Alapon

পলাশী বিপর্যয় : আজকের প্রেক্ষাপট


পলাশী বিপর্যয় : আজকের প্রেক্ষাপট
পলাশী ভাগ্যাহত এক নবাবের পরজয়ের দিন শুধু নয়, ইতিহাসের বাক ঘোরানো রক্তাক্ত উপখ্যান। একটি জাতির উত্থান পতনই শুধু নয় পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে দেয়া এক দুষ্টু ক্ষতের নাম। পলাশীর থরো থরো স্মৃতি রোমন্থন অতীতের বেদনাগুলো সামনে এনে হাজির করে; এর বিপরীতে জীবন এবং জমিনের নতুন বীজ বপনে চেতনার আলোকচ্ছটাকে দ্যুতিময় করে। অতীত হয়ে যাওয়া দুঃসহ বেদনার সরল রেখাগুলো নানান বক্রতা, জটিলতা আর ধোয়াশায় ঘেরা; যা এ জাতিকে দুশ বছরের গোলামীতে আবদ্ধ করেছিলো। উপমহাদেশের ইতিহাসে বিয়োগান্ত এ ঘটনা শুধু এই জনপদেরই নয় গোটা দুনিয়ার অর্থনীতি, রাজনীতি এবং বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় এক সুদুরপ্রসারী প্রভাব রেখে গেছে। ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তনে তুর্কী খেলাফতের সাথে এই জনপদের বিচ্ছিন্নতাকে মোটা দাগে সুষ্পষ্ট করে তুলেছে। প্রভাব পড়েছে ইরান আফগানিস্তান আর মধ্যপ্রাচ্যের ভু রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে। ইতিহাসের এ চড়াই-উতড়াই আর আশা-হতাশার ঘটনা-দূর্ঘটনাগুলো ভবিষ্যতের বুনিয়াদ গড়তে মানবগোষ্ঠীকে নিত্য নতুন চিন্তার দ্যোতনায় আন্দোলিত করে। ইতিহাস মানুষের বিশ্বাস এবং কর্মে প্রতিনিয়ত চিন্তার খোরাক যোগান দেয়। বর্তমানকে বিচার করে ভবিষ্যতের বুনিয়াদ গড়ার অপরিহার্য উপাদান ইতিহাস। পলাশীর বিয়োগান্ত ঘটনা আমাদের জাতিসত্বার সাথে অষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকা এমন দুঃখ দিনের করুণ কাহিনী। পলাশীর দুঃসহ ঘটনা আমাদের ইতিহাস, আস্তিত্ব আর বিশ্বাসের শক্তিশালী ভিতগুলোকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো, যার প্রভাব আজও নানাভাবে বিদ্যমান। দুশ বছরের ইংরেজ গোলামীর অবসান ঘটলেও তার দুষ্টু ক্ষতের প্রভাব আমরা অনুভব করি প্রতিনিয়ত।
পলাশী শুধু একটি মাঠের নাম নয়। পলাশীর শুধু কিছু আম গাছের সাড়ি নয়। ভাগীরথীর তীরের অম্র কাণনে দুই শক্তির লড়াইয়ের নামও পলাশী নয়। আপোষহীন নবাব সিরাজের স্মৃতিগাথা এ ময়দান। পলাশী মানে স্বাধীনতা রক্ষায় একদল সাহসী বীর, তার বিপরীতে অজস্র বিশ্বাসঘাতক আর বেঈমানের অট্টহাসি। জাতিসত্বার বিনাসে একদল বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রের ইতিহাস ধারণ করে আজও এ ময়দান কথা বলে। ভাগীরথীর সেই স্রোত নেই। নদীর দুই পারের মানুষগুলো নেই। সেই সময়ের কৃষকরা নেই। কৃষি নির্ভর গ্রামীণ জনপদের সাড়ি সাড়ি বাড়ি আর মুর্শিদাবাদের রাজ দরবারের কল কোলাহল নেই। এর পরও অসংখ্য স্মৃতি ধারণ করে ইতিহাস সচেতন মানুষগুলোর হৃদয়ে পলাশী নিয়ত চেতনার বহ্নি জালায়। স্বাধীনতাকামী মানুষের মানসপটে পলাশী মানে প্রতিনয়ত বিদ্রোহ আর যুদ্ধের দামামার মাঝে স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকার। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করা মীর জাফর, উমিচাদ, ঘষেটি বেগমদের বিরুদ্ধে দ্রোহ। পলাশী আমাদের চিনিয়ে দিয়েছে নায়ক আর খলনায়কের শ্রেণি চরিত্রকে। পর্দার আড়ালে বাস করা কালো কেউটে, বিষধর কালফনি আর হিংস্র শাপদের মূখোষ উম্মোচন করেছে পলাশী। রায় দূর্লভ, ইয়ার উদ্দিন, উমিচাঁদ, জগৎশেঠরা এখন আর কোনো ব্যক্তি সত্বার নাম ধারণ করে না। এ নামগুলো এক একটি বিশ্বাসঘাতকার প্রতীক।
পলাশী শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করার প্রেক্ষাপটকে উজ্জল আলোয় নিয়ে এসেছিলো। পলাশীর স্মৃতিকে ধারণ করে তাই আজও বন্ধুরূপী বিশ্বাস ঘাতক আর বেনিয়ার চরিত্র ধারনকারী খলনায়কদের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ করতে পারি। আধিপত্যবাদের দন্তনখর শুধু ফেলানীর লাশই উপহার দেয় না আমাদের স্বাধীনতা এবং সীমান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সাম্রাজ্যবাদের চতুর্মূখী হামলা আমাদের অস্তিত্ব আর বিশ্বাসের বট বৃক্ষের শেকড় কাটে প্রতিনিয়ত। সাহায্যের নামে এন জিও তৎপরতা, উন্নয়নের শ্লোগাণে চরিত্র বিনাশী কর্মকান্ড। সংস্কৃতি বিকাশের নামে জাতিসত্বা বিরোধী চরিত্রকে হাজির করা। সবই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। আড়াইশ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে এলেও পলাশী এবং নবাব সিরাজকে নিয়ে নির্মোহ আলোচনা খুব কমই হয়েছে। ইতিহাসের পেছনের সবচেয়ে নির্মম সত্য হচ্ছে- বিজয়ীরাই ইতিহাস রচনা করে। যেখানে পরাজিত ব্যাক্তির কথা স্থান পায় না। যদিও বা তাদের নাম চলে আসে; তবে সত্যকে এড়িয়ে মিথ্যাকেই তাদের নামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। নবাব সিরাজের ব্যাপারেও সত্যের চেয়ে মিথ্যাকেই বেশি স্থান দেয়া হয়েছে। একইভাবে পলাশীর বিয়োগান্ত ঘটনায় ষড়যন্ত্রের কুশীলব ব্রিটিশ বেনিয়ারা আজ ধোয়া তুলশীপাতা। পলাশী এবং নবাব সিরাজ সম্পর্কে সত্যাশ্রয়ী বই পুস্তক পাওয় দুস্কর। ইন্টারনেটে যা কিছু তথ্য পাওয়া যায় তার অধিকাংশই তথ্য বিকৃতি বৈ কিছুই নয়। অত্র নিবন্ধে ইতিহাসের অদ্যপান্ত লেখা যেমন সম্ভব নয়, একইভাবে ঘটনার কুশীলব সকলের বিবরণ তুলে ধরাও সম্ভব নয়। ইতিহাসের আলোর এ ক্ষীণধারা জাতিসত্বার অস্তিত্ব রক্ষায় বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মকে চিরায়ত বিশ্বাস, আদর্শ, ঐতিহ্য, দেশপ্রেম আর স্বকীয়তা রক্ষায় নতুনভাবে উদ্বদ্ধ করবে এটাই প্রত্যাশা।
বিগত কয়েক শতাব্দীকাল অব্দি বিশ্বব্যাপী ইংরেজ, ফরাসী, ডাচ, এবং ওলন্দাজ শক্তি গোটা দুনিয়ায় শক্তির বলে দেশ দখল এবং সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। আজ যারা নিজেদেরকে প্রথম শ্রেণির রাষ্ট্র বলে পরিচয় দিচ্ছে, তারা এক সময় অতি দরিদ্র রাষ্ট্রের কাতারে শামিল ছিল। বৃটেনের বর্তমান জৌলুসের পেছেনে তাদের দখলদারী আর আগ্রাসি বাণিজ্যিক কুট কৌশলই প্রধান উপজীব্য। বৃটিশ বণিকরা প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে আগমণ করে বাণিজ্য উপলক্ষ্যে। তাদের বাণিজ্যিক লাভ লোভে পরিণত হয় এবং আস্তে আস্তে এ দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তা হওয়ার জন্য তারা নানা কুট কৌশল আর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। ষোলশ’ খৃষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের একদল ব্যবসায়ী ইস্ট ইন্ডিজে ব্যবসা করার জন্য রাণী এলিজাবেথের সনদ লাভ করে। এ কোম্পানীর নাম ছিল ‘‘দি গভর্ণর এন্ড মার্চেন্টস অব লন্ডন ট্রেডিং ইন টু ইস্ট ইন্ডিজ’’ বেশ কিছুকাল পর ‘‘দি ইংলিশ কোম্পানী ট্রেডিং ইন টু দি ইস্ট ইন্ডিজ’’ নামে আর একটি প্রতিদ্বদন্দী বাণিজ্যিক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপের অন্যান্য বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর সাথে দুটি কোম্পানী এক হয়ে যায়। ঐক্যবদ্ধ কোম্পানীর নাম ‘‘দি ইউনাইটেড কোম্পানী অব মার্চেন্টস অব ইংল্যান্ড ট্রেডিং টু ইস্ট ইন্ডিজ’’ সংক্ষেপে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। এই কোম্পানী ভারতীয় উপমহাদেশে একচেটিয়া ব্যবসা করার অধিকার লাভ করে। ব্যবসার মাধ্যমে তারা অহমদাবাদ, আগ্রা, হয়ে ক্রমে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। এভাবেই আস্তে আস্তে তারা বাংলার নবাবী এলাকা এবং সমগ্র ভারত গ্রাস করে।১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কলিকাতা কাউন্সিল নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সংহাসনচূৎ করার জন্য এক প্রস্তাব পাশ করে। প্রস্তাব অনুযায়ী ক্লাইভ প্রথমে উমিচাঁদকে বসে আনে। উমিচাঁদ মীরা জাফরের সাথে যোগাযোগ করে তাকে নবাবের বিরুদ্ধে সড়যন্ত্রে শরীক করে। ষড়যন্ত্রকারীগণ জগৎশেঠের বাড়িতে এক বৈঠকে মিলিত হয়। ইংরেজ কোম্পানীর এজেন্ট ওয়াটস নিজের চেহারা ঢেকে মহিলাদের মতো পর্দা ঘেরা আসনে বসে এ বৈঠকে অংশগ্রহণ করে। বৈঠকে উমিচাঁদ রায় দূর্লভ, মীর জাফর, রাজবল্লভসহ বেশ কয়েকজন কর্তা ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। এখানেই তারা এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী মীর জাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে সকল প্রকার সহযোগিতা করতে সম্মত হয়।
বাংলা বিহার উরিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব নবাব সিরাজ উদ্দৌলা তার নানা আলী বর্দী খার মৃত্যুর পরে রাজ সিংহাসনে আসীন হন। নবাব সিরাজের দুঃখজনক পরাজয়ের জন্য অনেকেই তাঁর রাজনৈতিক অদূরর্শীতাকে দায়ী করেন। কেউ কেউ তো আগ বাড়িয়ে তাকে মদ্যপ এবং চরিত্রহীন বলতে দিধা করে না। অবশ্য ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ ইতিহাস এভাবেই লেখা হয়েছে। আপনি যদি ওপার বাংলায় যান কিংবা মুর্শিদাবাদে গিয়ে গ্রামের সাধারণ সহজ সরল কৃষকদের জিজ্ঞেস করেন সিরাজউদ্দৌলা কেমন লোক ছিল? অধিকাংশ লোকই নেতিবাচক উত্তর দিবে। এর কারণ বিজীতদের দ্বারা ইতিহাস রচিত হয়েছে আর সে ইতিহাসে পরাজিতদের চরিত্র হনন ছিল এক মৌলিক বিষয়। ড. মোহর আলী তার Mohor Ali, The History of Muslims of Bengal বইয়ে লিখেছেন, ‘পলাশী যুদ্ধের অব্যবহিত পর থেকেই সিরাজ চরিত্র হণনের একটি অসুস্থ প্রবণতা তৈরী হতে থাকে এবং যুদ্ধে পরাজয়ের সকল দায় দায়িত্ব তাদের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। এটা খুব সহজেই বোধগম্য যে, সিরাজের বিরোধীরাই পলাশী যুদ্ধ-পরবর্তী প্রায় দুই শতাব্দীকাল শাসন ক্ষমতায় অধিষ্টিত থেকেছে এবং পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সিরাজ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ও মূল্যায়ণকে প্রভাবিত করেছে’। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের অর্থ এ নয় যে, একজন শাসক গিয়েছে আর একজন শাসক এসেছে। এ উপমহাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংষ্কৃতি, আইন, শাসন, সামগ্রিক জীবনাচার, ধর্ম, কৃষ্টি, সভ্যতা,সামাজিকতা এবং অর্থনৈতিক জীবনে যে অমূল পরিবর্তন সাধিত হয়, তাতে সমাজের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলি হয়ে যায় সবচেয়ে নিঃস্ব, দরিদ্র, নির্যাতিত অপরদিকে একদল তোষামুদে দালাল তৈরী হয়, যারা সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তা বনে যায়। এই সামগ্রিক পরিবর্তনকে একজন নবাবের পতন হিসেবে দেখা মানে ইতিহাসের অবমূল্যায়ন করা, জাতিসত্বার অস্তি¡ সম্পর্কে বেখবর থাকা। মূলত বাংলার ক্ষমতা দখল এবং এখানকার সম্পদ লুণ্ঠনই ছিলো দখলদার ইংরেজদের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রধান বাধা ছিলো নবাব এবং সম্ভ্রান্ত তৎকালীন সমাজের মুসলিম পরিবারগুলো যারা কখনো ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি ছিলো না। এ জন্য তারা ষড়যন্ত্রের যে জাল বিস্তার করে তারই ধারাবাহিক ফল পলাশীর বিপর্যয়।
পলাশীর প্রান্তরে ইস্ট কোম্পানী কোনোভাইে সফল হতো না যদি ষড়যন্ত্রকারীরা সৈন্যদেরকে যুদ্ধ হতে বিরত না রাখতো। নবাবের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার, পদাতিক ৩৫ হাজার, অশ্বারোহী ১৫ হাজার মোট কামান ৫৩ টি। এর বিপরীতে রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। এর মধ্যে এ দেশীয় সিপাহী ২২০০ এবং ইউরোপীয়ান সৈন্য ৮০০। নবাবের এতো বিপুল সৈন্য সংখ্যা কিভাবে পরাজিত হয়? মূলত পলাশী প্রান্তরে কোনো যুদ্ধ হয়নি। ষড়যন্ত্রকারীরা সৈনিকদেরকে যুদ্ধ হতে বিরত রেখেছে এবং নবাবকে মৃত্যুর মূখে ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীর জাফর ও রায় দূর্লভের চক্রান্তে সৈন্যদের বিপুল সংখ্যক যুদ্ধ হতে বিরত থাকে। মীরমদন ও মোহন লাল স্বল্প সংখ্যক সৈন্য নিয়ে প্রাণপন লড়াই করেও ইস্ট কোম্পানীকে পরাস্ত করতে পারেন নি। ২৩ জুন বাংলার শেষ স্বাধীন সূর্য এখানেই অস্তমিত হয়। ৩০ জুন রাজমহলে নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকে গ্রফতার করা হয়। ০২ জুলাই ১৭৫৭ তাঁকে শৃঙ্খলিত অবস্থায় মুর্শিদাবাদে আনা হয়। রাতে মীর জাফর পুত্র মীরনের আদেশে ঘাতক মোহাম্মদী বেগ তাঁকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।
পলাশী বিপর্যয়ের পেছনে ঘরের বিভীষন যে ছিল প্রতিটি পদে পদে তা বোঝা যায় খুব সহজেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম দিকের কেরানী পরবর্তীতে লর্ড উপাধি পাওয়া লর্ড ক্লাইভ তাঁর নিজের ভাষায় বলেছেন, ‘ইংরজেরা ঘরের টাকা খরচ করে যুদ্ধ করে ভিনদেশ দখল করেছে। কিন্তু ভারত দখল করতে ইংল্যান্ড হতে এক পয়সাও আনতে হয়নি। সমস্ত অর্থই পাওয়া গেছে ভারতে৫ । কোনো সমাজ এবং জনপদে যদি বিশ্বাস ভঙ্গকারী কোনো গোষ্ঠী তৈরী হয়। জাতির অভ্যন্তরে বেঈমানের জন্ম হয় তবে সে সমাজের অবস্থা এমন করূণ হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বাস এবং আদর্শের যায়গায় তাই যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশী দরকার তা হচ্ছে আদর্শের প্রতি দৃঢ় আস্থা, নিজ ঈমান এবং বিবেকের দায়বদ্ধতা। যে বিষয়টির অভাবে একটি রাষ্ট্র ও সমাজ ভেঙে যাওয়া স্বাভাবিক। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা ইসলামী চিন্তানায়ক মাওলানা মওদূদী তার এক ভাষণে উল্লেখ করে বলেন, এই যে, ইংরেজরা দুশ বছর এ উপমহাদেশ শাসন করলো। তাদের কোতয়াল, তাদের সেনাবাহিনী, তাদের পুলিশ এ দেশের জনগণের মধ্য হতেই সরবরাহ করা হয়েছে। মুসলমানের সন্তান হয়ে আরেক মুসলমানের গলা কেটেছে ইংররেজের অনুগত সেবাদাস কর্মচারী হওয়ার কারণে। এই উপমহাদেশ হতেই তারা তাদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। যুগ ও সময়ের বিবর্তনে আমরা যেন আর একটি পলাশীর সামনে দন্ডায়মান। এমনি সময়ে নতুন করে শপথ নেয়া অত্যন্ত জরুরী। বাংলার পতনের রাজনৈতিক কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইতিহাসবিদ আব্বাস আলী খান লিখেছেন ‘ধবংসের বীজ বহু আগেই রোপন করা হয়েছিলো বাদশাহ আকবর কর্তৃক। যা ধীরে ধীরে বিশাল মহীরুহ আকার ধারণ করেছিলো।.... কোনো এক চরম অশুভ শক্তি শুধুমাত্র মুসলমানদের তৌহিদী আকীদা বিশ্বাস ও ইসলামী তামাদ্দুন ধ্বংস করার জন্য আকবরের প্রতিভাকে ব্যবহার করেছে, তা বিবেকসম্পন্ন মানুষ মাত্রই বুঝতে পারেন। কিন্তু আকবর তাঁর নিজের স্বপ্নসাধ পূরণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।
দেশপ্রেমিক সিরাজ এবং তার বিপরীতে একদল বিশ্বাসঘাতকের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের শিক্ষাকে ধারণ করে আজ বজ্র সাহসে বলীয়ান হওয়া দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। আমরা আমাদের চতুর্দিকে হায়েনার গোঙানি শুনতে পাই। রক্তচোষা ড্রাকুলারা আমাদের মানচিত্রে দন্তনখর বসাতে সদা অপতৎপরতা চালাতে নানান ছুতোয় বন্ধু সেজে হাজির হয়। সময় বয়ে চলে প্রতিদিন নতুন সূর্য উদিত হয়। প্রতিটি নতুন প্রভাতের আলোকচ্ছটায় নতুন সূযের রূপ রঙ একই থাকে। সবুজ বন বীথি আর নদীর ছলাৎ ছলাৎ বয়ে চলার শব্দে কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় না। একইভাবে মীর জাফরেরাও যুগে যুগে নানান আবয়বে হাজির হলেও তাদের উদ্দেশ্য এবং শ্রেণি চরিত্র একই থাকে। সময়ের নির্মম বাস্তবতায় আমরা আরো একটি পলাশীর দাড়প্রান্তে। শত্রæ-মিত্র চিহ্নিত করে বিশ্বাস এবং আদর্শের ভিত্তিতে এক দূর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর রচনা সময়ের অনিবার্য দাবী।
তথ্যসূত্র
১. ড. কে এম মোহসিন ,পলাশীর যুদ্ধ
২. প্রফেসর এম এ রহীম, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ‘আর কেনো পলাশী নয়’ স্মারকগ্রন্থ-১৯৯৭
3. Mohor Ali, The History of Muslims of Bengal-১৯৮৫, অনুবাদ-সালেহ মাহমুদ রিয়াদ
৪. আজকের দুনিয়ায় ইসলাম,সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, অনুবাদ-মুনির উদ্দিন আহমদ
৫. পলাশী চক্রান্তের নেপথ্যে, এরশাদ মজুমদার।
৬. আব্বাস আলী খান, বাংলার পতনের রাজনৈতিক কারণ, ‘বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস’
( দ্বিমাসিক শ্রমিক বার্তা, মে-জুন-২০২২ সংখ্যায় প্রকাশিত)

পঠিত : ৬২৩ বার

মন্তব্য: ০