Alapon

আপন আলোয় উদ্ভাসিত শেরে বাংলা


কলকাতায় নিজের অফিসে মামলার বাদীর সাথে আলাপ করছিলেন বিশালদেহী প্রখ্যাত বাঙ্গালি আইনজীবী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। যিনি হক সাহেব নামে সাধারণ মানুষের নিকট সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিলেন। এমন সময় তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আজিজুল হক শাহজাহান তড়িঘড়ি করে কক্ষে প্রবেশ করলেন। তিনি দ্যা হিন্দু পত্রিকা ফজলুল হকের সামনে রেখে রাগান্বিত হয়ে বললেন দেখুন কী লিখেছে! আপনি নাকি মুসলমান কৃষকদের ইংরেজদের কর দিতে নিষেধ করেছেন? সরকারি তহবিল হতে মুসলিম ছাত্রদের জন্য অপ্রয়োজনীয় হোস্টেল নির্মাণে করেন? পত্রিকায় পাতায় চোখ বুলিয়ে শেরে বাংলার মুখে মৃদু হাসির রেখা দেখা গেলো। তিনি বললেন, ‘ওরা আমার বিরুদ্ধে লিখেছে তার মানে হল আমি আসলেই পূর্ব বাংলার মুসলমান কৃষকদের জন্য কিছু করতে পেরেছি। যেদিন ওরা আমার প্রশংসা করবে সেদিন মনে করবে বাংলার কৃষকেরা বিপদে আছে।’

অবিভক্ত বাংলার প্রথম সর্বভারতীয় প্রভাবশালী মুসলিম নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। ১৯৪০ সালের ২২ থেকে ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরের ইকবাল পার্কে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। হঠাৎ সভাকক্ষে গুঞ্জন শুরু হলো, জিন্নাহ লক্ষ্য করলেন তাঁর বক্তব্যের দিকে কারো মনোযোগ নাই। তিনি ভাবলেন ঘটনা কী? এবার তিনি দরজার দিকে তাঁকালেন, দেখলেন সভাকক্ষে প্রবেশ করছেন এ. কে. ফজলুল হক। তিনি বুঝতে পারলেন প্রধান অতিথি চলে এসেছেন, তাই তার বক্তব্য শেষ করা উচিত। জিন্নাহ তখন বলেছিলেন, ‘When the tiger arrives, the lamb must give away.’ এই সম্মেলনে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর পশ্চিমাঞ্চালে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র এবং পূর্বাঞ্চালে বাংলা ও আসাম নিয়ে আরেকটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী করেন। যা ইতিহাসে লাহোর প্রস্তাব নামে খ্যাত। পরবর্তী সময়ে জিন্নাহ-সোহ্‌রাওয়ার্দী ষড়যন্ত্রের ফলে এই প্রস্তাব পাকিস্তান প্রস্তাব নামে রূপধারণ করে। জিন্নাহ বলেন, ‘প্রস্তাবটি টাইপ করার সময় ভুল করে Muslim majority states লেখা হয়েছে; আসলে হবে state। জিন্নাহর এই ধূর্ততার কারণে এ. কে. ফজলুল হক পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত হননি। তিনি বলেন, ‘জিন্নাহ আমার লাহোর প্রস্তাবের খাতনা করে ফেলেছে।’ মুসলিম লীগের অধিবেশনে এ. কে ফজলুল হক ভারতবর্ষের মুসলমানদের শোষণ-নির্যাতন সম্পর্কে উর্দুতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রদান করেন। তাঁর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে পাঞ্জাববাসী তাঁকে ‘শের-ই-বঙ্গাল বা বাংলার বাঘ’ উপাধি দিয়েছিলেন।

'জ্ঞানতাপস প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক এ. কে. ফজলুল হকের জীবনী লিখতে চান জেনে তিনি বলেছিলেন, ‘রাজ্জাক, সত্যি বলো, তোমার মতলবটা আসলে কী?’ প্রফেসর রাজ্জাক বললেন, ‘আমার এই বিষয়টা খুব ভালো লাগে--- আপনি যখন ইংরেজদের সাথে চলেন তখন মনে হয় আপনি জাত ইংরেজ। যখন বরিশালে আসেন মনে হয় আপনি বহুবছর ধরে নিজেই কৃষিকাজ করেন। আবার যখন কলকাতায় শ্যামাপ্রসাদ বাবুকে ভাই বলে ডাক দেন তখন আপনাকে আসলেই হিন্দু মনে হয়। আবার যখন ঢাকার নবাব বাড়িতে ঘুড়ি উড়ান তখন মনে হয় আপনিও নবাব পরিবারের একজন। নিজেকে কেউ আপনার মত এত পাল্টাতে পারে না। আপনি যাই বলেন, সত্য হোক, মিথ্যা হোক, মানুষ বিনা দ্বিধায় তা বিশ্বাস করে।’
'রাজ্জাক তুমি আমার মত পাল্টানো দেখলা কিন্তু আমার লক্ষ্য যে স্থিত সেটা দেখলা না! যুবক বয়সে একদিন বরিশালের দেহেরগতিতে খেয়া পার হচ্ছি। ওখান থেকে আমার গ্রামের বাড়ি খুব দূরে নয়। অনেকদিন বাদে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা হবে তাই মন ছিল উৎফুল্ল। খেয়া নৌকা থেকে নেমে সামান্য এগতেই একটা শিশুকণ্ঠে তীব্র কান্নার আওয়াজ কানে এলো। তাকিয়ে দেখি, কিছুটা দূরে নদীতীরের একটা কুঁড়েঘরের সামনে ছোটখাটো ভিড়। মনে হল শিশুর কান্নার শব্দটা ওখান থেকেই আসছে। কৌতূহলী হয়ে জোরে পা চালিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই কুঁড়েঘরের সামনে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম, গরিব পরিবারের সংসারের যা কিছু সম্বল- সামান্য টিনের তোরঙ্গ থেকে শুরু করে তৈজসপত্র, থালা বাসন, ঘটি বাটি, বালতি কড়াই, লাঙল, কোদাল, কাস্তে প্রভৃতি সমস্ত কিছু উঠোনের এক পাশে জড়ো করা রয়েছে। আর, সাত-আট বছরের একটি শিশু মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তার খালি গা। তবে দু’হাত দিয়ে শক্ত করে বুকে চেপে রেখেছে ছোট্ট একটা কাঁসার থালা। ওই থালাটি কেড়ে নিতে থানার পেয়াদা জোরাজুরি করতে গেলেই সে প্রতিবাদ জানিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। ওই থালাটুকু না নেওয়ার কাঁতর আর্জি জানিয়ে শিশুটির বাবা-মা পেয়াদাকে অনুনয় বিনয় করছে। কিন্তু পেয়াদার হম্বিতম্বি থামছে না। ওদের ঘিরে জড়ো হওয়া মানুষ নীরবে ঘটনাটি উপভোগ করছে। পেয়াদাকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, কুটিরের বাসিন্দা লোকটি একজন গরিব চাষি। দেনার দায়ে তাঁর সর্বস্ব ক্রোক হয়েছে। সেগুলি নিতেই লোকজনসহ পেয়াদা এসেছে। চাষির ঘরের বাকি সমস্ত সামগ্রী বিনা বাধায় হস্তগত হয়েছে। বাকি কেবল ওই ছোট্ট থালাটি। শিশুটি ওই ছোট্ট কাঁসার থালাটি কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি নয়। কারণ ওই থালাতেই সে রোজ খায়। বিষয়টি নিয়ে আমি আলোচনা করি বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান অশ্বিনীকুমার দত্তের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, রাজনৈতিক নেতারাই পারেন এর স্থানী সমাধান করতে কারণ তারাই আইন-কানুন বানান। সেদিনই আমি সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম আমার রাজনৈতিক জীবনের লক্ষ্য হবে শিশুটির থালাটি ফেরত দেওয়া। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমি সারাজীবন রাজনীতির মাঠে প্রয়োজন মতো অভিনয় করে যাচ্ছি।’

তরুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যখন সোহ্‌রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তখন অভিজ্ঞ এ. কে. ফজলুল হক পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বাংলার মাটিও তাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লীগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চাননা এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়েই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন- দাঁড়িয়ে বললেন, যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব। এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতেই হবে তাই বুঝালাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারপিট করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে মার খেয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি।’ বঙ্গবন্ধুর বাবা বলেছেন, ‘বাবা তুমি যাই করো শেরে বাংলার বিরুদ্ধে কিছু বলো না। শেরে বাংলা এমনি এমনি শেরে বাংলা হয়নি।’ এ. কে. ফজলুল হক জানতেন মাঝখানে ভারতকে রেখে পশ্চিম আর পূর্বে জোড়া দিয়ে এক পাকিস্তান করলে তা কখনো টিকবে না। ১৯৭১ সালে এসে দেখা গেল, তাঁর আশঙ্কা এবং ভবিষ্যতবাণীই সঠিক।

বরিশালের চাখারের মানুষ আবুল কাশেম ফজলুল হক ছিলেন কাজী মুহাম্মদ ওয়াজেদ ও সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। তিনি বরিশাল জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রাস এবং কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পাস করেন। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন বিশিষ্ট রসায়নবিদ প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ফজলুল হকের মেধায় তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তিনি একই বছরে গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ স্নাতক পরীক্ষা পাস করেন। ইংরাজি ভাষায় এম.এ. পাঠ শুরু করলেও পরে তিনি গণিতশাস্ত্রে এম.এ. ডিগ্রি নেন। কথিত আছে তিনি ইংরাজি ভাষায় এম.এ. পড়তে গেলে তাঁর এক সহপাঠী তাঁকে বলেছিলেন মুসলমান শিক্ষার্থীদের মেধা কম তাই তারা গণিত পড়তে ভয় পায়। আর সে কারণেই কি তিনি ইংরাজিতে এম.এ. পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওই সহপাঠীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মাত্র ছয় মাসের প্রস্তুতি নিয়ে তিনি গণিতে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ. পাস করেন।

তিনি আইনেও স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিলেন এবং কলকাতা হাইকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার আশুতোষ মুখার্জির অধীনে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে পেশা শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি বরিশাল আদালতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে আইন ব্যবসা ছেড়ে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। তাকে জামালপুর মহকুমার এস. ডি. ও হিসেবে পদায়ন করা হয়। জামালপুরে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা শুরু হলে এ. কে. ফজলুল হক লক্ষ্য করেন পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসনে হিন্দু আধিপত্য থাকায় হিন্দু জমিদার, তালুকদার ও মহাজন একত্রে মুসলমান কৃষকদের গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছে। তাঁর এই অভিজ্ঞতা বাকী রাজনৈতিক জীবনে পথনির্দেশ করেছিল। জমিদার ও মহাজনদের ঋণের শৃঙ্খল থেকে কৃষকদের মুক্ত করার জন্য তিনি এস.ডি.ও -এর পদ ছেড়ে দিয়ে তিনি সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদ গ্রহণ করেন। এসময় তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। সমবায়ের ভিত্তিতে ঋণ প্রদাণ করতে গিয়ে তিনি মহাজন ও ইংরেজ শাসকদের বিরোধীতার সম্মুখিন হন। সরকারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই তিনি চাকুরি ত্যাগ করেন এবং কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে স্বাধীন ব্যবসা শুরু ।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ। তিনি ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহ্বান করেন। এই সম্মেলন থেকেই জন্ম নেয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ঢাকার আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন এ. কে. ফজলুল হক। সেই অর্থে মুসলিম লীগের পথচলার শুরু থেকেই তিনি দলটির সঙ্গে ছিলেন। তিনি ১৯১৬ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত ছিলেন মুসলিম লীগের সভাপতি এবং একই সময়ে পাশাপাশি তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। দিল্লিতে ১৯১৮ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ. কে. ফজলুল হকই ছিলেন একমাত্র বাঙালি যিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন। তিনিই ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি যিনি একই সময়ে মুসলিম লীগ এর প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেস এর জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। লক্ষ্ণৌ শহরে ১৯১৬ সালে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে তিনি যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, তা 'লক্ষ্ণৌ চুক্তি' নামে অভিহিত করা হয়। এই চুক্তির অন্যতম একজন প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন এ.কে. ফজলুল হক। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রাদেশিক পর্যায়ে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। ওই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এবং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের তদন্তের জন্য মতিলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাস ও অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের নিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক গঠিত পাঞ্জাব তদন্ত কমিটির সদস্য তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯১৯ সালে এ. কে. ফজলুল হক খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন। কিন্তু অসহযোগের প্রশ্নে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। ১৯২০ সালে কংগ্রেস গৃহীত অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্রিটিশ পণ্য ও উপাধি বর্জনের তিনি সমর্থন করেন। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের পশ্চাৎপদ অবস্থার কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করে তিনি স্কুল ও কলেজ বর্জনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। বর্জনের সিদ্ধান্ত মুসলমান ছেলেমেয়েদের অগ্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করবে এটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই এইসময় তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন।

বাংলায় দ্বৈতশাসনামলে ১৯২৪ সালে প্রায় ছয় মাসের জন্য এ. কে ফজলুল হক শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দেশে শিক্ষা সংক্রান্ত অবকাঠামো সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি বহু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম এডুকেশনাল ফান্ড গঠন করে তিনি যোগ্য মুসলমান ছাত্রদের সাহায্য করেন। মুসলমান ছাত্রদের ফারসি ও আরবি শিক্ষাদানের জন্য তিনি বাংলায় একটি পৃথক মুসলমান শিক্ষা পরিদপ্তরও গঠন করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সকল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমান ছাত্রদের জন্য আসন সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা তিনি করেছিলেন। বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষার নতুন কাঠামো তৈরিতেও তাঁর ভূমিকা ছিল। ডাঃ কালিদাস বৈদ্য লিখেছেন, ‘আমাদের প্রথম জীবনে দেখেছি, এক দুই জন হিন্দুর সামনে দশ বারো জন মুসলমানও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না। ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রি হওয়ার পর থেকেই পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। প্রধানমন্ত্রি হয়ে হক সাহেব প্রকাশ্যে হিন্দুদের বিরুদ্ধে কিছু বললেন না বটে, কিন্তু গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুসলমানদের নিয়ে আলাদাভাবে বৈঠক করে তাদের নব জাগরণের ডাক দিলেন। নিজে তাদের সামনে হাজির হয়ে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে এক হুক্কায় তামাক খেয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, যেহেতু তিনি প্রধানমন্ত্রি ও ইংরেজদের পার্শ্বচর, তাই গোটা মুসলিম সমাজই রাজার পার্শচরে পরিণত হয়েছে। মুসলমানরাও দেখল যে তাদের ভালোমন্দ দেখতে রাজশক্তি তাদের পাশে আছে।’

শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক খুব ভালো করেই বুঝতেন। তাই তিনি মাঝে মাঝে বলেতেন, ‘পলিটিকস অব বেঙ্গল ইজ ইন রিয়েলিটি ইকনমিক্স অফ বেঙ্গল’। জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য তিনি জমিদার প্রথা বাতিলের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ঋণগ্রস্থ কৃষকদের রক্ষার জন্য বিনাখরচে তিনি বহু মামলা পরিচালনা করেন। তৎকালীন সময়ে মুসলিম লীগ ছিল মুসলিম জমিদার ও এলিট শ্রেণির সংগঠন ফলে জমিদারী প্রথা বাতিলের জন্য এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা আন্দোলনের তারা বিরোধীতা করেন। তাই এইসময় এ.কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। এ. কে. ফজলুল হক বলেছেন, ‘আম গাছে আম ধরে বলেই লোকে ঢিল মারে, ফজলি আম গাছে আরও বেশি করে মারে; শেওড়া গাছে কেউ ঢিল মারে না।’

১৯২১ সালে গৌরনদীতে প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রজা আন্দোলনকে সফল আর সংগঠিত করতে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াত শুরু করেন ফজলুল হক। বিভিন্ন জেলায় থাকা প্রজা আন্দোলনের নেতাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। ১৯২৬ সালে ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জে দেনার দায়ে কৃষকদের জমি কেড়ে নেয় জমিদার আর মহাজনেরা। এই ঘটনা খুব একটা নতুন ছিল না তখনকার মানুষের জন্য। তবে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকেই কৃষকদের মাঝে অসন্তোষ রূপ নেয় বিক্ষোভে। এই ব্যাপারটিকে নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের উপায়ে আনতে ডাক দেওয়া হয় প্রজা সম্মেলনের। মানিকগঞ্জের মহকুমার ঘীওর হাটের প্রজা সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য আহ্বান জানানো হয় ফজলুল হককে। সেখান থেকেই অত্যাচারী মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে অসহযোগের ডাক দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘দয়া করে জমি যখন নিয়েছে, এবার কর্তারা লাঙ্গল চষুক মাঠে নেমে। ফসল বুনুক, ফসল ফলাক, ফসল কাটুক।’

১৯২৭ সালে ‘নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি’ নামে নামে রাজনৈতিক দলের যাত্রা শুরু হয়। তিনি দলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। হক সাহেবের বিশাল ব্যক্তিত্ব আর বাগ্মিতার কারণেই দলটি জনপ্রিয় হতে থাকে। তবে বাংলার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক অদ্ভুত সমস্যারও সৃষ্টি হয়। মুসলিম লিগ আর কৃষক প্রজা পার্টি উভয়েরই কর্মী আর সমর্থকদের একটি বড় অংশ ছিল মুসলমান তরুণ সমাজ। তাই নির্বাচনে মুসলমানদের ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থেকেই মুসলিম লিগ আর কৃষক প্রজা পার্টির মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এছাড়াও বাংলার প্রভাবশালী মুসলিম লিগ নেতাদের অনেকেরই নিজেদের জমিদারী-জোতদারি ছিল, কৃষক প্রজা পার্টি তাদের স্বার্থে কুঠারাঘাত করেছিল। তাই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর এ. কে. ফজলুল হকের মধ্যে উত্তাপও বাড়তে থাকে। কৃষকের মুখপত্র হিসেবে কলকাতায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নবযুগ পত্রিকা।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুযায়ী ভোটাধিকার সাধারণ মানুষের জন্য সম্প্রসারণ করা হয়। ফলে বাংলার মুসলিম কৃষক ও নিম্নবর্ণের হিন্দুরা প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার লাভ করে। ভোটাধিকার সম্প্রসারণকে জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘এটি বহুসংখ্যক ব্রেকযুক্ত একটি ইঞ্জিনবিহীন গাড়ি।’ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলার ২৫০ আসনের মধ্যে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয় ১১৭ আসন। সাধারণ বিশ্লেষণে আসন বণ্টন এ ইঙ্গিত দেয়, মুসলমানরা যে দলের অনুসারীই হোক না কেন রাজনীতিতে ধর্মীয় ঐক্য ধরে রাখতে পারলে বাংলার শাসনক্ষমতা তাদের হাতেই থাকবে। এ আসন বরাদ্দ কলকাতাভিত্তিক হিন্দু রাজনীতিক নেতৃত্বের অখণ্ড বাংলা শাসনের স্বপ্ন ভেঙে দেয়।

১৯৩৬ সালের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি নিয়ে ফজলুল হক আর জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লিগ একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়। কৃষক প্রজা পাটির প্রতীক ছিল লাঙ্গল। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের সময়ে ফজলুল হক হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা। নির্বাচনে তাঁর রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে ওঠে, ‘লাঙ্গল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার’। বরিশাল জেলার পটুয়াখালী আসনে ছিল ঢাকার নবাব বংশের প্রভাবশালী মুসলিম লিগ নেতা খাঁজা নাজিমুদ্দীনের জমিদারি। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে সেখান থেকেই ফজলুল হক আর নাজিমুদ্দীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। এই নির্বাচনে এ. কে. ফজলুল হকের কাছে খাঁজা নাজিমুদ্দীন পরাজিত হয়েছিলেন বড় ব্যবধানে। ১৯৩৭ সালে বাংলায় মুসলিম লিগ আর কৃষক প্রজার এই লড়াই বাংলার বেশ বড় আলোড়ন তৈরি করেছিল। ফজলুল হক তার ভাষণে চমৎকার গল্প করতে পারতেন। মানুষের মনের ভাষা বুঝতেন। পটুয়াখালী জনসভায় তিনি হাজির হলেন ধুতি শার্ট আর মাথায় রুমি টুপি পরে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রথমেই বললেন, ‘ভাইয়েরা, মাত্র চারটি যুদ্ধের কথা আমি আপনাদের সামনে আজ বলব, প্রথম যুদ্ধ হয়েছে রয়-রয়, দ্বিতীয় যুদ্ধ হয়েছে কয়-কয়, তৃতীয় যুদ্ধ হয়েছে গয়-গয়, আর এবার যুদ্ধ হবে হয়-নয়।’ তারপর উত্সুক জনতা এ কথার মানে জানতে চাইল। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, প্রথম যুদ্ধ রাম-রাবণে, দ্বিতীয় যুদ্ধ কংস-কৃষ্ণের, তৃতীয় যুদ্ধ গান্ধী আর গভর্নমেন্টে, আর এবার হবে হক-নাজিমউদ্দীনে।’ জনতা হো হো করে হেসে উঠলেন। এ হ-ন যুদ্ধে সবাইকে অবাক করে দিয়ে খাজার পটুয়াখালীর কৃষক প্রজারা তাদের হক সাহেবকেই ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে। সবার হক সাহেব বরিশালে নিজের আসন থেকেও বিজয়ী হন। নির্বাচনী প্রচারণায় এ. কে. ফজলুল হক বলেন সরকার জমিদারদের কল্যাণে কাজ করছে, তারা তামাকের দাম বাড়ালেও সিগারেটের দাম বৃদ্ধি করে নাই। আবার পোস্টকার্ড সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে তাই দাম বৃদ্ধি করেছে কিন্তু ধনীদের জন্য যে টেলিগ্রাফ আছে তার ফ্রি বৃদ্ধি করে নাই। সাধারণ মানুষের কাছে ফজলুল হক এবং তাঁর দলের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ ছিল জমিদারি উচ্ছেদ, জোতদার-মহাজনদের অত্যাচার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকেই বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে হিন্দু জমিদারি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তৎকালীন সময়ে রায়তের সংখ্যা ছিল কম এবং জমি ছিল বেশী তাই জমিদারগণ জমি কেড়ে নিতেন না। কিন্তু উনিশ শতকে এসে রায়তের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ফলে জমিদারগণ নানা অজুহাতে জমি কেড়ে নেওয়া শুরু করেন। তাছাড়া জমিদারগণ ভূমিকর ছাড়া বিভিন্ন আবওয়াব ( অবৈধ কর ) কর তারা আদায় করতেন। দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকেরা জমিদারদের দেীরাত্ন্য থেকে মুক্তি পাবার জন্য কখনো কখনো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ঊনিশ শতকে হাজী শরীয়ত উল্লাহ, দুদুমিয়া ও তিতুমীরের নেতৃত্বে জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রজাদের রক্ষার জন্যই কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল । ১৯৩৭ সালের নির্বাচনী ঘোষণায় এ. কে. ফজলুল হক বললেন, ‘আজ হতে জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলো। ইনশাল্লাহ আমি অল্প সময়ের মধ্যে জমিদারি প্রথা বাতিল করব। বাংলার চার কোটি কৃষক মাথা উঁচু করে তাদের পায়ের ওপর শক্তভাবে দাঁড়াতে পারবে এবং তাদের সকল দাবি-দাওয়া আদায় করবে। খোদা আমাদের সাথে আছেন এবং আমাদের জয় অনিবার্য। কিন্তু খোদা না করুন আমি যদি পরাজিত হই তাহলে এ পরাজয় নেপোলিয়ান বোনাপার্টের ওয়াটার-লুর পরাজয়ের চেয়েও মহীয়ান হবে।’

নির্বাচনের ফলাফলে কৃষক প্রজা পার্টি সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসে। প্রথমেই কৃষক প্রজা পার্টি কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশনের চেষ্টা করে, কিন্তু অল্পের জন্য তা ভেস্তে যায়। বাধ্য হয়েই মুসলিম লিগের সাথে আলোচনায় শুরু করেন ফজলুল হক। শেষ পর্যন্ত মুসলিম লিগের সাথে কোয়ালিশনে যেতে হয় কৃষক প্রজা পার্টিকে। এ. কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে আঁতাত সম্পর্কে ঘোষণা করেন, ‘বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বাংলার মুসলমানকে আগে বাঁচাতে হবে। বাংলার মুসলমানকে বাঁচাবার জন্য মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা সমিতি দুটোকে বাঁচাতে হবে। আমাকেই দুটোর সভাপতি থাকতে হবে। মুসলিম লীগকে আমি খাজা-গজা-নবাব-সুবার হাতে ছেড়ে দিতে পারিনি। ঠিক তেমনি কৃষক প্রজা সমিতিকে আমি কংগ্রেসের হাতে তুলে দিতে পারি না।’

মুসলিম লিগের সাথে যুক্ত হয়ে মুসলিম লিগের অদূরদর্শী কাজের ভার ফজলুল হকের কাঁধেই চলে আসে। এই মন্ত্রীসভায় স্থান পান প্রভাবশালী মুসলিম লিগের প্রভাবশালী নাইট নবাবরা। ইংরেজ শাসকদের সাথে তাদের আঁতাতের ফলে কৃষক প্রজা পার্টির নিজেদের ইশতেহার বাস্তবায়নের সুযোগ কমে আসে, জমিদারি উচ্ছেদ থেকে শুরু করে মহাজন-জোতদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফজলুল হকের জন্য কঠিন হয়ে যায়। নির্বাচনের সময় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেও মন্ত্রীসভা গঠনের পর কৃষক প্রজা পার্টির সমর্থন কমতে থাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তবে অনেক বাঁধা বিপত্তির মাঝেও ফজলুল হক বাংলার কৃষকদের জন্য ১৯৩৮ সালে ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’ গঠন করেন, ১৯৩৯ সালে প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪০ সালের মহাজনী আইন পাশ হয়। প্রধানমন্ত্রী পদে বসেই এ. কে. ফজলুল হক প্রথম যে উল্লেখযোগ্য কাজটি করেছিলেন, তা হল ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন। এই বোর্ডের মাধ্যমেই দীর্ঘকালীন মহাজনি ঋণের ফাঁস থেকে বাংলার গরিব কৃষকদের মুক্তির দিশা মেলে। সারাদেশে প্রায় ১১০০০ ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের দায়িত্ব ছিল দু পক্ষেরই কথা শুনে প্রধানত মহাজনদের কাছে ঋণগ্রস্ত কৃষকদের অনাদায়ী ঋণ আনুপাতিক হারে কমানো এবং এভাবে তাদের ওপর থেকে চাপ লাঘব করা। ঋণগ্রস্ত কৃষককুলকে সাহায্য করার অন্য উপায়গুলি ছিল একজন ঋণগ্রহীতাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা এবং এভাবে তাকে ঋণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া, সর্বাধিক বিশটি শুনানির মাধ্যমে আনুপাতিক হারে কমানো ঋণ সহজ কিস্তিতে পরিশোধ করা, দেওয়ানি আদালতের ডিক্রি ও সার্টিফিকেট-এর কার্যকারিতা বন্ধ করা ইত্যাদি। ১৯৩৮ সালে স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের নেতৃত্বে একটি ভূমি রাজস্ব গঠন করেন । উক্ত কমিশন ১৯৪০ সালে পেশকৃত রিপোর্টে ক্ষতিপূরণ প্রদান সাপেক্ষে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সুপারিশ করে । কিন্তু ভূমি সংস্কারের বিরুদ্ধে জমিদারদের চাপ এবং ১৯৪১ সালে সরকারের পরিবর্তনের ফলে ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি । এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার ‘ পূর্ব বাংলা জমিদারি দখল আইন ‘ ( East Bengal Zamindari Acquisition Bill, 1951 ) পাস করেন । এরপরেই জমিদারি প্রথার অবসান ঘটে ।

তাঁর উদ্যোগেই শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার শুরু হয়, বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় স্কুল-কলেজের সংস্কার, হোস্টেল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করার জন্য বিল পাস করেন। কলকাতা কর্পোরেশনের আইনে সংশোধন করে আলাদা নির্বাচন প্রবর্তন, মাধ্যমিক শিক্ষা বিল নিয়েও কাজ শুরু হয়। মুসলিম লিগকে বাদ দিয়ে এবার ফজলুল হক হিন্দু মহাসভা, কৃষক প্রজা পার্টি আর কংগ্রেসের সুভাষপন্থী অংশকে নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। হিন্দু মহাসভার সাথে জোট করে মন্ত্রীসভা গঠন করায় রাজনীতি সচেতন তরুণ মুসলমান সমাজের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। মুসলিম লিগ এই মন্ত্রীসভাকে ‘শ্যামা-হক’ মন্ত্রীসভা নাম দেয়। যদিও এই মন্ত্রীসভার একজন অর্থাৎ শ্যামাপ্রসাদই ছিলেন হিন্দু মহাসভার মন্ত্রী। মুসলিম লিগের লক্ষ্যই ছিল হক সাহেবকে রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া। ২৮ মার্চ ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় হক মন্ত্রীসভার পতন ঘটে। বাংলার রাজনীতির মঞ্চে মুসলিম লিগের সোহরাওয়ার্দী আর খাঁজা নাজিমুদ্দিন হয়ে ওঠেন মুখ্য চরিত্র। হক সাহেব জনপ্রিয়তার দৌড়ে পেছনে না পড়লেও বয়সের দৌড়ে পেছনে পড়ে যান। পাকিস্তান আসলে জমিদারি উচ্ছেদ করা হবে, মানুষের অধিকার আদায় হবে এই রবে মুখরিত গ্রামগঞ্জ আর শহর। আপামর পূর্ব বাংলার মুসলমান বাঙালিরা তাই পাকিস্তান আদায়ের উন্মাদনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

অসীম সাহসী এই মানুষটি আমাদেরকে সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে প্রতিবাদ করার কথা বলেছেন। বাঙালী জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন অনেক আগেই । তিনি বলেছেন, যে জাতি তার বাচ্চাদের বিড়ালের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়, তারা সিংহের সাথে লড়াই করা কিভাবে শিখবে? আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন ফজলুল হকের শিক্ষক। আবুল মনসুর আহমদের সাথে আলাপচারিতায় ফজলুল হক সম্পর্কে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মন্তব্য : ‘ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি বাঙ্গালী। সেই সঙ্গে ফজলুল হক মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খাঁটি মুসলমান। খাঁটি বাঙ্গালীত্বের সাথে খাঁটি মুসলমানত্বের এমন অপূর্ব সমন্বয় আমি আর দেখি নাই। ফজলুল হক আমার ছাত্র বলে বলছিনা, সত্য বলেই বলছি। খাঁটি বাঙ্গালীত্ব ও খাঁটি মুসলমানত্বের সমন্বয়ই ভবিষ্যৎ বাঙ্গালীর জাতীয়তা।’ রেফারেন্স: আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, (পৃষ্ঠা ১৩৫-৩৬)। পহেলা বৈশাখের সরকারি ছুটি, বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা এই ফজলুল হকের অবদান । কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ফজলুল হক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন কারণ কৃষক--শ্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ এই উপমহাদেশে মাত্র একজন ব্যক্তি কৃষকদের জন্য রাজনীতি করেছেন । তিনি হলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক।

১৯৪৮ সালে ঢাকায় এসেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বললে ছাত্ররা তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানায়। জিন্নাহ ছাত্রদের সাথে বৈঠকও করেন। কিন্তু ছাত্ররা ছিল নাছোড়বান্দা। জিন্নাহর ধারণা হলো, ফজলুল হক ছাত্রদেরকে উসকানি দিচ্ছেন। জিন্নাহ এবার এ. কে. ফজলুল হকের সাথে দেখা করতে চাইলেন। কিন্তু এ. কে. ফজলুল হক দেখা করতে রাজি হলেন না। তিনি জিন্নাহকে ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করতেন। জিন্নাহর পীড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন এ. কে. ফজলুল হক। বন্ধ দরজার আড়ালে কথা হয়েছিল দুই অভিজ্ঞ নেতার। কিন্তু ইংরেজিতে কী ধরনের বাক্য বিনিময় হয়েছিল তাদের মধ্যে পরবর্তীতে তা লিখেছেন ফজলুল হকের একান্ত সহকারী আজিজুল হক শাহজাহান –

জিন্নাহ: তোমার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা ছিল না। তাই এখনো পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছো।
ফজলুল হক: প্রস্তাবটি তো আমিই করেছিলাম। পরে ওটার খতনা করা হয়েছে। আমি এটা চাইনি।
জিন্নাহ: পাকিস্তানের এই অংশ টিকে থাক এটা তুমি চাও না। তাই ভারতের কংগ্রেসের টাকা এনে ছাত্রদের মাথা খারাপ করে দিয়েছ। তারা আমাকে অপমান করছে।
ফজলুল হক: আমি এখানে কোনো রাজনীতি করি না। শুধু হাইকোর্টে মামলা নিয়ে চিন্তা করি। আইন আদালত নিয়ে থাকি।
জিন্নাহ: জানো, তুমি কার সাথে কথা বলছো?
ফজলুল হক: আমি আমার এক পুরোনো বন্ধুর সাথে কথা বলছি।
জিন্নাহ: নো নো, ইউ আর টকিং উইথ দ্য গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান ।
ফজলুল হক: একজন কনস্টিটিউশনাল গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা আমি জানি!
জিন্নাহ: জানো, তোমাকে আমি কী করতে পারি?
ফজলুল হক: (ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে) তুমি আমার এ্যাই করতে পারো। মিস্টার জিন্নাহ, তোমার ভুলে যাওয়া উচিত না এটা বাংলাদেশ এবং তুমি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সাথে কথা বলছ।
ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হয়ে যাবার পর এ. কে. ফজলুল হক ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৫২ সালে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল নিযুক্ত হন।

১৯৫৪ সালে দেশের সাধারণ নির্বাচনে তিনি 'যুক্তফ্রন্ট' নেতৃত্ব দিয়ে ২১ দফা ঘোষণা করেন। এর উল্লেখযোগ্য দফাগুলির মধ্যে ছিল: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, জমিদারি প্রথা বিলোপ, পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, ভাষা শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা উন্নয়নের কেন্দ্রে রূপান্তর, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা এবং পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা। বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে এ. কে. ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মোট তিনবার তার দল সর্বোচ্চ আসন না পেলেও ব্যক্তিগত যোগ্যতায় তিনি প্রধানমন্ত্রির পদ অলংকৃত করেছিলেন। এরপর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত ও কার্যকর হবার পর তিনি স্বারষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিয়ে করাচি থেকে ঢাকা চলে যান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই পদে তিনি ছিলেন সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। আটান্ন সালে পাকিস্তানের এক অভ্যূত্থানের পর তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়।

‘আজ ২৭ শে এপ্রিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেবের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। পাঁচ বৎসর পূর্বে (১৯৬২) যখন তিনি ঢাকায় মারা যান সেদিনও আমি জেলে ছিলাম। হক সাহেব ছিলেন পূর্ব বাংলার মাটির মানুষ এবং পূর্ব বাংলার মনের মানুষ। মানুষ তাঁহাকে ভালবাসতো ও ভালবাসে। যতদিন বাংলার মাটি থাকবে বাঙালি তাঁকে ভালবাসবে। শেরে বাংলার মতো নেতা যুগ যুগ পরে দুই একজন জন্মগ্রহণ করে। ...আজ লাহোর প্রস্তাবের মালিকের মৃত্যুবার্ষিকী। আর লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি করে আমি যে ৬ দফা দাবি পেশ করেছি তার উপর বক্তৃতা করার জন্য এ দিনটিতে আমাকে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। আল্লার মহিমা বোঝা কষ্টকর!’
শেখ মুজিবুর রহমান (কারাগারের রোজনামচা, পৃ.২৩১-৩২)

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জোট যে ২১ দফা দাবিসংবলিত ইশতেহার ঘোষণা করে, সেখানে ১৯ নং দফায় বলা হয়, ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও সার্বভৌম করা হইবে।’ এক যুগ পর ১৯৬৬ সালে বাঙালির আরেক জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেন। বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার প্রথম দফাই ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। শেরেবাংলা থেকে বঙ্গবন্ধু -এ দীর্ঘ সংগ্রামের প্রবাহমান স্রোতধারাই বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস।
১৯৪০ সালে ফজলুল হকের প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরে তাঁর প্রচেষ্টায় মুন্সিগঞ্জে প্রতিষ্ঠা হয় হরগঙ্গা কলেজ। তাঁর নিজের গ্রামেও তিনি একটি কলেজ এবং পাশাপাশি মাদ্রাসা ও হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফজলুল হকের উদ্যেগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসলামিয়া কলেজ ও মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লেডি ব্র্যার্বোন কলেজ।

এ কে ফজলুল হকের জীবনাবসান হয় ঢাকায় ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল। ঢাকায় তিন নেতার মাজারে বাংলার স্বাধীনতা পূর্ব তিন রাজনৈতিক নেতা এ. কে. ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমাধি রয়েছে। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি 'শ্রোতা জরিপ'-এর আয়োজন করে। শ্রোতা জরিপের বিষয় ছিলো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় চতুর্থ স্থানে ছিলেন এ. কে. ফজলুল হক।

পঠিত : ৫৪৬ বার

মন্তব্য: ০