Alapon

'ভুল বিপ্লবের নায়কেরা'



কর্নেল তাহের শিয়ালকোট সীমান্তের ধানক্ষেত ধরে হেঁটে হেঁটে পাকিস্তান ত্যাগ করলেন এক গভীর রাতে। সঙ্গে অনাগত ইতিহাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মেজর মঞ্জুর, তার স্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর কয়েকজন বাঙ্গালী সদস্য। তাদের সকলের উদ্দেশ্য একটিই- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করা, দেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করা।

চাঁদবিহীন রাতে অতি সন্তর্পণে জন্মভূমির পথে হেঁটে চলা সেই ছোট্ট কাফেলাটির বাকি সদস্যরা জানেন না- কর্নেল তাহেরের উদ্দেশ্য কেবল দেশকে স্বাধীন করা নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু। এই দেশকে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অন্তরালের উদ্দেশ্য সবার এক ছিল না। কেউ চেয়েছিলেন নিষ্কণ্টক ক্ষমতার মসনদ, কেউ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে, কেউ জাতীয়তাবাদ আবার কেউবা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ।

বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কর্নেল তাহেরের আজন্ম লালিত স্বপ্ন। এ স্বপ্ন তাকে গোটা জীবন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। নেত্রকোনার গহীন গ্রাম, চট্টগ্রামের পাহাড়, টেকনাফের জঙ্গল; এ স্বপ্ন বয়ে নিয়ে তিনি কোথায় ছুটে যান নি? মুক্তিযুদ্ধ তার সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠলো সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রস্তুতি মঞ্চ হিসেবে। দেশে ফিরেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করলেন এবং দায়িত্ব নিলেন ১১ নাম্বার সেক্টরের।

বাংলাদেশে কর্নেল তাহেরের পরিবারই একমাত্র পরিবার, যার ৭ ভাই-বোন একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এ জন্য তাঁর প্লাটুনের নামই হয়ে গিয়েছিল 'ব্রাদার্স প্লাটুন'। এই প্লাটুনের অধিনায়ক সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের। ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হচ্ছিল জামালপুর জেলার কামালপুর সীমান্তে। এক স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাহের। তাঁর চোখে ভাসতে লাগল আমেরিকার মতো পরাশক্তির নাগের ডগায় গড়ে ওঠা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবা, হো চি মিনের ভিয়েতনাম।
যুদ্ধে গোলার আঘাতে বাম পা হারালেন তাহের। কিন্তু স্বপ্ন মিইয়ে গেল না তার। স্বাধীন বাংলাদেশে এক পা নিয়েই লড়ে গেলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য। তিনি তখনও জানলেন না- অঙ্কের হিসেবে কত বড় ভুল করে ফেলেছেন। জানলেন না- তিনি যে বিপ্লবের স্বপ্ন বুনছেন, বাংলাদেশ তা ফলানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা নয়। এদেশের মাটি ও মানুষের সমগ্র সত্তা জুড়ে লেপ্টে মিশে আছে ইসলাম। সমাজতন্ত্র সেখানে পেরে উঠবে; এমন দুঃসাহস তার কোথায়? অবশেষে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে অভ্যুত্থানের গোপন ষড়যন্ত্রের দায়ে ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড বরণ করে অনেকটা স্বপ্ন ভঙ্গের ব্যর্থতা নিয়েই পৃথিবী ছাড়তে হলো তাঁকে।

সিরাজুল আলম খানকে বলা হয় 'রাজনীতির রহস্য পুরুষ'। ষাট এবং সত্তরের দশকের রাজনীতির কলকাঠি অন্তরালে থেকে অনেকাংশে তিনিই নেড়েছেন বলে কথিত আছে। অনেকটা কার্ল মার্ক্সসের মতো দেখতে সিরাজুল আলম খান ছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের থিংক ট্যাংক। নিজেকে সবসময় রহস্যে লুকিয়ে রেখে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। ৭ নভেম্বরের ব্যর্থ বিপ্লবের একজন অন্তরালের খলনায়ক হিসেবেও তাকে গণ্য করা হয়।

এক সময়ের তুখোড় মাঠের নেতা হলেও সময়ের ব্যবধানে নিজেকে গুটিয়ে নেন মাঠ থেকে, হয়ে ওঠেন আপাদমস্তক একজন সমাজতান্ত্রিক বোদ্ধা। ‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামলে দীর্ঘদিন জেলে থাকতে গিয়ে দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশ বিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন তিনি। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের উপর গড়ে ওঠে অগাধ পাণ্ডিত্য এবং দক্ষতা।

এই ব্যক্তিগত অধ্যয়ন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্বেও পরবর্তী জীবনে তাকে মার্কিন মুল্লুকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-’৯৭ সনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন তিনি। কিন্তু চিরদিনের জন্য আলোচনার অন্তরালে চলে যান বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে। একসময় ভেঙ্গে যায় তাঁর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তুরুপের তাস জাসদ। হারিয়ে যায় পুরোনো সাথীরা। আজীবন অকৃতদার এই মানুষটি সমগ্র জীবনের ব্যর্থ মিশন পরিচালনার গ্লানি নিয়ে এখন নিঃসঙ্গভাবে পার করছেন তার শেষ জীবনটি।

সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চরমপন্থী অংশটির নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজ শিকদার। সেই সময়ের বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় ত্রাসের নাম। সিরাজ শিকদার ছিলেন বুয়েটের শেরে বাংলা হলের আবাসিক ছাত্র। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক। বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে একসময় গড়ে তোলেন 'সর্বহারা পার্টি'। তার আন্দোলনের পলিসির সঙ্গে শুরুতে কর্নেল তাহের, সিরাজুল আলম খান, হাসানুল হক ইনুরা একমত হলেও চরমপন্থা গ্রহণ করায় পরবর্তীতে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে তাদের মতদ্বৈততা তৈরী হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম এনকাউন্টারে নিহত হওয়া মানুষটির নাম সিরাজ শিকদার।

এই মানুষগুলো সন্দেহাতীতভাবে ছিলেন তাদের সময়ের সবচেয়ে মেধাবী, সাহসী, চৌকস এবং আদর্শের জন্য আত্মোৎসর্গী মানসিকতার অধিকারী। তাঁরা ইসলামী বিপ্লবের ঝাণ্ডা ধরলে গল্পগুলো হয়তো অন্যরকম হয়ে উঠতো। গতিবেগ পেত ইসলামী বিপ্লবও। রাসূল (সা.) এর সেই উক্তির মতো- 'জাহেলী যুগে যারা শ্রেষ্ঠ, ইসলামী যুগেও তারা শ্রেষ্ঠ।' উমর (রা.) কিংবা খালিদ বিন ওয়ালীদ উভয় যুগেই নেতা ছিলেন; কী জাহেলী যুগ কী ইসলামী। দুর্ভাগ্য! জাতির এই সর্বোচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন মানুষগুলো একটি ভুল বিপ্লবের পিছনে তাদের পুরোটা জীবন কাটিয়ে গেলেন। ইসলামের ঝান্ডা উড্ডীন করার সৌভাগ্য হলো না তাদের।


~ মু. লাবিব আহসান

·

পঠিত : ৩৬৯ বার

মন্তব্য: ১

২০২২-০৫-২৭ ১২:০৬

User
জোহেব শাহরিয়ার

সমাজতন্ত্র এখন আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত এক হাস্যকর মতবাদের নাম। অথচ ইসলাম আগেও ছিলো, এখনো আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে।

submit