Alapon

"ছেলেদের যুদ্ধ ছেলেদের সংগ্রাম"



আমি একজন প্রাপ্ত বয়স্ক যুবক ছেলে। আমাকে প্রতিনিয়ত-ই সংগ্রাম করে যেতে হয় । করে যেতে হয় যুদ্ধ। তীব্র এক অসম যুদ্ধ চলে আমার মন-মগজ-মস্তিস্কের ভেতর। চলে ভীষণ ভয়ংকর এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমার অভ্যন্তরেই দুটো সত্ত্বা থাকে। দুটো পক্ষ থাকে। এক পক্ষ হলো আমার শখ-আহ্লাদ। আমার আবেগ-অনুভূতি। অন্য পক্ষ হচ্ছে আমার সামনেই মাথা তুলে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা এক নির্মম নিঠুর বাস্তবতা।

হররোজই এই যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধ চলে আমার সত্ত্বার সাথে আমার নফসের। ভীষণ ভয়ানক সে যুদ্ধ। আমি পরাজিত হয়ে হয়েও জিতে যাই। আমি পড়ে যেতে যেতেও ওঠে দঁড়াই।
আমি ছেলে, আমি আমার যুদ্ধের কথা কাউকে প্রকাশ করতে পারি না। আমি আমার নফসের সঙ্গে সংঘাতের কথা কাউকে বলতে পারি না। বললেও যে কেউ-ই তেমন একটা পাত্তা দেবে না। বুঝতে চাবে না। এমনকী চায়ও না...

আমি একজন রক্তে মাংসে গড়া যুবক ছেলে। আমি বারংবারই আমার নফসের খায়েশাতের কাছে আক্রান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ি। আমার কাছে সে আক্রমণ মোকাবেলা করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। আমার একটা মাত্র অস্ত্র; ঈমান। এই ঈমানও খুব জং ধরা। এই ঈমানও খুব ধারহীন। তবুও যা আছে, তা নিয়েই আমি অবিরত নিজের মানবিক দুর্বতাগুলোর সাথে যুদ্ধ করে যাই। আমার যুদ্ধে আমার সহযোগী হবার মতো আল্লাহর দুনিয়ায় কেউ নেই। হ্যাঁ, কেউই নেই।

আমার যুদ্ধে কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়ায় না। আমার যুদ্ধ কেউই বুঝতে চায় না। সবাই আমার কাছে বীর বিক্রমে সিংহ গর্জনে লড়াই করে বিজয়ী হবার প্রত্যাশা করে, আদতে কেউই আমার পাশে দাঁড়ায় না। আমাকে লড়াই সংগ্রামের অস্ত্রসস্ত্র সরবারহ করে না।
তবুও যদি আমি কোনোভাবে এই অসম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যাই, যদি আমি হেরে যাই, যদি পরাজয়ের তিলক কোনোভাবে আমাকে স্পর্শ করে ফেলে, তখন এ-সমাজের মানুষগুলোর কাছে আমি ভীষণ এক কাপুরুষ। আমি ভীষণ এক নীচু আর অযোগ্য ছেলে।

একটু সরস প্রকৃতির মানুষ এসব যুদ্ধে একবার হেরে যাবার পর তো লম্পট, ভণ্ড, মুখোশধারী ইত্যাদি বলে আমাকে জীবন-পথের সংগ্রাম থেকে, পুনরায় কোমর সোজা করে ওঠে দাঁড়াবার মতো পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করে। কেউই পুনরায় এসে আমাকে আবারও বীরের বেশে লড়াইয়ের মনোভাব যোগায় না। আমার হাত থেকে পড়ে যাওয়া তলোয়ারকে আমার হাতে তুলে দেওয়ার মতো ভালোবাসা ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করেনা।

আমি যখন লড়াই করেতে করতে ক্লান্ত, যখন আমি যুদ্ধে আহত হতে হতে, জখম হতে হতে ক্ষতবিক্ষত , তখন কিন্তু কেউই আমার সেই জখমগুলো সারিয়ে দিতে চেষ্টা করেনি। আমার ক্ষতের মধ্যে একটু হাত বুলিয়েও দেয়নি।

তারা শুধু দূর থেকে দেখেছে যে, আমি তো ভীষণ ভালো এক যোদ্ধা; কিন্তু আমি কতোটা জখম হয়েছি, কতোটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছি কিংবা হয়ে যাচ্ছি নিত্যদিন নিয়ম করে; সেটা কখনো কোনোদিনও তারা উপলব্ধি করেনি। কখনো তারা সেটা দেখেনি। অথচ যখনই আমি হেরে যাই, যখনই আমি হেরে গেয়েছি, তখনই এই এরাই আমাকে আরো বেশি খুন আর জখম করেছে।

ছেলেদের জীবন এটাই। ছেলেদের বাস্তবতা এমনই। এদের পাশে কেউই দাঁড়াতে চায় না। যতোদিন তারা লড়াইটা অব্যাহত রাখতে পারে, ততোদিন খুচরো একটা ধন্যবাদ প্রকাশ করবে দূর থেকেই। যদি বিজয়ী হয়ে আশপাশকেও জয় করতে পারে, কিংবা বিজয়ীর অভিনয় করতে পারে, তখন গিয়ে সে জয়ের স্বাদ, সে জয়ের গণিমত ভোগ করতে অনেকেই দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়াতে প্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু তাদের সংগ্রামের সময়গুলোতে কেউই তাদের পাশে থাকে না। তাদের আহত ক্ষতবিক্ষত হয়ে থাকা শরীরটাতে, তাদের জখমের চিহ্নওয়ালা পিঠ্টাতে হাত বুলিয়ে দেয়ার মতো কেউই থাকে না। যে ছেলেগুলো ভালো পথে থাকতে চায়, চলতে চায়, নিজের নফসকে পরাজিত করে বিজয়ীর বেশে চিরকাল মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে চায়; তাদের জন্যে এ-সমাজ ভীষণ অসহযোগী। সত্যিই ভীষণ অসহযোগী।

কারণ, তারা যখন হেরে যায়, তখন তাদেরকে যেমন ঘৃণা করা হয়, ঠিক যখন তারা যুদ্ধ করে, সেই সময়টাতেও মানুষ মনে করে হয়তো তারা রোবট টাইপের কিছু একটা, কিংবা অতিমানবীয় কোনো এক সত্ত্বা। এদেরকে কেন যেনো মানুষ রক্তে মাংসে গড়া একজন "স্বাভাবিক মানুষই" ভাবতে পারেনা। এদের যেনো কোনো স্বাদ-চাহিদা থাকতে নেই। এদের যেনো আবেগ-অনুরাগ থাকতে নেই! এদেরকে মানুষ ভাবলে তো মানুষের যে স্বভাব-প্রকৃতি, সেই স্বভাব-প্রকৃতিও বোঝার কথা। মানুষের আবেগ-অনুরাগও অনুধাবন করার কথা......
"ছেলেদের যুদ্ধ ছেলেদের সংগ্রাম"
~ রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ১০১১ বার

মন্তব্য: ০