Alapon

রাজ্যহীন সুলতান থেকে দিল্লির বাদশাহ



ভারতবর্ষে মুঘলদের কথা বললেই চলে আসে শক্তি , ক্ষমতা , যুদ্ধ , বিলাসিতা, ধার্মিকতা ও অধার্মিকতা। মুঘলদের ভারতে আসার পিছনে যে এক লম্বা সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প রয়েছ তা তাদের বিলাসিতার ইতিহাসের আড়ালে প্রায় হারিয়ে গিয়েছে। প্রথম মুঘল বাদশাহ বাবুর একদিনে দিল্লি দখল করেন নি। দিল্লি দখলের পিছনে ছিল বিরাট এক ঘটনা।

জহিরুদ্দিন মুহাম্মাদ বাবরের পিতা ছিলেন ফরগনা রাজ্যের শাসক। খুব অল্প বয়সে তিনি মাত্র পিতাকে হারান। তার যখন ১১ বছর বয়স , তখন তার পিতা এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় মারা যান। উত্তরাধিকার সুত্রে তিনি সিংহাসনের কাছে যান। তার প্রতিবেশি রাজ্যের শাসকরা ছিল স্ব আত্মীয়রাই। কিন্তু যেখানে যেখানে সিংহাসন সেখানে আত্মীয়তা ভয়ের কারণ।

বাবুর পিতৃ সুত্রে তইমুরি রক্তের অধিকারী ছিলেন। তার তইমুরি বংশে একটা কথা প্রচলিত ছিল,” হয় সিংহাসন নয় মৃত্যু” । বাবুর এই কথা সেই ছোটকাল থেকেই খুব ভালোভাবে বুঝেছিলেন। তার দু চাচা ছিলেন পার্শ্ববর্তী দুই রাজ্যের শাসক। তারা বাবুরকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। তারা চেয়েছিলেন বাবুরের ভাই জাহাঙ্গিরকে ক্ষমতায় বসাতে। কিন্তু সেসব বানচাল করে দিলেন বাবুর। এবার তিনি নজর দিলেন সমরখন্দের দিকে। সমরখন্দ ছিল তার পূর্বপুরুষ তইমুর লংয়ের রাজধানী । তিনি তার প্রিয় রাজধানীকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। তাকে নিয়ে বাবুরের গর্বের শেষ ছিল না। বাবুরেরও ইচ্ছা ছিল সমরখন্দ দখল করে বিরাট নব্য তইমুরি সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে।

১৪৯৭ সালে তিনি সমরখন্দ অভিযানে বের হন। প্রায় ৭ মাস অবরোধ করে রাখেন তিনি। অবশেষে সমরখন্দ দখল করতে তিনি সমর্থ হন। তবে তিনি বেশি দিন সমরখন্দ দখলে রাখতে পারেন নি। অনেক বার তিনি এটাকে হাত ছাড়া করে ফেলেছিলেন। প্রথমবার মাত্র ১০০ দিন সমরখন্দ দখল রেখে খবর পান তার স্বীয় ফরগনা রাজ্য হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। এবার তিনি ফরগনা রাজ্য উদ্ধার করতে গিয়ে সমরখন্দকে হারিয়ে ফেলেন। ১৫০১ সালে বাবুর আবার সমরখন্দ অবরোধ করেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে পালটে গিয়েছে অনেক কিছু। পালটে গিয়েছে সেখানকার শাসক। সেই সমরখন্দকে দখল করে নিয়েছিল যুদ্ধবাজ উজবেক নেতা শায়বানি খান। অবরোধ করে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল তিনি পেলেন না। পুনরায় তিনি নিজ ফরগনা মুক্ত করার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাশ। সেটাও তার কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে গেলো। তিনি হয়ে গেলেন রাজ্যহীন এক সুলতানে।
তারপর,তিনি সামান্য কিছু অনুচর নিয়ে তাসখন্ডে মামার কাছে আশ্রয় নেন। তার পরিকল্পনা একটি বিশাল সেনা বাহিনি গঠন করা। তাই তিনি বিভিন্ন যুদ্ধবাজ জাতিকে দলে ভেড়াতে চেষ্টা করেন , এমনকি নিজের সাবেক শত্রু বাদখশানি জাতের সেনারাও তার দলে যোগ দেয়।

১৫০২ সালে তিনি বুঝতে পারেন পিতৃ ভুমি ফরগনা ও স্বপ্নের সমরখন্দ তার ভাগযে আল্লাহ লিখে রাখেন নি। তাই তিনি ফরগনা ও সমরখন্দ উদ্ধার করার চেষ্টা বাদ দিলেন। নিজের সেনা শক্তি বাড়ানোর জন্য তিনি নানীর পরামর্শে এক মঙ্গোলীয় গোত্রপতির মেয়েকে বিয়ে করেন। তবে তাদের মাঝে সম্পর্ক ভালো ছিল না।

বাবরের সমস্ত জীবন ছিল যুদ্ধে ভরা মহাকাব্য । ১৫০৪ সালে তিনি তার নতুন স্বপ্ন নিয়ে হিন্দুকুশ পেরিয়ে আফগানের কাবুলে আসেন। তখন সেখানের শাসক ছিলেন উলুঘ বেগ নামের এক ব্যক্তি। তিনি এক শিশু উত্তরাধিকারী রেখে মারা যান। এই সুবর্ণ সুযোগ বাবুর হাত ছাড়া করলেন না। তিনি দখল করে নিলেন কাবুলকে। ১৫২৫ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানকার শাসক ছিলেন।

১৫০৫ সালে রাজস্ব কম আসায় তার নজর যায় সমৃদ্ধ ভারতবর্ষের দিকে। একই বছর হিরাত রাজ্যের শাসক মির্যা হুসাইন বাইকারার সাথে তার মিত্রতা হয় এবং তারা সমরখন্দ দঝল করে শায়বানিকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু বাইকারা পরবর্তী বছর অভিজানের পুর্বেই মারা যান। তাই এই অভিযান আর সম্ভব হলো না।

শায়বানি খানের কাছে বাবুরের বোন বন্দি ছিল। পারস্য সম্রাট শাহ ইসমাইলের হাতে শায়বানি নিহত হলে বাবুর তার বোন খানজাদা বেগমকে ফিরে পান। সাথে ফিরে পান সমরখন্দকেও । বোনকে ফিরে পাওয়ার উপহার হিসেবে তিনি পারসিক শিয়াদের একটু বেশি সুবিধা দিয়ে ফেলেছিলেন। যার জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হয়। পারসিকদের কারণে সেখানে তখন শিয়াদের প্রভাব বাড়ছে । তাই রাজ্যের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। যার ফলাফল স্বরূপ আবার তিনি সমরখন্দকে হাতছাড়া করে ফেলেন।

কাবুলে বসে তার নজর পরেছিল ভারতের দিকে । সমরখন্দ হারিয়ে তিনি এবার ভারত দখলের চিন্তা করলেন। তিনি তার সামরিক শক্তি বাড়াতে থাকেন। সেই সাথে এক দলত্যাগি অটোম্যান সেনা তাকে পরিচিত করিয়ে দেন মাচলক বন্দুক ও কামানের সাথে। তখনো ভারতে এই অস্রের ব্যবহার শুরু হয়নি। বাবুর এগিয়ে আসতে থাকে ভারতের দিকে। একদিকে এক পাহাড়ি নেতা অপরদিকে দিল্লির বাদশাহ ইব্রাহিম লোদি।
১৫২৬ সালে পানিপাতে মুখোমুখি হয় ইব্রাহিম লোদি ও জহিরুদ্দিন মুহাম্মাদ বাবুরের বাহিনি।

অসংখ্য সফলতা ও বিফলতার পর তিনি মুখ দেখেন শান্তির। দখল করে নেন দিল্লি। কিন্তু তার ভাগ্যে ভার শাসন বেশিদিন থাকেনা। মাত্র ৩ বছর শাসন করে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।


সুত্রঃ মুঘলনামা

পঠিত : ২৯৫ বার

মন্তব্য: ০