Alapon

মাদায়েনে এক বিস্ময়কর অভিযান!



মাদায়েন ছিল ইরাকের একটি শহর। এটি ছিল মুশরিক পার্সিয়ানদের রাজধানী। এখানে সম্রাটের সুরম্য শ্বেত পাথরের প্রাসাদ ছিল। বর্তমানে এই শহর তাক কাসরা নামে পরিচিত।

কাদেসিয়ার যুদ্ধে জয়লাভের পর সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. বহুদিন অপেক্ষা করছিলেন উমার রা.-এর নির্দেশের অপেক্ষায়। উমার রা. প্রায় দু'মাস পর মাদায়েনে বাকী পার্সিয়ানদের দমন করার জন্য অনুমতি দিলেন। মহিলা ও শিশুদের রেখে উমার রা. রওনা হতে বলেছিলেন। অবশেষে প্রচুর সৈন্যকে মহিলা ও শিশুদের নিরাপত্তায় রেখে রওনা হলেন সা'দ রা.। উমার রা. নির্দেশ দিলেন, যেসব সৈন্য নিরাপত্তায় থেকে যাবে তারাও যেন গণিমতের ভাগ পায়।

পার্সিয়ান সৈন্যরা এই মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখী হতে রাজি ছিল না। তাই তারা মুসলিমদের আগমনের খবর শুনে পালাতে লাগলো। মুসলিমরা পর্যায়ক্রমে বুরস, ব্যবিলন, কুসি ও সাবাত শহর দখল করে। সাবাতের কিছু অংশ যুদ্ধের মাধ্যমে বাকী অংশ চুক্তির মাধ্যমে মুসলিমদের দখলে আসে। উমার রা. ইরাকের সাধারণ মানুষের সাথে ভালো আচরণের নির্দেশ দিলেন। সৈন্যরাও নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করলেন। ইয়াকের সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়ে গেল। তারা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়ে মুসলিম সৈন্যরা তাদের কোনো সম্পদ কেড়ে নেয়নি বরং ভাই হিসেবে তাদের স্থান দিয়েছে। এটা তাদের মনে গভীরভাবে দাগ কাটলো। তারা খাদ্য ও তথ্য দিয়ে মুসলিমদের সাহায্য করলো।

মুসলিমরা বাহরসীর নামে একটি শহর অবরুদ্ধ করে রাখলো। শত্রুরা দুর্গের ভেতর থেকে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল। মুসলিমরাও প্রায় দুইমাস দুর্গ ভাঙ্গতে সক্ষম হয়নি। এসময় মুসলিমদের পার্সিয়ান মিত্ররা ২০টি কামান তৈরি করে দেয় মুসলিমদের। মুসলিমরা কামান দিয়ে পাথর নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল বাহরসীরের দুর্গে। এতে ভেতরের সৈন্যরা ভীত হয়ে পড়ে। তারা আত্মসমর্পন করে। বাহরসীরে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে পার্সিয়ান সম্রাটের দূত মুসলিমদের কাছে আসে। দূত বললো, আমাদের সম্রাট জানতে চেয়েছেন, তোমাদের সাথে সমঝোতা বা শান্তিচুক্তি করার কী উপায় আছে? যার ফলে টাইগ্রিস নদীর ওপার থেকে পাহাড় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করবো। আর তোমরা টাইগ্রিস পর্যন্ত রাজত্ব করবে।

কেউ কিছু বলার আগে মুসলিম কমান্ডার আবু মুকাররিন আসওয়াদ ইবনে কুতবা জবাব দিলেন। কিন্তু তিনি কী কথা বললেন তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন নি, অন্যান্য মুসলিমরাও বুঝতে পারেন নি। কিন্তু তার বক্তব্যের পর মুশরিকরা বাহারসীর ছেড়ে মাদায়েনের দিকে পালাতে লাগলো। মুসলিমরা আবু মুকাররিনকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি তাদের কী বলেছেন? তিনি বললেন, সেই আল্লাহর শপথ! যিনি মুহাম্মদ সা.-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আমি কী বলেছি, আমি নিজেই জানিনা। কিন্তু আমি নিশ্চিত আমি কল্যাণকর কথা বলেছি। আমার নিজের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করছি। সা'দ রা. ব্যাক্তিগতভাবে আবু মুকাররিনের তাঁবুতে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। কী এমন কথা বলেছেন যার জন্য তারা সদলবলে পালাতে লাগলো? আবু মুকাররিন একই কথা বললেন, আমি জানি না।

এরপর সা'দ রা. পুরো শহর অধিকার করলেন। এখান থেকে প্রচুর অস্ত্র ও ধনসম্পদ পাওয়া গেল। শহরে কোনো পার্সিয়ান সৈন্যকে পাওয়া গেল না। তারা সবাই মাদায়েনে পালিয়ে গেছে। দুর্গের মধ্যে কয়েকজন বন্দিকে পাওয়া গেল। তাদের জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের সৈন্যরা পালিয়ে গেল কেন? তারা বললো, আপনাদের কাছে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হলো। কিন্তু আপনারা বললেন, আমরা যতক্ষণ না কুসীর লেবুর সাথে আফরিজিন ফুলের মধু মিশিয়ে না খাবো ততক্ষণ তোমাদের সাথে কোনো সন্ধি হবে না। এই উত্তর শুনে আমাদের সম্রাট ইয়াজদিগার্দ বললেন, //হায়! হায়! ওদের মুখে ফেরেশতারা কথা বলছে! আরবদের পক্ষে ফেরেশতারা আমাদের উত্তর দিচ্ছে! আমাদের প্রত্যাখ্যান করছে। এই লোকটি যা বলছে এর মানে হলো আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো// এই বলে তিনি সবাইকে দ্রুত মাদায়েন যাওয়ার নির্দেশ দেন।

বাহারশির ও মাদায়েনের মধ্যে ব্যবধান শুধু টাইগ্রিস নদী। বাহারশিরে এসে মুসলিম সৈন্যরা সম্রাটের শ্বেত প্রাসাদ দেখতে পেল। তারা বললো! আল্লাহু আকবার! এই সেই প্রাসাদ যা সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এদিকে বাহারশির থেকে মাদায়েনে যাওয়ার সমস্ত নৌকা নিয়ে গেছে পার্সিয়ানরা। তখন টাইগ্রিস নদী ছিল পানিতে একেবারে পরিপূর্ণ। বিশাল জলরাশির ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। সা'দ রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী টাইগ্রিস নদীর তীরে অসহায় হয়ে পড়লো। সম্রাট ইয়াজদিগার্দ মূলত নদীর এই প্রাকৃতিক সুরক্ষা পেতে যুদ্ধ না করেই বাহারশির ছেড়ে দিয়েছে। যখনই মুসলিমরা কেউ কেউ সাঁতরে পার হওয়ার স্টেপ নিচ্ছিল তখনই পার্সিয়ানরা তীর নিক্ষেপ করে তাদের ঠেকিয়ে দিচ্ছিল।

নদী পার হওয়া নিয়ে সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. চিন্তা করছিলেন। এসময় মুসলিমদের মিত্র কিছু পার্সিয়ান নাগরিক সা'দ রা.-কে টাইগ্রিস নদীর সবচেয়ে কম দুরত্ব ও কম গভীরতার অংশের পথ বাতলে দিল। সা'দ রা. সেখানে গিয়ে বুঝলেন নদী পার হওয়ার মতো নয়। এসময় পানির আকার ও গতি বেড়ে গেল। প্রচণ্ড স্রোতের কারণে পানিতে প্রচুর ফেনা তৈরি হলো। চিন্তিত হয়ে পড়লেন সা'দ রা.। এই অবস্থায় তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। এসময় তিনি স্বপ্ন দেখলেন ঘোড়াগুলো নদী পার হয়ে যাচ্ছে। তার তন্দ্রা টুটে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন এটা মহান সৃষ্টিকর্তার ইশারা।

তিনি সাহাবীদের ডাকলেন। একটি আবেগময় জিহাদি ভাষণ দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন আমরা ঘোড়া দিয়ে নদী পার হয়ে যাবো। তিনি তার দেখা স্বপ্নের কথাও বললেন। মুসলিম সৈন্যরা সমস্বরে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তাকবির ধ্বনি দিল। এরপর তিনি সাহসী যোদ্ধাদের আহবান জানালেন যারা আগে নদী পার হতে আগ্রহী। আসিম ইবনে আমর তার সাহসী ছয়শত সৈন্য নিয়ে এগিয়ে এলেন। আসিম ইবনে আমর তার ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়ালেন। এক অশ্বারোহী সৈন্য ঘোড়া হাঁকিয়ে সামনে এসে বললেন, আরে! এই পানির ফোঁটাকে আপনারা ভয় পাচ্ছেন? এরপর তিনি সূরা আলে ইমরানের ১৪৫ নং আয়াত পাঠ করলেন। //আল্লাহর অনুমতি ব্যাতীত কারো মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু মেয়াদ অবধারিত//।

এই কথা বলে তিনি ঘোড়া নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। আসিম সবাইকে নদীতে নামতে নিষেধ করলেন। শুধু ৬০ জন সাহসীকে তার সাথে নদীতে নামতে নির্দেশ দিলেন। বাকীদের নির্দেশ দিলেন পাড়ের পার্সিয়ান সৈন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করতে। ঘোড়াগুলো সাঁতরে পার হচ্ছিল বিধায় পার্সিয়ান সৈন্যরা আক্রমণ করলো। আসিমের নির্দেশে পাড়ের মুসলিম সৈন্যরা পার্সিয়ানদের ঘোড়াগুলোর চোখে তীর মারতে শুরু করলো। পার্সিয়ানরা নদীর তীর ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। আসিমরা আল্লাহর কুদরতে নিরাপদে নদী পার হয়ে গেলেন। পার হয়েই তিনি ও তার বাহিনী পার্সিয়ান মুশরিকদের ধাওয়া দিলেন।

এরপর আসিমের সব সৈন্য নদী পার হয়ে গেল। এরপর কা'কার দল নদী পার হয়ে গেল। এরপর যখন নদীর ওপাড়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত হলো তখন বাকীসব সৈন্যকে নদী পার হওয়ার নির্দেশ দিলেন। এরপর সা'দ রা. ঘোড়া নিয়ে পানিতে লাফিয়ে পড়লেন। সকল মুজাহিদ খরস্রোতা টাইগ্রিস নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তারা স্থলপথে যেভাবে রাস্তা অতিক্রম করে সেভাবেই নদী অতিক্রম করতে লাগলেন।

সা'দ রা. আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করলেন যাতে সবাই নিরাপদে পৌঁছে যায়। সবাই পৌঁছে গেলে সা'দ রা. জিজ্ঞাসা করলেন, কারো কি কিছু হারিয়েছে? একজন সাহাবি অভিযোগ করলেন তার একটি বাটি হারিয়ে গেল। সা'দ রা. তখনি দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আমার সাথীদের মধ্যে কারো যেন কোনো মালামাল না হারায়। পরে ঢেউয়ের ধাক্কায় বাটি তীরে এসে পৌঁছালো। এই দিনটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

এরপর সা'দ রা. তার বাহিনী নিয়ে পার্সিয়ানদের ধাওয়া করলেন। কিন্তু তার আগেই পার্সিয়ানরা পালিয়ে গেল তাদের ধন সম্পদ নিয়ে। তা সত্ত্বেও প্রচুর ধনসম্পদ থেকে গেল প্রাসাদে। সালমান ফারসি রা. তিনিদিন আহবান জানালেন, প্রাসাদে কেউ থাকলে যেন বেরিয়ে আসে। তিনদিনেও কেউ বেরিয়ে না আসলে মুজাহিদরা প্রবেশ করে এবং প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা পায়। এর পরিমাণ প্রায় ৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা।

কোথাও কেউ ছিল না। সা'দ রা. সেই শ্বেত প্রাসাদকে নামাজের জায়গা হিসেবে নির্ধারণ করেন। এসময় তিনি সূরা দুখানের ২৫-২৯ নং আয়াত পাঠ করেন। //কত বাগ-বাগীচা, ঝর্ণাধারা, ফসল ও জমকালো প্রাসাদ তারা ছেড়ে গিয়েছে। তাদের পিছনে কত ভোগের উপকরণ পড়ে রইলো যা নিয়ে তারা ফুর্তিতে মেতে থাকতো। এই হয়েছে তাদের পরিণাম। আমি অন্যদেরকে এসব জিনিসের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিয়েছি। অতঃপর না আসমান তাদের জন্য কেঁদেছে না যমীন এবং সামান্যতম অবকাশও তাদের দেয়া হয়নি।//

এরপর সা'দ রা. আট রাকায়াত শোকরানা নামাজ আদায় করলেন। পরবর্তী জুমআর দিনে তিনি প্রাসাদে জুমআর নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি এখানে অবস্থান নেন এবং চারদিকে সৈন্য পাঠিয়ে আশে পাশের শহরগুলো দখল করেন। সেই সূত্রে ইরাকের জালুলা, তিকরিত ও মসুল জয় হয়।

উমার রা. এর কাছে পারস্যের বাজধানী বিজয়ের খবর পৌঁছলো। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। একইসাথে প্রচুর গনিমতের মালামাল আসলো। সম্রাটের ব্যবহার্য বহু দামী পোষাক ও অলংকার আসলো উমার রা.-এর কাছে। উমার রা. এগুলো মদিনাবাসীদের দেখালেন। উপস্থিত লোকদের মধ্যে ছিল সুরাকা ইবনে মালিক। তিনি ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। উমার রা. তাকে সব পোষাক, জুতো ও অলংকার পরতে বললেন। সুরাকা বলেন, আমি ভেবেছিলাম, এই সুন্দর জিনিসগুলো আমি পাব। আমি খুশি হয়ে পরে নিলাম।

এরপর উমার রা. তাকে সবার সামনে হাঁটতে বললেন। তারপর বললেন, ব্যাপারটি কতই না উত্তম! মাদলাজ গোত্রের এক সাধারণ বেদুইনের গায়ে পারস্যের খসরুর পোষাক! এরপর বললেন, এগুলো খুলে ফেল।

এরপর বললেন, হে আল্লাহ! আপনার রাসূল ও নবীকে আপনি এত সম্পদ দেননি। তিনি আমার চেয়েও বহু সম্মানিত। আপনি এগুলো আবু বকরকেও দেননি। তিনিও আপনার নিকট আমার চেয়ে অনেক বেশি প্রিয় ও সম্মানিত। অথচ এগুলো আপনি আমাকে দিয়েছেন। যদি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে এত সম্পদ আমার কাছে অর্পন করেন তবে তা থেকে আমি আপনার নিকটই আশ্রয় চাই। তারপর তিনি এত কাঁদতে লাগলেন যে, উপস্থিত কারো আর এই সম্পদ ও অলংকারগুলোর প্রতি আগ্রহ থাকলো না। এরপর কাঁদতে থাকা উমার রা. আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা.-কে বললেন, সন্ধ্যার আগেই এগুলো বিক্রি প্রাপ্ত অর্থ বিলিয়ে দেন।

পঠিত : ৬২৬ বার

মন্তব্য: ০