Alapon

"শবে বরাত নিয়ে : একটা প্রশ্ন কিছু কথা"




আমাদের শবে বরাত তো ঈদানীং জৌলুশ হারিয়েছে। তো যখন উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে আমাদের শবে বরাত পালিত হতো, তখন আমরা কী অর্জন করতে পেরেছি? বৃটিশদের গোলামির পূর্বেও এটা ভীষণ উদ্দীপনার সাথে পালিত হতো। এরপরেও হতো। অথচ খাইরুল কুরুনী তথা সর্বশ্রেষ্ট প্রজন্ম আসহাবে রাসুলগণ, তখন তো উৎসবের নামে এমন কিছু পালন ও লালন হতো না। অথচ দেখুন, তখন দিকে দিকে কী দারুণভাবেই না আমাদের বিজয় কেতন উড়েছে। অর্ধ্ব পৃথিবী আমাদের করতলগত হয়েছে। আর যখন আমাদের হাত থেকে আমরা আমাদের সর্বশেষ অংশটুকুনও হারিয়েছি; তখনও কিন্তু আমরা এই জৌলুশময় উৎসব পালন করতাম। এই যে এটার জৌলুশ হারিয়ে যাওয়া, এটা ইদানীংই হারিয়েছে।

মনে আছে, আমরাও ছোটোকালে গোসল করে মসজিদে যেতাম , জিলাপি হাতে নিয়ে বাড়ি আসতাম। আমাদের অনেক খেলার সাথি, আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব বাজি-পটকা ফোটাতো। মসজিদে গিয়ে হৈহুল্লোড় ও দৌড়াদৌড়ি করা হতো, নারিকেল গাছ-সুপারিশ গাছের ডগায় ডগায় অনেকেই চড়ে বেড়াতো।

এতো গেলো আমাদের কচিকিশোর থাকাবস্থার কথা, এদেশের একজন নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদও তাঁর সময়ের শবে বরাতের উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেছেন-
"আমি যখন ছোট ছিলাম তখনো শবে বরাত উৎসব হতো, এখনো হচ্ছে। তবে উৎসব পালন প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। একালের ছেলেমেয়েদের আমাদের সময়কার উৎসবটির কথা বলতে ইচ্ছে করছে।

আজ আইন করে পটকা ফুটানো নিষেধ করা হচ্ছে। আমাদের সময়ে এই আইনের প্রয়োজন হয়নি। এক সপ্তাহ আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় পটকার দোকান। ছোটদের প্রিয় ছিল তারাবাতি, কাঠির আগায় পটকা, মার্বেল পটকা। একটু বখাটে ধরনের ছেলেদের জন্যে মরিচ বাতি। কাঁচা মরিচ সাইজের হাউই। দেয়াশলাই-এ আগুন লাগাতে হয়–আগুন লাগানোমাত্র শাঁ করে আকাশে উড়ে যায়।

সে সময় ছেলেমেয়েদের বাবারা পটকা কিনে দিতেন। কিছু তারাবাতি, কিছু লাঠিপটকা, কিছু মার্বেল পটকা। মনে আছে, কাঠি-পটকা হাতে আমরা গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতাম। কিছুক্ষণ পর পর গোণা হতো–মোট কয়টা পটকা আছে। তারাবাতির প্যাকেট থাকত বুক পকেটে। যখন-তখন পকেট থেকে তারাবাতির প্যাকেট বের করে বাতির সংখ্যা গোণা ছিল অবশ্যকর্তব্যের একটি।

পটকার দোকানে মোমবাতিও বিক্রি হত। শবে বরাতের সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা। হালুয়ার ব্যাপারটা ছিল কিনা মনে পড়ছে না, হয়তো ছিল। তবে। গোশত-রুটির কথা মনে আছে। চালের আটার রুটি এবং প্রচুর ঝাল দিয়ে রাধা গরুর মাংস। ঝোলে কব্জি পর্যন্ত ডুবিয়ে রুটি খাওয়া শবে বরাতের অবশ্য করণীয় কর্মকাণ্ডের একটি।
রাতের খাওয়ার পরই গোসল। হাড় কনকনে শীতে গোসল সারতে হতো। গরম পানি না, পুকুরে। কারণ গোসল করে পাড়ে উঠার পর গা থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে যত ঘাস ভিজত তত সোয়াব। সোয়াব বাড়ানোর জন্যে ভেজা গায়ে ঘাসের উপর।" [ বই : সকল কাঁটা ধন্য করে]

তো এই যে এমন জৌলুশ হারানোই যদি উম্মাহর পতনের একটা কারণ হয়, আমাদের আত্মপরিচয় বিস্মৃত হবার উপাদান হয়, আমরা সেই জৌলুশ থাকাবস্থাতেই কেন আমাদের পতনের সাক্ষী হয়েছি? আসহাবে রাসুল কোন উৎসবের শক্তিতে আধা জাহান জয় করেছে? এসব বলে কি আমরা একটা ইসলামের মূল প্রাণসত্তাকেই হারিয়ে ফেলছি না? দ্বীনের প্রাণ সত্তা বুঝি উম্মাহর শ্রেষ্ট প্রজন্মরা যা করেনি তার মধ্যেই নিহিত?

আমার অনেক শ্রদ্ধেয় এবং স্নেহপরায়ন আদর্শিক-সহবস্থান সম্পন্ন ভাইয়েরাও দেখি ইদানীং এসব নিয়ে অতি আবেগধর্মী লেখালেখি করছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাঁরা বলতেছেন এটা হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, এটা ইবাদাত না। আমার কথা হচ্ছে, শবে বরাত কোন দৃষ্টিতে সংস্কৃতি হতে যাবে? শবে-বরাত মুবারাক বলে আবার নতুন করে সম্ভোধন প্রক্রিয়া চালু হচ্ছে, এটা কোন ধরনের সংস্কৃতি? শবে-বরাত কি আসলেই উৎসব-উদ্দীপনার দিবস? নাকি এটা ইবাদাতেরই দিবসই হতে পারে?

শবে-বরাত বা নিসফি মিন শাবান নিয়ে যদিও অনেকেই অনেক প্রান্তিকতার আশ্রয় নেয়, তবে সেটা ভিন্ন বিষয়। কারণ আমি এসব প্রান্তিকতার ধারেকাছেও কখনো ঘেঁসতে চাই না, যদিও মানবিক দুর্বলতার কারণে আমার মাঝেমধ্যে অনেকটা প্রকাশ হয়ে যায় বা চলে আসে! আমার কথা হচ্ছে, শবে বরাত সহীহ কি বেদ'আত আমি সেটার বিতর্কে না গিয়ে আমি মনে করি যে, সাধারণ যে মানুষগুলো এ রাতকে কেন্দ্র করে মসজিদে আসছে, অন্য সময় যেখানে ডেকেও মসজিদে আনা যায় না, সেখানে এসব মানুষদেরকে মসজিদে আসার পরে পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করে কুরান-সুন্নাহর বাণী শোনানোর কাজ আন্তরিকতার সাথেই করা উচিৎ ।

কিন্তু, একে বিদ'আত বলে পুরোদমে এগ্রেসিভ ওয়েতে প্রত্যাখ্যান করা, কিংবা একে ধর্মীয় দৃষ্টিতে বৈধতা দিতে না পেরে সংস্কৃতির নামে আরেকাট জাহিলিয়াতের পথকে প্রশস্ত করা কখনো কল্যাণ বয়ে আনে না। আপনি যদি একে সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করেন, তবে এই সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কার্যক্রমকেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর এসব করা মানেই দ্বীনের প্রাণ সত্তাকে ধীরে ধীরে খুইয়ে ফেলা। ইসলামকেও হিন্দু ধর্মের মতো অনেকটা উৎসব-সর্বস্ব ধর্মে পরিণত করে ফেলা।

আবারও বলি যে, এর উৎসব উদযাপনের পেছেনে "খাইরুল কুরূন" সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম সাহাবাদের থেকে শুরু করে তাবে'ঈ কিংবা তাবেতাবে'ঈ পর্যন্ত কারোই কোনো কর্ম বা সমর্থন নেই। এমনকি তাঁরা কেউ কাউকে দেখে এদিনে কোনো সম্ভোধন ( শবে বরাত মোবারক বা এমন কিছু) করেছেন বলে প্রমাণের ছিঁটেফোটাও নেই। তাঁরা ঈদ উপলক্ষ্যে একে অন্যকে সম্ভোধন করতেন, কিন্তু শবে বরাত বা নিসফি মিন শাবান উপলক্ষ্যে নয়।
আপনারা সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে পূর্বের সেই জাহিলিয়াত বা বিকৃতিগুলোকে প্রশ্রয় দেবেন না। আপনারা হয়তো ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই করেছেন বা বলতেছেন এসব, কিংবা সেক্যুলারদের মুখ আর মগজ থেকে বের হওয়া বাঙালি সংস্কৃতির বিকল্প হিসেবেই তাদের উসুল ফলো করে বা তাঁদের মগজে চিন্তা করেই বলতেছেন যে, আমাদেরও তাহলে আরো কিছু উৎসব লাগবে, আমাদেরও কিছু সংস্কৃতি লাগবে, যেটার নাম হবে বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি; ক্যান ভাই, কমিউনিস্ট-সেক্যুলারদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমাদেরকেও "বাঙালি মুসলিমদের সংস্কৃতি" নাম দিয়ে এমন একটা জিনিস বের করতে হবে কী কারণে? একজন নিখাঁদ মুসলিমের জন্যে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত রাসুল প্রদর্শিত সাংস্কৃতিক কার্যক্রমই যথেষ্ট নয়?

আপনারা যারা বলেন যে, দুর্গাপূজা, হলি উৎসব ছাড়া বাঙালি যুবকদের জন্য আর কোনো উৎসব থাকলো না; আমি বলতে চাই, একজন সচেতন মুসলিম ছেলে কি কখনো দুর্গোৎসবে শামিল হবে বা হয়েছে? আমাদের কাজ কি শুধু অমুসলিমদের অনুকরণে একটার পর একটা কপি-পেস্ট চিন্তা প্রয়োগ করা? নাকি সমস্যার মূলেই হাত দেয়া উচিৎ? আমাদের কি উচিৎ নয় ইসলাম সম্পর্কে, দ্বীনের বিধান সম্পর্কে, তাওহিদ আর শিরক সম্পর্কে যুবকদের জ্ঞান দান করা, সচেতন করা?? আমাদের এসব সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক উৎসব তো আগে আরো বেশি ছিলো, সেটা কি ইসলামের জন্যে উপকারী ছিলো?

পঠিত : ৩৮৪ বার

মন্তব্য: ০