Alapon

একজন মুমিন যেভাবে প্রজ্ঞাবান হবেন...?



পূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশাজ্জ ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহুর দুটো গুণ পছন্দ করেন। দুটো গুণের মধ্যে একটি হলো ‘হিলম’। হিলম শব্দের দুটো অর্থ হয়। সেই দুই অর্থ দুটো গুণ বুঝায়। সেগুলো হলো:

প্রজ্ঞা
রাগ নিয়ন্ত্রণ


আজ আমরা প্রজ্ঞা নিয়ে কথা বলবো। প্রজ্ঞা হলো এমন এক গুণ, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পছন্দ করেন। এটা মুমিনের আখলাকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর গুণবাচক নামগুলোর মধ্যে একটি নাম হলো ‘আল-হাকিম’; যার মানে হলো প্রজ্ঞাবান।

প্রজ্ঞার আরবি শব্দ হলো ‘হিকমাহ’। যে জিনিস যেখানে থাকার কথা, সেখানে রাখা বুঝাতে আরবরা হিকমাহ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। আলেমগণ হিকমাহর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন- “কোনো কিছু এমনভাবে করা, যার ফলে ক্ষতি কমানো যায় এবং লাভ বাড়ানো যায়।” অর্থাৎ, দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য এমনকিছু করা, যার ফলে দুনিয়া ও আখিরাতে লাভ হয় বেশি, ক্ষতি হয় কম।

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন: “তিনি যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করেন এবং যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়, সে নিশ্চয়ই প্রচুর কল্যাণ লাভ করে।” [সূরা বাকারা ২: ২৬৯]

আল্লাহ লুকমান আলাইহিস সালামকে প্রজ্ঞা দান করেন। আল্লাহ বলেন: “আমি লুকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছিলাম আর বলেছিলাম, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকো।” [সূরা লুকমান ৩১: ১২]

আল্লাহ যাকে ইচ্ছে তাকে হিকমাহ দান করতে পারেন। এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, আল্লাহ যেহেতু আমাকে হিকমাহ দান করেননি, আমার করার কী আছে?

আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি যে, চরিত্রের কিছু অংশ আল্লাহ দান করেন, কিছু অংশ অর্জন করে নিতে হয়। আল্লাহ আপনাকে হিকমাহ দান করেননি মানে এই না যে আপনি সেটা অর্জন করতে পারবেন না।

প্রত্যেকের যেমন শক্তিমত্তা আছে, তেমনি দুর্বলতা আছে। একেকজনকে আল্লাহ একেকভাবে সৃষ্টি করেছেন। তার মানে এই না যে, আপনাকে যে গুণ দেয়া হয়নি সেটা অর্জনের চেষ্টা করবেন না। আপনার মধ্যে যদি কোনো চারিত্রিক গুণ না থাকে, তাহলে আপনি সেটা অর্জনের চেষ্টা করবেন। একইভাবে আমরা হিকমাহ বা প্রজ্ঞার গুণও অর্জন করতে পারি। কিভাবে? কুরআনের একটি আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে দাওয়াত দেবার পদ্ধতি বলে দেন।

সেই আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ দেন- “তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে মাধ্যমে আহ্বান করো এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক করো। নিশ্চয়ই একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভালো করেই জানেন।” [সূরা আন-নাহল ১৬: ১২৫]

যদি এমন হতো যে, প্রজ্ঞার গুণ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আমরা সেই গুণ অর্জন করতে পারবো না, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে এভাবে বলতেন না। আল্লাহ যেহেতু আমাদেরকে বলেছেন প্রজ্ঞার সাথে দাওয়াত দিতে, সেহেতু এই গুণ আমাদের মধ্যে না থাকলেও আমরা সেটা অর্জন করতে পারি।

হিকমাহর অনেকগুলো ভাগ আছে। সেগুলো হলো:

১। দ্বীনের ব্যাপারে হিকমাহ:
শ্রেষ্ঠ হিকমাহ হলো দ্বীনের ব্যাপারে হিকমাহ। দ্বীনের ব্যাপারে হিকমাহ মানে হলো- শরীয়তে যেভাবে বলা আছে, সেভাবে জীবনযাপন করা। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “প্রজ্ঞার মূল ভিত্তি হলো আল্লাহকে ভয় করা।” [ইমাম বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান: ৭১২]

যখন আপনি বুঝবেন কে আপনাকে সৃষ্টি করছেন, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কী কী করতে হবে, সেটা হবে শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞা।

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন: “নিশ্চয় তাওবা কবুল করা আল্লাহর জিম্মায় তাদের জন্য, যারা অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে। তারপর শীঘ্রই তাওবা করে। অতঃপর আল্লাহ এদের তাওবা কবুল করবেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা আন-নিসা ৪: ১৭]

সাহাবীগণ বলতেন: “আল্লাহর বান্দা যে গুনাহের কাজ করে, তা তারা না জানার কারণে অজ্ঞতাবশতই করে।” [তাফসীরে তাবারী: ৮/৮৯]

সাহাবীগণ আরো বলতেন: “বান্দা যে গুনাহই করুক, সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবেই করা হোক না কেনো, সেটা তারা অজ্ঞতাবশত করে।” [তাফসীর ইবনে কাসির: ২/৩০৯]

আপনি যদি আল্লাহর আদেশ, নির্দেশ মেনে চলেন, তাহলে আপনি প্রজ্ঞাবান। আর আপনি যদি আল্লাহর আদেশ অমান করেন, তাহলে আপনি অজ্ঞ। এখানে, প্রজ্ঞার বিপরীত হলো অজ্ঞতা।

২। মানবজাতির সাথে হিকমাহর সহিত আচরণ

আপনি যখন কারো সাথে কথা বলবেন, লেনদেন করবেন, তখন হিকমাহর সাথে করবেন। আপনি আপনার শত্রুর সাথেও হিকমাহর সাথে আচরণ করবেন। হিকমাহর প্রয়োগের ফলে আপনার সম্পর্ক গড়তে পারে, হিকমাহর অভাবে সম্পর্ক ভাঙ্গতে পারে। অনেক সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবার মূল কারণ হলো হিকমাহর সাথে আচরণ না করা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, অফিসের কর্মকর্তা-মালিকের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় হিকমাহর সাথে কাজ না করার ফলে।

৩। হিকমাহর সাথে ব্যবসা করা

ব্যবসা করার ক্ষেত্রে হিকমাহর প্রয়োজন। আপনি যখন কিছু কিনবেন, তখন বুঝেশুনে কিনবেন। যখন কিছু বিক্রি করবেন, তখনও বুঝেশুনে বিক্রি করবেন।

এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে আমরা হিকমাহ অর্জন করতে পারি? কিভাবে আমরা প্রজ্ঞাবান হতে পারি?

১। আল্লাহর কাছে চাইতে হবে

যেকোনো কিছু পেতে হলে সবার আগে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে। আপনি যদি আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কাছে চান, আল্লাহ আপনাকে দান করবেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করেন- “হে আল্লাহ! আপনি তাঁকে হিকমাহ শিক্ষা দিন।” [সহীহ বুখারী: ৩৭৫৬]

তখন এমন না যে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু জন্মগ্রহণ করেননি বা তিনি ছোটো ছিলেন। তিনি তখন কিশোর ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই অবস্থায় তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করেন, আল্লাহ যেন তাঁকে হিকমাহ শিক্ষা দেন, তাঁকে যেন প্রজ্ঞাবান বানান।

ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে দু’আ করেন- ‘রাব্বি হাবলি হুকমা’। অর্থাৎ-
“হে আল্লাহ! আমাকে হিকমাহ দান করুন।” [সূরা আশ-শুআরা ২৬: ৮৩]

২। জ্ঞানার্জন করা

আপনি যদি প্রজ্ঞার গুণ অর্জন করতে চান, আপনাকে জ্ঞানার্জন করতে হবে। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আপনি প্রজ্ঞাবান হতে পারেন।

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে একটি দু’আর উল্লেখ করেন: “হে আমাদের রব! তাদের মধ্যে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদেরকে আপনার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দিবেন; আর তাদেরকে পবিত্র করবেন।” [সূরা বাকারা ২: ১২৯]

আমরা কুরআন ও সুন্নাতের জ্ঞানার্জন করে দ্বীনের প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারি। অন্যান্য বিষয়ের বইপত্র পড়ে সেসবের প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারি।

৩। অভিজ্ঞতা

উমাইয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: “অভিজ্ঞতা ছাড়া প্রজ্ঞা অর্জন করা যায় না।” অনেকসময় দেখবেন কিশোর-যুবকরা কোনো কিছু ভাবনা-বিচার ছাড়াই একটি কাজ করে। কারণ, তাদের অভিজ্ঞতা নেই। অন্যদিকে, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষরা হুট করে ভাবনা-চিন্তা ছাড়া কোনো কাজ করে না।

অভিজ্ঞতা আপনাকে এমন কিছু শেখাবে, যা বই শেখাতে পারবে না।

৪। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে

আপনি যদি খোলা মনে কোনো কিছু পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে সেখান থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবেন। আপনার আশেপাশের সমাজ, মানুষের কাছ থেকে প্রজ্ঞা শিখতে পারবেন। তাদেরকে দেখে বুঝতে পারবেন কিভাবে প্রজ্ঞার সাথে কোনো কাজ করতে হয়। কিন্তু, আপনি যদি অহংকারী হন, তাহলে আপনার দ্বারা হবে না। আপনি শিখতে পারবেন না।

আমাদের পূর্ববর্তী আলেমগণ বলতেন: “প্রজ্ঞবান সে, যে অন্যের ভুল দেখে শিখে; অন্যরা তার ভুল দেখে শেখার আগে।”

একই ভুল একজন করেছে। আপনি শিখেছেন। আপনি সেই ভুল করেননি। কিন্তু, আপনিও যদি একই ভুল করেন, তাহলে তো আপনি প্রজ্ঞাবান হলেন না। আপনি যদি দ্বীনি ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাবান হতে চান, তাহলে প্রজ্ঞাবান আলেমের সাহচর্যে থাকুন। আপনি যদি ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাবান হতে চান, তাহলে প্রজ্ঞাবান ব্যবসায়ীর সাথে থাকুন।

৫। ইতিহাস পাঠ

আপনি ইতিহাস পড়লে মানব জাতির উত্থান পতনের কাহিনী সম্পর্কে জানতে পারবেন। আপনি বুঝতে পারবেন কী করার ফলে কোন জাতির বা কোন ব্যক্তির পতন হয়েছে এবং কিসের ফলে কোনো জাতি বা কোনো ব্যক্তি সফল হয়েছেন। আপনার বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে ইতিহাস পাঠ সহায়ক হবে। আপনি অতীতের সাথে বর্তমানের মিল খুঁজে পাবেন।

ড. ইয়াসির ক্বাদি

পঠিত : ৩৯৯ বার

মন্তব্য: ০