Alapon

একজন সফল প্রত্যাবর্তনকারীর গল্প...



তরবারি নয় বরং বণিকদের হাত ধরে ইসলাম প্রচার কথা যদি বলা হয় তাহলে সবার আগে চলে আসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কথা। বহুকাল ধরে আরব ও পরে গুজরাট বণিকদের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান বাণী ছড়িয়েছে এই অঞ্চলে।

বণিকদের নির্মল ব্যাবহার, চারিত্রিক মাধুর্যতা ও ব্যাবসায়িক সততা যেসব অঞ্চলের মানুষকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে তার মধ্যে মালাক্কা ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে। এবং এখানেই পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মুসলিম বণিকদের প্রচেষ্টায় দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার প্রথম শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে মালাক্কার পত্তন ঘটে। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা দেখার চেষ্টা করব, ঠিক কিভাবে কোনো বিজয় অভিযান ছাড়াই একটি সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হলো।
মালাক্কা কখনও বিখ্যাত অঞ্চলের মধ্যে পরত না। এটা ছিল একটা ধীবর গ্রাম, যেখানে বসবাস ছিল মূলত জেলেদের। আর এটা ছিল মৌসুমী আবাস অঞ্চল। মালাক্কা নামটি প্রথম ১৩৬০ সালে শ্যাম (থাইল্যান্ড) দেশ কর্তৃক প্রকাশিত তার অধীন অঞ্চল গুলোর তালিকায় একটি গ্রাম হিসেবে স্থান পায়।

মালাক্কা রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পরমেশ্বর নামক একজন সুমাত্রার শৈলেন্দ্র যুবরাজ। ১৩৯০ সালে মাজাপাহিতদের রাজা বিক্রমবর্ধনের সঙ্গে পূর্ব জাভার বীরভূমের মধ্যে সংঘটিত উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় পরমেশ্বর পালেম্বাং থেকে পালিয়ে আসেন এবং থাইল্যান্ডের সামন্ত রাষ্ট্র তুমাসিকে (বর্তমান সিংগাপুর) আশ্রয় নেন। এখানে আটদিন থাকার পর তিনি ঐ স্থানের সরকার প্রধানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। পাঁচ বছর পরে তিনি থাইল্যান্ডের অপর সামান্তরাজ্য পাতানির শাসক কর্তৃক বিতাড়িত হন।

এবার তিনি অনুচর বর্গ সহ মোয়ার নদীর তীরে আশ্রয় নেন। এখানে ভৌগোলিক ভাবে সুবিধা না হওয়ায় পরমেশ্বর ১৪০০ সালে দলবল সহ মুয়ার থেকে মালাক্কা নামক স্থানে গমন করেন। তিনি যখন এখানে অর্থাৎ মালাক্কায় এলেন তখন তা ছিল একটি সাধারণ গ্রাম। তার কর্মপরিকল্পনা ও সেই অনুযায়ী যথেষ্ট পরিশ্রমের ফলে খুব দ্রুতই মালাক্কা পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশির মধ্যে সবচেয়ে স্বনামধন্য বন্দরনগরীতে পরিণত হলো। বণিকদের যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া ও পণ্যের সঠিক দাম পাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে আরব ও গুজরাট বণিকদের বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হল এই মালাক্কা।

ধীরে ধীরে থাইল্যান্ডের চোখে মালাক্কা শত্রু হিসেবে পরিগণিত হতে থাকল। কারণ থাইল্যান্ডের তুমাসিক ছিল সমগ্র মালয় জগতের নৌ- বাণিজ্যের কেন্দ্র, কিন্তু এখন সেই স্থান অধিকার করে ফেলছে মালাক্কা!

তাই পরমেশ্বর মালাক্কার নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করতে ও থাইল্যান্ডের বিপক্ষে সহযোগী পাওয়ার আশায় চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করলো, আর চীনেরও এমন একটা সুযোগের দরকার ছিল দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু চিন যেহেতু খুব দূরে অবস্থিত। তাই আকস্মিক বিপদে সাহায্য পাওয়ার আশায় পরমেশ্বর পাশ্ববর্তী অঞ্চল গুলোর সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির পরিকল্পনা করলেন।

এই ক্ষেত্রে মালাক্কার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ছিল পাসাঈ রাজ্য ; যেখানে ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীতে ইসলামের বিস্তার ঘটেছিল। পাসাঈ রাজ্যে প্রবেশের পূর্বেই পরেমেশ্বরের জীবনে সৃষ্টিকর্তার গায়েবী কুদরতে /রহমতে একজন চীনা মুসলিম নাবিক ও দূৎ চোং- হোর সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। চং-হোর চারিত্রিক মাধুর্যতাই ধিরে ধিরে তার অজান্তেই তাকে ইসলামের পথে প্রভাবিত করছিল।

পরমেশ্বর এই পর্যায়ে পাসাঈ রাজের কাছে উপস্থিত হন মালাক্কাকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে। পাসাঈ রাজাও (কিছু মতে সুলতান) চাচ্ছিলেন তার পাশাপাশি এই মালয় জগতে একটি মুসলিম বন্ধু রাষ্ট্র থাকুক, তাই তিনি পরমেশ্বরের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। প্রথম দিকে পরমেশ্বর রাজি না হলেও, চীনা নাবিক ও তার বন্ধু চোং -হোর সাথে থাকার ফলে এবং মুসলিম বণিকদের অনেক কাছ থেকে অবলোকনের সুযোগ পাওয়ার ফলে পরমেশ্বরের মনেও ইসলাম সম্পর্কে ভালোবাসা কাজ করছিল। কারণ সর্বদা বণিকদের সাথে ওঠাবসা করার ফলে তিনি খুব কাছ থেকেই মুসলিম ও অমুসলিম বণিকদের চারিত্রিক গুণ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।

অবশেষে ১৪১৪ সালে তিনি সপরিবারে ইসলামের সুশিতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম পরিবর্তন করে " ইস্কান্দার শাহ" রাখেন। এরপর ধিরে ধিরে তিনি প্রজাসাধারনের কাছেও ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি পাসাঈ রাজকন্যার সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন।

পাসাঈ এর সাথে সম্পর্কের ফলে ধিরে ধিরে পারলাক ও আচেহনের (রাজ্য) সাথে ইস্কান্দার শাহের উন্নত বন্ধুত্বের সৃষ্টি হয়। এভাবেই একসময়ে দেশছাড়া হয়ে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় বশা ও পূনরায় পালিয়ে ধীবর গ্রামে আশ্রয় নেওয়া পরমেশ্বর হয়ে উঠলেন মালয় জগতের সবচেয়ে প্রতাপশালী মুসলিম শাসক "ইস্কান্দার শাহ"। ১৪২৪ সালে ৭২ বছর বয়সে এই সফল প্রত্যাবর্তনকারীর দুনিয়ার জীবনের অবসান ঘটে!

- সানজিদা কুররাতাইন

পঠিত : ১০০৮ বার

মন্তব্য: ০