Alapon

সুয়েজ ক্রাইসিস, মিশরের এক অবিস্মরণীয় বিজয়...



সুয়েজ খাল (Suez Canal) ইউরোপের সাথে এশিয়ার বাণিজ্যের মেরুদণ্ড। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুয়েজ খাল থেকে প্রতি বছর ৬.৩ বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব আদায় করে। সুয়েজ খাল মিশরে অবস্থিত এবং মিশরের সরকারের মালিকানাধীন। কিন্তু আগে এরকম ছিলো না। ১৯৫৬ সালে মিশর একে জাতীয়করণ করলে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইসরায়েল মিশরকে আক্রমণ করে। সৃষ্টি হয় সুয়েজ সংকট কিংবা সুয়েজ ক্রাইসিসের। সুয়েজ খালের ইতিহাস কী? সুয়েজ ক্রাইসিস কেন তৈরি হয়েছিলো? সুয়েজ ক্রাইসিসে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কী ভূমিকা ছিলো? এটি কী করে মিশরের বিজয় হয়ে উঠলো? চলুন এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক।

সুয়েজ খাল আজ যেখানে অবস্থিত সেখানে আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর পূর্বেও প্রাকৃতিক সরু খাল ছিলো। সে হিসেবে বলা যায় আজ থেকে ৪০০০ বছর পূর্বেও সুয়েজ খালের অস্তিত্ব পাওয়া ছিলো। আধুনিক তথা আজকের সুয়েজ খালের নির্মাণ শুরু হয় ১৮৬৯ সালে একজন ফরাসি কুটনৈতিক ফার্দিনান্দ ডি লেসিপেস (Ferdinand D Lesseps) এর উদ্যোগে। ১৮৭৯ সালে সুয়েজ খাল নির্মাণ শুরু হওয়ার ১০ বছর পর সুয়েজ খাল নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুয়েজ খাল ইউরোপ থেকে এশিয়ার দূরত্ব ৫০০০ নর্টিকেল মাইল কমিয়ে দেয়। সুয়েজ খাল "Suez Canal Company" এর মালিকানাধীন ছিলো। সুয়েজ কেনাল কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ারের মালিক ছিলো ফ্রান্স এবং মিশর। কোম্পানি এবং মিশরের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী সুয়েজ খাল নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পরবর্তী ৯৯ বছর এটি কোম্পানির মালিকানধীন থাকবে। ৯৯ বছর শেষ হওয়ার সাথে সাথে মিশর সুয়েজ খালের মালিক হয়ে যাবে। ১৮৭৫ সালে মিশরের রাজা (Ismael Pasha) ঋণ পরিশোধের জন্য সুয়েজ খালে থাকা মিশরের মালিকানা ব্রিটেনের কাছে বিক্রি দেয়। যা সুয়েজ খালের পুরো মালিকানার ৪৪ শতাংশ ছিলো। ব্রিটেন শুরুতে নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করে সুয়েজ খাল নির্মাণের বিরোধীতা করেছিলো। সুয়েজ খাল নির্মাণের পর ব্রিটেনের অধিকাংশ বাণিজ্য সুয়েজ খাল দিয়েই হতো। তাই ব্রিটেন এই খালের মালিকানা অর্জন করতে চাচ্ছিলো। অবশেষে মিশর ১৮৭৫ সালে মিশরের শেয়ার কেনার মাধ্যমে সুয়েজ খালের মালিকানা লাভ করলো।

১৮৮৮ সালে মিশর পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশ কলোনি হয়ে যায়। ফলে সুয়েজ খালের প্রায় সম্পূর্ণ মালিকানা বিট্রেনের হাতে চলে আসে। যে কোন ধরনের সংঘাত থেকে সুয়েজ খালকে নিরাপদ রাখতে ১৮৮৮ সালের একটি চুক্তিতে সুয়েজ খালকে "Neutral Zone" নিরপেক্ষ অঞ্চল ঘোষণা করা হয় এবং অন্য সকল দেশকে সুয়েজ খাল ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়৷ কিন্তু এই চুক্তি শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ ছিলো। মিশর ব্রিটেনের কলোনি ছিলো এবং সুয়েজ খাল ব্রিটেনের কৌশলগত অস্ত্র ছিলো। ব্রিটেন তাঁর এই কৌশলগত অস্ত্র থেকে প্রচুর সুবিধা আদায় করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন নিজের এবং মিত্র দেশগুলোর জাহাজ ছাড়া অন্য কোন জাহাজা সুয়েজ খাল দিয়ে চলাচল করতে দেয় নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২২ সালে মিশর ব্রিটেন থেকে পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করে৷ তাও মিশরের ওপর ব্রিটেনের অনেক প্রভাব ছিলো এবং মিশরে ব্রিটেনের সেনাবাহিনীও মোতায়েন ছিলো।

মিশরের সরকার এবং জনগণ ব্রিটেনের সামরিক উপস্থিতির ওপর অসন্তুষ্ট ছিলো। ১৯৩৬ সালে মিশর এবং ব্রিটেনের মধ্যে "Anglo-Egyption Treaty" এঙ্গলো-মিশর চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন সুয়েজ খালের নিরাপত্তার জন্য মোতায়েনকৃত সৈন্য বাদে বাকী সকল সৈন্য আগামী ২০ বছরের মধ্যে প্রত্যাহার করবে। ১৯৫২ সালে মিশরে এক বিপ্লবের শুরু হয়। এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জামাল আব্দুল নাসের (Gamal Abdul Nasir) করছিলেন। জামাল আব্দুল নাসের মিশরে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরোধী ছিলেন।

জামাল আব্দুল নাসের ১৯৫৪ সালে মিশরের প্রধানমন্ত্রী হন। তাঁর ক্ষমতা নেওয়ার সাথে সাথে মিশরের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিলো। মিশর ইসরায়েলের জন্য তিরান প্রণালী (Tiran Strait) বন্ধ করে দেয়। জামাল আব্দুল নাসের মিশরীয়দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি মিশরের ওপর বিদেশি হস্তক্ষেপ বন্ধ করবেন এবং নীল নদের ওপর আসওয়ান বাঁধ (Aswan Dam) নির্মাণ করবেন। ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক ক্রমাগত খারাপ হওয়ায় জামাল আব্দুল নাসের আমেরিকার কাছে অস্ত্র চান। যেহেতু আমেরিকা ইসরায়েলের বন্ধু রাষ্ট্র। তাই আমেরিকা মিশরের এই অনুরোধ প্রত্যাখান করে। আমেরিকা অস্ত্র দিতে অস্বীকার করলেও আসওয়ান বাঁধ নির্মাণের জন্য অর্থ সহায়তা দিতে প্রস্তুত ছিলো। এছাড়া ব্রিটেনও মিশরকে আসওয়ান বাঁধ নির্মাণের জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়ার কথা বলেছিলো। আমেরিকা অস্ত্র দিতে অস্বীকার করায় জামাল আব্দুল নাসের চেকোস্লোভাকিয়ার (Czechoslovakia) সাথে অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করেন।

চেকোস্লোভাকিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের জোটসঙ্গী ছিলো। তাই আমেরিকা ও ব্রিটেন অস্ত্র চুক্তি পছন্দ করে নি এবং অস্ত্র চুক্তির কারণ দেখিয়ে আসওয়াম বাঁধ নির্মাণের জন্য অর্থ সহায়তা দিতে অস্বীকার করে। জামাল আব্দুল নাসেরের কাছে এত বৃহৎ বাঁধ নির্মাণের অর্থ জোগাড় করার অন্য কোন উপায় ছিলো না। এছাড়া তিনি আগে থেকেই মিশরে ব্রিটিশ সামরিক উপস্থিতির বিরোধী ছিলেন। তাই তিনি ১৯৫৬ সালের ২৬ শে জুলাই সুয়েজ খালকে জাতীয়করণ করার ঘোষণা দেন।

জামাল আব্দুল নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে বলেন এই খালের রাজস্ব দিয়ে আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ করা হবে। সুয়েজ খালের জাতীয়করণ অনেক বড় পদক্ষেপ ছিলো। যা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তিদের নাখোশ করতো। কিন্তু জামাল আব্দুল নাসের তাঁর পরোয়া না করেই এই সিদ্ধান্ত নেন। ফলাফল স্বরুপ ব্রিটেন এবং ফ্রান্স এই সিদ্বান্তে চরম অসন্তুষ্ট হয়। কারণ ফ্রান্স এবং ব্রিটেনই সুয়েজ খালের অধিকাংশ শেয়ারের মালিক ছিলো। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য থেকে উৎপাদিত তেল এই খালের মাধ্যমেই ইউরোপে যায়। ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিলো তেল। তাই সুয়েজ খালের জাতীয়করণ অস্তিত্ব সংকট হিসেবে দেখা দেয়। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সিদ্ধান্ত নেয় এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো জামাল আব্দুল নাসেরের সরকার পতন ঘটানো।

ব্রিটেন এই সমস্যার দ্রুত সমাধান চাচ্ছিলো। যার জন্য লন্ডনে একটি কনফারেন্সও হয়। এই কনফারেন্সে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স আবারও সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর হাতে দিয়ে দিতে বলে। আমেরিকা এই কনফারেন্সে যে কোন ধরনের আক্রমণের প্রচন্ড বিরোধীতা করে। শীতল যুদ্ধের এই সময়ে আমেরিকা চাচ্ছিলো না এমন কোন পদক্ষেপ নেওয়া হোক যার মাধ্যমে আরবদেশগুলো সোভিয়েত ব্লকে চলে যায়। কিন্তু ব্রিটেন আমেরিকার আপত্তির কোন পরোয়া করে নি। এই সমস্যার সমাধানের জন্য ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইসরায়েল প্যারিসে একটি গোপন চুক্তি সই করে। এই চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল প্রথমে সুয়েজ খালে হামলা করবে।

মিশর যখন এর জবাব দিতে শুরু করবে তখন ফ্রান্স এবং ব্রিটেন মিশর ও ইসরায়েলকে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করতে বলবে। স্বাভাবিকভাবেই মিশর তা প্রত্যাখান করবে। মিশর প্রত্যাখান করার ফলে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অযুহাত পেয়ে যাবে। তারা মিশরের ওপর হামলা করবে এবং জামাল আব্দুল নাসেরের সরকারের পতন ঘটাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসরায়েল ১৯৫৬ সালের ২৯ শে অক্টোবর মিশরের সিনাই উপদ্বীপে (Sinai Peninsula) হামলা করে এবং তা দখল করে নেয়।

ফ্রান্স এবং ব্রিটেন তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মিশর ও ইসরায়েলকে যুদ্ধ বিরতি করার আল্টিমেটাম দেয় এবং মিশরকে সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান করে৷ ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের ধারণা মোতাবেক মিশর তা প্রত্যাখান করে। এভাবে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার অযুহাত পেয়ে যায়। দু দিন পর ফ্রান্স এবং ব্রিটেন মিশরের ওপর হামলা করে। তারা পোর্ট সাঈদ (Port Said) এবং পোর্ট ফুয়াদ (Port Fuad) দখল করে নেয়। ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের আগ্রাসনের বিপক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব দেওয়া হলে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন তা ভেটো করে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের এই হামলাকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। অবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন শীতল যুদ্ধের সময় ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের ওপর হামলার হুমকি দেয়। অন্যদিকে আমেরিকার অনুমতি না নিয়ে আমেরিকার মিত্রদেশগুলোর এমন পদক্ষেপ আমেরিকাও পছন্দ করছিলো না।

আমেরিকা তাঁর মিত্রদেশগুলোর ওপর অসন্তুষ্ট ছিলো। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার (Dwight Eisenhower) তাঁর ভাষণে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং ইসরায়েলকে সৈন্য প্রত্যাহার না করলে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকি দেন। আমেরিকার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকি কাজ করে। ৬ নভেম্বর ব্রিটেন যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে এবং ডিসেম্বর নাগাদ ফ্রান্স এবং ব্রিটেন তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। মার্চে ইসরায়েলও সৈন্য প্রত্যাহার করে। যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করার পর জাতিসংঘের শান্তি রক্ষী ফোর্সে মিশরে আসে এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের সৈন্য প্রত্যাহার তত্ত্বাবধান করে। প্রথমে ইসরায়েল, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনকে সফল মনে হলেও তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর ফলে চুক্তি অনুযায়ী সুয়েজ খাল ১৯৫৮ সালে মিশরের হওয়ার কথা থাকলেও মিশর ১৯৫৬ সালেই সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায়। এভাবে সুয়েজ ক্রাইসিস মিশরের কুটনৈতিক, ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক বিজয়ে পরিণত হয়। ফ্রান্স এবং ব্রিটেন কিছু না পেলেও ইসরায়েল তিরান প্রণালী ব্যবহারের অনুমতি পায়। এভাবে এটা ইসরায়েলেরও বিজয়। জামাল আব্দুল নাসের ইসলাম পন্থীদের দমনের জন্য কুখ্যাত থাকলেও এই ঘটনার পর তিনি আরব বিশ্বের একজন নায়ক হিসেবে পরিচিত পান। এই ঘটনার পর ব্রিটেন বুঝতে পারে সে আর সুপার পাওয়ার নেই। আমেরিকা এখন সুপার পাওয়ার। এই ঘটনার পর মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রভাব বাড়তে থাকে।


তথ্যসূত্রঃ
১। Suez Canal Authority.
২। Suez Canal - HISTORY.
৩। 9 Fascinating Facts About the Suez Canal - HISTORY.
৪। Suez Canal revenues hit all-time record at $6.3 billion | AP News
৫। Suez Crisis - Definition, Summary & Timeline - HISTORY
৬। Suez Crisis | Definition, Summary, Location, History, Dates - Britannica.
৭। Why Was The Suez Crisis So Important? | Imperial War Museums

সাইফুল্লাহ আল মানসুর

পঠিত : ১০৫৪ বার

মন্তব্য: ০