Alapon

দ্য কাশ্মির ফাইলস: ভারতে মুসলিম হত্যাযজ্ঞের আয়োজনে দ্য ডেইলি স্টার যেভাবে যুক্ত হলো ~




ভারতে হালে একটি সিনেমা নিয়ে বেশ হইচই হচ্ছে। কাশ্মির ফাইল নামে সেই সিনেমাটি ইতোমধ্যে ভারতে ব্লকবাস্টার এবং বিপুল পরিমান আয় করেছ। সিনেমাকে তার আয় মাপার রেওয়াজ আছে বলে হিসাবে এই সিনেমাটিও বেশ আলোচনায় এসেছে। সিনেমাটিতে কাশ্মিরি এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিপুল ঘৃণা ছড়ানোর চিত্রও দেখা গেছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের দ্য ডেইলি স্টার একটি রিভিউ ভিডিও পোস্ট করেছে সিনেমাটি নিয়ে। রিভিউ না বলে একে চলমান ঘৃণায় ডেইলি স্টার ও এর উপস্থাপক সৈয়দ নাজমুস সাকিবের কন্ট্রিবিউশানই বলা ভালো। ( কমেন্টে দেখুন) এবং সেই সূত্র ধরেই এই আলোচনা। কাশ্মিরের আজাদির ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে কিছু নোকতা রাখা জরুরী মনে হলো।

সিনেমাটা যারা দেখেছেন তারা জানেন এটা একটা Genocide Call বা মুসলমদের বিরুদ্ধে গনহত্যার ডাক। ফলে হলে সিনেমা দেখার পর প্রকাশ্যে মুসলিমদের হত্যার স্লোগান দেয়া হয়েছে বলেও একাধিক সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।

পাশাপাশি এই সিনেমাতে সত্য বলে যা উপস্থাপন করা হয়েছে তারা ইতিহাসের প্রচন্ড এরকম বিকৃতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সত্যের বিপরীত- সে ব্যাপারে মোটাদাগে ইতিহাসবীদরা তো বটেই ডানপন্থী ইতিহাসবিদের একাংশ একমত।

আরএসএস ও বিজেপির প্রোপাগান্ডা এই সিনেমাটি ইতোমধ্যে বিজেপি শাসিন প্রায় সকল রাজ্যে করমুক্ত প্রচারের সুযোগ পেয়েছে এবং কিছু রাজ্যে সিনেমাটিকে হলে গিয়ে দেখার জন্য সরকারি কর্মচারিদেরও অর্ধ দিবস সময় ছুটি দিয়েছে। ফলে এটির উদ্দেশ্য নিয়ে আলাদা বর্নানার দরকার নেই।

কাহিনী সংক্ষেপ

কাশ্মির ফাইলস নামের এই সিনেমার কাহিনির কেন্দ্রবিন্দু প্রবীণ পণ্ডিত পুষ্করনাথ (অনুপম খের)। তাঁরই পরিবার, মেয়ে, ছেলে খুন হয় বলে দেখানো নয় সিনেমায়। একমাত্র নাতি কৃষ্ণ(দর্শন) বেঁচে থাকে। পুষ্করকে আশ্রয় নিতে হয় উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। এই কৃষ্ণ পরবর্তিতে ভর্তি হয় জেএনইউ-তে। ৩২ বছর পর দাদুর চিতাভস্ম শ্রীনগরের পরিত্যক্ত বাড়িতে কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হয় দাদুর বন্ধুদের। এঁদের কথোপকথনের মধ্য দিয়েই কাহিনী এগোয়। কাহিনী এটুকুই।

সিনেমাটি আদতে হিন্দুত্ববাদী ওয়ার্ল্ড ভিউয়ের একটা সিনেম্যাটিক প্রচার। অবশ্য এতে কোনো রাখ ডাক নেই। হিন্দিভাষি ওয়েবসাইট দ্য লাল্লানটপের এডিটর সৌরভ দ্বিভেদীর কাছে বেশ খোলামেলাই ছবির পরিচালক বিবেক অগ্নিহত্রী স্বীকার করেছেন যে ছবিটি আদতে একটা 'ন্যারেটিভ ওয়ারের অংশ' যেখানে তিনি লিবারেলদের শিক্ষা দিতে চান।

ছবিতে জহরলার নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষককে নিয়ে ঘৃণা আছে, মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা আছে, সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, উপস্থাপন, ইনটেনশন নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু আপাতত আমাদের ভাবনার বিষয় হলো- এরকম সিনেমা নিয়ে ডেইলি স্টারের উৎসাহ ক্যানো।

ছবিটির ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে বিস্তারিত কথা বলার আগে দ্য ডেইলি স্টারের রিভিউ বা প্রসংশার দিকে একটু মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। রিভিউটি শুনে প্রথমে মনে হয়েছে এটি আরএসএস পরিচালিত পত্রিকার কোনো অভিবাদন ক্লিপ।

সিনেমাটি নিয়ে যা বলতে চাচ্ছে দ্য ডেইলি স্টার

দ্য ডেইলি স্টারের সৈয়দ নাজমুস সাকিব নামের এক উপস্থাপক কাশ্মির ফাইলস নামে রিভিউয়ের শুরুতেই জাজমেন্ট দিয়ে বলছেন, "এটি একটি সত্য ঘটনা এই ঘটনাতে মিথ্যা কিছুই নেই (!)" এবং কোন ঘটনাটি সত্য সে ব্যাপারে কাহিনী পর্যালোচনার আগেই তিনি আসামি চিহ্নিত করে বলছেন "সে সময় শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞ করেছিলো সেখানকার মুসলিমরা(!)" এপরে সাকিব আবার বলছেন " এই সিনেমাটি বানানো হয়েছে অত্যাচারের শিকার পন্ডিতরা তার উপর, তারা কি পরিমান অত্যাচারের স্বীকার হয়েছিলো ঐ সময়কার মুসলিমদের দ্বারা " এভাবে লাগাতার দোষারোপের পরের অংশে এই উপস্থাপক কেবলই সিনেমাটির প্রসংশা করে গেছেন, যা সিনেমা পর্যালোচনার ইতিহাসেই বিরল এবং উপস্থাপকের চুরান্ত অশিক্ষার নিদর্শন।

দ্য ডেইলি স্টার যেভাবে সত্য বিকৃতিতে অংশ নিলো

সাকিব বারবার বলছেন " মুসলমানরা হত্যা করেছে"। কিন্তু এই তথ্যটি সাকিব, ডেইলি স্টার এবং আরএসএস ছাড়া অন্য কোনো ইতিহাসে নেই। এক্ষেত্রে বলে নেয়া ভালো কাশ্মিরের পন্ডিতদের উপর সে সময় যে সংহিসতা ঘটেছিলো তার কোনো জাস্টিফিকেশন থাকতে পারেনা এবং নেই। কাশ্মিরি মুসলিমরা এখনো তাদের পন্ডিত প্রতিবেশীদের অপেক্ষারত এবং তাদের পরিনতির জন্য দুঃখিত। কিন্তু আম ভাবে সাকিব যেভাবে হত্যাকারি হিসাবে তামাম মুসলিমদের উপস্থাপন করেছেন তা বিপজ্জনক তো বটেই ইতিহাসেরও বিকৃতি। ফলে সাকিব ও দ্য ডেইলি স্টারকে সংক্ষেপে কিছু ঘটনা জানতে হবে।

কন্টেক্সট ছাড়া ইতিহাস পাঠের সমস্যা

সবক শুরু করার আগে আমরা তৎকালীন কাশ্মিরের হালত নিয়ে একটু আলোচনা করলে বুঝতে সুবিধা হবে। কাশ্মিরে অন্যায্য ভাবে ভারতের নিয়ন্ত্রনে আছে ১৯৪৭ সাল থেকে। এটি আমার ব্যক্তিগত মত নয় বরং আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। এরপরে লম্বা সময় ধরে কাশ্মিরকে যেতে হয়েছে জুলুমের মধ্য দিয়ে।

কাশ্মির জুরে ভারতীয় আচরন এবং নিপিড়নের প্রবল হতাশার সেই পরিস্থিতে ১৯৮৭ কাশ্মিরে নির্বাচন ঘনিয়ে আসে। এই প্রথম বারের মত গঠিত হয় ‘ মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট’ নামে একটি যুক্তফ্রন্ট। এই ফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে করে এবং বলাই বাহুল্য বিপুল ভোটেই তারা জয়ের কাছাকাছি চলে যায়। এমন অবস্থা থেকে ভারতের তরফ থেকে প্রকাশ্য জালিয়াতি করে এমইউএফকে পরাজিত ঘোষনা করা হয় নির্বাচনে ।

এবং কংগ্রেস তার নিজের লোক ফারুক আব্দুল্লাকে নির্বাচনে বিজয়ী বানায় এবং এমইউএফের অনেক তরুণ নেতাকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন শুরু করে। এরপরেও এমইউএফ সাইয়েদ আলী শাহ গিলানি আর মিরওয়াইজ কাজি নিজারসহ বেশ কয়েকজন তরুন বিজয়ী হন এই নির্বাচনে। প্রচন্ড নিপীড়নে দ্রত পদত্যাগও করেন তারদ। কিন্তু এই নিপিড়ন এবং অসম্মান অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। ফলে তরুনরা এ সময় আন্দোলন শুরু করে বলা এই আন্দোলন বাধ্য হয়েই এক সময় সশস্ত্র হয়ে পরে।

হামিদ শেখ, আশফাক ওয়ানি, জাভেদ মীর ও ইয়াসিন মালিকদের মতো তরুণেরা সীমান্ত পার হয়ে জেকেএলএফ ( জাম্মু কাশ্মির লিবারেশন ফ্রন্ট) নামে সংগঠনে যুক্ত হয়। যারা নিজেদের পরিচয় দিত হাজি নামে (HAZY তাদের নামের প্রথম অক্ষর ধরে)। এই পর্যায় তারা পাকিস্তান থেকে কোনো সহযোগিতাই পায়নি। প্রাত একই সময় কাশ্মিরিদের উপরে নিপীড়ন বিপুল হারে বাড়তে থাকলে তরুন বিদ্রোহীরাও বেশ কিছু জবাবি হামলা করে।

এমন পরিস্থিতে ভারত নিজের পছন্দের ফারুক আব্দুল্লাহ সরকারকেও বরখাস্ত করে। এবং কাশ্মীরে গভর্নর শাসন জারি করে জাগমোহন মালহোত্রা নামে একজন হিন্দু ন্যাশনালিস্টকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয়। মুসলিম নিপিড়নে জাগমোহনের আগেই খ্যাতি ছিলো। এই নিয়োগের আগে তিনি দিল্লিতে মুসলিম বস্তির উপর বুলডোজার চালিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের ভরসার পাত্র হয়েছিলেন।

তার নিয়োগের পরেই কাশ্মীর জুড়ে ব্যাপক নিপীড়ন চলতে থাকে। এবং কাশ্মিরের গাওকাদালে বিক্ষোভকারীদের তার হাতেই গনহত্যার শিকার হতে হয়। যার রেশ পরবর্তীতে পন্ডিতদের হিযরতের কারন হয়ে দাড়ায়।

কাশ্মিরের রাজনৈতিক হালত কেমন ছিলো সে সম্পর্কে ধারনা দেয়া যেতে পারে একটি ঘটনার মাধ্যমে। মিরওয়াইজ কাশ্মিরের ধর্মীয় পদ। ঠিক এ সময় তৎকালীন মিরওয়াইজ মারা যান। তার জানাজার সময় লাখো মানুষের সমাগম হয়। সেখানেও ভারতীয় জগমোহনের নির্দেশে প্যারামিলিটারি হামলা করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কাশ্মীরিদের মধ্যে গেরিলাদের প্রতি সহানুভূতি বাড়তে থাকে।

এমন একটি অবস্থায়ই ঠিক কাশ্মিরি পন্ডিতদের ঢাল বানানো হয় ভারতের তরফ থেকে। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন আমরা যেই সময় নিয়ে আলাপ করছি যখন কাশ্মিরে কেন্দ্রের শাসন চলছিলো । বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর সেই কেন্দ্রিয় সরকারে সহযোগি ছিলো হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরী বিজেপি আর আরএসএস।

মুসলমানরা কি হিন্দুদের হত্যা করেছিলো ?

কাশ্মিরে সহিংসতার শুরু নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। এবং বোঝার চেষ্টা করেছি কিভাবে ভারতীয় শাসকরাই এই উপত্যাকায় অশান্তির আনজাম দিয়েছিলো। কিন্তু প্রশ্নটা হলো সিনেমা আর দ্য ডেইলি স্টার যেভাবে বলার চেষ্টা করছে- মুসলমানরা হিন্দুদের হত্যা করেছে তার সত্যটা কতটুকু ?

উত্তর হলো- আগাগোড়া মিথ্যা। মূলত এই ন্যারেটিভটিই হাজির হয়েছে কাশ্মিরিদের প্রতি ঘৃনা এবং তাদের প্রতি নিপিড়নের বৈধতা থেকে। মূলত কাশ্মিরি পন্ডিতদের উপর হামলার একটি পয়েন্ট ধরা হয় জেকেএলএফ প্রধান মকবুল ভাটকে ফাসির আদেশ দেয়া বিচারক নীলকান্থ গাঞ্জোকে হত্যা।

কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে এটি একটি রাজনৈতিক ঘটনা। এই হত্যার আগে পরে একাধিক মুসলিম নেতা হত্যার স্বীকার হয়েছে। অপ্রচলিত সেই যুদ্ধে পক্ষে বিপক্ষে নানান হত্যাকান্ড ঘটেছে। যার দশভাগের একভাগও ধর্মীয়ভাবে হিন্দু নয়। এবং এখন পর্যন্ত কাশ্মিরের বিভিন্ন জায়গায় পন্ডিতরা বাস করছে প্রতিবেশির মত। পাশাপাশি মকবুল ভাটের ফাসিও যে একটি বিচারিক হত্যাকান্ড এবং তার ফাসির ব্যাপারে অনেক বিচারিক নিয়মও মানা হয়নি সে ব্যাপারেও আজ কোনো সন্দেহ নেই।

ফলে রাজনৈতিক ঘটনাকেই হাজির করা হয়েছে হিন্দু-মুসলিম লড়াই হিসাবে। প্রশ্ন হলো- এটা তো আরএসএসের এজেন্ডা। ডেইলি স্টার এটা এডাপ্ট করলো কবে থেকে ?


নাম্বার গেম

প্রোপাগান্ডা এই সিনেমায় বারবার দেখানো হয়েছে এবং বলার চেষ্টা করা হয়েছে কাশ্মিরে গনহত্যা ঘটেছে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। পরিচালক বিবেক বলছে লম্বা এই সময়ে - নিহত পন্ডিতদের সংখ্যাটি চার হাজার। কিন্তু অফিশিয়ালি এই সংখ্যাটা দুইশ বিশের বেশি নয় এমনকি খোদ কাশ্মিরি পন্ডিতরা বলছে- সংখ্যাটি ছয়শের বেশি না। এবং নব্বইয়ের সেই সময়ে নিহত পন্ডিতদের সংখ্যা কোনো পরিসংখ্যানেই নব্বই পার করেনা। তাহলে ছবির এই সংখ্যাটি কোত্থেকে এলো? এবং এই বয়ানটি কিভাবে ডেইলি স্টারের এই উপস্থাপকের কাছে “ সবটাই সত্যি- কোনো মিথ্যা নেই হিসাবে’ বিবেচ্য হলো ?

কাদের হাতে খুন হয়েছিলো পন্ডিতরা ?


ডেইলি স্টারের সাকিব বললেন - ‘হত্যা করেছে মুসলিমরা’ম। এটা ছবিতেও প্রকাশ্যে বলা হয়নি। প্রথমত হত্যার কোনো বৈধতা থাকতে পারেনা। কিন্তু হত্যা এবং হিযরতের পার্থক্যে বুঝতে হবে। রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া একটি অপ্রচলিত যুদ্ধে সে সময় কাশ্মিরের পন্ডিতদের হিযরত করতে হয়েছিলো সে দায় কাশ্মিরের মুসলিমদের উপরে চাপানো সারাসার বদমায়শি।

বরং জেকেএলএফ এর নেতৃত্বও সেদিন ডিফেন্সিভ ভুমিকায় ছিলো যদিও পক্ষ হিসাবে তাদের দায় আছে। ‘হত্যা’ আর একটি চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মাঝে সহিংসাতার শিকার হওয়া এক নয়। সাকিবকে অপ্রচলিত যুদ্ধ, গনহত্যার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের সহিংসতা কি তা বুঝতে হবে, কেবল মুসলিম ঘৃণা করলেই হচ্ছেনা।

কাশ্মিরি মুসলিমরা এখনো পন্ডিতদের কবর জিয়ারত করে

সিনেমা এবং ডেইলি স্টারের বয়ানে যেভাবে 'হত্যাকারি' হিসাবে মুসলিমদের হাজির করা হলো তা যে কতটা দুর্ভাগ্যজনক বলার অপেক্ষা রাখেনা। কারন নাদিমারগের মত যেসব স্থানে পন্ডিতরা হত্যার শিকার হয়েছিলো সেইসব কবর এখনো আবাদ করে প্রতিবেশির হক আদার করে যাচ্ছেন কাশ্মিরিরা। এখনো আগলে রাখছেন পন্ডিতদের বসত ভিটা। তাহলে বিদ্বেষপূর্ন এই সিনেমা আর ডেইলি স্টারের প্রতিহিংসামূলক বয়ান উৎপাদনের ন্যায্যতা কি ?

ইতিহাসের চেরি পিকিং

জাগমোহন সে সময় কাশ্মিরের গভার্নর হবার পর কাশ্মিরের জুরে খন্ড খন্ড হত্যাযজ্ঞ হয়েছে বহু। কেবল ১৯৯০ সালের একটি ঘটনাতেই শ খানেক কাশ্মিরিকে মারা হয়েছে রাস্তায়। সিনেমায় একই সময়কার হিযরতের কাহিনি চিত্রায়িত করা হলেও কাশ্মিরে ঘটা এসব গনহত্যার কোনো জিকির নেই। ।

১৯৯১ এর ২৩ ফেব্রুয়ারির রাতে কাশ্মিরের কুপওয়ারা জেলার কুনান পোশপোরা গ্রামে প্রবেশ করে অসংখ্য নারীকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করা হয় সামরিক সদস্যদের দ্বারা । কাশ্মীরে ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ দিবস পালন করা হয়। এসব কিছুই নেই সিনেমায়৷ এরকম সিনেমা ডেইলি স্টারের ‘ সত্য- কোনো মিথ্যা নেই’ হিসাবে ভালো লাগলে বাংলাদেশীদের আশংকিত হবার দরকার আছে।

অভিনেতা নির্বাচনঃ যেন বিজেপির মঞ্চ নাটক

আবার সিনেমটির অভিনেতা নির্বাচনের দিকেও একটু মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। অনুপম খের বলিউডে বিজেপি ম্যান হিসাবেই পরিচিত। জেএনইউতে হামলা এন্টি মুসলিম প্রোপাগান্ডা সব কিছুতেই তার হাজিরানা আছে। ছবির আরেক অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী কিছুদিন আগেই ঘুরে ঘুরে পশ্চিম বঙ্গে বিজেপির হয়ে ভোট চেয়েছে। ফলে ছবিতে বিজেপির পছন্দের ন্যারেটিভকে হাজির করতে কোনো প্রশ্নের মুখেই পরতে হয়নি কাউকে।

প্রতিবাদকে সন্ত্রাস হিসাবে হাজির করা

ছবিতে মুসলমানদের দোষি করার চেষ্টা করা হয়েছে বারবার। এবং কাশ্মিরিদের বিভিন্ন প্রতিবাদের খন্ডচিত্রকে হাজির করা হয়েছে সন্ত্রাস হিসাবে। এটা স্পষ্টতই কাশ্মিরিদের ন্যায্য লড়াইকে খল হিসেবে হাজির করার চেষ্টা। বলার অপেক্ষা রাখেনা এই চেষ্টাটি করা হয় বহু যুগ থেকে কাশ্মিরিদের উপর নিপিড়িনের বৈধতা দানের জন্য। আন্তর্জাতিক মানবাধিকরা সংস্থাগুলোও কাশ্মিরিদের উপর ক্রামাগত জুলুমে নথি রাখছে।

মুসলিম এবং মুক্তমতের উপর ঘৃণা

কাশ্মির ফাইলস সিনেমাটিতে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়কে ( সিনেমায় নাম দেয়া হয়েছে -এএনইউ ) দেখানো হয়েছে ভিলেন হিসাবে। বিশ্ববিদ্যালয়টির অপরাধ যে তারা বিভিন্ন সময়ে কাশ্মিরিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে দাড়িয়েছে। এটি কেবল মাত্র একটি ন্যারেটিভের লড়াই হিসাবে দেখলে চলবেনা। বরং অসহিণষতার মুহুর্তে অন্যায়ার প্রতিবাদের ভাষাগুলোকেই রুদ্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের খল হিসাবে হাজির করা মোটাদাগে মানে একটি সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে উস্কানি দেয়ার শামিল।

খোদ কাশ্মিরি পন্ডিতদের অভিযোগ

সিনেমাতে রবি খান্না নামের এক ভারতীয় বিমান বাহীনি কর্মকর্তাকে দৃশ্যায়িত করা হয়েছে। যেখানে তাঁর স্ত্রীর অভিযোগ করেছেন, তাঁর পরিবার এই মুভির উদ্দেশ্য বিষয়ে একমত নয়।

যে কারনে উদ্বিগ্ন হতেই হয়

ভারতে এই মুহুর্তে জাতিগত হত্যাযজ্ঞের আয়োজন চলছে সে ব্যাপারে নোম চমস্কির মত বৈশ্বিক চিন্তাবিদরাও আতংকিত এবং উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন প্রদেশে বিজেপি রাজনৈতিকভাবে সফলতা লাভ করছে স্রেফ তারা মুসলিমদের শায়েস্তা করবে এই প্রতিশ্রুতির উপরে।

দ্য কাশ্মির ফাইলস নামের অতিরঞ্জিত কাহিনীর এই মুভির নামে ইতোমধ্যেই নানান প্রেক্ষাগৃহে মুসলিমদের প্রতি হত্যাযজ্ঞের স্লোগানের কথাও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। এমনকি কাশ্মির ফাইলস নামের এই সিনেমাটি প্রদর্শিত হবার পরে কাশ্মীরি শিক্ষার্থীদের প্রতি সহিংসতারও একাধিক খবর এসেছে।

এমন একটি অবস্থায় মুক্তমত ও প্রতিবাদের ভাষাগুলোকে ভিলেন হিসাবে চিত্রায়িত করা এবং তাদের অবস্থানকে নেতিবাচক হিসাবে হাজির করা নাৎসি জার্মানির লেনি রিফেনস্টালের মত পরিচালকদের কথাই স্বরন করায়। যারা চলচিত্রের মাধ্যমে লাখো মানুষের হত্যার আয়োজন করেছিলো। এর পরিনতি ছিলো হলোকাস্ট।

সুতরাং এরকম একটি সিনেমা দ্য ডেইলি স্টারের মনে ধরলে এবং তাকে ফ্যাক্ট হিসাবে প্রচার করলে জাতিগতভাবে আমাদের আতংকিত হবার দরকার আছে। কারন এর মধ্যে দিয়ে তারা মুসলিম বিরোধী গনহত্যার আয়োজনেরই অংশিদার হলো। আসন্ন এক মুসলিম বিরোধী হত্যাযজ্ঞের ভাগিদারি করলো।

পঠিত : ৩৫৫ বার

মন্তব্য: ০