Alapon

Islamophobia and Orientalism



বেসিক আলোচনা

> ভূমিকা
> ওরিয়েন্টালিস্ম ও তার উদ্দেশ্য
> ইসলাম-বিদ্বেষ এবং ওরিয়েন্টালিস্ম
> ওরিয়েন্টালিস্মের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব
> উপসংহার

ভূমিকা

একবিংশ শতাব্দীতে যদি আমাদের জিজ্ঞেস করা হয় পৃথিবীতে কোন ধর্মের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিদ্বেষ, প্রচার-প্রপাগান্ডা চলে? উত্তরটা কী হবে তা এক ছোট বাচ্চারও জানার কথা। উত্তরটা হবে ‘ইসলাম’এর বিরুদ্ধে !
ইন্টারনেটের যুগে ইসলাম-বিদ্বেষ তথা ইসলামোফোবিয়া এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। বাংলাতেই অসংখ্য ইসলাম-বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদী ব্লগ ও ওয়েবসাইট রয়েছে। সেখানে ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য,ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা, ইসলামের নৈতিকতা, বিজ্ঞান, ইসলামে নারী অধিকার, কোরান-হাদীস, ইসলামী আইন, মুহম্মদ সা. এর জীবনী রিলেটেড অনেক সংশয়-সন্দেহ তুলে একটার পর একটা আর্টিকেল ভর্তি করা হয়েছে।লেখাগুলো অসংখ্য মুসলিম প্রতিনিয়ত পড়ছে এবং তাদের ইমান-আমল সব সংশয়, নাস্তিকতাবাদের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেই আর্টিকেলগুলো বাস্তবিক পক্ষেই প্রচণ্ড ঘৃণা, হিংসা, মিথ্যাচার, বিদ্বেষে ভরপুর যৌক্তিকতার চেয়ে। আমাদের ভাইয়েরা প্রতিনিয়ত ইসলাম-বিদ্বেষী দাবীসমূহের জবাব দিয়ে যাচ্ছেন অনলাইনে আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তারপরও কিছু ফাঁক থেকে যায়। কোন কিছুর মূল চিহ্নিত না করে শাখা-প্রশাখাগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করলে, শাখা-প্রশাখাগত সমস্যাগুলো সাময়িক সমাধান হলেও সামগ্রিকভাবে এটা কার্যকরি হবে না। বরং তা আরও নতুন সমস্যা সৃষ্টি করবে মূল থেকে।তাই মূলে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। নাস্তিকদের ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ভিত্তি কোথা থেকে আসে আর কিভাবে আসে তা চিন্তা করতে হবে। ভিত্তিতে আঘাত হানতে পারলে পুরো বিল্ডিং ধ্বসে পরে। আমাদের বোঝা উচিত দেশীয় নাস্তিক্যবাদী এসব ব্লগ সহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যে ইসলাম-বিদ্বেষ রয়েছে তা আসে মোস্টলি আধুনিকতাবাদী পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুসরণ থেকে।যেখানে মানবিক প্রবৃৃত্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয় সেখানে এক স্রষ্টার কাছে সার্বিকভাবে আত্মসমর্পণ করার নীতি ইসলাম আবশ্যিকভাবেই ঘৃণিত হবে এবং সমাজ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হবে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি যা। পশ্চিমা সভ্যতা ও ইসলাম নিয়ে আলোচনা বিশেষ দাবী রাখে এমতাবস্থায়।

পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ইসলাম নিয়ে যদি আলোচনা করি তাহলে এটা জেনে রাখা উচিত পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে মুসলিম বিশ্বের হাজার বছরের ঐতিহাসিক সংঘাত রয়েছে [1] ক্রুসেড থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদ, মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপের মাঝে বহুবিধ মোকাবেলা ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা অঙ্কন করে পশ্চিমে। [2] তা আজ আরও বর্ধিত অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিরোধে। [3] ইসলাম-বিদ্বেষ পশ্চিমে মিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে । ২০১৬ সালে CAIR এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের Berkeley Center for race & gender একসাথে গবেষণার ফল প্রকাশ করে “Confronting Fear: Islamophobia and its Impact in the United States” প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনে জানা যায় ২০০৮-২০১৩ সালের মাঝে ইসলামোফোবিয়া ছড়াতে নিয়োজিত দলগুলো অনুদান পেয়েছে কমপক্ষে ২০৫ মিলিয়ন ডলারের অর্থ! [4] বিশাল নেটওয়ার্ক এভাবে অর্থায়নের ফলে গড়ে উঠেছে ইসলাম বিদ্বেষ প্রচারের জন্য প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার দেশ আমেরিকায়। মিডিয়ার ইসলামকে সহিংস প্রমাণের অতরঞ্জিত অপপ্রচারও রয়েছে। [5][6] এসমস্ত বিষয়গুলো পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম-বিদ্বেষের মূর্তি দিনের আলোর মত স্পষ্ট করে দেয়।

একবিংশ শতাব্দীতে ইসলামকে নিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার এরকম অসহনশীল ও বিদ্বেষমূলক যে মনোভাব দেখতে পাই তার শিকড় তালাশ করলে বের হয়ে আসে ক্রুসেড পরবর্তী পাশ্চাত্য সভ্যতারই গর্ভধারণ করা এক মতবাদ ‘ওরিয়েন্টালিস্ম’। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে শুরু করে সারা বিশ্বে ইসলাম-বিদ্বেষের ন্যারেটিভ একাডেমিকভাবে ওরিয়েন্টালিস্মের প্রদত্ত।[7] দেশী-বিদেশী মুসলিম দাঈ ভাইদের এ বিষয়টির উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন।ওরিয়েন্টালিস্ম থেকেই ইসলাম-বিদ্বেষের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়েছে সবখানে। শাখা-প্রশাখাগুলোরই অংশ পশ্চিমের ইসলাম-বিদ্বেষ কিংবা দেশীয় নাস্তিক্যবাদী ব্লগসমূহ ও প্রাচ্যে ইসলামের প্রতি তিক্ততা! আমার লেখাটির উদ্দেশ্য পাশ্চাত্য ওরিয়েন্টালিস্মের স্বরূপ,এর থেকে বের হয়ে আসা মুসলিম-বিদ্বেষ,
ইসলাম-বিদ্বেষ স্পষ্ট করা ও ওরিয়েন্টালিস্মের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা। ওরিয়েন্টালিস্মকে সঠিকভাবে রিয়েলাইজ করতে পারলে ইসলাম সম্পর্কিত তথাকথিত সমস্যাগুলোর ভিত্তিতেই ধ্বস নামবে ইনশাআল্লাহ। নাস্তিক-স্যেকুলারদের ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সামনে ওরিয়েন্টালিস্ম নিয়ে বিশ্লেষণ যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করবে।

ওরিয়েন্টালিস্ম ও তার উদ্দেশ্য

‘ওরিয়েন্টালিস্ম’ আঠারো ও উনিশ শতকে শুরু হওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান চর্চা পশ্চিমা স্কলারদের প্রাচ্য সম্পর্কিত। যার মাঝে রয়েছে প্রাচ্যের ভাষা,সাহিত্য, ধর্ম,দর্শন,ইতিহাস,কলা, আইন ইত্যাদি।[8] যেসব স্কলার ওরিয়েন্ট তথা প্রাচ্য রিলেটেড এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন তাদের ওরিয়েন্টালিস্ট বলা হয়। আলোচিত ওরিয়েন্টালিস্ট Edward W. Said ওরিয়েন্টালিস্টদের পরিচয় দিয়েছে এভাবে– ‘যিনি সামগ্রিকভাবে প্রাচ্য সম্পর্কে অথবা এর বিশেষায়িত কোনো অংশ সম্পর্কে শিক্ষা দেন, লেখালেখি করেন বা গবেষণা করেন তিনি –নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী যেই হোন না কেন, তিনি ওরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যতাত্ত্বিক। এবং তিনি যা করছেন তা-ই ওরিয়েন্টালিস্ম বা প্রাচ্যতত্ত্ব।’[9]
পাশ্চত্য সভ্যতার স্কলাররা ওরিয়েন্টালিস্মের মাধ্যমে প্রাচ্যের জ্ঞানের কর্তৃত্ব অধিকার করেন।

আসল কথা ওরিয়েন্টালিস্মের সাথে যতটা না নিখাঁদ জ্ঞান চর্চার সম্পর্ক ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল পশ্চিমা রাজনৈতিক এবং ঔপনিবেশের সম্পর্ক।[10] প্রাচ্যের মানুষের চিন্তা-দর্শন নিয়ন্ত্রণের দ্বার হয় ওরিয়েন্টালিস্ম পাশ্চাত্য কর্তৃক।চিন্তা ও চর্চার এক পশ্চিমা ইউরোপীয় কাঠামো হিসেবে এটি গড়ে ওঠে।[11] বিশেষ করে পশ্চিম দ্বারা প্রাচ্যের শত বছরের উপনিবেশের অন্যতম হাতিয়ার ওরিয়েন্টালিস্ম। [12] পাশ্চাত্যের উপনিবেশ সমাজগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য জ্ঞানচর্চা উদ্দেশ্য ছিল এটির।[13] ঔপনিবেশিবাদী পশ্চিমের প্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের স্বার্থে এ মতবাদ বিস্তৃতি পায়।[14] ওরিয়েন্টালিস্ম উনিশ শতকে এবং তার পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বারা প্রাচ্যের নির্মাণকে বোঝায়। [15]ওরিয়েন্টালিস্ম মতবাদটি সামগ্রিকভাবে প্রাচ্যের উপর পশ্চিমা আধিপত্যবাদ কায়েম করতে চায়।

এর মাধ্যমে পশ্চিমকে রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক উচ্চতর প্রমাণের চেষ্টায় অন্যসব সভ্যতাকে নিম্নতর প্রমাণের চেষ্টা করা হয়।[16] প্রাচ্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান,অর্জনকে ইছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে যাওয়া হতো।[17] যা পুরো ইউরোসেন্ট্রিক অন্যায়,যুক্তিবিরুদ্ধ বায়াসনেস। মানবসভ্যতার ক্ষেত্রে কেবল পশ্চিমারাই শ্রেষ্ঠ,অগ্রগামী ছিল এটা ঐতিহাসিকভাবে স্পষ্ট ভুল।(মানব সভ্যতায় পশ্চিমের বাহিরের অন্যান্য জাতিরও অবদান কোন অংশে কম নয়)পাশ্চাত্য চিন্তা তথা ওরিয়েন্টালিস্ম পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ-ঔপনিবেশিকবাদের কারণে এই স্পষ্ট ভুল মতটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।[18] প্রাচ্যের দেশসমূহ অসভ্য, সেকেলে, অনুন্নত পিছিয়ে আছে।উন্নতর আধুনিক সুপেরিয়র পশ্চিমের উচিত তাদের সাহায্য করা।[19] এরকমভাবে কলোনিয়ালিস্মের তথা ঔপনিবেশবাদের শোষণ ও নির্যাতনের বৈধতা তৈরী হয়েছে ওরিয়েন্টালিস্মের বদৌলতে।[20]
তাহলে এটা আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হওয়া উচিত ওরিয়েন্টালিস্ম পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন প্রাচ্যে তথা এশিয়ার দেশসমূহের সভ্যতাগুলোর প্রতি পশ্চিমের প্রভাব প্রতিপত্তি গড়ে তুলবে প্রাচ্যে। পশ্চিমকে শ্রেষ্ঠতর মাপকাঠিতে উন্নীত করবে,বাকিসব কিছুকে খারাপ, সেকেলে, ত্রুটিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করবে। [21] এটি সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা ইউরোপীয় মনোভাবের মোড়কে কাজ করে।[22]

মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কেও যখন পাশ্চাত্য ওরিয়েন্টালিজম পড়াশোনা শুরু করে তখন তার চিরচেনা রূপেরই প্রকাশ পায়। [23] ধর্মীয়,রাজনৈতিক,মনস্তাত্ত্বিক কারণের পাশাপাশি ইসলামকে কেবল পশ্চিমের প্রতিদ্বন্দীই নয়,পশ্চিমের চ্যালেঞ্জ হিসেবেও বিবেচনা করে ওরিয়েন্টালিস্ম।[24] ক্ষেত্রবিশেষে প্রাচ্যের অন্য সভ্যতাগুলোর চেয়ে আরও ভয়ঙ্করভাবে। আজ পৃথিবীতে এত ভয়াল ও প্রচণ্ড ইসলাম-বিদ্বেষ এত সহজে ছড়ায়নি। ওরিয়েন্টালিস্মের ব্যাপক ভূমিকা আছে এখানে। সামনের আলোচনায় তা আসছে। আগানোর তাগিদে ওরিয়েন্টালিস্ম নিয়ে কথা বলে নিলাম।

ইসলাম-বিদ্বেষ এবং ওরিয়েন্টালিস্ম

মুসলিমদের সাথে শতব্দীব্যাপী চললাম ক্রুসেড যুদ্ধে পরাজয়ের পর পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষিত খ্রিশ্চানরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় ইসলামকে সামরিক শক্তির বলে ধ্বংস করা কখনো সম্ভব নয়।[25] এরপর চার্চ কর্তৃক ইসলামকে স্টাডি করে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরী করা হয় ।[26]যা আঠারো-উনিশ শতকে মুসলিম বিশ্বে পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের সময়ে দারুণভাবে হালে পানি পায় ওরিয়েন্টালিজস্মের দরুন। ইসলামের সাথে সম্পর্ক্তি প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ে ওরিয়েন্টালিস্টরা কাজ শুরু করে।তাদের বাঁধাধরা মাপকাঠিতেই তারা ইসলামকে মূল্যায়ন করতে থাকে।যার ফলে ইসলামের প্রতি বিরহ মনোভাব তৈরী করার প্র‍য়াস তারা যুগিয়েছিল।ইসলামের প্রতিটি ক্ষেত্র ওরিয়েন্টালিস্টদের আক্রমণের স্বীকার হয়।তার মধ্যে সিগনিফিকেন্ট হলো :

১.ইসলামের ইতিহাস ও মুসলিমদের বিকৃত
উপস্থাপন।

২.মহানবী সা. এর উপর নগ্ন আক্রমণ।

৩.ইসলামের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, আলিমদের সম্পর্কে ভুল ধারণা দেওয়ার মাধ্যমে ইসলামকে আন্ডারমাইন করা।

৪.মুসলিম নারীদের সম্পর্কিত অবাস্তব ফ্যান্টাসী।

ওরিয়েন্টালিস্ম এবং ইসলামোফোবিয়া একটা আরেকটার পরিপূরক বললেও ভুল হবে না।ইতিহাস থেকে আমরা তাই বুঝতে পারি।ইসলামকে সবধরনের হেও প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে গেছে ওরিয়েন্টালিস্ম! আজ সারা বিশ্বে মুসলিমদের যে বর্বর,জঙ্গী,সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত করানো হয় এর পেছনে ওরিয়েন্টালিস্মের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।[27]
আঠারো-উনিশ শতকের পশ্চিমা স্কলার, ট্র‍্যাভেলার John Lewis Bouchart মুসলিম বিশ্বে ছদ্মনামে ভ্রমণ করেন এবং মিশরে মৃত্যুবরণ করেন।তিনি তার বইয়ে আরবদের তথা মুসলিমদের খুব বাজেভাবে চোর,ডাকাত হিসেবে তুলে ধরেন।[28] আরেকজন ওরিয়েন্টালিস্ট স্কলার Charles Doughty ইসলামকে আরবদের আতঙ্কজনক রূপ হিসেবে উল্লখ করেন তার লেখায়।[29] ফ্রান্সের ওরিয়েন্টালিস্ট Bernard Carra de Vaux ইসলামকে পাশ্চাত্য খ্রিশ্চিয়ান শক্তিগুলোর জন্য ভয়ানক হুমকি হিসেবে বিবৃতি দেন।[30]

ইসলাম অস্ত্রের জোরে ছড়িয়েছে এমন ধারণা গ্রহণ করেন কুখ্যাত ও প্রভাবশালী ওরিয়েন্টালিস্ট Sir William Muir।[31]
Edward W. Said ওরিয়েন্টালিস্টদের আরব(ইসলাম ও মুসলিম উদ্দেশ্য) সম্পর্কিত ধারণা এভাবে ব্যক্ত করেন যে, “আরবদের ধরে নেওয়া হয়েছিল উটের পিঠে সওয়াররূপে– সন্ত্রাসী মনোভাবাপন্ন,লম্বা নাক,ধর্মত্যাগী,যাদের অবাঞ্চিত সম্পদ সভ্যতার মুখে মুখে এক বিরাট বাধার মত।” [32]
পশ্চিমা বুদ্ধিজীবি Barthélemy d' Herbelot তার বিখ্যাত বিবলিউথিক ওরিয়েন্টালিজস্মের ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করয়েছ। এক ভাগ পবিত্র ও অপর ভাগ অপবিত্র।অপবিত্রের মূল হিসেবে রেখেছেন ইসলামকে। [33]এবং তার গ্রন্থ ইউরোপে আদর্শ রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।[34]
আমেরিকার একাডেমিয়ায় ওরিয়েন্টালিস্ম, পাশ্চাত্য স্কলাররা ইসলামের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষমূলক ও হিংসাত্মক ছিলেন।[35]
শুধু ক্লাসিক্যাল অরিয়েন্টালিস্টরাই নয়,খোদ Edward W. Said, যিনি কিনা ওরিয়েন্টালিস্টদের বায়াসনেসের বিপক্ষে কলম ধরেছেন, তিনি পর্যন্ত ওরিয়েন্টালিস্মের ইসলাম-বিদ্বেষ থেকে বের হতে পারেননি। তিনি বলেন, “মুসলিমরা পুরাতন একটা ধর্মের অনুসরণ করে আর তার মাঝে শান্তি খুঁজে।”[36] আরও বলেন, “এমন নয় যে ইসলাম এমন কিছু করেনি,যা ত্রাস,ধ্বংস দৈত্যসুলভ ঘৃণ্য,অসভ্য বর্বর জাতির সাথে সাদৃশ্যময়”। [37]
Edward W. Said এর ইসলাম-বিদ্বেষ মুসলিম স্কলার মুহম্মদ আসাদ রহ. এর বক্তব্য থেকে পুরোপুরি পরিষ্কার হয়।তিনি বলেন, “প্রাচ্যবিদদের(তথা ওরিয়েন্টালিস্ট) ইসলাম বিদ্বেষ মূলত একটি মৌরসী স্বভাব এবং প্রকৃতিগত অভ্যাস”।[38] Said এর ওরিয়েন্টালিস্ট বৈশিষ্ট্যই তাঁর ইসলাম-বিদ্বেষের নিয়ামক।

ওরিয়েন্টালিস্টদের কড়াল গ্রাস থেকে রক্ষা যায়নি প্রিয়নবী সা. এর সিরাহ পর্যন্ত।মহানবী সা. কে ভুয়া(নাউযুবিল্লাহ) নবী প্রমাণের চেষ্টা করে ওরিয়েন্টালিস্টরা।[39] প্রিয়নবীকে নিয়ে পশ্চিমা শার্লি এব্দো পত্রিকার ব্যাঙ্গচিত্র আর ওরিয়েন্টালিস্ম একি মিলনে আবদ্ধ।ওরিয়েন্টালিস্ট স্কলার Montgomery Watt স্বীকার করেন ,“পশ্চিমা দেশগুলিতে ইতিহাসের পাতায় হযরত মুহম্মদ সা.কে যত ঘৃণিত ও হেয় প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে, বিশ্ব ইতিহাসে অন্য কোন মহামানবের ক্ষেত্রে এমন করা হয়নি।” [40]

নবিজি সা. এর জীবন সম্পর্কিত পশ্চিমাদের মিথ্যাচার নিয়ে হিস্ট্রিয়ান,স্কলার Thomas Carlyle বলেন, “মুহাম্মাদ সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণা হল তিনি ছিলেন একজন ছদ্মবেশী প্রবঞ্চক, অসত্যের মূর্ত প্রতীক, যার ধর্ম হল কেবলই অজ্ঞতা ও হীনবুদ্ধিতার সমষ্টি – এ ধারণা এখন যে কারও কাছেই অগ্রহণীয়। (পশ্চিমাদের) মিথ্যার ফুলঝুরি যা প্রবল উৎসাহে এই মানুষটির চতুর্দিকে পুঞ্জিভূত করা হয়েছে,তা কেবল আমাদের জন্যই লজ্জাকর।” [41]
পাশ্চাত্যবাদী ওরিয়েন্টালিস্টরা ইসলামের জ্ঞানের ট্র‍্যাডিশন নিয়েও অনেক মিথ্যাচার, বিকৃত ধারণা রটনা করে। মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান ও ধর্মের এক বিরোধের ন্যারেটিভ দেখানোর চেষ্টা করে [42] ইসলামকে পশ্চাৎপদ প্রমাণ করার জন্য।সেই ধারায় মুসলিম আলিমদের সম্পর্কে অনেক বাস্তবতা বিবর্জিত কথা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেমন, ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী আলিম গাযালি রহ. কে মুসলিম বিশ্বের স্বর্ণযুগের পতনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা।[43] ওরিয়েন্টালিস্টদের এই পক্ষপাতদুষ্ট ন্যারেটিভ থেকে নাস্তিক ইসলাম-বিদ্বেষী ইবনে ওরাক ও আয়ান হিরসি আলি একই ভাবে দোষ দিয়েছেন গাযালি (রহ.)কে অযৌক্তিক, বিজ্ঞান-বিরোধী হিসেবে।[44] এমনিভাবে ইসলামের আলিমদের বিরুদ্ধে ইসলাম-বিদ্বেষী মনোভাব প্রসার করেছেন ওরিয়েন্টালিস্টরা......!

এবার নারী বিষয়ে আসা যাক। ইসলামের নারীদের নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের এমনিতেও চিন্তার কোন শেষ নেই। মুসলিম নারীরা ইসলামী বিশ্বে রক্ষণশীলতার যাঁতাকলে পিষ্ঠ।ইসলাম নারীদের কোন অধিকার দেয় না।ইসলাম নারীদের দাসীর মত দেখে, এসব নারী সম্পর্কিত অভিযোগগুলো পশ্চিমের খুব কমন ইসলামের বিরুদ্ধে। [45] এসবের বেসিসও আসে ওরিয়েন্টালিস্ম থেকে। পাশ্চাত্য স্কলারদের কর্তৃক ইসলামী সমাজে মুসলিম নারীদের অত্যাচারিতা নির্যাতিতা হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। এটি ইউরোপের মুসলিম বিশ্বে কলোনিয়াল শাসনের বৈধতা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছিল [46]। যা সাম্প্রতিক কালের আমেরিকার আফগানিস্তানে আক্রমণের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। [47] ওরিয়েন্টালিস্টরা উপনেবেশবাদী স্বার্থে ইসলামে নারীদের অবস্থানকে খারাপ প্রমাণের চেষ্টা আজও পশ্চিমের মুসলিম বিশ্বে অবৈধ দখলদারিত্বের জাস্টিফিকেশন এবং ইসলামকে খারাপ হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা অসংখ্য ভুলে ধারণার ছড়াছড়ি বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কিত !

ওরিয়েন্টালিস্মের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব

মুসলিম বিশ্বে ওরিয়েন্টালিস্ম বিভিন্ন ধরনের প্রবলেম সৃষ্টি করেছে যা আজ অবধি মুসলিম বিশ্বকে ভোগাচ্ছে। পাশ্চাত্য ঔপনিবেশবাদী শক্তি প্রাচ্যের দেশসমূহে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে আসে। ঔপনিবেশবাদীরা চেয়েছে তাদের দখলকৃত অঞ্চল যেন তাদের দ্বারা ডমিনেট হয়, ইভেন তারা সেখান থেকে চলে গেলেও।তারা চেয়েছিল এমন এক শ্রেণী তারা তৈরী করে দিয়ে যাবে যেটা চিন্তা-চেতনায় তাদের মত হবে,তাদের ভাবাদর্শ দ্বারা চালিত হবে। ব্রক্ষাস্ত্র ওরিয়েন্টালিস্ম ছিল ঔপনিবেশবাদীদের কাছে প্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য। ইসলামী বিশ্বে পশ্চিমের মতই ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করে ফেলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মুসলিম বিশ্বে ইসলামকে রাজনীতি দর্শন থেকে আলাদা করার প্রস্তাব দেন ডাচ ওরিয়েন্টালিস্ট Christiaan Snouck Hurgronje। [48] এভাবেই দ্বীন [49] ইসলামকে আমাদের রাষ্ট্র থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়।আমাদের দ্বীন কেবল ঘরের চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে পরে। যেই দ্বীন মানবজীবনের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা থাকার কথা সেই দ্বীন আজ কেবল মসজিদে কোণঠাসা। মুসলিম বিশ্বের শাসনক্ষমতা বর্তমানে যাদের হাতে তারাও কলোনিয়াল পাশ্চাত্যবাদী হয়ে পাশ্চাত্যের গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া মতবাদগুলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গ্রহণ করে নিয়েছে। সেসবকে তারা ওহীর চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করছে। কেবল এটাই নয়, ওরিয়েন্টালিস্টরা তাদের কলমের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত এক এমন দাস শ্রেণীর জন্ম দিয়ে গেছে, যারা পশ্চিমা লেন্সে সব দেখতে পছন্দ করে। যারা ধর্মকে উন্নত করতে হবে,দ্বীনের সংস্কার করতে হবে এমন জঘন্য শ্লোগান তোলে। [50] ১৪০০ বছরের ইসলামকে তার জায়গা থেকে পশ্চিমা তরীকায় সাজাতে চায়। [51]পাশ্চাত্য মডার্নিস্ম [52] তথা তাদের প্রবৃত্তির সাথে যা মিলবে তাকে এসব মুসলিম নামধারী দাসেরা গ্রহণ করবে, আর যা ইসলামের মিলবে না তাকে বর্জন করবে নয়তোবা মডার্নিস্মের উপযোগী করে ভিন্ন ব্যখ্যা করবে।পশ্চিমা এক প্রভাবশালী মডার্নিস্ট নারীবাদী মুসলিম তো সরাসরি বলেছেন কুরানের যা কিছু মডার্নিটির বিপরীতে যায় তা অন্যভাবে ব্যখ্যা করতে
হবে। [53] আবার মডার্নিস্মের সাথে ওরিয়েন্টালিস্মের গভীর সংযোগ তো রয়েছেই। [54] চেতনার বুদ্ধিবৃত্তিক ঔপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠা করে ওরিয়েন্টালিস্টরা মুসলিম বিশ্বে,যা মুসলিম বিশ্বকে পাশ্চাত্যের অনুগামী করে রেখেছে ও দ্বীন ইসলামকে পাশ্চাত্যের উপযোগী করে উপস্থাপন করছে।যার ফল আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা হওয়া আল্লাহরই জমিন থেকে বঞ্চিত।


উপসংহার

ইসলাম-বিদ্বেষের সয়লাব চারিদিকে ওরিয়েন্টালিস্মের কারণে এটা প্রমাণিত। জেনারেল আম মুসলিমদের উচিত ওরিয়েন্টালিস্ম দ্বারা প্রভাবিত পাশ্চাত্য যেকোন লিটেরেচার পরিহার করে চলা যদি না ইমান-আমল যথেষ্ট শক্ত হয়।তা না হলে ওরিয়েন্টালিস্মের বায়াসনেসে পরে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এটা উপলব্ধিতে আনা, ওরিয়েন্টালিস্টরা ইসলামকে স্টাডি করে তাদের ক্রিয়েট করা পাশ্চাত্য নির্দিষ্ট মানদণ্ডের বেসিসে।ইসলামী মেথোডোলজির চেয়েও তারা পাশ্চাত্য মেথোডোলজিকে বেশি প্রেফার করে [55]।কিন্তু আমাদের ইসলামকে বুঝতে হবে ইসলামী মেথোডোলজি অনুযায়ী।[56] নাহলে অনেক ধরনের সমস্যা উদ্ভূত হবে এবং এখনও হচ্ছে। [57] তবে দুঃখজনক হলো আমাদের আলিম সমাজ যুগের প্র‍্যাক্টিক্যাল চাহিদা সম্পর্কে অনবগত ছিল।ইসলাম নিয়ে যে পরিমাণ পর্যাপ্ত পরিমাণ কাজের দরকার ছিল,সেই আশানুরূপ কাজ উনারা করতে পারেননি।যার ফলে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে ইসলাম রিলেটেড ওরিয়েন্টালিস্টদেরই বই-পত্র একাডেমিকভাবে পাঠ্য ছিলো [58] যা শিক্ষিত মুসলিম যুবসমাজকে চিন্তাগত ধর্মত্যাগের দুয়ারে ঠেলে দিচ্ছিলো। [59]
এ নিয়ে মুস্তফা আস সিবাঈ রহ.বলেন,
“ মুসলিম বিশ্বের যেসব ছাত্ররা নিজ নিজ দেশে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে তাঁরা বরাবরই মুখিয়ে থাকে ব্রিটেন ও আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার জন্য।যার কারণে ইসলামি স্টাডিজের ছাত্রদের সামনে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের জন্য ওইসব বিতর্কিত রেফারেন্স গ্রন্থই হয় তাদের একমাত্র ভরসা।
আর এই ছাত্ররা যেহেতু আরবী ভাষায় অনভিজ্ঞ তাই তাদের কাছে ইসলাম সম্পর্কে কুৎসা ও অপপ্রচারগুলোই মনে হয় স্বয়ং মুসলিম আইনজ্ঞ( তথা ফকিহ বা বিধানবিদ ) ও বিশেষজ্ঞদের গ্রন্থ থেকেই সংকলন করা।” [60]
এসব থেকে উত্তরণ হওয়ার জন্য মুসলিমদের নিজেদের গবেষণা অত্যন্ত জরুরি।
এজন্য লেখা ও গবেষণায় আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে গত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম ও দাঈ ইল্লাল্লাহ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বলেন, “প্রাচ্যবিদদের নেতিবাচক প্রভাব রোধ করার জন্যে এবং সৃষ্ট অনিষ্টের সংশোধনের জন্য ইসলামের আলেমসমাজ, গবেষক ও চিন্তাবিদদেরকে জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অবশ্যই কলম ধরতে হবে।মুসলিম বিশ্বের সামনে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সঠিক ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে হবে।সাথে সাথে সেই প্রশংসিত দিকগুলোর প্রতি যথাযথ যত্নবান থাকতে হবে– যা প্রাচ্যবিদদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য; বরং তাদের থেকে একটু এগিয়ে থাকতে হবে এ ক্ষেত্রে।একইভাবে মৌলিক গবেষণা,বিস্তর অধ্যয়ন, গভীর দৃষ্টিভঙ্গি,নিশ্চিত ও সঠিক সোর্স এবং শক্তিশালী প্রমাণের দিক দিয়ে তাদের লেখা ও রচনাগুলো প্রাচ্যবিদদের লেখা ও রচনার তুলনায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে।এছাড়া, তাদের লেখা ও গবেষণাসমূহ সব ধরনের বিশুদ্ধতা ও সর্বশেষ যোগ্যতার সাক্ষরবহনকারী হতে হবে, হতে হবে নির্ভুল যার মধ্যে জ্ঞানগত কোন ত্রুটি থাকবে না” [61]
----
লেখার প্রায় শেষের দিকে এসে একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার বলে আমি আমি করছি।অনেকে ভাবতে পারেন আমি ঢালাও ভাবে সব স্কলারকেই ওরিয়েন্টালিস্ট বলে খারাপ বলছি।সব স্কলারকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিচ্ছি।ভাবতে পারেন সব স্কলার তো আর ইসলামের বিরুদ্ধে বলেননি, সবাই সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা নিয়ে কাজ করেননি [62]। অনেকে তো ইসলামকে ভালোও বলেন! সত্য কথা হলো আমার উদ্দেশ্য সবাইকে ইসলাম-বিদ্বেষী সাম্রাজ্যবাদী ওরিয়েন্টালিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করা একদমই নয়। পশ্চিমা অনেক স্কলার ইসলাম রিলেটেড অনেক সেরা মানের কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন।তাদের এইসব কাজগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। কিন্তু তাদের এরকম কাজগুলো তাদের ওরিয়েন্টালিস্ট কিংবা ওরিয়েন্টালিস্ট বৈশিষ্ট্য হওয়া থেকে আটকে রাখবে না। সমস্যা তাদের পশ্চিমা বায়াসনেস।আমাদের এটা জানতে হবে ,“ ইসলাম কে নেগেটিভলি প্রদর্শন করলেই ওরিয়েন্টালিস্ট হয়ে যায় না,আবার ইসলামকে ভালো বললেই কেউ অ-ওরিয়েন্টালিস্ট পরিবর্তিত হয়ে যায় না।পজিটিভ নেগেটিভ দিয়ে কেউ ওরিয়েন্টালিস্ট হয়ে উঠে না;বরং সেটা নিশ্চিত করে তার কাজের কোয়ালিটি, সেটা নিশ্চিত করে তার মেথোডোলজি।[63]
বর্তমান ওয়েস্টার্ন স্কলারদের আবার ওরিয়েন্টালিস্ট বলাটা আউটডেটেড।আগেকার ঔপনিবেশিক স্কলারদের বর্তমানে ওরিয়েন্টালিস্ট বলা হয়ে থাকে।
‘ওরিয়েন্টালিস্ট’ টার্মটা এখন নেতিবাচক হিসেবেই ইউস্যুয়ালী দেখা হয়।ওরিয়েন্টালিস্টদের প্রভাব ওয়েস্টের স্কলারদের মাঝে থাকা অস্বাবিক নয়,বরং স্বাভাবিক এবং ওরিয়েন্টালিস্ট কাজ এখনও আসছে।[64]
লেখাটার মূল ফোকাস ইসলাম-বিদ্বেষের রুট ধরে ওরিয়েন্টালিস্ম ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কথা তুলে আনা।তা শুরুতেই বলে নিয়েছিলাম। তাহলে এবার আশা করছি আমি আমার অবস্থানটা স্কলারদের ব্যাপারে পরিষ্কার করতে পেরেছি।
-----
পরিশেষে, আমাদের মুসলিমদের ওরিয়েন্টালিস্ম নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আজকের ইসলাম-বিদ্বেষকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে রিফিউট এবং পশ্চিমের চিন্তার সীমারেখা বোঝার জন্য ওরিয়েন্টালিস্মের ব্যবচ্ছেদ প্রয়োজন। ইসলামের দাওয়াহ'র জন্য এই কাজ অত্যন্ত ম্যাসিভ হবে। সর্বোপরি আল্লাহ আমাদের সমগ্র বাতিল শক্তির বিরুদ্ধে হক্ব ও ইমানের সহিত টিকে থাকার তৌফিক দিক।আমিন,ইয়া রাব্বুল আলামীন।

বি:দ্র: এই লেখায় যা কিছু উপকারী ও কল্যাণকর তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। যা কিছু ত্রুটিযুক্ত ও অকল্যাণকর তা আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে।আমার জন্য সবার কাছে দুয়ার আরজি।জাজাকাল্লাহ।
-----
Reference and Notes
[1] Richard W. Bulliet, The Case for Islamo-Christian Civilization (New York: Columbia University Press, 2004) 43-45.
[2] Jocelyne Cesari, “Islamophobia in the West: A Comparison between Europe and the United States, ”in Islamophobia: The Challenge of Pluralism in the 21st Century, ed. John L. Esposito And Ibrahim Kalin, (New York: Oxford University Press,2011) 21.
[3] ইসলাম এবং পশ্চিমা বিশ্বের মাঝে বর্তমানে একধরনের বিরোধ কাজ করছে।অবশ্য সেটা গত ১৪০০ বছর ধরেই আছে।দুটোই লিডিং ডমিনেন্ট সভ্যতা-সংস্কৃতি। মুসলিম সংস্কৃতির নিজস্ব দর্শন পশ্চিম থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন এবং তা কখনোই পশ্চিমা এনলাইটমেন্ট থেকে বের হয়ে আসা খ্রিষ্ট যুগ পরবর্তী বাদ-মতবাদগুলোর সাথে আপোশ করে না। কারণ মুসলিম দর্শন এক আল্লাহর নির্দেশের উপর প্রতিষ্ঠিত।সে জায়গায় মানবিক প্রবৃত্তি-চাহিদাকে প্রাধান্য হিসেবে নেওয়া পশ্চিমা মতবাদগুলোর সাথে ইসলামের সংঘাত হবেই।ইসলামের সাথে পশ্চিমা আধুনিক সংস্কৃতির বিরোধ,রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেক সমস্যার সৃষ্টি করছে মুসলিমদের জন্য।মুসলিম বিশ্ব আজ পশ্চিমের অবৈধ দখলদারিত্ব, সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক-সামরিক আগ্রাসনের শিকার চরমভাবে।পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ইসলামের রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কলহ-সংঘর্ষ ও পারস্পারিক সম্পর্ক বুঝতে আগ্রহীরা দেখুন: Jonathan Lyons,Islam through Western eyes: from the crusades to the war on terrorism ( New York: Columbia University Press,paperback edition 2014),Bernard Lewis, Islam and West ( New York: Oxford University Press 1993)
বাংলাতে: আসিফ আদনান, চিন্তাপরাধ
( Ilmhouse Publication,২০১৯), ড্যানিয়েল হাকিকাতজু, সংশয়বাদী( Ilmhouse Publication ,২০২১) মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ), পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি
[4] Confronting Fear: Islamphobia and its Impact in the United States, p. viii.
[5] Terror attacks by Muslims receive 357% more press attention, study finds. The Guardian,20 July, 2018.
[6] Malise Ruthven,Islam: A Very Short Introduction ( ‎Oxford University Press, 2012)
মিডিয়ার ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ওয়েস্টের স্যেকুলার-লিবেরাল সংস্কৃতির প্রতি বায়াসনেস,
সমসাময়িক রাজনীতি-কূটনীতি ও ইসলামের প্রতি ঘৃণা থেকে আসে।
[7] Badrane Benlahcene.“Orientalism as a cultural root of Western Islamophobia." Journal of Islamic Thought and Civilization 11, no. 2 (2021): 77.
[8] Orientalism: cultural field of study,Britannica.
[9] খালিদ সাইফুল্লাহ, ওরিয়েন্টালিজম: প্রাচ্যে পশ্চিমা জ্ঞানতাত্ত্বিক আগ্রাসন,Fateh24 ।
[10] Vivek Chibber, “ The Dual Legacy of Orientalism” in After Said: Postcolonial Literary Studies in the Twenty-First Century,ed. Bashir Abu-Manneh, (Cambridge: Cambridge University Press,2019) 37-38
[11] মুসা আল হাফিজ, প্রাচ্যবিদদের দাঁতের দাগ( মাকতাবাতুল আযহার,২০১৫); পৃষ্ঠা ৫১।
[12] Vivek Chibber , “ The Dual Legacy of Orientalism” 38.
[13] Badrane Benlahcene,“Orientalism as a cultural root of Western Islamophobia." 77.
[14] Ibid.
[15] Orientalism: an overview, ScienceDirect.
[16] Shoaib Malik, “Al-Ghazālī” in The Cambridge History of Atheism,ed. Michael Ruse, (Cambridge University Press,2021) 292.
[17] Ziauddin Sardar,Orientalism( Open University Press,1999) 60.
[18] Zachary Lockman,Contending Visions of the Middle East: The History and Politics of Orientalism (New York: Cambridge University Press,2010) 74.
[19] Ibrahim Kalin,“ Roots of Misconception: Euro-American Perceptions of Islam Before and After September 11” in Islam, Fundamentalism, and the Betrayal of Tradition,ed. Joseiph E.B.Lumbard(World Wisdom,2009) 166.
[20] Arman Firman,Orientalism কি আর Orientalist কারা? (Independent Academia) 3-4.
[21] Ibid 1.
[22] Ibrahim Kalin,“ Roots of Misconception: Euro-American Perceptions of Islam Before and After September 11” 169.
[23] ড. মুসতফা আস-সিবাঈ,
ওরিয়েন্টালিজমের প্রথম পাঠ( মুভমেন্ট পাবলিকেশন্স,২০২১)
[24] এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ,কাভারিং ইসলাম ( সংবেদ প্রকাশনা ২,২০০৬); পৃষ্ঠা ৬৮।
[25] Zachary Lockman, 38-39.
[26] Ibid 39
[27] Badrane Benlahcene,78.
[28]Ibid.
[29]C. Doughty, Travels in Arabia Deserta (London: The Medeci society, 1921) V1/101, 597; Hussein, Sira’ Al-Gharb, 53-57.
[30] Badrane Benlahcene,80.
[31]Hassam Munir,“ Did Islam Spread by the Sword? A Critical Look at Forced Conversions”( Yaqeen Institute for Islamic Research,2018) 5.
[32] মুসা আল হাফিজ;পৃষ্ঠা ৬৫।
[33] প্রাগুক্ত;পৃষ্ঠা ৯২।
[34] প্রাগুক্ত;পৃষ্ঠা ৯৩।
[35] ড. মুসতফা আস-সিবাঈ; পৃষ্ঠা ৭২।
[36] Arman Firman,16.
[37] মুসা আল হাফিজ; পৃষ্ঠা ৯৪।
[38] প্রাগুক্ত; পৃষ্ঠা ১৭০।
[39] Badrane Benlahcene, 77-78.
[40] মুসা আল হাফিজ;পৃষ্ঠা ৯৫।
[41] কে ছিলেন মুহম্মদ (ﷺ)? রাফান আহমেদ।
[42] Syed Nomanul Haq,“ That Medieval Islamic Culture Was Inhospitable to Science” in Galileo Goes to Jail and Other Myths about Science and Religion, ed. Ronald L. Numbers (Harvard University Press,2009) 35-42.
[43] Asadullah Ali,“ The Structure of Scientific Productivity in Islamic Civilization: Orientalists Fables” ( Yaqeen Institute for Islamic Research,2017) আরমান ফিরমান,“ ইমাম গাযালি,দর্শন ও মুসলিম বিশ্বে বিজ্ঞানের পতন” ( Independent Academia)
[44] Shoaib Malik, “Al-Ghazālī”, 293.
[45] ইসলামে নারী সম্পর্কিত বিভ্রান্তির অপনোদন: Dr. Nazir Khan,Tesneem Alkiek and Safiah Chowdhury. “ Women in Islamic Law: Examining Five Prevalent Myths” ( Yaqeen Institute for Islamic Research,2019)
[46] Zachary Lockman, 69-70.
[47] Kate Zebiri,“ Orientalist Themes in Contemporary British Islamophobia,”, Islamophobia: The Challenge of Pluralism in the 21st Century, ed. John L. Esposito And Ibrahim Kalin, (New York: Oxford University Press,2011) 175.
[48] Mohamad Zaidin bin Mat.“ The Weakness of the Islamic Civilization: The Causes and its Solution” International Journal of Academic Research in Business and Social Sciences Vol. 7, No. 10 (2021) 257.
[49] দ্বীন পরিভাষাটি অনেক ব্যাপক। কেবল কিছু আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টি ধর্মই নয়: Syed Muhammad Naquib Al-Attas,Islam and Secularism ( Kualalampur: International Institute of Islamic Thought and Civilization,1993) 51-95.
[50]সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী, মুসলিম লেখক ও প্রাচ্যবিদদের ইসলাম বিষয়ক গবেষণামূলক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা (ঢাকা: মুহাম্মদ ব্রাদার্স,২০১৫); ১৬-১৭।
[51] মুসা আল হাফিজ; পৃষ্ঠা ১৮২।
[52] মুসলিমদের মাঝে মডার্নিস্ম ফিতনা ও অরিয়েন্টালিজমের মাঝে সম্পর্ক নিয়ে বিস্তারিত সামনে লেখার ইচ্ছা রাখি ইনশাআল্লাহ। আলাদা আর্টিকেলের প্রয়োজন হবে এটা বোঝাতে। মুসলিম বিশ্বে মডার্নিস্ম ও মডারেট ইসলাম কিভাবে ফাংশন করে তা নিয়ে ধারণা পেতে আসিফ আদনান ভাইয়ের ৩ পর্বের ‘র‍্যান্ড, মডারেট ইসলাম, মডার্নিস্ট মুভমেন্ট’ সিরিজটি পড়া আবশ্যক। এবং আরও দেখা যায়– ইভান ইয়াজবেক হাদ্দাদ ও টেইলর গলসনের Overhauling Islam: Representation, Construction, and Cooption of ‘Moderate Islam’ in Western Europe’ শীর্ষক প্রবন্ধটি ।
[53] Jonathon A.C. Brown,Misquoting Muhammad: The challenge and Choices of Interpreting the Prophets Legacy ( Oneworld Publications, 2014)
[54] Arman Firman, “ Orientalism কি আর Orientalist কারা?” 4.
[55] Angelika Neuwirth. “Orientalism in Oriental Studies?Quranic Studies as a Case in Point" Journal of Qura'nic Studies.
[56] ইমরান রাইহান, ইতিহাস পাঠ: প্রসঙ্গ কথা (চেতনা প্রকাশন)
[57] অনেক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। যার মাঝে একটি হলো হাল জামানার হাদীস অস্বীকারকারী আহলে কুরান ফিতনা।
[58] সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী; পৃষ্ঠা ১৯-২০।
[59] প্রাগুক্ত; ২৫।
[60] ড. মুসতফা আস-সিবাঈ; পৃষ্ঠা ৭২
[61] সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী;পৃষ্ঠা ২০।
[62] Zachary Lockman,74.
[63] Arman Firman, 8.
[64] Ibid,18.

পঠিত : ৫৬২ বার

মন্তব্য: ০