Alapon

জালিম-নাস্তিক-ইসলাম বিদ্বেষী কারো মৃত্যুতে মুমিনের করণীয়



ঈমানদারদেরকে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, যালিম ও নাস্তিকের মৃত্যুকে যালিম ও নাস্তিকের মৃত্যু বলাই হলো সত্যবাদীর আলামত। এখানে অতি আবেগি সেজে ইসলামকে নিজের মত করে প্রচার করার বা কোনো নাস্তিক ও যালিমের প্রতি দয়া দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ ইতিহাসের পাতায় এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংরক্ষিত আছে। আর তা হলো, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাকাফী ছিলেন একজন অত্যাচারী ও যালিম শাসক। তার নির্দেশে অনেক আলেমের শিরশ্ছেদ করা হয়েছিলো। বহু ওয়ালী আল্লাহকে সে অনেক কঠোর নির্যাতন করেছিলো। ইতিহাস আরও লিপিবদ্ধ করে রেখেছে যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কোরআনের প্রচার প্রসারেও ব্যাপকভাবে খেদমাত করেছে। শুধু তাই নয়; মুসলিম রাজ্যের সম্প্রসারণেও তার প্রচুর ভূমিকা রয়েছে।

কিন্তু সেই হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সম্পর্কে ইতিহাসের নথিতে আরো বলা আছে যে, যখন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মারা যায়, তখন আল্লাহর এক খাস বান্দা ইব্রাহিম নাখাঈ এত বেশি খুশি হয়েছিলেন যে, তাঁর চোখ থেকে সেদিন আনন্দের অশ্রু প্রবাহিত হয়েছিলো। এখানেই শেষ নয়; হাজ্জাজের মৃত্যুতে হাসান বসরি এবং উমর বিন আবদুল আজিজ আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের জন্য সিজদায় পড়ে গিয়েছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে, যালিম ও নাস্তিকের ব্যাপারে আমাদের অর্থাৎ ইসলামপন্থীদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন হওয়া উচিত। সবার কাছে জালিম ও নাস্তিকের একই পরিচয় থাকা উচিত। অর্থাৎ সে যালিম ও ইসলাম বিদ্বেষী ছিলো, একথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে হবে।
অত্যাচারীকে অত্যাচারী বলার সাহস রাখতে হবে। সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম, আর সে জীবিত হোক বা মৃত, সে অন্য কোনো নেক আমল করেছে কি করে নাই, এটি দেখার বিষয় নয়। তার সকল অপকর্ম সম্পর্কে দেশ ও জাতিকে প্রকাশ্যে জানান দিতে হবে।
কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি যে, যখনই কোনো যালিম বা নাস্তিক মরে যায়, তখনই আমাদের মধ্য হতে কিছু অতি আবেগী এসব নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষীদের মৃত্যুতে অন্যদেরকে ইন্না লিল্লাহ্ বলার জন্য নাসীহাহ্ করতে চলে আসে। এই সেই বলে তাদের মৃত্যুতে ইন্না লিল্লাহ্ পড়ার পরামর্শ দিতে থাকে। তাদের জন্য জন্য দো‘য়ার আবেদন নিয়ে অন লাইনে হাজির হয়ে যায়।

সে যে এই দেশের ইসলাম ও মুসলমানদের কী পরিমাণ ক্ষতি করেছে এটি বলতে লজ্জা করে। সে ইসলাম বিদ্বেষী শক্তির উত্থানে কী পরিমাণ সহযোগিতা করেছে? ইসলাম ও আলেমদের বিরুদ্ধে কত ধরণের কুমন্ত্রণা সাপ্লাই করেছে এবং দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকার কত হাজার হাজার পাতা ইসলামের বিরুদ্ধে লিখে কালো করেছে? এগুলো সব ভুলে গিয়ে এখন ইন্না ইল্লাহ্ বলে তথাকথিত ইসলামিস্টরা তার জন্য দো‘য়ার আবদার নিয়ে হাজির হয়েছে।

যদি কোনো ব্যক্তি ইসলাম ও আলেম-ওলামাদের বিরোধীতার জন্য লেখার মাধ্যমে যুলুম অত্যাচারের পাহাড় ভেঙে ফেলে, ইসলাম বিদ্বেষীদের পক্ষ হয়ে কলম ধরে, সরকারকে ইসলামপন্থীদের টুটিচেপে ধরার জন্য বুদ্ধি সাপ্লাই দেয়, এধরণের নাস্তিক ও ইসলাম বিদ্বেষীদের মৃত্যুর পর কিছু মানুষ তাকে যালিম, নাস্তিক না বলে মানবতার হিতৈষী হিসেবে স্মরণ করতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, যালিমের ব্যাপারে তাদের অবস্থান দুর্বল ও সন্দেহজনক।
আমাদেরকে আরো মনে রাখতে হবে, মৃত্যুর কাজ যালিমের দাগ ও কলঙ্ক ধুয়ে মুছে ফেলা নয়; বরং এসব যালিম ও নাস্তিকদেরকে কেয়ামতের ময়দানে অনুষ্ঠিত আল্লাহর একক ট্রাইবুন্যালে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়ার কাজটি করে মাত্র। তার যুলুম ও নাস্তিকতা এবং ইসলাম বিদ্বেষী হওয়ার জন্য তাকে শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে। আপনি ইন্না লিল্লাহ্ বলার কে?

তাই যখন ঈমানদারদের কোনো একজন নাস্তিক বা যালিম শাসকের মৃত্যুর পর দো‘য়া করে বলে উঠে যে, আল্লাহ! তাকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান করুন, তাকে আপনার আরশের ছায়ায় স্থান দিন এবং হাউজে কাওসার পান করান ও তাকে মহানবী (স.)-এর সাহচর্য দান করুন, তখন প্রকৃতপক্ষে এধরণের অতিদরদীরা ভুলে যায় যে, পরকাল কেন ও কী কারণে সংঘটিত হবে? কেন সবাইকে আল্লাহর আদালতে দাঁড়াতে হবে? আর কিয়ামাতের দিনের মালিক কেন সব মানুষকে একত্র করে সবার হিসাব নেবেন?
প্রকৃতপক্ষে ঈমানেদারকে বুঝতে হবে যে, আখেরাতের প্রতি আমাদের বিশ্বাস অত্যন্ত স্পষ্ট এবং দৃঢ় হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দো‘য়া কিন্তু আমাদের ঈমান-আক্বিদার প্রকাশ ঘটায়। এটি যিনি বুঝতে পারবেন, তিনি আগাচৌসহ কোনো নাস্তিক ও যালিমের জন্য কখনো দো‘য়া করতে পারবেন না।
অতএব আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আমরা যখন একজন যালীম ও নাস্তিকের মৃত্যুকে যালিম ও নাস্তিকের মৃত্যু বলি, তখন আমরা সত্যের সাক্ষ্য দেওয়ার দায়িত্ব বহন করি মাত্র। তার সাথে শত্রুতার প্রকাশ ঘটাই না। কারণ এমন সাক্ষ দেয়া মুসলিম উম্মাহর ঈমানী দায়িত্ব।

স্বাহীহ্ বুখারীর একটি বর্ণনা অনুসারে, সাহাবায়ে কেরাম যখন একটি জানাযার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিলেন যে, এটি একটি খারাপ ব্যক্তির জানাযাহ্ এবং যখন তারা অন্য আরেকটি জানাযার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলেছিলেন যে, এটি একজন ভাল মানুষের জানাযাহ্, এটি শুনে তখন রাসূল (স.) বললেনঃ যার প্রশংসা করেছেন তার জন্য বেহেশত নির্ধারণ করা হয়েছে এবং যার যুলুম অত্যাচারের কথা স্মরণ করে তার জন্য বদ্ দো‘য়া করেছন, তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ ঈমানদাররা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী।

এই পৃথিবীতে মুমিনদের অবস্থান ও দায়িত্ব হলো সত্যের সাক্ষ্য দেওয়া। যারা ভালো তাদেরকে ভলো বলবে, আর যারা খরাপ তাদেরকে খারাপ বলবে। এটি ঈমানদারের ঈমানী দায়িত্ব। এখন অতিদরদী সেজে এক দল বের হয়েছে, তারা যে যত বড় যালিম ও নাস্তিক তার জন্য ততবেশি দো‘য়ার আবেদন নিয়ে হাজির হয়ে যায়। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন খুবই স্পষ্ট। তাদের উপরিউক্ত ঘটনাটি আমাদেরকে মনে রাখতে হবে।
এর মানে এই নয় যে, মৃতদেরকে গালি দেওয়া ইসলামে অনুমোদিত। মৃতদেরকে গালি দেওয়া নিষেধ। কিন্তু একজন অত্যাচারী, যালিম ও নাস্তিককে যালিম ও নাস্তিক বলা গালি নয়; বরং এটি একটি সত্যের প্রকাশ্য ঘোষণা মাত্র। অতএব গালি ও সত্যের ঘোষণার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। কারণ এই সত্যের ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিটি জীবিত যালিম ও নাস্তিককে মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, তোমরা অত্যাচার ও নাস্তিকতা বন্ধ না করলে মৃত্যুর পরও তোমাদেরকেও যালিম ও নাস্তিক হিসেবে ঘৃণার সাথে স্মরণ করা হবে।
একজন অত্যাচারী মারা গেলে তার অত্যাচারকে উপেক্ষা করা এবং তার অন্যান্য গুণাবলী খুঁজে বের করা এবং বর্ণনা করা আসলে ইতিহাস এবং আগামী প্রজন্মকে ভুল উপাদান সরবরাহ করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই মিথ্যা উপাদানটি পরবর্তী প্রজন্মকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। এসব বিশেষণ মানব সমাজ ও মানবতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। কারণ আপনার এসব আবেগি দো‘য়া তাদের দৃষ্টিতে এসব যালিম ও নাস্তিকরা মানবতার হিতৈষী হিসাবে বিবেচিত হবে।
আল্লাহর রাসূল (স.) কোরআনের আলোকে আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে, যখন কোনো বিপদ আপতিত হয় তখন إنا لله وإنا إليه راجعون পাঠ করতে হবে। তাই মুসলমানরা যখন কষ্টে বা বিপদের মধ্যে থাকে তখন এই নাববী শিক্ষার আলোকে ‘ইন্না লিল্লাহ্’ পড়ে।
তাই এখন কোনো যালিম ও নাস্তিক মারা গেলে যদি আমরা ইন্না লিল্লাহ্ পড়া শুরু করে দেই, তাহলে আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, এসব যালিম ও নাস্তিকদের মৃত্যুকে আমরা নিজেদের জন্য বেদনার কারণ মনে করছি, আর তাই ইন্না লিল্লাহ্ পড়ছি।
অথচ অত্যাচারী শাসক, যালিম ও নাস্তিকের মৃত্যু মানব সমাজে বিপদের আগমন নয়; বরং বিপদের উত্তীর্ণ হওয়ার আলামাত।

অত্যাচারী শাসক যখন শাস্তির পর্যায়ে পৌঁছায় তখন ইমাম তাউস কুরআনের সূরাতুল আনআম এর ৪৫ নং আয়াতটি পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আর তাই হাজ্জাজ বিন ইউসুফের যখন মৃত্যুর খবর তিনি শুনলেন, তখন তিনি আনন্দিত হয়ে এই আয়াতটি পাঠ করলেন:
فَقُطِعَ دَابِرُ الْقَوْمِ الَّذِينَ ظَلَمُوا وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
"সুতরাং যারা যুলুম করেছিল তাদের মুলোচ্ছেদ করা হলো। আর সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বিশ্বজাহানের প্রতিপালক।"

অতএব আগাচৌসহ প্রত্যেক যালিম ও নাস্তিকের মৃত্যুতে এই সত্যটি ঘোষণা করা প্রতিটি মুসলমানে ঈমানী দায়িত্ব। ঈমানদারদের আঙিনায় এটি শুরু হলে যালিমদেরকে যুলুম থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্ক করা হবে। অন্যথায় আল্লাহর সকল সৃষ্টি কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের উপর অভিসম্পাত বা লা‘নাত বর্ষণ করতে থাকবে। আর আল্লাহ্ যালিম এবং নাস্তিকদেরকে কেয়ামতের দিন অবশ্যই পাকড়াও করবেন।


-ডক্টর আতাউর রহমান নদভী।

পঠিত : ৭৯৫ বার

মন্তব্য: ০