Alapon

শ্রমজীবী মহিলা ও তৃতীয় নয়নের উপলব্ধি...



গার্মেন্টস ফ্যক্টরীতে শ্রমিক হিসেবে মহিলাদের বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়। তারা প্রতিবাদ করে কম, একটু কান্না করে আবার কাজে মনোযোগ দেয়। গ্রুপিং, দলাদলিতে পারদর্শী নয়, তাছাড়া আরো ভাল চাকুরীর সন্ধানে ঘুরার সময়ও পায় না। এসব কারণেই মহিলারা গার্মেন্টেসে চাকুরীর সুযোগ পায় বেশী। সেখানে কাজের খতিয়ান থাকে প্রতি মিনিট হিসেবে। ফাঁকি, গপ্প, খোশালাপের ন্যূনতম সুযোগ সেখানে নাই। পিটের বেকায়দা পূর্ন জায়গায় চুলকানি হলেও, উৎপাদন শ্লথ হবার ভয়ে, হাত চালানোর মওকা নাই।

সুপারভাইজার, এসিস্ট্যান্ট, প্রোডাকশন ম্যানেজার, কোয়ালিটি কন্ট্রোলারের সার্বক্ষণিক নজরদারীর ভিতরে শ্রমিকদের কাজ করতে হয়, তাছাড়া সামান্যতম অন্যমনস্ক হলেই, একটু অন্যমনস্কতার সুযোগে, হাতের আঙ্গুল সেলাই হয়ে যেতে পারে। মুহূর্তে আঙ্গুল দ্বি-খণ্ডিত হওয়ার ভয়ও থাকে। আঙ্গুল দ্বিখণ্ডিত কিংবা সেলাই হয়ে গেলে প্রাথমিক চিকিৎসা স্বরূপ বকাঝকা তো থাকবেই, কেননা সে অন্যমনস্ক হয়েছিল। যদি দেবী দুর্গার মতো ১০টি হাত এসব শ্রমজীবী মহিলার থাকত; তাহলে এক সাথে ১০ হাতের কাজও গার্মেন্টেসেএ করা লাগত।

অফিসের বিরামহীন কাজের শেষে তাদের ভোগান্তির শেষ নেই। সন্ধ্যা বেলায় ঠিক সময়ে, নিরাপদে বাসায় পৌঁছা এক দুশ্চিন্তার ব্যাপার। রাস্তার বখাটে ছেলে, মাস্তান, হাইজ্যাকার, কর্তব্যরত? পুলিশের চোখ এড়িয়ে সুন্দরী নারীদের বাসায় পৌঁছা আর ম্যারাথন দৌড়ে গ্রীসের রাজধানীতে পৌঁছা প্রায় সমান কথা। চলার পথে পথে শ্রমিকদের দৈনন্দিন বাজার করতে হয়। তাদের বাসায় ফ্রিজ না থাকাতে, মাছ-গোশত-সবজি কোনটাই পুরো সপ্তাহের জন্য সংরক্ষণ করতে পারেনা। বাজারের অখাদ্য, কুখাদ্য, ছাঁটা-ছেড়া তরিতরকারির অংশ বিশেষ তারাই খরিদ করে। তারা কখনও বড় মাছ ও গোশত কিনতে পারেনা।

মাছ-গোশত বাজারে ১০০ গ্রাম হিসেবে বিক্রি হয়না বলে, তা ক্রয় করা এখনও তাদের নাগালের বাইরে। কারণ তাদের কে প্রতিদিনের খানা প্রতিদিন রান্না করে খেতে হয়। বাসায় যা রেখে আসা হবে, দুপুরে চুলার তাপের অভাবে তা নির্ঘাত পচে যাবে। যথারীতি বখাটে, মাস্তানকে ফাঁকি দিয়ে বাসায় পৌঁছল, দেখা গেল ঘরে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ ঠাট্টা-মশকরা করে দু একবার এসে দেখা দিল তো, গামলায় পানি নেই। যেভাবে হোক অন্ধকারে হাতড়িয়ে সব গুছানো হলে তো, চূলায় গ্যাস নেই। প্রচণ্ড গরমে একটু বাতাস নেবার জন্য যেই বারান্দায় পা রাখল, রাস্তার বখাটে ছেলের দৃষ্টি তাদের দিকেই; টিজ খেতে হল, ক্ষেত্র বিশেষে বাড়ি ওয়ালার বাড়তি উপদ্রবও থাকে।

আধা ক্ষিদে নিয়ে, বিদ্যুৎ বিহীন ঘরে, ফ্যানের ঘূর্ণনের বাতাস ব্যতীত, মোমবাতির আলোতে যেই শুইতে গেল, মশার কোরাস ধ্বনির অত্যাচারে ভবজগৎ অতিষ্ঠ হল। এভাবে মশার কামড়, মাছির বিরক্তি, দুঃস্বপ্নের ঘুম, ছারপোকার অত্যাচার, রাতের অন্ধকার, নালার দুর্গন্ধ, বখাটের উৎপাত, বাড়ীওয়ালার প্যানপ্যানানি, ছোট্ট ভাইয়ের আবদার, মা-বাবার চিকিৎসা, ফ্যাক্টরিতে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা, রাস্তার যানজট, খাদ্য-দ্রব্যের চড়া-মূল্য, সর্বোপরি চৈত্রের ভবদহের গরমকে রাত্রিতে আলিঙ্গন করে, প্রতিটি শ্রমিকের রাত যায়, দিন আসে।

এই ভজঘট কেলেঙ্কারির নরকে বসবাস করে, সুস্থ চিন্তা চেতনা-বোধ এখনও যে তাদের মগজে বিদ্যমান, সে জন্য আল্লাহকে অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। এ জীবন যিনি দেখেননি, তিনি শ্রমজীবী মানুষের জীবন উপলব্ধি করেননি, তিনি স্রষ্ঠাকে চিনেন নি। যদি কেউ দেখত, অন্তত একটি সপ্তাহের জন্য ভুক্তভোগী হত, তাহলে কস্মিনকালেও তার হাতে ফাস্ট ফুড হিসেবে বার্গার-পিজা শোভা পেতনা। কারণ এসব দেখলে মানুষের তৃতীয় নয়ন খোলে যায়। তাইতে কবি নজরুল বলেছেনঃ “এ দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খৃষ্টের সম্মান”।

- Nazrul Islam Tipu

পঠিত : ৩০৮ বার

মন্তব্য: ০