Alapon

আমরা মুসলমান নাকি মানুষ?


আধুনিক যুগে পাশ্চাত্য সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের অন্যতম প্রধান বিষয় হলো ‘হিউম্যানিজম’, যাকে বাংলায় মানববাদ বলা হয়। তবে মানববাদ না বলে ‘মানবপূজা’ শব্দটাই এই ক্ষেত্রে যথার্থ হয়। হিউম্যানিজম মূলত ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন থেকে ধর্মকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করার মৌলিক ধারণা। পুরো পশ্চিমা সভ্যতা ও পুঁজিবাদ দাঁড়িয়ে আছে এই একটা চিন্তার উপর।
আদতে মানুষ এবং মুসলিম বিপরীতমুখী কোনো বিষয় নয় যে, এর যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে। একজন ব্যক্তি একইসাথে মানুষ এবং মুসলিম হতে পারে। তা হলে এই বিতর্ক কেন? কারণ, মানুষ (human) বলতে পশ্চিমারা দীনমুক্ত যে স্বাধীন সত্তাকে বুঝায়, ইসলাম তার অনুমোদন করে না। পশ্চিমা মানববাদ আজ মানবিকতার বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু ইসলাম মানববাদের এমন কার্মকাণ্ড মেনে নেয় না।
আমাদের খুব ভালো করে বুঝতে হবে পশ্চিমাদের যে বল্গাহীন স্বাধীনতার মানববাদ তা দিয়ে একজন মুসলিমের মুসলিম পরিচয়ের যে দাবি ও গর্ব, তাকে সংকটে ফেলবার জন্যই এই বিতর্ক। পশ্চিমাদের কাছে ‘মানুষ’ নিছক আকৃতিগত বিষয় নয়; বরং তা হচ্ছে একটি দর্শন (Epistemological Concept), যা স্রষ্টা কিংবা অন্য কোনো অথরিটির কর্তৃত্ব থেকে দায়মুক্ত। নিঃসন্দেহে যা কিছু ইসলাম নয় এবং যে মুসলিম নয়, ইসলাম তাকে নাকচ করে; কিন্তু এই অবস্থাকেও ইসলাম তার প্রতি ইনসাফ করে। তবে অবশ্যই সেই ইনসাফ হবে ইসলামের সংজ্ঞায়িত অধিকার। পশ্চিমা লাগামহীন স্বাধীনতার অধিকার নয় যে, মানুষ যা ইচ্ছা তা-ই করবে। ইসলামে মানবাধিকারের প্রথম সবক হচ্ছে মানুষকে তার স্রষ্টার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অথচ পশ্চিমা মানবাধিকারের দাবি হচ্ছে মানুষকে এই অধিকার দেওয়া যে সে নিজেই তার স্রষ্টা। একজন মুসলিম কখনো এটা মেনে নিতে পারে না। আমি কি আল্লাহর দাসত্ব অস্বীকারকারী পশ্চিমা ‘হিউম্যান’ নাকি আল্লাহর দাসত্ব স্বীকারকারী ‘মুসলিম’? প্রশ্ন হলো এটা। এবার আপনার দায়িত্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
সুতরাং হিউম্যানিজমের ধারণা অনুযায়ী মানুষের প্রকৃত অবস্থান বান্দা নয়; বরং স্বাধীন (Autonomous) এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা (Self-determined)। সেক্যুলারিজম খুব জোরালোভাবেই দাবি করে যে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন করার জন্য আমাদের ‘ইনসানিয়্যাত’ তথা মানবতার ভিত্তিতে ভাবা শিখতে হবে; কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বর্ণ ও বংশের ভিত্তিতে নয়। অর্থাৎ সমাজব্যবস্থার ভিত্তি এমন কোনো বিষয় হতে হবে, যা আমাদের সবার মাঝেই আছে আর তা হলো ‘ইনসানিয়্যাত’। পশ্চিমাবিশ্ব এই ধারণাকে ‘হিউম্যান রাইটস’ নাম দিয়ে একটি পৃথক ধর্ম বানিয়ে নিয়েছে। আর গোটা পৃথিবীকে তারা নিজেদের বানানো এই মাপকাঠি দিয়েই বিচার করছে।
সেক্যুলাররা তাদের ‘হিউম্যানিজম’ ধারণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করার জন্য একটি কমন প্রশ্ন তোলে—‘আমাদের আসল পরিচয় মানুষ নাকি মুসলিম!’ তাদের নিকট এই প্রশ্নের ব্যাপক এবং প্রচলিত উত্তর হলো, আমাদের আসল পরিচয় ‘আমরা মানুষ’। আমাদের নিজেদের প্রথমে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখা লাগবে। মুসলিম হিসেবে চিন্তা করলে মাত্র কয়েক কোটি মানুষ নিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু মানুষের জায়গা থেকে চিন্তা করলে পুরো পৃথিবীর সকলেই এসে যাবে। মূলত এই ধারণার মাধ্যমেই সেক্যুলারিজম ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয়ে রূপান্তরিত করেছে।
কারণ হিউম্যানিজমকে মাপকাঠি হিসেবে মেনে নেওয়ার পর এটাই যৌক্তিক মনে হবে যে সামাজিক জীবনের ভিত্তি এমন কোনো বিষয় হওয়া উচিত, যা সবার জন্যই মূল এবং সবার মাঝেই আছে। যেন একটি সামগ্রিক জীবনাদর্শ অস্তিত্ব লাভ করতে পারে। যদি ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ কায়েম হওয়া সঠিক হয় তা হলে বংশ বর্ণ ইত্যাদি বিষয়ের ভিত্তিতে সমাজ কায়েম হওয়াকেও সঠিক মনে করতে হবে। মানুষের মূল অবস্থান ‘ইনসানিয়্যাত’ মেনে নিলে ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে যায়। এটা এর আবশ্যিক ফল। আর এটাই সমস্ত সেক্যুলার রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ভিত্তি (সেটা লিবারেলিজম হোক কিংবা সমাজতন্ত্র)।
সেক্যুলারিজম দ্বারা আমাদের উদ্দেশ্য হলো এমন জীবনব্যবস্থা, যা ওহির পরিবর্তে মানবীয় বিবেকের মাধ্যমে গঠিত হয়েছে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, কোনো কোনো ইসলামি বুদ্ধিজীবী যখন সেক্যুলারদের সাথে কথা বলে তখন তারা হিউম্যানিজমের ভিত্তিতে কথা বলে। ফলে দেখা যায়, হয়তো তারা আলোচনায় পরাজিত হয়; কিংবা অত্যন্ত দুর্বল এবং ঠুনকো দলিলের আশ্রয় নেয়। হিউম্যানিজমকে প্রত্যাখ্যান করা ব্যতীত ধর্মকে সামাজিক জীবনে শামিল করার পলিসি বানানো অসম্ভব। আমাদের আলোচিত প্রশ্ন ‘আমরা মানুষ নাকি মুসলমান’-এর সুস্পষ্ট এবং অকাট্য উত্তর হবে ‘আমি মুসলমান (আল্লাহর সৃষ্টি ও তার কাছে আত্মসমর্পণকারী অর্থে)’।
তা হলে আমি কি মানুষ নই? হ্যাঁ, আমি মানুষও। তবে আমি পশ্চিমা সংজ্ঞায়িত অর্থে মানুষ নই যে, আমি আমারই দাস। মানুষ হওয়া তো একটি সৃষ্টিগত ঘটনা এবং আমার মুসলমানিত্ব প্রকাশের মাধ্যম। আমাদের মূল পরিচয় হলো আমরা গোলাম তথা আল্লাহর সৃষ্টি। মানুষ হওয়ার পূর্বের কথা হলো আমরা মাখলুক (সৃষ্টি)। আমাদের একজন স্রষ্টা আছেন। এখন মানুষ হওয়ার ব্যাপারটি একটি ঘটে যাওয়া বিষয়ের মতো।
বিষয়টি ভালো করে বুঝার জন্য এভাবে চিন্তা করা যেতে পারে যে যদি আমরা মানুষ না হতাম তা হলে কী হতাম? এর দুটি সুরত রয়েছে। হয়তো ফেরেশতা হতাম নয়তো কোনো প্রাণী, উদ্ভিদ, জড়পদার্থ হতাম; কিন্তু আমরা যা-ই হই না কেন- সর্বাবস্থায় আমাদের মৌলিকত্ব হলো আমরা মাখলুক। অর্থাৎ অস্তিত্বের সম্ভাব্য প্রতিটি অবস্থাতেই আমাদের মৌলিক অবস্থান একজন আবদ, বান্দা বা গোলামের। এখন আমার গোলামির বহিঃপ্রকাশ বিভিন্নভাবে হতে পারে।
উদাহরণত, আমি যদি পোকা হই, তা হলে আমার ‘আবদিয়্যাত’-এর প্রকাশ পোকার সুরতেই হবে। আবার আমি যদি ফেরেশতা হই তা হলে ফেরেশতার সুরতেই আমার আবদিয়্যাতের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। এবার আমি যদি মানুষ হই তবে এটা আমার আবদিয়্যাত প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। মোটকথা, আমার সুরত তো পরিবর্তন হতে পারে; কিন্তু আমি যদি সৃষ্টি হই তবে আমার অবস্থান সর্বদা মাখলুক, আবদ এবং বান্দাই থাকবে। কোনোক্রমেই এই অবস্থা পরিবর্তনযোগ্য নয়। আমার সকল অবস্থা এই অর্থে নির্ধারিত যে আমার অস্তিত্বের কিছুই আমি নিজে সৃষ্টি করতে পারি না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেভাবে চেয়েছেন, আমার কোনো ইচ্ছা ছাড়াই, ঠিক সেভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করার ব্যাপারে বাধ্য ছিলেন না।
সুতরাং প্রমাণিত হলো, আমার সত্তাগত অবস্থান মুসলিম (আবদিয়্যাত)। ইনসানিয়্যাত আমার আবদিয়্যাত প্রকাশের মাধ্যম মাত্র। আবদিয়্যাত ছাড়া আমার ইনসানিয়্যাতের কোনো মূল্য নেই। মুসলমানিত্বকে আবদিয়্যাত দ্বারা ব্যাখ্যা করার কারণ হলো আক্ষরিক অর্থে প্রত্যেক বান্দা মুসলমানই হয়; সে স্বীকার করুক বা না করুক। প্রতিটি মানুষই গোলাম। এখন সে যদি অন্তর ও জবান দ্বারা এর স্বীকৃতি দেয়, তা হলে সে মুমিন ও মুসলিম (স্বীয় অবস্থান স্বীকারকারী)। আর যদি এটা মেনে নিতে অস্বীকার করে, তা হলে সে কাফের (স্বীয় অবস্থান অস্বীকারকারী)। অন্যভাবে বললে, কাফের কোনো নতুন কিংবা ভিন্ন অবস্থান নয়; বরং মূল অবস্থান অস্বীকারকারী মাত্র।
যখন প্রমাণিত হলো আমাদের মৌলিক অবস্থান বান্দা হওয়া আর ইনসানিয়্যাত আমাদের আবদিয়্যাত প্রকাশ করার মাধ্যম মাত্র, তখন এটা বুঝা খুব সহজ হয়ে গেল যে আমাদের ইনসানিয়্যাতের সেই বহিঃপ্রকাশই সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হবে, যাতে আবদিয়্যাত রয়েছে। সেখানে নিজের প্রবৃত্তি ও নফসপূজা থাকলে গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ আল্লাহর কাছে আমাদের আবদিয়্যাত প্রকাশ করার একমাত্র পন্থা হলো ইসলাম। এজন্য আমাদের ইনসানিয়্যাত তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র ইসলাম অনুযায়ী হবে। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَمَنْ یَّبْتَغِ غَیْرَ الْاِسْلَامِ دِیْنًا فَلَنْ یُّقْبَلَ مِنْهُ
যে ইসলাম ছাড়া অন্য জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করবে, তা গ্রহণযোগ্য হবে না।[১]
অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন,
اِنَّ الدِّیْنَ عِنْدَ اللهِ الْاِسْلَامُ
আল্লাহর কাছে (আবদিয়্যাত প্রকাশের) একমাত্র দীন হলো ইসলাম।[২]
কেউ কেউ বলতে পারেন মানুষ হওয়ার নিশ্চয় আলাদা কোনো মর্যাদা রয়েছে। কারণ, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই কথার জবাব উপরের আলোচনাতেই রয়েছে। ইনসানিয়্যাত মূলত আবদিয়্যাত প্রকাশের উত্তম সুরত। আবদিয়্যাতের জন্যই ইনসানকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত বলেছেন। কারণ আবদিয়্যাতের সবচেয়ে কঠিন এবং ব্যাপক বিষয় ইনসানের সাথে সংশ্লিষ্ট। পুরো শরিয়ত তাদের সাথেই ব্যাপকভাবে সম্পর্ক স্থাপন করে রেখেছে, যা অন্য কোনো মাখলুকের সাথে সম্ভব নয়। এখন যেই আবদিয়্যাতের খাতিরে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত হলো, তা-ই যদি না থাকে তা হলে কী করে মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত হবে! এজন্য আল্লাহ তাদেরকে পশুর সাথে তুলনা করেছেন; বরং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলেছেন।[৩]
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আরেকটি ভুল ধারণা দূর হওয়া উচিত। তা হলো, ধর্মশিক্ষা দেওয়ার আগে বাচ্চাদের মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়ার ধারণা। অর্থাৎ প্রথমে তাকে শেখানো হবে মানুষ কী? এরপর ধর্মের কথা। বাস্তবে এটাই হিউম্যানিজম তথা মানববাদকে সঠিক প্রমাণের একটি চিত্র। কারণ ধর্মের বাইরে নিজের অস্তিত্ব জানার অর্থই হলো মানুষ তার অস্তিত্বের ক্ষমতা এবং পরিচিতি নিজের মাঝেই সংরক্ষণ করে। এটার অথরিটি তার আছে এবং সেটা নবীদের শিক্ষা ব্যতীতই সম্ভব। অর্থাৎ আল্লাহকে বাদ দিয়ে ‘মানুষ’-ই স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অবস্থান, being without God. প্রশ্ন হলো, নিজেকে ধর্মের বাইরে শুধু মানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়ার কী উদ্দেশ্য? আমি নিজের ইনসানিয়্যাতকে কী ভাবি( আবদিয়্যাত প্রকাশের মাধ্যম, নাকি মৌলিক সত্তা? যদি ইনসানিয়্যাতকে মৌলিক অবস্থান ও সত্তা মেনে নেওয়া হয়, তবে এটাই মানববাদ। আর যদি আবদিয়্যাত প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তা হলে ধর্মের বাইরে নিজেকে পরিচিত করানো কেবল হাস্যকরই নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষ কুফরও।[৪] [৫]
১) সূরা আলে ইমরান- ৮৫
২) সূরা আলে ইমরান- ১৯
৩) সূরা আ'রাফ-১৭৯
৪) ইসলামী ব্যাংকারী আওর জমহুরিয়্যাত, ১৭২- ১৭৫ পৃষ্ঠা
৫) হিউম্যান বিয়িং, ৯৬-১০১ পৃষ্ঠা

পঠিত : ৩০২ বার

মন্তব্য: ০