Alapon

বুদ্ধিবৃত্তিক অঙনে মুসলিমদের ঐতিহাসিক ভুল



সুলতান আল ফাতিহের ঐতিহাসিক ভুলসমূহের মধ্যে একটি ভুলের প্রভাব সাম্রাজ্যের ওপরে কয়েক দশক কিংবা কয়েক শতাব্দী পরে পড়েছিল। তাই এই ভুলের ব্যাপারে কেউ আলােচনা করেননি। সেই ভুলটি হলাে, তার সাম্রাজ্যে মুদ্রণযন্ত্র না আনা। অথচ তার শাসনামলে পশ্চিম ইউরােপে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়েছিল।জার্মান প্রকৌশলী গুটেনবার্গ (Gutenberg) পঞ্চদশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে,অর্থাৎ সুলতান আল ফাতিহের ক্ষমতা গ্রহণের ১০ বছর পূর্বে জার্মানীর মাইনজ (Mainz)।শহরে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন।আইনগত কিছু কারণে আবিষ্কারের পর মুদ্রণযন্ত্রের প্রসার কয়েক বছর বিলম্বিত হয়েছিল। তারপর অতি দ্রুত মাইনজ থেকে ইউরােপের বেশ কিছু শহরে ছড়িয়ে পড়ে।কেউ কেউ মনে করেন, গুটেনবার্গ কর্তৃক মুদ্রণযন্ত্রে চলমান অক্ষর ছাপার পদ্ধতি আবিষ্কার মানব-ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে সমগ্র ইউরােপে বইপত্র হাতে লেখা হতাে এবং গ্রন্থের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার।কিন্তু মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর (১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে) অধিকাংশ গ্রন্থ যান্ত্রিকভাবে মুদ্রিত হওয়া শুরু হয়।বইপত্রের সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক মিলিয়ন। মাইনজের পর ১৪৬৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম মুদ্রণযন্ত্র গ্রহণ করে জার্মানীর কোলন (Cologne) শহর, তারপর ১৪৬৬ খ্রিষ্টাব্দে নেয় বাসেল (Basel)। তারপর মুদ্রণযন্ত্র চলে যায় ইতালীয় শহরগুলােতে। ১৪৬৭ খ্রিষ্টাব্দে রােমে (Rome) এবং ১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ভেনিসে (Venice) পৌছে। তারপর ১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দে মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন ঘটে ফ্রান্সের প্যারিসে (Paris), জার্মানির নুরেমবার্গে (Nuremberg) এবং হল্যান্ডের আটরেচটে (Utrecht)। তারপর ১৪৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুদ্রণযন্ত্র একসঙ্গে কয়েকটি ইতালীয় শহরে প্রবেশ করে। শহরগুলাে হলাে, মিলান(Milan), নাপােলি (Naples) এবং ফ্লোরেন্স (Florence)। ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে একশরও অধিক ইউরােপীয় শহরে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।তার মধ্য হতে শুধু ইতালিতেই ছিল ৪৭টি ছাপাখানা।

ইউরােপের এই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের ক্ষেত্রে উসমানি সাম্রাজ্যের অবস্থান কোথায় ছিল?
আমরা জানি, সুলতান আল ফাতিহ ইউরােপের জ্ঞানের ক্রমবিকাশের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতেন। ইউরােপের বেশ কয়েকজন জ্ঞানী-গুণীর সঙ্গে তার যােগাযােগ ছিল।তার কয়েকজন গুপ্তচর ছিল, যারা ইউরােপের বিভিন্ন শহরের; বিশেষভাবে ইতালি,আরও বিশেষভাবে ভেনিসের সংবাদ এনে দিত। এই জায়গাগুলােতে মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন ঘটেছিল। সুলতান আল ফাতিহের আমলে উসমানি সাম্রাজ্যে মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে আসার ব্যাপারে উদাসীনতা পরবর্তী সময়ে সাম্রাজ্যকে অনেক ভুগিয়েছে। বিশ্ব এগিয়ে গিয়েছে, উসমানি সাম্রাজ্য এবং শাম, মিশর, আলজেরিয়ার মতাে উসমানি সাম্রাজ্যের অনুগত সমস্ত আরব অঞ্চল পিছিয়ে পড়েছে। উসমানি সাম্রাজ্যে মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে আসার জন্য সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহের মতাে উদার মানসিকতার একজন সুলতানের প্রয়ােজন ছিল। তিনিই যখন এই অবদান রাখতে পারেননি,তখন তার পরবর্তী সুলতানগণও এই কাজে বিলম্ব করেছে।এমনকি তারা এক অদ্ভুত ফতােয়া প্রকাশ করেছিল,যাতে এই দাবিতে মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক করা হয় যে,মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহারে কুরআন শরীফ ও ধর্মীয় গ্রন্থগুলাে বিকৃত হয়ে যেতে পারে। শাইখুল ইসলাম আবদুল্লাহ আফেন্দি মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহারে বৈধতার ফতােয়া প্রদানের আগ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। শাইখুল ইসলাম এই ফতােয়া প্রদান করেছিলেন ১৭১৬ খ্রিষ্টাব্দে। উসমানি সাম্রাজ্য মুদ্রণযন্ত্র ব্যবহার করেছে ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে। অর্থাৎ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের প্রায় তিন শতাব্দী পরে! কী নিয়ে আমরা আলােচনা করব! জ্ঞানের কোন শূন্যতার বিবরণ আমরা দেবাে!

এই বিপর্যয়ের দায় শুধু সুলতান আল ফাতিহকে দিচ্ছি না; বরং সম্ভবত এ ক্ষেত্রে তিনি কমই দায়ী।কারণ, তার আমলে মুদ্রণব্যবস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে নতুন।আর মুদ্রণযন্ত্র ছিল তার শত্রুদের কাছে।তার মাঝে এবং শত্রুদের মাঝে বেশ কিছু যুদ্ধ হয়েছিল, যাতে স্বাভাবিক সম্পর্ক ব্যাহত হয়েছিল। তারপরও আমরা এ ক্ষেত্রে সুলতান আল ফাতিহকে অপারগ মনে করি না। কারণ,এই প্রযুক্তি ক্রয়ের মাধ্যমে সহজেই সংগ্রহ করা যেত।আর উসমানি সাম্রাজ্য মুদ্রণযন্ত্র ক্রয়ে অক্ষম ছিল না। সুলতান আল ফাতিহের কাছে প্রত্যাশা ছিল যে,তিনি এই সিদ্ধান্ত নেবেন।সুলতান আল ফাতিহ যখন মৃত্যুবরণ করলেন, তখন তার পরবর্তী সুলতানগণও এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে পড়েন। প্রতিপক্ষ ইউরােপীয় দেশগুলাে থেকে পিছিয়ে পড়ে উসমানি সাম্রাজ্য। সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহের পুত্র দ্বিতীয় বায়জিদ ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে;অর্থাৎ সুলতান আল ফাতিহের মৃত্যুর চার বছর পর উসমানি সাম্রাজ্যে মুদ্রণযন্ত্র প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেন। ১৪৯৪ খ্রিষ্টাব্দে যখন ইহুদিরা তাদের ধর্মীয় গ্রন্থাবলি সংরক্ষণের জন্য মুদ্রণযন্ত্র আনার অনুমতি চায়, তখন তিনি তাদেরকে এই শর্তে অনুমতি দেন যে,তা দিয়ে আরবি কিংবা তুর্কি ভাষায় কোনাে বই ছাপানাে যাবে না, প্রকাশনা শুধু হিব্রু ভাষাতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।ঠিক দ্বিতীয় বায়জিদের পন্থাই অনুসরণ করেছেন পরবর্তী উসমানি সুলতানগণ তিন শতাব্দীজুড়ে! এ বিষয়টিকে আমি সুলতান আল ফাতিহের শাসনকালের অন্যতম বৃহৎ ভুল মনে করি। বিশেষভাবে মনে করি এজন্য যে, তিনি ইলম ও জ্ঞানের মূল্য জানতেন। এ বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন ও এই আবিষ্কারের মূল্য বােঝার সক্ষমতা তার ছিল। আর এটি এমন বিষয় ছিল, যা উসমানি সাম্রাজ্য ও মুসলিমদের নানাবিধ উৎকর্ষ দান করত।কিন্তু পরিস্থিতি এই ধারাতেই প্রবাহিত হয়েছে!
—ড. রাগিব সারজানি,নি’মাল আমির মুহাম্মাদ আল ফাতিহ,খণ্ড ৩,পৃ: ৪২৬-৪২৯
[ছবিতে গুটেনবার্গের প্রিন্টিং প্রেস]

পঠিত : ৩০৬ বার

মন্তব্য: ০