Alapon

বিজ্ঞান গবেষণা কেন ফরজ?



ভদ্রলোক চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন কয়েক বছর আগে। সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক ছিলেন। এখন ঘুরে বেড়ান দেশ বিদেশে। সবশেষ বেড়াতে গিয়েছিলেন সাইপ্রাস (গ্রীক অংশে)।
একাকী হাঁটছিলেন সাইপ্রাসের লিমাসল শহরের (Limassol city- 34.7071° N, 33.0226° E) সমুদ্রের তীরঘেঁষা পাহাড়ি পথে, যেখানে শুধু শুষ্ক খনখনে পাথরের পাহাড়। খুব সামান্য কিছু বিশেষ জাতের গাছগাছালিই কেবল পাথুরে পাহাড়ে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু সেই পাহাড়ের গায়েই একটি প্রাপ্তবয়স্ক সতেজ সবল ডুমুর গাছ (ত্বীন বা Fig) দেখে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। স্থানীয় লাখো মানুষের চোখে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও এটা এই অধ্যাপক সাহেবের চোখে অস্বাভাবিক লেগেছে।

তিনি চেয়েছিলেন পেশাদার গবেষণা আর নয় এখন শুধুই বিশ্রাম, কিন্তু এই ডুমুর গাছ তাকে ঘুমাতে দেয়নি। তিনি তার উদ্ভিদ বিদ্যার জ্ঞানের সাথে কোন ভাবেই এই ডুমুর গাছটিকে মিলাতে পারছিলেন না।

ডুমুর বা ত্বীন গাছ সাধারণত সেঁচ যুক্ত নরম মাটিতে জন্মায়। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ডুমুর গাছ হওয়া খুব স্বাভাবিক কিন্তু সেঁচ বিহীন পাথুরে পাহাড়ে বছরের পর বছর ধরে একটি বড় আকারের গাছ সতেজ ও ফলবান থাকা তেমনি খুবই অস্বাভাবিক।
স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে তিনি গাছের আসল গোড়া খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন এবং দেখলেন বড় একটি গর্তের কয়েক ফুট নিচ থেকে গাছটি উঠে এসেছে। পরের দিন তিনি গর্তে ঢুকে খনন করে এর আসল রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে তার গোড়ায় মাটির নিচে মানুষের কঙ্কাল দেখতে পেয়ে স্থানীয় পুলিশকে জানালেন। পুলিশ সেখান থেকে তিনটি মৃতদেহ (কঙ্কাল) উদ্ধার করেন এবং তারা এখবর জানিয়ে দেন তূর্কী-গ্রীস যুদ্ধের সময় নিখোঁজ হওয়া ব্যাক্তিদের নিয়ে কাজ করা তদন্ত কমিশনের প্রধান জিনোফন ক্যালিস কে।
(উল্লেখ্য যে, সাইপ্রাস দ্বীপের মালিকানা/ দখলদারিত্ব নিয়ে ১৯৬৩- ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তুরষ্ক ও গ্রীসের মধ্যে যুদ্ধ/সমস্যা চলতে থাকে এবং শেষতক সাইপ্রাস দুইভাগ হয়ে যায়। এক অংশ তুর্কী সাইপ্রাস এবং অন্যটি গ্রীক সাইপ্রাস। ঘটনাটি গ্রীক সাইপ্রাসের।)

২০০৬ সাল থেকে মিস্টার ক্যালিস ও তার দল ১৯৭৪ সালের যুদ্ধে নিখোঁজ হওয়া তালিকাভুক্ত ২০০২ জন নিখোঁজ ব্যাক্তির হসিদ (খোঁজ/শেষ পরিণতি) জানতে কাজ করে যাচ্ছেন এবং এ পর্যন্ত ৮৯০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার বা তাদের পরিচিতি নিশ্চিত করতে পেরেছেন।
তিনটি কঙ্কালের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয় এবং একজনের ডিএনএ মিলে যায় এমন একজনের সাথে যিনি তার ছোট ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন এবং অনেকের মতো তিনিও তদন্ত কমিশনকে নিজের ডিএনএ নমুনা দিয়েছিলেন ।
বর্তমানে ৮৭ বছরের বৃদ্ধা মুনুর হেরগুনার জানান, তার ছোট ভাই আহমেত হেরগুনার সেসময় তুর্কী রেজিস্টেন্স আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন যারা তখন গ্রীক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করত।

একদিন সন্ধ্যায় তার ভাই এবং সে বাড়ীতে বসে বাগান থেকে তুলে আনা পাঁকা ডুমুর (ত্বীন) খাচ্ছিলেন। এমন সময় দরজায় কড়া নড়ে এবং দরজা খুলতেই কয়েজন লোক তার ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
ঘটনাটি তদন্ত করে এবং গর্তের মাটির রাসায়নিক পরীক্ষা করে কমিশন জানিয়েছে যে, তিনজন লোককে হাত পা বেঁধে পাহাড়ের এই গুহায় ঢুকানো হয়েছিল এবং অতঃপর ডিনামাইট বিস্ফোরণ করে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল।
আর এই বিস্ফোরণে গুহার উপরের দিকে বড় একটি ছিদ্র তৈরী হয়। যেখান দিয়ে ধুলাবালি, আলো এবং বৃষ্টির পানি ঢুকে ডুমুর গাছটিকে বেড়ে উঠতে এবং বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছে।

আর ডুমুর গাছটির জন্ম হয়েছিল আহমেত হেরগুনারের পেটে থাকা তাজা বীজ থেকেই।
মৃত হলেও ৪৫ বছর পর ভাইয়ের খোঁজ পেয়েছেন এজন্য তিনি খুশি হয়েছেন এবং কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
...........
উদ্ভিদ বিজ্ঞানের স্বল্প জ্ঞান থেকে (আমি মাসুদ আলম) এটাই জানি যে ফাইকাস জাতের (Genus) উদ্ভিদের ফলের বীজ থেকে সরাসরি মাটিতে চারা জন্মায় না। প্রথমে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় অন্ধকার বায়ুশূন্য আর্দ্র স্থানে কমপক্ষে ১২ ঘন্টা রাখলে সেটা প্রথমে অঙ্কুরিত হয় এবং পরে সেটা মাটি বা আর্দ্র দেয়াল ঘেঁষে বড় হয়।

খেয়াল করে দেখবেন যে, বট পাকুড় ইত্যাদি এই জাতীয় গাছ গুলো সাধারণত দেয়াল কিংবা স্যাঁতস্যাঁতে ইট সিমেন্টের তৈরী দেয়ালের গায়েই বেশি জন্মায়।
কেননা এসব গাছের পাঁকা ফল পাখি খায় এবং তাদের পেটে অঙ্কুরিত হয় এবং তাদের মল থেকেই দেয়াল বা গাছের কোঠরে এই গাছ গুলো জন্মায়। ঠিক তেমনিভাবে ত্বীন/ ডুমুর ফলের তাজা বীজ ২৪-৪৮ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখার পর উষ্ণ তাপমাত্রায় অন্ধকার স্থানে রেখে দিলে ৭-১৪ দিনের মধ্যে বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা গজায়। উল্লেখিত ঘটনাটির ক্ষেত্রে সম্ভবত তেমনটিই ঘটেছিল।

যাহোক, শিক্ষা ও বিজ্ঞান গবেষণা মানব জীবনে কতোটা প্রয়োজন এবং উপকারী, এই ঘটনা খুব সামান্য একটি উদাহরণ মাত্র।
আর এজন্যই জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ (অত্যাবশ্যক)।
ধন্যবাদ।

মাসুদ আলম
(তথ্যঃ ডেইলি সাইপ্রাস টাইম সংবাদপত্র। অধ্যাপক সাহেবের অনুরোধে সংবাদপত্রটি তাঁর নাম প্রকাশ করেনি। ছবিতে- সেই ডুমুর গাছটি এবং জিনোফন ক্যালিস।)

পঠিত : ৫০৩ বার

মন্তব্য: ০