Alapon

জান্নাতের পথিক...




বিয়ের পর প্রথম যেদিন জানতে পেরেছিলাম আমার স্বামীর আরো একটি স্ত্রী ছিল এবং তিনি তাকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন, সেদিন আর নিজেকে সামাল দিতে পারিনি। খেয়ে না খেয়ে, যত্নে - অযত্নে ঘরের এক কোণায় পরে থাকতাম!

দ্বীনের জ্ঞান আমার আগে থেকেই ছিল আলহামদুলিল্লাহ। তাই আমি কোনো হারাম রিলেশনে জড়াইনি কখনো৷ যার জন্য এত বছর নিজেকে হিফাজত করলাম তার এই হারামের ইতিহাস শুনে কিছুতেই তাকে আর মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু মানতে তো আমাকে হতোই। রবের দেওয়া কালিমা পড়ে যাকে বিয়ে করেছি তার হক্ব তো আদায় করতে হতোই। কারণ আমি তালাকের মতো কঠিন হালালে কখনোই যেতে চাইনি, যাইওনি আলহামদুলিল্লাহ। তবে এই পথটা নিতান্তই সহজ ছিল না আমার জন্য। তবে রব্ব যা কিছু সহজ করেন তা কঠিন করার কে ই বা আছে। আমার বিষয় টাও তিঁনিই সহজ করেছিলেন, আলহামদুলিল্লাহ।

[১]
"আমরা কি তোর খারাপ চাই"- কথাটা বলার মধ্য দিয়েই বিয়ে করার জন্য আমাকে রাজি করানো হয়েছিল। সারাজীবন বাবা-মা'র অবাধ্য হইনি। তাই শেষ মুহুর্তে এসেও অবাধ্য হলাম না। তাদের দেখা পাত্রের সাথে বিয়ে করে নিলাম। যদিও বিয়ের আগে ইস্তিখারা করেছিলাম, তবুও যেহেতু বিয়ে ভাঙেনি সেহেতু ছেলেটা আমার জন্য উত্তম ই হবে বলে মনে মনে শান্তি পাচ্ছিলাম।

বিয়ে হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম অর্ধাঙ্গের সাথে আমার আকাশ পাতাল পার্থক্য। একজন দক্ষিন মেরু হলে অন্য জন নিঃসন্দেহে উত্তর মেরুর বাসিন্দা। নামাজ-কালামে একদম মন নেই। তবে একটা দিক ভালো লাগতো যে দ্বীন নিয়ে কোনো জ্ঞান দিলে চুপচাপ মনোযোগ সহকারে শুনতো এবং কিছুটা হলেও মানার চেষ্টা করতো, আলহামদুলিল্লাহ।

[২]
মেয়েরা হয়তো একটু বেশিই প্রেমময়ী হয়। তাই বলেই হয়তো তারা মায়ের জাতি। আমিও কিছু দিনের মধ্যেই তার মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম, তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তাই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম তার হিদায়াতের জন্য রব্বের নিকট দু'আ করা শুরু করবো এবং সাথে যতটুকু পারা যায় চেষ্টা ও করতে হবে। কারণ প্রিয় মানুষটাকে জাহান্নামের পথে হাঁটতে দেখলে অন্তর যে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় তা ভালোভাবেই টের পাচ্ছিলাম।

রব্ব যাকে হিদায়াহ দিতে চান তার হিদায়াহ পাওয়া কেউ রোধ করতে পারে না! আমার অর্ধাঙ্গ ও খুব জলদি হিদায়াহর আলো পায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, দাড়ি রাখা কিছু দিনের মধ্যেই শুরু করে দেয়, আলহামদুলিল্লাহ। তবে পুরোপুরি দ্বীনের বুঝ পেতে তখন ও অনেকটা বাকি। বিশেষ করে হালাল-হারামের বিষয়গুলো।

[৩]
স্বামীর জন্য দু'আ করতে করতে নতুন বিবাহিত জীবন আনন্দেই কেঁটে যাচ্ছিল আলহামদুলিল্লাহ। পাশাপাশি স্বামীর পরিবর্তন দেখে রব্বের নিকট ভীষণ কৃতজ্ঞ ছিলাম। উনার মতো মানুষিকতার একজন লোককে স্বামী হিশেবে পেয়ে শুকরিয়ায় মাথা নত হয়ে আসতো।

দু'জনের বৈবাহিক জীবন ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন তার আগের বিয়ের কথা শুনে সব এলোমেলো হয়ে গেল। কোনো ভাবেই তার এই ঘৃণিত অতীত মেনে নিতে পারছিলাম না। কষ্টের অনলে প্রতিনিয়ত আমার অন্তর দগ্ধ হচ্ছিল। তার সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল আমার।

[৪]
রাত জেগে কান্না করতাম আর রব্বের নিকট অভিযোগ করতাম, উত্তম জীবনসঙ্গীর জন্য এত এত দু'আ করবার পর ও তিঁনি কেন এমন একজনকে আমার অর্ধাঙ্গ করলেন। রব্ব কেন আমার দু'আ কবুল করলেন না।

হঠাৎ আমার ভাবনাতে ছেঁদ ঘটলো। রব্ব সত্যিই কি আমার দু'আ কবুল করেননি? আমাকে উত্তম একজন অর্ধাঙ্গ দান করেননি? নাকি আমিই বুঝতে ভুল করেছি? রব্ব তো তাঁর বান্দাদের না চাইতেই কত কিছু দেন। আর চাওয়ার পর ও কি আমাকে দেবেন না? নাহ, এমনটা তো হতেই পারে না।

আমি আবার ভাবনার ঝুলি নিয়ে বসলাম। প্রথম থেকে সব মেলাতে লাগলাম। কই আমার অর্ধাঙ্গ তো খারাপ নয়৷ সে তো এখন আমার দ্বীন পালনেও সাহায্য করে৷ আমায় বেপর্দা হতে ফোর্স করে না। অথচ চোখের সামনেই তো কত দ্বীনি বোনদেরকে বিয়ের পর বেপর্দা হতে দেখেছি শুধুমাত্র তাদের স্বামীর কারণে। আল্লাহ তো তবে আমার দু'আ কবুল করেছেন ই। আমায় নব-ধার্মিক একজন স্বামী দান করেছেন।

[৫]
ধীরে ধীরে আমি নিজেকে বুঝাতে থাকি। রব্ব তো আমাদের সকল গুনাহ মাফ চাইলেই মাফ করে দেন। সেখানে আমি কারো তিক্ত অতীত নিয়ে কিভাবে নাক ছিঁটকাতে পারি! আর যেই অতীতের জন্য আমি তাকে ঘৃণা করছি এমন ও তো হতে পারে সেই অতীতের জন্য অনুতপ্ত হয়েই সে আজ রব্বের কাছে প্রিয়।

এক সময় আমি এসব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিই। রব্ব আমাদের সম্পর্ক আবার আগের মতো সুন্দর করে দেন। আমাদের সংসার জীবনের এতগুলো বছরে আমি কখনোই তার অতীত নিয়ে তাকে কথা শুনানো তো দূরের কথা, এগুলো তাকে মনেও করতে দিইনি। তার অতীতের কিছু শুনতেও চাইনি। শুধু হারাম-হালালের পার্থক্য শিখিয়ে তাকে সেই হারাম রিলেশনের জন্য মন থেকে তাওবাহ কর‍তে বলেছি।

[৬]
আমি এবং আমার স্বামী আমাদের সন্তানগুলোকে হাফেয-আলেম বানিয়ে তারপর দুনিয়াবি পেশাদার বানানোর নিয়ত করেছি। সেই নিয়ত অনুযায়ী আমাদের ছেলেটাকে হিফযখানাতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি।

আমার স্বামী মাঝেমধ্যে বলেন অই সময়টাতে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমার জীবন হয়তো আবার ও এলোমেলো হয়ে যেতো। আমি রব্বের দেখাও পেতাম না।

কান্না বিজারিত কন্ঠে তার হাত দু'টো ধরে আমি তাকে বলি, আপনার হিদায়াতের পেছনে আমার কোনো হাত নেই। রব্ব চেয়েছিলেন আপনি তাঁর দেখা পান তাই পেয়েছেন। আমি তো আপনার অর্ধাঙ্গিনী। আমি তো মাত্র আপনার অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করতে এসেছি।

তিনি আমার হাত দু'টো আরো শক্ত করে ধরে বলেন, হাত দু'টো যখন ধরেছি দু'আ করি আর আশা রাখি জান্নাহ অব্দি আল্লাহ এইভাবে ধরে রাখবার তৌফিক দেবেন। আমাদেরকে জান্নাতের পথের পথিক করবেন ইংশা আল্লাহ।

- সায়মা ইসলাম রিজভী,

পঠিত : ৩৫৫ বার

মন্তব্য: ০