ খুঁজে পেতে কষ্ট হয়ে যাবে, যেখানে অন্তত কথার দ্বারা পরস্পরকে আঘাত করা হয়নি!
এখানে মেয়ের চেয়ে মেয়ের পরিবারের এবং ছেলের চেয়ে ছেলের পরিবারের চাহিদা থাকে বেশি।
মেয়ের চাহিদা কী! মনমতো একজন স্বামী, যে তাকে ভীষণ ভালোবাসবে। সুখে-সবরে সঙ্গ দেবে। বিয়ের দিন তার শখ থাকে সাজগোজের। বিয়ের পরে স্বামী সঙ্গে থাকবে।
কিন্তু তার পরিবার কী চাইবে? দশ লাখ টাকা কাবিন দিতে হবে।
দশ লাখ টাকা কাবিনের যুক্তি কী?
তাহলে ছেলে তাদের মেয়েকে যত-যাই হোক, টাকা পরিশোধের ভয়ে তালাক দিতে পারবে না।
দেখুন ভাই, কাবিন বা মোহরানার টাকা অবশ্যই পরিশোধ্য। আপনি যদি চিন্তা করেই রাখেন, দশ লাখ টাকা শোধের ভয়ে আপনার মেয়েকে সে তালাক দিতে পারবে না, এতে কী হলো? আপনিই পরোক্ষভাবে তার টাকা অপরিশোধ হবে মেনে নিচ্ছেন। আপনার মেয়েও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
সে টাকা তো হারাল, দুইজনের বনিবনা না হলে সারাজীবন মানসিক টর্চার ভোগ করতে হবে। স্বামী তাকে ছাড়বে না ঠিক, তাকে সময় ও ভরণও দেবে না। গোপনে হয়তো পরকীয়াও করবে! কথায় কথায় খোঁটা ও খোঁচা দেবে। সংসারে অশান্তি করবে।
তারপর বিয়ের দিন বা আগে-পরে প্রায় পরিবারেই দেখা যায়, পাত্রপক্ষকে দৃষ্টিকটু মন্তব্য করে। পাত্রীর স্বজনেরা খুঁটিনাটি প্রসঙ্গেও ঠকে গেছে ভেবে শুরু করে জেরা বকাবাদ্য। ধরুন আপনার ওয়াদা ছিল, বিয়ের দিন দশ কেজি মিষ্টি আনবেন। কোনো কারণে পরিমাণে কম হলো, বা আনতেই পারলেন না। বাস, যাবেন কই! শুরু হয় নিন্দা তিরস্কার। এবং বাজেভাবে মহিলাদের ভেতর এই স্বভাবটা অতিমাত্রায় প্রকট। অনুষ্ঠানে আসা পাত্রের আত্মীয়াদের দফাসারা না করে তারা শান্ত হতে পারে না।
এর ফলাফলও হয় খুব বিদঘুটে। এই মেয়ে তো স্বামীর সংসার করে! সারাজীবন কথায় কথায় বিভিন্ন কাজে ও উপলক্ষ্যে তার এসব শুনতে হয়। স্বামীর মুখে, শ্বাশুড়ির মুখে, ননদদের মুখে এসব শুনতে, খোঁচা শুনতে নিশ্চয়ই তার কষ্ট হয়! এর দায় কার? তার ভালোর জন্য বিয়ের আসরে প্রচুর সমাজপ্রথা দেখিয়ে যে বিষ মারল, মেয়েটি কি নিজের পরিবারকে ক্ষমা করতে পারবে?
অথচ আমরা দেখি, আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন হযরত ফাতিমা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ে করতে যান, তার কাছে কিচ্ছু নেই। নবীজি বললেন, আমি যে তোমাকে একটা বর্ম উপহার দিয়েছিলাম, সেটা কই?
তিনি বললেন, সেটা আমার কাছে আছে ইয়া রাসুলাল্লাহ। তবে বেশ পুরোনো এবং খারাপ হয়ে গেছে।
নবীজি বললেন, তা-ই বিক্রি করে দাও।
আলি রাযিয়াল্লাহু আনহু বাজারে গেলেন বর্মটি বিক্রি করতে। উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহু এসে চারশ দিরহাম দিয়ে কিনে নিলেন। বললেন, ভাই, এতে তো তোমার প্রয়োজন সারবে!
হ্যাঁ, সারবে।
ধরো, এই বর্মটি আমি তোমাকে উপহার দিলাম।
দিরহাম এবং বর্ম উভয়টি নিয়ে তিনি ফিরে এলেন।
বিখ্যাত তাবেয়ি সাঈদ ইবনু মুসায়্যিবের অনিন্দ্য সুন্দরী এক মেয়ে ছিল। খলিফা আবদুল মালিক নিজের ছেলের জন্য প্রস্তাব পাঠালেন। সাঈদ রাজি হলেন না। খলিফা তাকে নানান রকম চাপে ফেলতে শুরু করলেন, তবু দিলেন না।
কিছুদিন পর কুরাইশের এক হতদরিদ্র ছেলে দেখা করতে এল। অনেক দিন পর এসেছে দেখে সাঈদ জিগ্যেস করলেন, এতদিন এলে না কেন?
আমার স্ত্রী মারা গেছে।
আমাকে খবর দাওনি কেন, জানাযায় আমিও শামিল হতাম! তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলেছো?
আমার কাছে বিয়ে করার মতো যোগাড়যন্ত্র কিচ্ছু নেই।
তুমি বিয়ে করতে ইচ্ছুক কি না, সেটা বলো!
জি, ইচ্ছুক।
সঙ্গে সঙ্গে সাঈদ ইবনু মুসায়্যিব নিজের অতি সুন্দরী আদুরে দুলালীকে হতদরিদ্র বিপত্নীক কুরাইশি ছেলের সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দিলেন।
যুবক তো মহাখুশি, বন্ধুদের থেকে ধারদেনা করে হলেও আয়োজন-অনুষ্ঠান করবে।
সন্ধ্যায় সাঈদ মেয়েকে নিয়ে যুবকের দুয়ারে হাজির। যিনি সাধারণত কোথাও যান না, তাকে দেখে যুবক ব্যস্ত হয়ে উঠল। সাঈদ ইবনু মুসায়্যিব বললেন, তুমি বিয়ে করেছো, স্ত্রী থাকতে একা রাত কাটাবে কেন? এই বলে মেয়েকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
যথাসময়ে যুবক তার নববধূর ঘোমটা তুলে দেখে, সুবহানাল্লাহ, এ তো পরমা সুন্দরী! তারপর জানতে পারে, তার নববধূ কুরআনের হাফেজা, হাদিসের জ্ঞানী। ইসলামের বিধিবিধান সম্বন্ধে যথেষ্ট জানাশোনা শিক্ষিত তরুণী।
মাশাআল্লাহ। এমন একজন মেয়েকে সাঈদ স্বয়ং খলিফার ছেলেকে না দিয়ে তুলে দিলেন অতি সাধারণ এক বিপত্নীক যুবকের হাতে! কোনো কথা কাটাকাটি নেই। পরস্পর দুনিয়াবি চাহিদা নেই। আখেরাতই তাদের আসল। পুণ্যময় জীবনই তাদের আকাঙ্ক্ষা। এ কারণেই তাদের যুগ ছিল সোনালি। তাদের ঘরে জন্মেছে যুগের সেরা ব্যক্তিত্বরা। তারা হয়ে আছেন অনুসরণীয়।
আর আমাদের সমাজে বিয়ে মানে গুনাহের আসর। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, কী এক অতিমারি রূপ নিয়েছে 'সমাজপ্রথা' নামক বিদঘুটে কার্যকলাপ। করোনার টিকা বেরিয়েছে, কিন্তু বিয়ের আসরে আয়োজনে স্বজনে 'সমাজপ্রথা'র টিকা কবে পুশিং হবে, ইসলামে আমরা কবে ফিরে যাব, আল্লাহ মালুম।
.
ওমর আলী আশরাফ
ওয়াসেকপুর

পঠিত : ৩১৩ বার

মন্তব্য: ০