Alapon

ইমাম ইবনু তাইমিয়া যখন তাতারদের মুখোমুখি


.
তাতার, ইতিহাসের একটি ভয়ানক কালো অধ্যায়ের নাম। সেসময়কার মুসলিমরা তাতারদের বিষয়ে এতটাই আতঙ্কিত ছিল যে, তখন আরবে একটি প্রবাদ প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল: “যদি কেউ বলে, তাতাররা হেরে গেছে, তাহলে তার কথা বিশ্বাস কোরো না।”
আনুমানিক ৬০৩ হিজরিতে তাতার সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। তাদের উৎপত্তিস্থল চীনের উত্তরে অবস্থিত মঙ্গোলিয়া দেশে। তাদের নেতা ছিল চেঙ্গিজ খান। মঙ্গোলীয় ভাষায় ‘চেঙ্গিজ খান’ অর্থ শক্তিধর, বিশ্বশাসনকর্তা। চীনের উত্তরে অবস্থিত ‘জুবি’ উপত্যকার অধীবাসীদের ‘তাতার’ বলা হয়। তাতাররা ছিল পরিশ্রমী, যাযাবর, দুর্ধর্ষ ও রক্তলোলুপ। কিন্ত এই মূর্খ-অসভ্য-বর্বর জাতির না ছিল কোনো ধর্ম, না কোনো ধর্মগ্রন্থ, না ছিল কোনো সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান বা বুদ্ধিবৃত্তি। ফলে তাতার নেতা চেঙ্গিজ খান স্বজাতির জন্য একটি ধর্মের প্রবর্তন করে। এ ধর্ম ছিল বড়ো অদ্ভূত। তাদের ধর্ম ছিল বিভিন্ন ধর্মের সংমিশ্রণে সৃষ্ট এক নবধর্ম। চেঙ্গিজ খান ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম, বৌদ্ধধর্মের কতিপয় বিধি-বিধান একত্রিত করে এবং নিজের পক্ষ থেকে কতিপয় বিধান সংযোজন করে তাতারদের জন্য একটি ধর্মীয় গ্রন্থ প্রণয়ন করে। এটির নাম ছিল ‘ইয়াসিক’ বা ‘ইয়াসাহ’। ৬১৬ হিজরিতে তাতার নামক আজাব মুসলমানদের উপর নেমে আসে। সুলতান আলাউদ্দিন খাওয়ারিজমের ‘বুখারা’ আক্রমণের মধ্য দিয়ে তারা মুসলিম সাম্রাজ্যগুলো ধ্বংসের সূচনা ঘটায়। তারা প্রায় ৪০ বছর পর্যন্ত একটানা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে এ আজাব অব্যাহত থাকে।

মুওয়াফফিক আব্দুল লতিফ বলেন— “যেন গোটা বিশ্ব ও বিশ্বমানবতাকে ধ্বংস করাই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, রাজত্ব ও সম্পদ (অর্জন) তাদের কোনো লক্ষ্য ছিল না!”
তাতার আতঙ্ক মুসলমানদের মধ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, কোনো তাতারিকে দেখলে মুসলমানরা মনে করত যেন পিশাচ এসে গেছে। অনেক সময় একজন তাতারি একটি গলির মধ্যে ঢুকে একাই একশ’ জন মুসলিমকে হত্যা করেছে! কেউ ভয়ে বাধা পর্যন্ত দেয়নি। এমনকি একবার এক তাতারি মহিলা পুরুষের বেশে একটি ঘরে ঢুকে একের পর এক সবাইকে হত্যা করে! আরেকটি ঘটনা— এক তাতারি একজন মুসলিমকে আটক করে। কিন্তু তার কাছে কোনো তরবারি ছিল না। সে মুসলিম ব্যক্তিকে হুকুম করে, ‘আমি এখনই বাজার থেকে তরবারি এনে তোকে হত্যা করব। তুই একটুও নড়বি না।’ বেশ কিছুক্ষণ পর নরাধম তাতারটি বাজার থেকে অস্ত্র এনে মুসলিম লোকটির গলা কাটে। কিন্তু সেই মুসলিম ব্যক্তিটি পালানোর চিন্তা পর্যন্ত করেনি!

৬৫৬ হিজরি। বাগদাদে হালাকু খান চালায় অবিশ্বাস্য এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ঐতিহাসিকদের মতে, এ সময় বাগদাদে প্রায় ১৮ লক্ষ লোক নিহত হয়! হালাকু বাগদাদে প্রবেশ করে খ্রিস্টানদের প্রকাশ্যে মদ্যপান ও শুয়োরের গোশত খাওয়ার নির্দেশ দেয়। মুসলমানদের জোর করে মদ পান করানো হয়, মাসজিদগুলোকে মদে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আজান নিষিদ্ধ করা হয়। তখন ছিল রামাদান মাস। ইমাম ইবনু কাসির রহিমাহুল্লাহ বলেন, “চল্লিশ দিন পর্যন্ত বাগদাদে গণহত্যা ও লুটতরাজ অব্যাহত ছিল। হাট-বাজারে, অলিতে-গলিতে লাশের স্তূপ পড়ে ছিল। লাশ পচা গন্ধে সারা শহর দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল। অসংখ্য মানুষ এই মহামারিতে মারা যায়।”

শেষমেশ, ৬৫৮ হিজরিতে মিশরের সুলতান সাইফুদ্দিন কুত্‌যের হাতে ‘অজেয়’ তাতারদের পরাজয় ঘটে। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি ‘তারিখুল খুলাফা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “আইনে জালুতের যুদ্ধের পর ‘তাতারদের পরাজয় অসম্ভব’ এই প্রবাদ মিথ্যা সাব্যস্ত হয়।”
ফলে কতিপয় অজ্ঞাত, অখ্যাত ও নিবেদিতপ্রাণ মুবাল্লিগের দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতে তাতারদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের ধারা শুরু হয় এবং মহান আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ-অনুকম্পায় এক সময় সমস্ত তাতার জাতি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আগমণ করেন।
তাতার সম্রাট চেঙ্গিজ খানের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য চার পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র জুজি খানকে সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশ, হালাকু খানের নেতৃত্বে থাকে পারস্যের ইলখানিয়া শাসনাধীন অঞ্চল, চুগতাই খানের অধীনে মধ্যাঞ্চল এবং উগতাই খানের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল। এই চার ভাগেই জোরেশোরে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু হয় এবং এক শতাব্দীর মধ্যেই সকল তাতারি জাতিগোষ্ঠী ইসলামে দীক্ষিত হয়।

‘Preaching of Islam’ (দাওয়াতুল ইসলাম নামে অনূদিত) গ্রন্থে লেখক টি. ডব্লিউ. আর্নল্ড বলেন, “মোগলদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন বারাকাহ খান।” এভাবে কতিপয় অজ্ঞাত, অখ্যাত ও নিবেদিতপ্রাণ মুবাল্লিগের দাওয়াতের মাধ্যমে তাতারদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের ধারা শুরু হয়। ইসলাম গ্রহণের পর সে ‘সুলতান গিয়াস উদ্দিন’ নাম ধারণ করে। বুখারা থেকে আগত দু’জন শ্রমিকের থেকে ইসলামের শিক্ষা, নীতিমালা এবং বিধিবিধানের বর্ণনা শুনে সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়। ইমাম ইবনু কাসির ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, “৬৯৪ হিজরিতে চেঙ্গিজ খানের নাতি ‘কাজান’ সম্রাট মনোনীত হয় এবং সে আমির তুযানের হাতে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে ‘মাহমুদ’ নাম ধারণ করে এবং জুময়ার জামায়াতে অংশগ্রহণ করে।”

তাতাররা ইসলাম গ্রহণ করলেও তাদের ধর্মপালন নিয়ে তৎকালীন আলেমগণের সন্দেহ ছিল। বিশেষ করে মুসলিম অঞ্চলগুলোর উপর হামলা, মুসলিম এলাকা জবরদখল ইত্যাদি দিকগুলো মুসলিমদের দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। মাহমুদ কাজান দামিশ্‌ক দখলে অভিযান পরিচালনা করলে সেখানকার নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও উলামাদের তার দরবারে আমন্ত্রণ জানায়। সেই সুবাদে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াও আমন্ত্রণ পান। দরবারে ইবনু তাইমিয়ার সাথে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে মাহমুদ কাজান তাঁর সাহসিকতা দেখে একটি মন্তব্য করেন। সে বলে— “কে এই ভদ্রলোক? এমন ভয়ঙ্কর (সাহসী) লোক আমি জীবনে দেখিনি।” [আল বাযযার: ৭২-৭৩]

তাতাররা যেহেতু আরবি বুঝত না, তাই কথপোকথনের জন্য দোভাষী নিয়োগ করা হয়। শাইখুল ইসলাম দোভাষীকে বললেন, “কাজানকে বলো— তুমি নিজেকে একজন মুসলিম মনে কর! আর আমাদের জানা মতে, তোমার সাথে মুয়াজজিন, কাজি, ইমাম ও শাইখগণ আছেন। অথচ তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এসেছ! কেন তোমরা আমাদের দেশে প্রবেশ করেছ? অথচ তোমার পূর্ববর্তী হালাকুরা ‘কাফির’ ছিল। তারা ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। তারা অঙ্গীকার দিয়ে পূরণ করেছিল। অথচ তুমি অঙ্গীকার করে তা পালন করনি।”
এভাবে কাজান, কুতলুশাহ, বুলাই ও অন্যান্য নেতাদের সাথে তাঁর আলোচনা চলতে থাকে। এরপর তাদের সামনে খাবার পরিবেশন করা হয়। সবাই আনন্দের সাথে খেলেন। কিন্তু ইবনু তাইমিয়াহ খাবারে হাত পর্যন্ত দিলেন না। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘কেন খাচ্ছেন না?’ তিনি বললেন, ‘কীভাবে আমি তোমাদের খাবার গ্রহণ করব, যার সবগুলো তোমরা মানুষের সম্পদ থেকে লুট করেছ, আর এগুলো রান্না করেছ মানুষের গাছ কেটে?’
এরপরে কাজান ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহর কাছে দুয়া চাইলে তিনি দুয়া করলেন, “হে আল্লাহ! তোমার এই বান্দা মাহমুদ (কাজান) যদি সত্যিকার অর্থে তোমার কালিমাকে সমুন্নত করার জন্য এবং তোমার দিন্‌কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুদ্ধ করে, তাহলে তাকে সাহায্য কোরো, তাকে শক্তিশালী কোরো, তাকে দেশ ও জাতির রাজত্ব দাও। আর যদি যশ ও খ্যাতির জন্য, দুনিয়ার ক্ষমতা লাভের জন্য, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এবং ইসলাম ও মুসলমানদের লাঞ্ছিত করার জন্য যুদ্ধ করে, তাহলে তাকে লাঞ্ছিত কোরো, অপমানিত কোরো, তাকে ধ্বংস করে দাও ও তার বংশ নিশ্চিহ্ন করে দাও।”

ইবনু তাইমিয়াহ যখন দুয়া করছিলেন তখন কাযান হাত উত্তোলন করে ‘আমিন’, ‘আমিন’ বলছিল! বর্ণনাকারী বলেন— যখন ইবনু তাইমিয়া এমন দুয়া করছিলেন, তখন আমরা আমাদের কাপড়গুলো গুটিয়ে নিচ্ছিলাম। আমাদের ভয় হচ্ছিল যে, যখন তাকে হত্যার আদেশ করা হবে, তখন রক্ত প্রবাহিত হয়ে আমাদের কাপড়গুলো ভিজে যাবে! আমরা যখন তার নিকট থেকে চলে যাচ্ছিলাম তখন কাজি নাজিমুদ্দিন ও অন্যান্যরা তাকে বললেন, ‘তুমি নিজের সাথে আমাদেরকেও হত্যা করছিলে? আমরা আর তোমার সাথে থাকব না।’ তখন তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমিও তোমাদের সাথে থাকব না।’
আমরা চলে গেলাম। তিনি ও তার কিছু সাথি রয়ে গেলেন। পরে কাজানের বিশেষ ব্যক্তিরা তাঁর কাছে দলে দলে এসে দুয়া চাচ্ছিল। [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১৪/৮৯]
দুর্ধর্ষ তাতার বাহিনী আক্রমণের বিরুদ্ধে মুসলিমদেরকে প্রেরণা দানে ইবনু তাইমিয়ার ভূমিকা ছিল অনন্য। ৭০২ হিজরিতে কাশহাবের যুদ্ধে সৈন্যদের সারি এগিয়ে চলছে, এমনই সময় তিনি মুজাহিদদেরকে সাওম ভাঙার প্রয়োজনীয়তার উপর ফাতাওয়া দেন। কিন্তু তারা এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে থাকায়, ইবনু তাইমিয়া নিজেই তাদের সামনে সাওম ভাঙেন। এতে মুজাহিদরা আশ্বস্ত হয়ে সাওম ভাঙেন।

মাহমুদ কাজানের মৃত্যু হলে ক্ষমতায় আরোহণ করে তারই ভাই উলজাতু খুদাবান্দাহ। পরে সে নিজে ‘মুহাম্মাদ বিন আরগুন’ নাম গ্রহণ করে। সে ৭০৩ থেকে ৭১৬ হিজরি পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় আরোহণ করে সে প্রথমে মামলুকদের সাথে বিরোধ কমিয়ে আনে এবং মামলুকদের কাছে পত্র প্রেরণ করে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের আহ্‌বান জানায়। ফিতনা অপসারণ করে সন্ধি স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। পত্রের শেষের দিকে লেখা ছিল— “পূর্বে যা ঘটেছে আল্লাহ ক্ষমা করে দিন। আর পূর্বের অবস্থায় যে ফিরে যাবে আল্লাহ প্রতিশোধ নিবেন।” তার পত্রের জবাব দেওয়া হয় এবং দূতকে সসম্মানে হাদিয়াসহ বিদায় দেওয়া হয়। [আহমাদ ইবনু আলি মাকরিযি, আস-সুলুকু লিমা‘রিফাতি দুয়ালিল মুলুক: ২/৩৭৯]

কিন্তু একবছর যেতে না যেতেই এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। আর তা হলো উলজাতু শিয়া রাফিযিদের মতাদর্শ গ্রহণ করে। শিয়া ধর্মীয় নেতা ‘ইবনু মুতাহ্‌হার হুল্লি’র প্রভাবে সে এই মতাদর্শে দীক্ষিত হয়। মুহাম্মাদ বিন আরগুনের কাছে তার যথেষ্ট সম্মান ছিল। ফলে এ সুযোগে সে তাকে সুন্নিদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। এছাড়াও সে ‘কিতাবু মিনহাজিল কারামাহ’-র লেখক। আরগুন আরব-অনারব সর্বত্র শিয়া মতাদর্শ প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। এই নিকৃষ্ট জীবটি জুময়ার খুতবার ধরন পরিবর্তন করে দেয়। আলি রদিয়াল্লাহু আনহু ব্যতীত অন্যান্য খলিফাদের নাম মুছে দেয়। সুন্নি শাসকগোষ্ঠীর সাথে শত্রুতা শুরু করে। সুন্নিদের বিরুদ্ধে পথভ্রষ্ট খ্রিস্টানদের কাছে সাহায্য চায়। অবশেষে সে তার আসল রূপে ফিরে আসে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ শিয়া নেতা হুল্লির ‘কিতাবু মিনহাজিল কারামাহ’ গ্রন্থের প্রতিবাদে ‘মিনহাজুস সুন্নাতিন নাওয়ায়িইয়া ফি নাক্কি কালামিশ শিয়া ওয়াল কাদারিয়া’ শিরোনামে গ্রন্থ রচনা করেন। এতে তিনি শিয়া-রাফিযিদের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করে খুতবায় চার খলিফার নাম চালু করার কথা বলেন।

৭০২ হিজরি সনে মুহাম্মাদ বিন আরগুন সুন্নিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সিরিয়া আক্রমণ করে। তারা যখন দামিশকের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে তখন লোকেরা পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। এরই মধ্যে ইবনু তাইমিয়া এদের বিরুদ্ধে লোকদের উদ্‌বুদ্ধ করেন। তিনি লোকদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাতারদের বিরুদ্ধে আলোচনা করতে লাগলেন। এরপরেও লোকদের আস্থা অর্জন করতে পারছিলেন না। ফলে তিনি তাদের বললেন, “আমি মুসলিম সৈন্যদের সামনে গিয়ে জিহাদের আয়াত পাঠ করে তাদেরকে তাতারদের বিরুদ্ধে উদ্‌বুদ্ধ করব। প্রতিরোধের জন্য দুর্গ তৈরি করা হবে। তারা যদি আমাদের একটি একটি করে ইটও খুলে নেয় তবু আমরা তাদের কাছে মাথা নত করব না।” কিছু বিজ্ঞ লোকের পরামর্শে তিনি মিশরের সুলতান কালাবুনের সমর্থন ও সাহায্যের উদ্দেশে মিশরে যান। সেখানে সুলতান মুহাম্মাদ বিন কালাবুনকে বোঝাতে সক্ষম হন। সুলতান সেনা দিয়ে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন। গঠিত হয় মিশর ও সিরিয়ার সমন্বয়ে যৌথবাহিনী। কিন্তু সমস্যা হয় ফকিহগণের মাসআলায়। তারা বললেন, “আমরা কী করে তাতারদের বিরুদ্ধে লড়াই করব— অথচ তারা কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করেছে?” ইমাম ইবনু তাইমিয়া বলিষ্ঠ কণ্ঠে তাদের সংশয় দূর করে বলেন, ‘এরা তো সেই খারিজি সম্প্রদায়, যারা আলি রদিয়াল্লাহু আনহু ও মুয়াবিয়া রদিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল।” তিনি আরও বলেন, “যারা শরিয়তের মূলধারা থেকে বের হয়ে সালাত, সিয়াম ও অন্যান্য ইবাদাত পরিত্যাগ করেছে, তারা তো মুসলিম নয়। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা ওয়াজিব। আমি তাদের সৈন্যদের মাঝে প্রবেশ করে দেখেছি, তারা সালাত আদায় করে না। তারা চেঙ্গিজ খানের শিক্ষা ও আদর্শের রাষ্ট্র কায়েমের জন্য লড়াই করে। তোমরা যদি আমাকে তাদের পক্ষ হতে লড়াই করতে দেখ, তাহলে আমাকে হত্যা করবে, যদিও আমার মাথার উপর কুরআন থাকে।” [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১৪/২৪]

এই বজ্রকঠিন ভাষণ শুনে লোকেরা নতুনভাবে উজ্জীবিত হয় এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। দামিশকের ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণে ‘শাকহাব’ নামক স্থানে যুদ্ধ শুরু হলো। ইবনু তাইমিয়া ও তাঁর সাথীরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এই যুদ্ধে মিশরের আমির রুকনুদ্দিন বাইবার্স ও হুসামুদ্দিন লাজিন অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু মিশরীয় সৈন্যদের আসতে দেরি হওয়ায় অনেক মুসলিম দিশাহারা হয়ে পড়ে। ইবনু তাইমিয়া যুদ্ধের কৌশল হিশেবে দিক পরিবর্তন করেন। এতে কিছু মানুষ মনে করল, তিনি হয়ত যুদ্ধ থেকে পলায়ন করছেন! এজন্য লোকেরা বলাবলি শুরু করল— যিনি আমাদের পালাতে নিষেধ করলেন, তিনি নিজেই এখন পালাচ্ছেন!

এরই মধ্যে দিনের শেষ প্রান্তে দামিশকের আমির ফখরুদ্দিন আইয়ায এসে তাদের সুসংবাদ দিলেন যে, মিশরীয় ও সিরীয় সৈন্যদের একত্রিত হওয়ার সময় এসে গেছে। আগামী দিন জুময়াবার, তাতারদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত যুদ্ধ হবে। মিশরের সুলতান উপস্থিত হন। রামাদানের চাঁদ তাদের উঁকি দিচ্ছে। শাইখুল ইসলামের ইমামতিতে তারাবিহর সালাত আদায় করা হয়। পরের দিন শনিবার, সবাই আতঙ্কের মধ্যে সকাল কাটায়। আল্লাহর কাছে দুয়া করে। নারী ও শিশুরা ছাদে উঠে তাকবির ধ্বনি দেয়। শেষমেশ যুদ্ধ শুরু। যুদ্ধে আল্লাহর রহমতে তাতার সৈন্যরা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়। ইবনু তাইমিয়া বিজয় আনন্দে দামিশকে প্রবেশ করেন। বহু তাতার সমর্থক সঠিক ইসলামে ফিরে আসে। তারা মাসজিদ নির্মাণ করে সালাত আদায় শুরু করে। কিন্তু তিনি বাইরের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ শেষ করলেও ঘরের শত্রুদের বিরুদ্ধে তখনও যুদ্ধ চালিয়ে যান। ভেতরের গাদ্দারদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে তিনি একদল সেনা নিয়ে ‘লুবনান’ পাহাড়ের দিকে রওনা হন। তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেন। [আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১৪/২৩-২৬]

আল্লাহর দুশমন আরগুন ৭১২ হিজরিতে শামে আক্রমণ করে। আরগুন মারা গেলে তার ছোট ছেলে আবু সায়িদ ক্ষমতায় আসীন হন। তিনি বড় হওয়ার পরে তিনি সুন্নাত কায়েমের প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়ী হন এবং চার খলিফার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে খুতবা চালু করেন। [আদ-দুরারুল কামিনা: ৫/১১৩] চেঙ্গিজ, হালাকু, আরগুনের মতো তাতারদের পথেই হাঁটছে তাদেরই উত্তরসূরি বর্তমানের চীন।
.
|| ইমাম ইবনু তাইমিয়া যখন তাতারদের মুখোমুখি ||
—সাফওয়ান বিন বাসার
.

পঠিত : ৬১১ বার

মন্তব্য: ০