Alapon

খোলাফায়ে রাশেদীনের চার খলিফার ঐতিহাসিক কিছু ভাষণ



মসজিদে নববীতে গণ বায়আত ও সপথের পর হযরত আবুবকর (রাঃ) যে ভাষণ দান করেন, তাতে তিনি বলেছিলেনঃ
“আমাকে আপনাদের শাসক নিযুক্ত করা হয়েছে, অথচ আমি আপনাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। সে সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার জীবন ন্যস্ত, আমি নিজে ইচ্ছা করে এ পদ গ্রহণ করিনি। অন্যের পরিবর্তে আমি নিজে এ পদ লাভের চেষ্টাও করিনি, এ জন্য আমি কখনো আল্লার নিকট দোয়াও করিনি। এ জন্য আমার অন্তরে কখনো লোভ সৃষ্টি হয়নি। মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ এবং আরবদের মধ্যে ধর্ম ত্যাগের ফেতনার সূচনা হবে- এ আশংকায় আমি অনিচ্ছা সত্ত্বে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এ পদে আমার কোন শান্তি নেই। বরং এটা এক বিরাট বোঝা, যা আমার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। এ বোঝা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই। অবশ্য আল্লাহ যদি আমার সাহায্য করেন। আমার ইচ্ছা ছিল, অন্য কেউ এ গুরুদায়িত্ব- ভার বহন করুক। এখনও আপনারা ইচ্ছা করলে রাসুলুল্লা (সঃ)- এর সাহাবীদের মধ্য হতে কাউকে এ কাজের জন্য বাছাই করে নিতে পারেন। আমার বায়আত এ ব্যাপারে আপনাদের প্রতিবন্ধক হবে না। আপনারা যদি আমাকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)- এর মানদন্ডে যাচাই করেন, তাঁর কাছে আপনারা যে আশা পোষণ করতেন, আমার কাছেও যদি সে আশা করেন, তবে তার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ, তিনি শয়তান থেকে নিরাপদ ছিলেন, তাঁর ওপর ওহী নাযিল হতো। আমি সঠিক কাজ করলে আমার সহযোগিতা করবেন, অন্যায় করলে আমাকে সোজা করে দেবেন। সততা হচ্ছে একটি আমানত-গচ্ছিত ধন। আর মিথ্যা একটি খেয়ানত-গচ্ছিত সম্পদ অপহরণ্ তোমাদের দুর্বল ব্যক্তি আমার নিকট সবল। আল্লার ইচ্ছায় যতক্ষণ আমি তার অধিকার তাকে দান না করি। আর তোমাদের মধ্যকার সবল ব্যক্তি আমার নিকট দুর্বল-যতক্ষণ আল্লার ইচ্ছায় আমি তার কাছ থেকে অধিকার আদায় করতে না পারি। কোনজাতি আল্রার রাস্তায় চেষ্টা সাধনা ত্যাগ করার পরও আল্লাহ তার ওপর অপমান চাপিয়ে দেননি-এমনটি কখনো হয়নি। কোন জাতির মধ্যে অশ্লীলতা বিস্তার লাভ করার পরও আল্লাহ তাদেরকে সাধারণ বিপদে নিপতিত করেন নাএমনও হয় না। আমি যতক্ষণ আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)- এর অনুগত থাকি, তোমরা আমার আনুগত্য করো। আমি আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)- এর নাফরমানী করলে তোমাদের ওপর আমার কোন আনুগত্য নেই। আমি অনুসরণকারী, কোন নতুন পথের উদ্ভাবক নই।” [আততাবারী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৫০। ইবনে হিশাম, আস সীরাতুন নববিয়্যা, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩১১, মাতবাআতু মুস্তফা আল-বারী, মিসর- ১৯৩৬, কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং- ২২৬১, ২২৬৪, ২২৬৮, ২২৭৮, ২২৯১, ২২৯৯।]
সিরিয়া ও ফিলিস্তিন যুদ্ধে হযরত আমর ইবনুল আ’স (রাঃ)-কে প্রেরণ কালে হযরত আবুবকর (রাঃ)- যে হেদায়াত দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
“আমার! আপন প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সকল কাজে আল্লাকে ভয় করে চলো। তাঁকে লজ্জা করে চলো। কারণ, তিনি তোমাকে এবং তোমার সকল কর্মকেই দেখতে পান। ………….পরকালের জন্য কাজ করো। তোমার সকল কর্মে আল্লার সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ্য রেখো। সঙ্গী-সাথীদের সাথে এমনভাবে আচরণ করবে, যেন তারা তোমার সন্তান। মানুষের গোপন বিষয় খুঁজে বেড়িয়ো না। বাহ্য কাজের ভিত্তিতেই তাদের সঙ্গে আচরণ করো। ……. নিজেকে সংযত রাখবে, তোমার প্রজা সাধারণও ঠিক থাকবে।” [কানযুল ওম্মাল, ৫ম খন্ড, হাদীস নঙ- ২৩১৩।]

হযরত ওমর (রাঃ) তাঁর এক ভাষণে বলেনঃ
“লোক সকল। আল্লার অবাধ্যতায় কারোর আনুগত্য করতে হবে- নিজের সম্পর্কে এমন অধিকারের দাবী কেউ করতে পারে না। ….. লোক সকর। আমার ওপর তোমাদের যে অধিকার রয়েছে, আমি তোমাদের নিকটতা ব্যক্ত করছি। এসব অধিকারের জন্য তোমরা আমাকে পাকড়াও করতে পারো। আমার ওপর তোমাদের অধিকার এই যে, খেরাজ বা আল্লার দেয়া ‘ফাই’ (বিনা যুদ্ধে বা রক্তপাত ছাড়াই যে গনীমাতের মাল লব্ধ হয়) থেকে বেআইনীভাবে কোনো কিছু গ্রহণ করবো না। আর আমার ওপর তোমাদের অধিকার এই যে, এভাবে যে অর্থ আমার হাতে আসে, অন্যায়ভাবে তার কোন অংশও আমি ব্যয় করবো না।” [ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা- ১১৭।]


বায়আতের পর হযরত ওসমান (রাঃ) প্রথম যে ভাষণ দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
“শোন, আমি অনুসরণকারী, নতুন পথের উদ্ভাবক নই। জেনে রেখো, আল্লার কিতাব এবং রাসূল (সঃ)-এর সুন্নাহ মেনে চলার পর আমি তোমাদের নিকট তিনটি বিষয় মেনে চলার অঙ্গীকার করছি। একঃ আমার খেলাফতের পূর্বে তোমরা পারস্পরিক সম্মতিক্রমে যে নীতি নির্ধারণ করেছো, আমি তা মেনে চলবো। দুইঃ যেসব ব্যাপারে পূর্বে কোন নীতি-পন্থা নির্ধারিত হয়নি, সেসব ব্যাপারে সকলের সাথে পরামর্শক্রমে কল্যাণভিসারীদের পন্থা নির্ধারণ করবো। তিনঃ আইনের দৃষ্টিতে তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে না পড়া পর্যন্ত তোমাদের ওপর হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবো।” [আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৪৪৬।

হযরত আলী (রাঃ) হযরত কায়েস ইবনে সা’দকে মিসরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠাবার কালে মিসরবাসীদের নামে যে ফরমান দান করেন, তাতে তিনি বলেনঃ
“সাবধান! আমি আল্লার কিতাব এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর সুন্নাহ মুতাবিক আমল করবো- আমার ওপর তোমাদের এ অধিকার রয়েছে। আল্লার নির্ধারিত অধিকার অনুযায়ী আমি তোমাদের কাজ-কারবার পরিচালনা করবো এবং রাসুলুল্লার সুন্নাহ কার্যকরী করবো। তোমাদের আগোচরেও তোমাদের কল্যাণ কামনা করবো।”
প্রকাশ্য জনসমাবেশে এ ফরমান পাঠ করে শোনাবার পর হযরত কায়েস ইবনে সাআ’দ ঘোষণা করেনঃ “আমি তোমাদের সাথে এভাবে আচরণ না করলে তোমাদের ওপর আমার কোন বায়আত নেই।” [আততাবারী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা- ৫৫০-৫৫১।]
হযরত আলী (রাঃ) জনৈক গবর্ণরকে লিখেনঃ
“তোমরা এবং জনসাধারণের মধ্যে দীর্ঘ প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করো না। শাসক ও শাসিতের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা দৃষ্টির সংকীর্ণতা এবং জ্ঞানের স্বল্পতার পরিচায়ক। এর ফলে তারা সত্যিকার অবস্থা জানতে পারে না। ক্ষুদ্র বিষয় তাদের জন্য বৃহৎ হয়ে দাঁড়ায়, আর বিরাট বিষয় ক্ষুদ্র। তাদের জন্য ভাল মন্দ হয়ে দেখা দেয়, আর মন্দ গ্রহণ করে ভালর আকার; সত্য-মিথ্যা সংমিশ্রিত হয়ে যায়।” [ইবনে কাসীর, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৮।]

বইঃ খেলাফত ও রাজতন্ত্র
সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (রঃ)

পঠিত : ৫৯১ বার

মন্তব্য: ০