Alapon

বোহেমিয়ান কবির প্রতি রইল অফুরন্ত ভালোবাসা

মধ্যরাত! সংসদ ভবন এলাকা দিয়ে রাস্তায় হাটছি। বহুদিন হয়ে গেল মধ্যরাতে বের হই না। কিন্তু এই দিন কী যে হল, ঘরে আর বসে থাকতে পারলাম না। খুব সম্ভবত সেই দিন চন্দ্রগ্রহণ ছিল। চন্দ্রগ্রহণের পরে আবার সুপারমুন।


আকাশে এক থালা সমান চাঁদের নিচে হাটছিলাম, তখন কেন জানি হঠাৎ করেই কবি আল মাহমুদের লেখা ‘কবির মুখ’ বইটার কথা মনে পড়ে গেল।


এমনই এক থালা সমান এক চাঁদের রাতে কবি নুর আলী ফকিরের সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। নুর আলী ফকির তাঁকে বৃক্ষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, পরিচয় করিয়েছেন মাটির সঙ্গে। নুর আলী ফকিরের বোহেমিয়ান জীবন কবিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ‍নুর আলী একজন বৃক্ষপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। উল্লেখ্য, নুর আলী ফকির কবির ধর্ম ভাই ছিলেন। এরপর গুটি বসন্ত হয়ে নুর আলী ফকির মারা গেলে তা কবির মনে ভীষণ দাগ কাটে।


বিখ্যাত এবং সফল মানুষদের শৈশব যেভাবে লিপিবদ্ধ হয় কবি আল মাহমুদের জীবন তেমনটি ছিল না। তাঁর জীবনী লিখতে গিয়ে কেউ কখনোই বলতে পারবে না, তিনি ছোটবেলা থেকেই তুখোড় ছাত্র ছিলেন। বরঞ্জ তিনি সবসময় একাডেমিক শিক্ষা থেকে মনোযোগটাকে যতোদূর সম্ভব মহাকাশে তুলে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। আর গোটা পৃথিবীটাকেই তিনি পাঠশালায় রূপান্তর করবার এক অসাদ্ধ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ক্লাসে ১ম স্থান অধিকারী তথাকথিত ভালো ছাত্রদের সম্পর্কে কবি বলেছেন-


‘ক্লাসের সবচেয়ে নীরস গোমরামুখ ছেলেটি ছিল সবচেয়ে ভালো ছাত্র। সে হাসত না। দিনরাত তার একমাত্র কাজ ছিল উবু হয়ে অঙ্ক নিয়ে পড়ে থাকা। কিম্বা পড়া মুখস্ত করা। তাকে সবাই ভালবাসত। শিক্ষকগণ সকলেই ছিলেন তার প্রতিই যত্নবান। তাকে সবাই ঠেলত বেশি নম্বরের দিকে। পড়তে পড়তে তার চোখ দুটি ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। বড় হয়ে সে নিশ্চয়ই মানুষ হয়েছিল। আমরা কেউ জানি না সে কতবড় মানুষ হতে পেরেছিল। শুধু এটুকু আন্দাজ করি অনেক মানুষের ভিড়ে সে হারিয়ে গিয়েছে।’- (কবির মুখ-পৃ: ৫৩)


গোমরামুখো সেই ভালো ছাত্ররা মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেলেও কবি আল মাহমুদ আজ এবং আগামীকাল কিংবা বাংলাদেশের স্থায়ীত্বের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িতে থাকবেন।


বইতে কবির সংসার জীবনের কথা পাবেন। কবি তখন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’র প্রুফ রিডারের চাকরী করেন। একদিন তাঁর মা চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন, তাঁর বিবাহ ঠিক করা হয়েছে। কবি প্রস্তুতি নিয়ে বিবাহের উদ্দেশ্যে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। সেই যাওয়া তারপর কবি ফিরে আসেন তিনমাস পর।


এই তিনমাস যে তিনি নববধূর প্রেমে ডুবে ছিলেন তার বিশোদ বর্ণনা কবি তাঁর বই এ উল্লেখ করেছেন। কবি তাঁর যৌন জীবনের কথাও বেশ খোলাখুলি ভাবে লিখেছেন।


কবি তখন শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরী করেন। একদিন কবির টেবিলে হলুদ খামে ভরা একখানি চিঠি এলো। কবির এক প্রমিলা ভক্তের হৃদয়ের অনুভূতি মিশ্রিত চিঠি। সেই চিঠিতে মিশ্রিত ছিল কবিকে ভীষণভাবে কাছে পাবার আকুঁতি। চিঠির শেষে সেই প্রমিলার বাসার ঠিকানাও ছিল। কবি সেই চিঠিখানা ভাজ করে বাড়ি চলে গেলেন। তারপর তার স্ত্রীর হাতে চিঠিখানি দিলেন এবং কবির স্ত্রী একটানে চিঠিখানা পড়া শেষ করলেন। চিঠিখানা পড়া শেষ হলে কবির স্ত্রী শুধুমাত্র একটা শব্দই উচ্চারণ করলেন, ‘বদ মাগী’।


কবি যৌবনের শুরু থেকেই বোহেমিয়ান জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। তিনি কোথাও স্থির হয়ে দির্ঘদিন অবস্থান করেছেন, এমন নজির খুব কমই দেখা গেছে। কবির এক চাচী ছিলেন যার কোন ছেলে ছিল না। একটাই মেয়ে। মেয়েটার বিবাহ হবার পর ভীষণ একলা হয়ে যান। তখন কবির মায়ের কাছে অনুরোধ করে কবিকে নিজের কাছে নিয়ে যান এবং ছেলের জন্য আকাঙ্খা ও হাহাকার নিশ্রিত সমস্ত ভালোবাসা কবির পিছনে ঢেলে দেন। কিন্তু একদিন কবি সেখান থেকেও চলে আসেন। কবির চাচী কবিকে বলেছিলেন, ‘শিকড়হীন মানুষ’।


এই শিকড়হীন মানুষটাকে কবির স্ত্রী প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন। কবির ছেলে মেয়ে হবার পর একদিন কবি বললেন, ‘আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি। কবির স্ত্রী অনেকটা এভাবে বললেন, ‘ঠিক আছে যাও। তোমাকে আমি আটকাবো না। তোমায় আমি কোন দায়িত্বের ভারেও ধরে রাখবার চেষ্টা করব না। তোমায় আমি তোমার মত করে বেঁচে থাকবার সমস্ত স্বাধীনতাটুকু দিয়ে দিলাম।’


কবি বলেন, ‘এরপর থেকে আমি আর কোত্থাও যেতে পারিনি। মানুষ সম্ভবত বাধাপ্রাপ্ত হতে চায়। বাধাপ্রাপ্ত হলে সে যেনতেন উপায়ে হলেও সেই কাজটি করতে চায় এবং কাজটার প্রতি ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠে। বিবাহের পর আমার বোহেমিয়ান জীবনে কখনো বাধাপ্রাপ্ত হই নি। তাই কখনো হুট করে উধাও হই নি। এমনকি বিবাহের পর এই বোহেমিয়ানপনা কেন জানি না আমার ভিতর থেকেই হারিয়ে গেল। সম্ভবত, কেউ বাধা দেয় নি বলেই আর হারাতে পারিনি।’


যাদের বোহেমিয়ান জীবনের প্রতি টান আছে সেইসাথে আছে বইয়ের প্রতি আকর্ষণ। তাদের জন্য এই বইটি সিলেবাস হিসেবে বিবেচ্য হবে বলে আমার ধারণা। সবশেষে বলব, কবির জীবনের এই স্বীকারোক্তি কবিকে আরো অনেক বেশি উজ্জল করে রাখবে। কবি আল মাহমুদের প্রতি রইল বোহেমিয়ান ভালোবাসা। ❤️

পঠিত : ৭৭৫ বার

মন্তব্য: ০