Alapon

মেয়ে হিসেবে মা-বাবার প্রতি আপনার দায়িত্ব: প্রেক্ষিত স্বামীর ভূমিকা...



কুরআন ও হাদিসে মা-বাবার অধিকার সংক্রান্ত যে সকল নির্দেশনা রয়েছে, সেগুলো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই সমান। কুরআনে বলা হয়েছে, মা-বাবার সঙ্গে বিনম্র আচরণ করতে; সেইসাথে এমন কিছু না করতে যেটা মা বাবার কষ্টের কারণ হয় কিংবা যেটাতে তাদের প্রতি আপনার বিরক্তিভাব প্রকাশ পায়। হাদিসেও খুব সুন্দর ভাবে ব্যাপারটা তুলে ধরা হয়েছে, বলা হয়েছে, মা-বাবা আপনার জান্নাতের সদর দরজা; সুতরাং আপনি চাইলে জান্নাতে প্রবেশের জন্য সে দরজাটা সযত্নে আগলে রাখতে পারেন, আবার চাইলে গুঁড়িয়েও দিতে পারেন।

মা-বাবার এই গুরুত্ব ও মূল্যমান শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত। কাজেই সন্তান হিসেবে এই গুরুত্ব ও মূল্যবান রক্ষা করা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে—সবার জন্যই সমান জরুরি।
গত কিস্তিতে আমরা যেহেতু মা-বাবার প্রতি বিবাহিত পুরুষের দায়িত্ব কতটুকু এবং ব্যবহারিক জীবনের সেটা কে আঞ্জাম দিবে সে ব্যাপারে আলাপ করেছি, তাই আজকে আমরা আলাপ করবো মা-বাবার প্রতি বিবাহিত নারীর দায়িত্ব কতটুকু এবং সে ক্ষেত্রে স্বামীর ভূমিকা কী হতে পারে, সে বিষয়ে।

মূল আলাপে যাওয়ার আগে একটা বিষয় খুব ভালো করে বুঝতে হবে, সেটা হচ্ছে, সন্তান হিসেবে তো বটেই সাধারণ বিচারেও নারী-পুরুষের দায়িত্বের মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য আছে। যেমন সন্তান, স্বামী ও বাবা হিসেবে একজন পুরুষের ওপর সবসময়ই মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান ও ভাই-বোনদের দেখভাল করার দায়িত্ব বর্তায়। এই দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে তাদের শিক্ষাদীক্ষা, আর্থিক ব্যয়ভার, শারীরিক ও মানসিক সেবা ও সঙ্গ এবং অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানসহ সবকিছু। পুরুষ হওয়ার পর আপনার অর্থনৈতিক সংগতি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাক বা না থাক, আপনার দায়িত্বাধীন লোকগুলো অপরিণত, অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম হলে, উপরোক্ত দায়িত্বগুলো আপনার উপরই বর্তায় এবং সেগুলো আপনাকেই পালন করতে হবে।

কিন্তু আপনি যদি মেয়ে হন, আপনার যদি অর্থনৈতিক সঙ্গতি না থাকে, আপনার স্বামীগৃহ দূরে হওয়ায় আপনি যদি তাদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সঙ্গ দিতে না পারেন, অথবা আপনার যদি ভাই, নানা বা রক্তসম্পর্কীয় অন্য কোনো সামর্থ্যবান অভিভাবক থাকে, তাহলে মা-বাবার প্রতি উপরোক্ত দায়িত্বগুলো আপনার উপর বর্তায় না। অবশ্য এক্ষেত্রে আবেগ কেন্দ্রিক ও মানবিক একটি দৃষ্টিকোণ থেকে যায় ঠিক; তবে মেয়ে হিসেবে আপনি এই দায়িত্বগুলো পালন না করেও, জান্নাতের সদর দরজা অটুট রাখতে পারবেন এবং তা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেন, ইনশাল্লাহ।

এতক্ষণ আমরা আলাপ করছিলাম, মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষের দায়িত্বের মধ্যকার চরিত্রগত পার্থক্য নিয়ে। মেয়েদের দায়িত্বের এই চরিত্রগত পার্থক্য বজায় থাকে সাধারণত বিবাহের আগপর্যন্ত; বিবাহের পরেও কদাচিৎ এটা ক্ষুদ্র পরিসরে বাকি থাকতে পারে; তবে মৌলিকভাবে বিবাহের পরে নারীর দায়িত্বের মধ্যে প্রকৃতিগত পরিবর্তন ঘটে। অর্থাৎ বিয়ের আগে একটি মেয়ের অনৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব থাকে মা-বাবার প্রতি সদাচরণ করা, তাদের দেখভাল করা, তাদের কাজে সাহায্য করা, তাদের কষ্ট লাঘব করা এবং তাদের শারীরিক সেবার পাশাপাশি মানসিকভাবে সঙ্গ দেওয়া; সেইসাথে ছোটদের প্রতি তাঁর দায়িত্বগুলো পালন করা ও ঘরদোর গুছিয়ে রাখা।

কিন্তু বিবাহের পরে এই দায়িত্বগুলোই পরিবর্তিত হয়ে যায় অন্য খাতে। অর্থাৎ বিবাহের আগে একটি মেয়ের যত কর্মতৎপরতা থাকে তার মা-বাবার সংসার ঘিরে, সেগুলোই পরে করতে হয় স্বামী ও তার সংসার কেন্দ্র করে। এগুলোই তখন হয়ে ওঠে তার নৈতিক, ধর্মীয় ও পারিবারিক দায়িত্ব।

আমরা যদি একটু খোলা মনে ভাবি, তাহলে দেখতে পাব, নারীর দায়িত্বের এই প্রকৃতিগত পরিবর্তন ছাড়া পরিবার ব্যবস্থা ঠিক রাখা কনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ একটি নারীর সম্পূর্ণ বা সিংহভাগ বিনিয়োগ তার স্বামীর পরিবারে না হলে, স্বামীর পরিবার ঠিক রাখা বা গুছিয়ে তোলা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। এটি একটি দুর্লঙ্ঘ্য ও সর্বজন স্বীকৃত সত্য। কাজেই এই পরিবর্তনের স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় নেই।

এরপরও মেয়ে হিসেবে তো বটেই; সাধারণ একজন মানুষ হিসেবেও বয়স্ক মা-বাবার প্রতি আপনার আবেগের একটা জায়গাটা থেকেই যায় এবং সেই জায়গায় থেকে আপনার স্বামী আপনাকে কতটা সঙ্গ দেয়, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ধরা দেয়। একটু পরেই আমরা এ ব্যাপারে আলাপ করব ইনশাল্লাহ।

নারী-পুরুষের দায়িত্বের চরিত্রগত পার্থক্য এবং নারীর দায়িত্বের প্রকৃতিগত পরিবর্তন বোঝার পর একটু খেয়াল করলে দেখতে পাবো যে, পুরুষের দায়িত্বে কিন্তু কোনো পরিবর্তন আসেনি; বরং সংযোজন হয়েছে আরো একজন নতুন মানুষ এবং সেই সূত্রে তার পরিবারেরও খানিক দায়িত্ব।

এখন আসা যাক স্ত্রী তার পরিবর্তিত দায়িত্বের মধ্যে থেকে মা-বাবার প্রতি দায়বোধ কিভাবে রক্ষা করবে এবং সে ক্ষেত্রে স্বামীর ভূমিকা কী হবে, সে প্রসঙ্গে। প্রথমটির ব্যাপারে সংক্ষেপে বললে, বলা যায় স্ত্রী যদি পরিবর্তিত দায়িত্বগুলো ভালোভাবে পালন করার মধ্য দিয়ে স্বামীর মন জয় করতে পারে এবং মা-বাবার প্রতি তার যে দায়বোধ আছে সেটা স্বামীর মধ্যে সঞ্চার করতে পারে, তাহলে খুব সহজেই স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে দুটি পরিবারের যথাযথ দেখভাল করা খুবই সহজ এবং সেইসাথে আনন্দদায়ক বলেও বিবেচিত হবে।

এই কথাটা স্বামীর দিক বিবেচনা এনে, এভাবেও বলা যায় যে, স্বামী যদি স্ত্রীর পরিবর্তিত দায়িত্বগুলো তাকে বোঝানোর পাশাপাশি সেক্ষেত্রে তাকে যথেষ্ট সাহায্য করে, এবং তার পরিবারকে সার্বিক বিচারে স্ত্রীর নিজের পরিবারের পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে স্বামীর মা বাবার প্রতি স্বামীর যে দায়বোধ আছে, সেটা স্ত্রীর মধ্যে সঞ্চারিত হবে এবং সেই সূত্র ধরে দুটো পরিবার খুব ভালো সময় যাপন করতে পারবে। যেহেতু এখানে আলাপ চলছে মেয়ে হিসেবে একজন স্ত্রীর মা-বাবার প্রতি দায়বোধ নিয়ে, তাই স্বামীর দিক থেকে ব্যাপারটা বিচার করা এখানে একটু গৌণ।

উপরে বলা হয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থায় মা বাবা ও ভাই বোনদের দায়িত্ব মেয়েদের উপর বর্তায় না; বিয়ের পরে তো মোটেও না। এখন এখানে যে দায়িত্বের কথা বলা হচ্ছে, সেটা ধর্মীয় ও বিচারিক দায়িত্ব। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থাকা সবসময়ই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং সাধারণভাবে ধর্মও তার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।
যাই হোক, মা-বাবার অবস্থা যদি স্বাভাবিক না হয়, অর্থাৎ তাদের যদি চলার মতো অর্থ না থাকে, কিংবা তারা শারীরিকভাবে অক্ষম হন, অথবা তাদের ব্যয়ভার বহন ও দেখভাল করার মত পুরুষ অভিভাবক না থাকে, তাহলে সন্তান হিসেবে বিবাহের পরেও মেয়ের উপর সে দায়িত্ব বর্তাবে, যদি তাঁর সামর্থ্য থাকে। তখন সে দায়িত্ব পালনে স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়া ও সাহায্য করা স্বামীর ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব বলে বিবেচিত হবে।

বিচারিক এই দায়িত্বের ক্ষেত্রে তো বটেই, মেয়ে হিসেবে একজন স্ত্রীর মধ্যে তার মা-বাবা ও পরিবারের প্রতি যে দায়বোধ থাকে, সেগুলো পালনেও স্ত্রীকে সাধ্য অনুযায়ী সর্বাত্মক সাহায্য করা ও সঙ্গ দেওয়া স্বামীর পারিবারিক ও নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

এক্ষেত্রে স্বামী যেসব কাজ করতে পারে বা যেসব কাজ তার করা উচিত সেগুলো হচ্ছে, স্ত্রীকে তার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করার সুযোগ দেওয়া, নিজেও সুযোগ করে মাঝেমধ্যে স্ত্রীর মা বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, নিজে এবং পারিবারিকভাবে স্ত্রীর পরিবারের খোঁজ খবর রাখা, বিশেষ সমস্যা বা প্রয়োজন দেখা দিলে সাধ্য অনুযায়ী অর্থনৈতিক সাহায্য করা বা বুদ্ধি পরামর্শ দেওয়া এবং অবশ্যই স্ত্রী ও স্ত্রী-পক্ষীয় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্মানজনক ও হৃদ্যতাপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রাখা।

আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামী পরিবার ব্যবস্থা বুঝার যোগ্যতা দান করুন এবং সেইসাথে পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তার সর্বোচ্চ সুফল ঘরে তোলার সুযোগ করে দিন।

- আকরাম হোসাইন

পঠিত : ২৫৯৯ বার

মন্তব্য: ০