Alapon

পশ্চিমা দা'ঈ সংকট এবং সংকট থেকে সৃষ্ট ভ্রান্তিসমূহ



"পশ্চিমা দা'ঈ সংকট এবং সংকট থেকে সৃষ্ট ভ্রান্তিসমূহ"


১) মুসলিমদের জন্য কুফুরের পরিবেশে বসবাস করাটাই বিপদজনক। এটা তাদের ঈমানের জন্য হুমকির কারণ। মুসলিমদের জন্য কাফিরদের ভূমিতে স্থায়ী বসবাসের অপারগতা, প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতার প্রশ্নে পরে আসছি। আমাদেরকে প্রথমে বুঝতে হবে এর বৈধতার প্রশ্নে ইসলাম কেন এতো কঠোর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, " মুশরিকদের মধ্যে বসবাসরত প্রত্যেক মুসলিম থেকে আমি মুক্ত।" ঠিক একই মর্মের আরো কয়েকটি রেওয়ায়েত পাওয়া যায়।

মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, নিশ্চয় যারা নিজেদের প্রতি যুলুমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, 'তোমরা কী অবস্থায় ছিলে'? তারা বলে, 'আমরা যমিনে দুর্বল ছিলাম'। ফেরেশতারা বলে, 'আল্লাহর যমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে'? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা কতই না মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল।(সূরা নিসা-৯৭) এতো কঠোরতার কারণ এটাই যে, এই বসবাসের ফলে একজন মুমিনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ঈমান হুমকির মুখে থাকে। এমনকি ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় সে ইসলাম বিরোধী পরিকল্পনার অংশ হয়ে যাওয়ার আশংকায় থাকে। ইসলামের প্রতি তার কমিটমেন্ট নষ্ট হতে থাকে। শাইখ আব্দুল্লাহ আজ্জাম রহিমাহুল্লাহ তার পুরো তাফসীরে তাওবা জুরে স্থায়ীভাবে ইউরোপে বসবাসের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন ঘটনা, পরিচিত-অপরিচিত নানা মানুষের অবস্থা তুলে ধরে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কীভাবে তারা আল্লাহর শরীয়ত থেকে দূরে সড়ে আসতে থাকে। শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ ইবনে উসাইমিন রহিমাহুল্লাহ বলেন, "কাফির দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা একজন মুসলিমের দ্বীনি দায়িত্ব, নৈতিকতা, আচরণ ও আদবের জন্য মারাত্মক হুমকি বহন করে। আমরা অনেকেই দেখেছি, যারা এসব দেশে সেটেল হয়েছে তারা গোমরাহ হয়েছে এবং পরিবর্তিত হয়ে ফিরে এসেছে। তারা ফাসিক-ফাজির হয়ে ফিরে এসেছে। অনেকে মুরতাদ হয়ে গেছে এবং নিজের দ্বীনসহ সব ধর্মে অবিশ্বাসী হয়ে ফিরেছে। তারা দ্বীনকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে এবং দ্বীন ও এর অনুসারীদের; অতীত ও বর্তমান নিয়ে বিদ্রূপ করে। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। কীভাবে একজন মুসলিম কাফিরদের ভূখণ্ডে জীবন কাটানোর ব্যাপারে পরিতৃপ্ত হতে পারে, যেখানে প্রকাশ্যে কুফুরের আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় এবং আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আইন ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা হয়? নিজ চোখে এসব দেখার পর, নিজ কানে এসব শোনার পর একসময় অন্তর এগুলোর অনুমোদন দিতে থাকে...।" (মাজমুঊ ফাতাওয়াশ শাইখ ইবনে উসাইমিন, ফতোয়া নং ৩৮৮)

বিশেষ প্রয়োজনে সাময়িক সময়ের জন্য সেখানে অবস্থান ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রেও অনেক সতর্কতা জরুরি। তবে অধিকাংশ মুসলিমই সেখানে সেটেল হোন পার্থিব সুখ ও উন্নতির জন্য। দ্বীনের প্রতি তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ থাকে না।অথচ ইমামরা এই ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোরতা দেখিয়েছেন। কারণ মানুষ অবশ্যই তার পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়। পারিপার্শ্বিক এই প্রভাব থেকে মুমিন দ্বীনের ব্যাপারে সংবেদনশীলতা হারাতে থাকে। দীর্ঘ সময় একটা বিষয় দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে দ্বীনের ব্যাপারে গায়রাত ফওত হয়ে যায়। পাশ্চাত্য পরিবেশের সাথে ইসলামের নির্দেশগুলোর বিরোধ দেখে তার মাঝে হীনমন্যতা কাজ করে। আর তখনই তার ভিতরে উক্ত পরিবেশ বিরোধী ইসলামের প্রতিটি বিধান নিয়ে সংশয় কাজ করতে থাকে। এই সংশয়ে কেউ কেউ সরাসরি মুরতাদ হয়ে যায়। আর কেউ কেউ নানাভাবে কম্প্রোমাইজ ও কাটছাঁটের আশ্রয় নেয়। পরিস্থিতির শিকার এমন বিকৃতিকে ইজতিহাদ, ফিকহুল হাল ইত্যাদি দ্বীনি টার্ম দিয়ে গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়। এটাই বাস্তবতা। সত্য গ্রহণের মানসিকতা নিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আপনি এই ফলাফলের সাথে অবশ্যই একমত হবেন। এজন্য প্রথমত আমাদেরকে কাফেরদের ভূমিতে বসবাসের বিষয়টিকেই ইসলামী শরীয়ার আলোকে বিবেচনায় নিতে হবে।

এখানে একটা প্রশ্ন আসতে পারে, বর্তমান মুসলিম দেশগুলোর অবস্থাও তো এক। একথা সত্য, মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত নেই। তবুও এই ভূখণ্ডগুলোর সামাজিক বাস্তবতায় পশ্চিমের সাথে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। এটা আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। হ্যাঁ এটা অনস্বীকার্য যে, মুসলিম দেশগুলোও দিন দিন সেদিকে এগোচ্ছে এবং এটা খুব দ্রুতই। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনো উক্ত প্রশ্ন কার্যকর হওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

২) মহান আল্লাহ তা'য়ালা সকল মানুষের অন্তর্যামী। কাফেরদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে তিনিই সর্বাধিক অবগত। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, "আর ইয়াহুদি ও নাসারারা কখনোই তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করো।" (সূরা বাকারা-১২০) একই মর্মের বেশ কয়েকটি আয়াত রয়েছে পবিত্র কুরআনে। যদি এটাই কাফেরফের মনস্তত্ত্ব হয়, তাহলে বুঝতে হবে কাফেররা পরিপূর্ণভাবে আপনার দ্বীন পালন করতে দিবে না। তাদের মিল্লাতের কিছু বিষয়কে মেনে নিতেই হবে। তবেই তারা আপনার প্রতি আশ্বস্ত হবে। সাথে তাদের মিল্লাতের সাথে যেকোন প্রকার সংঘর্ষিক এক্টিভিটি তারা আপনার থেকে সহ্য করবে না। বর্তমান বাস্তবতায় বুঝতে হলে সেকুলারিজম ও লিবারেলিজমের উদাহরণ খুবই সুস্পষ্ট। এগুলো কুফফারদের দ্বীন। কাফেরদের রাষ্ট্রে এগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে হয়ত আপনি টিকে থাকতে পারবেন না। আপনি যদি বিশুদ্ধভাবে ইসলাম পালন করতে চান, এগুলোর সাথে কোন না কোনভাবে সংঘর্ষ বাঁধবেই।

এই বাস্তবতাকে আমরা মেনে নিলাম। সাথে সাথে ইসলামী শরীয়ার আলোকে বিবেচনার পর ধরে নিলাম, পাশ্চাত্য দেশে আপনার বসবাস একটা অপারগতা কিংবা প্রয়োজনীয়তা। (যদিও অধিকাংশের ক্ষেত্রেই বাস্তবতা ভিন্ন) এখন একদিকে আপনাকে সেখানে অবস্থান করতে হচ্ছে, অন্যদিকে কাফেররা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না যদি না আপনি তাদের মিল্লাতকে মেনে নিন। তাদের পক্ষ থেকে সত্যিকার অর্থেই আপনার হত্যা কিংবা অঙ্গহানি হওয়ার আশংকাও আছে। এই পরিস্থিতিতে আপনার করণীয় কী? এই পরিস্থিতিতে আপনি হয়ত তুকিয়া অবলম্বন করতে পারেন। তুকিয়া হল মৌখিক আপোষ কিংবা তোষামোদ। কিন্তু আন্তরিকভাবে কখনোই আপোষ করা বিষয়গুলোকে সমর্থন করা যাবে না। তখন সেটা আর তুকিয়া থাকবে না। আবার যেকোন ক্ষেত্রেই তুকিয়া অবলম্বন করা যাবে না। নিশ্চিতভাবে তুকিয়া গ্রহণ না করার কারণে আপনার হত্যা ও অঙ্গহানির আশংকা থাকতে হবে।

এখানে আরেকটা বিষয় ক্লিয়ার হওয়া দরকার। তুকিয়ার ব্যাপারটা পরিপূর্ণভাবে একজন নাগরিকের সাথে প্রাসঙ্গিক। কেউ যদি নিজেকে একজন দায়ী হিসেবে দাবী করে, তার জন্য বৈধ নয় তুকিয়ার আশ্রয় নিয়ে মানুষের কাছে ইসলামকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা। কারণ দায়ীর দায়িত্ব হল, ইসলামকে সঠিকভাবে কোন প্রকার বিকৃতি ছাড়া হীনমন্যতায় না ভুগে আপোষহীনভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা। আল্লাহর ইচ্ছায় যারা মানার তারা মেনে নিবে আর যারা প্রত্যাখ্যান করার করবে। দায়ীর দায়িত্ব নয় মানুষকে আশ্বস্ত করার জন্য বিকৃতভাবে আপোষের সাথে দ্বীনকে উপস্থাপন করা। (আলহামদুলিল্লাহ কাফেরদের রাষ্ট্রে থেকেও কিছু দায়ী আপোষহীনভাবে দ্বীনকে প্রচার করে যাচ্ছেন) যদি কোন দায়ী সামগ্রিকভাবে আপোষহীনতা ধরে না রাখতে পারেন, তার জন্য উচিৎ হল অন্ততপক্ষে সেসব বিষয়ে নিশ্চুপ থাকা যেখানে সে আসলেই অক্ষম।

তথাপি আমরা মেনে নিলাম কোন দায়ীর উপর বিভিন্ন মহল থেকে চাপ ও এজেন্ডা থাকে ইসলামের সেসব বিষয়ে আপোষপূর্ণ কথাবার্তা বলার, যেগুলো পাশ্চাত্য লিবারেলিজমের সাথে সাংঘর্ষিক। এটাকে উক্ত দায়ীর জন্য তুকিয়া হিসেবেই ধরে নিলাম। কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে, তুকিয়া বাহ্যিক বিষয়। বিশ্বাসের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই এবং তুকিয়া দাওয়াতের বিষয়বস্তুও নয়। সহজ বাংলায় বললে, এটা কাফেরদের সাথে প্রতারণা। এমন দ্বীমুখীতা অনেক সময় কফেরদের দেশে বৈধ হয়। এটাকে নিফাকের মত শর'য়ী অভিধেয় দেয়া যায় না। ( যেমনটা কিছু বিভ্রান্ত মুসলিম চিন্তক দাবি করে) পাশ্চাত্যে বসে আপনি পর্দার ব্যাপারে আপোষের কথা বলছেন, ফ্রি মিক্সিং নিয়ে ছাড়ের সবক দিচ্ছেন, LGBT অধিকার মেনে নিচ্ছেন, মোট কথা পাশ্চাত্য পরিবেশের সাথে সাংঘর্ষিক এমন সব ইসলামী বিধানের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ করছেন। মুসলমানদের প্রতি সুধারণাবশত আমরা মেনে নিচ্ছি এগুলো তুকিয়ার অংশ। কিন্তু যেই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, ইলমীভাবে উক্ত বিষয়গুলোতে অবশ্যই আপনাকে ইসলামের ট্রাডিশনাল অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। একাডেমিকভাবে কোন প্রকার আপোষ ছাড়াই আপনাকে ইসলামের এসব সুস্পষ্ট বিধানে বিশ্বাস রাখতে হবে। মোটকথা ঈমান ও ইলমের জায়গায় আপনাকে সৎ থাকতে হবে। এটা না হলে আপনি তুকিয়ার সীমালঙ্ঘন করে ফেললেন। যেটা অনেক সময় রিদ্দাও হতে পারে। আল্লাহর পানাহ!

আগেই বলেছি যে, তুকিয়া দাওয়ার বিষয় না। এটা মুসলিমদের আইডোলজিও না। একজন পাশ্চাত্য দায়ীর এমন বিকৃতিকে আপনি দাওয়াত হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন না। ইসলাম এর বৈধতা দেয়নি আপনাকে। এসব বিষয়ে অবশ্যই আপনাকে এড়িয়ে চলতে হবে পাশ্চিমা দায়ীকে। কারণ তিনি তুকিয়ার অবস্থানে আছেন। তিনি নিজেকে এমন অবস্থানে আবিষ্কার করতে পারছেন না, যেখান থেকে ইসলামকে আপোষহীনভাবে তুলে ধরতে পারেন। বড় পরিতাপের বিষয় হল, পশ্চিমা দায়ীদের বিভ্রান্তি কথা বললে কিছু ভাই ঠিকই নসীহত করেন যে, তারা চাপে থাকে, পশ্চিমা সমাজের সাথে সাংঘর্ষিক কোন কথা তারা বলতে পারেন না। কিন্তু সেসব ভাই এই বাস্তবতার সবক দেয়ার পাশাপাশি এর ফলাফলকে মেনে নিতে চান না। তারা ঠিকই আপোষ নীতিকে আইডোলজি হিসেবে গ্রহণ করছে, ইলমীভাবে মেনে নিচ্ছে। আবার সাধারণ মুসলিমদেরকে তুকিয়ার স্বার্থে গ্রহণ করা মত-অবস্থানের দাওয়াতও দিচ্ছে। অথচ উক্ত বাস্তবতার ফলাফল এটাই যে, তাদের থেকে আপোষহীন ভাবে ইসলামের সঠিক বিধানটা আসবে না। ফলে আমাদের জন্য জরুরী হল, পশ্চিমে অবস্থান করা এসব স্কলার, দাঈ বা প্রতিষ্ঠান থেকে ইলম নেয়া ও তাদের মত-অবস্থানের অনুসরণ করা সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলা।

আল্লাহ তাওফিক দিলে সামনে যেই পয়েন্টগুলো নিয়ে আলোচনার ইচ্ছা আছে, সেগুলো আসলে সংকট না। সংকট থেকে সৃষ্ট কিছু ভ্রান্তি এবং এই ভ্রান্তিগুলো কেবল পাশ্চাত্যে অবস্থানরত দায়ীদের মধ্যেই দেখা যায় না; বরং পাশ্চাত্য সভ্যতায় প্রভাবিত অনেক মুসলিম চিন্তকের ক্ষেত্রেও ভ্রান্তিগুলো সমভাবে কার্যকর। তাদের মাঝেও এই প্রবণতাগুলো পাওয়া যায়। পাশ্চাত্যের সাথে ইসলামকে কম্প্রোমাইজ করার বিষয়টিকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য কিছু ভ্রান্ত দালিলিক ভিত্তির আশ্রয় নেয়া হয়। এটা না করলে সাধারণ মুসলিমদেরকে তাদের অবস্থানের ব্যাপারে আশ্বস্ত করা সম্ভব না।

এরকম একটি মৌলিক ভ্রান্তি হল, আল্লাহর তাক্বদীরি কিংবা তাকওয়ীনি বিষয়কে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা। যা মূলত একান্তই আল্লাহর সৃষ্টিগত বিষয়। মহান আল্লাহ তা'য়ালা মানুষ সৃষ্টি থেকে শুরু করে বিশ্বপরিচালনার জন্য যেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চলমান রেখেছেন এবং জগতে যা কিছু ঘটে সেটাই আল্লাহর কদরের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর শরীয়ার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই এবং কদর শরীয়তের উৎসও নয়।

ক্বদর দিয়ে শরীয়াহকে প্রত্যাখ্যান করা অনেক পুরাতন ভ্রান্তি। মক্কার মুশরিকরাও তাদের শিরকী কর্মকাণ্ডের পক্ষে ক্বদরকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করত। পবিত্র কুরআনে এই সংক্রান্ত বেশ কিছু আয়াত রয়েছে। যেমন মুশরিকরা বলত, "যদি আল্লাহ চাইতেন তাহলে আমরা শিরক করতাম না, ফেরেশতাদের পূজা করতাম না, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করতাম না।" ( সূরা আন'আম -১৪৮, সূরা যুখরুফ-২০)

আয়াতগুলোর তাফসীরে মুফাসসিরে কেরাম তাকওয়ীনি এবং তাশরীয়ি বিষয়ের পার্থক্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। যার সারমর্ম হল, আল্লাহর তাকদীরি বিষয় কখনো বান্দার কর্মের পক্ষে দলিল হতে পারে না এবং এর মাধ্যমে কখনো শরীয়তের বিধান এবং প্রত্যাশায় বিকৃতি ও শিথিলতা আনা যাবে না। (ইবনে কাসীর-৪/৫৭০, আত- তাহরির ওয়াত তানওয়ীর- ৭/২০৬)

ক্বদরকে ব্যবহার করে শরীয়াহকে প্রত্যাখ্যান করার বিভিন্ন রূপ আছে। নাস্তিকদের মধ্যেও এই প্রবণতা আছে। " ভাগ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত হলে মানুষ কেন শাস্তির সম্মুখীন হবে" এই জাতীয় প্রশ্নগুলো এই ক্যাটাগরীতেই পড়ে। ইন্টারফেইথ এবং মুক্তচিন্তার পক্ষেও ক্বদরকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, "পৃথিবীর সব মানুষ ইসলাম গ্রহণ করবে না। এটা আল্লাহ তা'য়ালার রীতি। মানুষের ধর্মগত ও মতাদর্শিক বিভাজন আল্লাহর সুন্নাহ। সুতরাং কোন ধর্ম কিংবা মতই মন্দ কিছু নয়।"

কেউ কেউ আবার ইসলামকে একমাত্র সত্য দ্বীন হিসেবে মেনে নিলেও আল্লাহর এই ক্বদরী বিভাজনকে দলিল বানিয়ে কাফেরদের সাথে ওয়ালা বারা, জিহাদ সহ ইত্যাদি শর'য়ী বিধানকে প্রত্যাখ্যান করে কিংবা বিকৃতি করে থাকে।

মুফাসসিরে কেরাম এই ধরণের ভ্রান্ত কুযুক্তির সমাধান অনেক আগেই দিয়ে গেছেন। সমস্ত মানুষ ঈমান আনবে না- এটা আল্লাহ তা'য়ালার তাকওয়ীনি কিংবা তাক্বদীরি বিষয়। এটা কখনোই বান্দার ঈমান না আনার পক্ষে দলিল হতে পারে না এবং এটা তাদের জন্য নৈতিক অনুমোদনও নয়। কারণ আল্লাহর শর'য়ী প্রত্যাশা হল, তাদেরকে ঈমান আনতে হবে। এই প্রত্যাশা বাস্তবায়ন না করলে তাদের ব্যাপারে শর'য়ী সব নির্দেশনাই বাস্তবায়ন হবে। ক্বদরী প্রত্যাশার ভিত্তিতে এসব নির্দেশনায় কোন ধরণের শিথিলতা আসবে না।

এমনিভাবে সমস্ত মুসলিম মদ পান, যিনা, চুরি ইত্যাদি থেকে বিরত না থাকাও আল্লাহর ক্বদরী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এখন এটাকে বিবেচনা করে উক্ত কর্মগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট শর'য়ী বিধান, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সীমায় কোন পরিবর্তন কিংবা শিথিলতা আনা ও দাবি করা একই প্রবণতার ফসল। আল্লাহর ক্বদরী সিদ্ধান্তকে বিবেচনা করে এসব কর্মকে অধিকার সাব্যস্ত করা, নৈতিকভাবে ঘৃণা না করা কিংবা প্রচারকারী সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও স্থানগুলোর ধ্বংস কামনা না করা কখনোই বৈধ নয়। এটা ক্বদরকে ব্যবহার করে শরীয়াহকে প্রত্যাখ্যান করারই নামান্তর।

ক্বদরকে ব্যবহার করে শরীয়াহকে প্রত্যাখ্যানের আরেকটি ভয়াবহ দিক হল ইতিহাসকে বিধান গ্রহণের উৎস বানানো। ইতিহাস কখনোই ইসলামী শরীয়ার উৎস নয়। একজন সামান্য তালিবুল ইলমের কাছেও বিষয়টি স্পষ্ট থাকার কথা। ইতিহাস আল্লাহর ক্বদরের অন্তর্ভুক্ত। ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে সৃষ্টিজগতে আল্লাহর ক্বদর সম্পর্কে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি। ইতিহাস আমাদের কাছে কিছু তথ্য সরবরাহ করে। যার মাধ্য বিভিন্ন ঘটনাবলীর বিবরণ জানতে পারি। সেখানে ভাল-মন্দ সব কিছুরই অস্তিত্ব আছে। ইতিহাস ভাল-মন্দের আয়না, তবে ভাল-মন্দের উৎস নয়। ভাল-মন্দের উৎস কুরআন এবং সুন্নাহ। ইতিহাস দিয়ে শরীয়াহকে বিচার করা যায় না। বরং শরীয়ার মাধ্যমে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তারপর শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে শরীয়ার মাপকাঠিতেই। আল্লাহর আমরে শর'য়ী হল কুরআন এবং সুন্নাহ। আর ইতিহাস আল্লাহর আমরে ক্বদরী।

প্রাচ্যবিদবিদদের ইতিহাস পাঠের একটি পদ্ধতি হল historicalism তথা ইতিহাসবাদ। এই পদ্ধতির মূল কথা হল, ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূলনীতির ভিত্তিতে কোন কিছুর শুদ্ধাশুদ্ধির হুকুম প্রয়োগ করা যাবে না। বরং ইতিহাসে দেখতে হবে সেটার ধরণ, প্রভাব ও অবস্থান কী ছিল। সেই আলোকে বিষয়টিকে বিচার করা হবে। এই প্রবণতা মুসলিমদের দ্বীন বিনষ্ট এবং তাদেরকে বিভ্রান্ত করার পিছনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। ইতিহাসকে বিধান গ্রহণের উৎস মানা একদিকে ক্বদরকে ব্যবহার করে শরীয়াহ প্রত্যাখ্যানের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে এই প্রক্রিয়া প্রাচ্যবিদদের ইতিহাস পাঠের নিকৃষ্ট নীতির সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। সব মিলিয়ে বিষয়টি আল্লাহর শরীয়তে ফাসাদ তৈরির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।
ইতিহাসের বর্ণনায় কয়টা শর'য়ী দণ্ডবিধি বাস্তবায়িত হওয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়- এই সংখ্যার চেয়ে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল এই ব্যাপারে ইসলামী শরীয়াহ কী বলে? ইতিহাসে কোন কোন শাসক শাতেমে রাসূলের বিচার করল না- এই অনুসন্ধান শাতেমের ব্যাপারে আল্লাহর শর'য়ী নির্দেশে শিথিলতা আনার বৈধতা রাখে না। ইতিহাসে সমকামীরা প্রশ্রয় পেয়েছে কি না- এই তথ্য তাদের অপরাধ লঘু করার শর'য়ী অনুমোদন রাখে না। কোন কিছুর বিধান বর্ণনার জন্য ইতিহাসের ভাষায় কথা বলা ইলমী খিয়ানত। একাডেমিক জায়গা থেকে এটি সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতি। বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে কথা বলতে হবে ফিকহের ভাষায়।

যদি ইতিহাসকে বৈধ-অবৈধের উৎস মানা হয়, তাহলে জগতে অবৈধ বলে কিছু থাকবে না। যদি ইতিহাসকে শাস্তি বাস্তবায়নের মাপকাঠি বানানো হয়, তাহলে জগতে কোন অপরাধই শাস্তিযোগ্য থাকবে না। কারণ ইতিহাস আল্লাহর ক্বদর বা তাকওয়ীনি বিষয়। পৃথিবীতে ঘটিত, ঘটিতব্য এবং চলমাম সবই এর অন্তর্ভুক্ত। যেখানে ভাল-মন্দ সব কিছুর সমাহার রয়েছে। এখন সেখান থেকে ভাল-মন্দ ছেঁকে আনার জন্য আমাদের দ্বারস্থ হতে হবে আল্লাহর শরীয়ার কাছে। শরীয়তের মাধ্যমেই সব কিছুর বিচার করতে হবে, ক্বদর দিয়ে নয়। আমাদের জীবন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উৎস আল্লাহর শরীয়ত।


এই পর্যায়ে যেই সমস্যাটার কথা বলব এটা খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। বর্তমান সময়ের অনেক খ্যাতিমান স্কলার থেকে শুরু করে একদম সাধারণ মুসলিমদের মাঝেও ব্যাপকহারে এই সমস্যাটি দেখা যায়। সেই সমস্যাটির নাম হল প্রাগমেটিজম তথা বাস্তবতাবাদ। কোন ব্যক্তির চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি যদি নিছক বাস্তবতাই হয় তবে তাকে প্রাগমেটিক বলে। সাধারণত যারা পুঁজিবাদী আদর্শ অনুসারে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা প্রাগমেটিক বা বাস্তবতাপূজারী হয়। তাদের কাছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দিষ্ট কোন নীতি নেই। বাস্তবতা থেকেই সে আইন গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে ইসলামে আইন গ্রহণের একমাত্র উৎস হচ্ছে তার শরীয়ত। কোন বাস্তবতা এই শরীয়তকে পরিবর্তন করতে পারে না। বরং যে কোন বাস্তবতায় এই অপরিবর্তনীয় শরীয়াহ থেকে করণীয় নির্ধারণ করতে হয়।

মুসলমানদের মধ্যে যারা পাশ্চাত্যের উৎকৃষ্টতায় বিশ্বাসী তারা পাশ্চাত্যের এই উৎকর্ষতাকে মেনে নিতে বলে। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে, অন্যভাবে বললে অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নিতে বলে। অথচ এই অর্থে কোন মুসলমানই বাস্তবতা প্রবণতায় ভুগতে পারে না। একজন মুসলমান প্রাগমেটিক হতে পারে না। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে ইসলামে কি বাস্তবতার কোন মূল্যায়ন নেই? মুসলমানরা কি বাস্তবতা বিবর্জিত এক জাতি? উত্তর হল, ইসলামে বাস্তবতার অবশ্যই এক ধরণের মূল্যায়ন রয়েছে। তবে সেটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের উৎস হতে পারে না। শরীয়তই একমাত্র উৎস মুসলমানদের করণীয় নির্ণয়ের জন্য। একজন মুসলমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় রাখবে,তার দ্বারা প্রভাবিত হবে না। সে বাস্তবতা দ্বারা পরিবর্তন হবে না।বরং বাস্তবতাকে পরিবর্তন করবে শরীয়ার মাধ্যমে। এখন সে যদি বাস্তবতাকে বিবেচনায় না রাখে, তাহলে সেটাকে পরিবর্তন করবে কিভাবে? সুতরাং ইসলামে বাস্তবতা বিবেচনার দাবি রাখে, অনুসরণের না। কোন জিনিসের বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার অর্থ তাকে গ্রহণ করে নেয়া কিংবা অনুসরণ করা নয়। এমনটি মনে করা সম্পূর্ণ ভুল।

কুরআন - সুন্নাহ এবং ইসলামী ইতিহাসে এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেখানে আম্বিয়ায়ে কেরাম ও ইসলামী ব্যাক্তিত্বরা নানান বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু তারা সেই বাস্তবতাকে অনুসরণ করেননি। সেটাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উৎস বানাননি। বরং শরীয়ার আলোকে সেটাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছেন শরীয়তের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে। উদাহারণস্বরূপ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনিকেই দেখানো যায়। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ওহী নাযিল হল এবং তিনি ইসলাম প্রচার করতে শুরু করলেন, তখন তিনি অনেক দূর্বল ছিলেন। পক্ষান্তরে মক্কার কাফেররা ছিল অনেক শক্তিশালী আর প্রতাপশালী। এটা এক বাস্তবতা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভালভাবেই এই বাস্তবতাকে জানতেন। তাদের অত্যাচার, নিপীড়ন সহ্য করেছেন। তথাপি এক মুহূর্তের জন্য ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত হননি। স্বীয় অবস্থানে অটল থেকেছেন। তাদের অবস্থান গ্রহণ করেননি এবং তার অনুসরণের চিন্তাও করেননি।

মদিনায় যখন ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর হল, তখনো তা সামরিক,অর্থনৈতিক ভাবে ততটা মজবুত হয়নি। পক্ষান্তরে পারস্য-রোম ছিল তখনকার সুপার পাওয়ার। সার্বিকভাবে সমৃদ্ধশালী। এটাও এক বাস্তবতা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বাস্তবতাকে ভালভাবে জানতেন। তবুও তিনি পারস্য-রোমের অনুসরণ করেননি। বরং তাদের অবস্থানকে ভুল সাব্যস্ত করে দাওয়াত প্রদান করেছেন। এমনকি তাদের সাথে লড়াইয়ের ও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

সাইয়্যেদ কুতুব (রঃ) বলেছেন , "তৎকালীন মক্কা তথা আরবের বাস্তবতার দাবী এটাই ছিল যে , আরব জাতীয়তাবাদ অথবা অর্থনৈতিক মুক্তির আহ্বান জানিয়ে আরবদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং একটা সুসংগঠিত সালতানাত প্রতিষ্ঠা করা। একাজটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে করা খুবই সহজ ছিল এবং এই ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে কোনপ্রকার বিপদ - আপদের সন্মুখীন হওয়ার নূন্যতম আশঙ্কা ছিল না। এই প্রক্রিয়ায় একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি মানুষকে ' লা - ইলাহা ইল্লাল্লাহু ' এর দাওয়াত দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। আল্লাহর অভিপ্রায় এমন ছিল না। এভাবে বাস্তবতাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ামক মনে করা ইসলামের সাথে যায় না এবং তা ইসলামের জন্য ফলদায়কও নয়।"

পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল ইসলামী ব্যাক্তিত্বের অবস্থান এমনটাই দেখা যায়। বর্তমান আমেরিকা তালেবানদের জন্য ছিল এক বাস্তবতা। কিন্তু তারা এই বাস্তবতাকে মেনে নেননি।আর এই না মেনে নেয়ার মাঝেই মুসলমানদের কল্যান নিহিত। মূসা আলাইহিস সালামের সময় ফির'আউন ছিল এক বাস্তবতা, ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের সময় নমরুদ ছিক আরেক বাস্তবতা। কিন্তা তারা কেউই সেসব বাস্তবতাকে মেনে নেননি, অনুসরণ করেননি। বরং শরীয়ার স্বতন্ত্রতায় সেগুলোকে বিলুপ্ত করেছেন। এরকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। সবগুলো উল্লেখ করতে গেলে আলোচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আজ মুসলিমদের মধ্যে তুলনামূলক অগ্রসর অংশও পাশ্চাত্য কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে বাস্তবতাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ামক বানিয়ে নিয়েছে।

বাস্তবতায় প্রভাবিত হয়ে শরীয়ার বিধান ও মূল্যবোধে হাত দেয়া প্রকারান্তরে ক্বদরকে দলিল হিসেবে মেনে নেয়ার মতই। এই ব্যাপারে দ্বিতীয় পর্বে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। পৃথিবীতে বিদ্যমান সবকিছুই বাস্তবতা এবং সেগুলো আল্লাহর ক্বদরের অন্তর্ভুক্ত। যেখানে ভাল-মন্দ সব কিছুই আছে। এখন বাস্তবতার দোহাই দিয়ে শরীয়াহকে প্রত্যাখ্যান করার সবক দেয়া কিংবা শিথিলতা আনয়ন করা "ইস্তিদলাল বিল ক্বদর" এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। যেমন কেউ বলল, "বর্তমানে সমকামী আন্দোলন একটি বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে আপনি অস্বীকার করতে পারেন না।" এই কথার দুটো উদ্দেশ্য হতে পারে। একটা হল, এই বাস্তবতা থেকে চোখ বুজে নিয়ে আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন না। বরং এই ব্যাপারে শরীয়াহ আপনাকে যেই কর্তব্য দিয়েছে সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। এই অর্থে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এর আরেকটি অর্থ হতে পারে এবং এই অর্থটাই অধিকাংশ মুসলিম নিয়ে থাকে। সেটা হল, এই বাস্তবতাকে আপনার বরদাশত করতে হবে এবং এর সাথে আপোষ করতে হবে, তাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এটাই হল প্রাগমেটিজম।

দেখবেন কেউ আজমতের সাথে শরীয়ার বিধান পালন করতে গেলে মুসলিমদের ভিতর থেকেই কেউ কেউ তাকে উদ্দেশ্যে করে বলে, "বোকা মুসলিম" অথবা "বাস্তবতাবিরোধী"। এরকম গালিগুলো আসলে অতি বাস্তবতা প্রবণতারই প্রভাব থেকে আসে। আমাদের বাস্তবতা পূজা এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক মুসলিমের কাছেই শরীয়ার বিধানগুলো বাস্তবতা বিরোধী মনে হয়। বিদ্যমান নানান মতবাদের ব্যাপারে যখন সে শরীয়তের দৃঢ় অবস্থান জানতে পারে, তখন সে আসমান থেকে পড়ে বসে। "এটা বাস্তবতা বিরোধী, ইসলামে বাস্তবতা বিরোধী কিছু নেই" বলে সে বয়ান ছাড়ে। মানে সে বাস্তবতা দিয়ে শরীয়াহকে বিচার করছে।

মুসলমান কখনোই বাস্তবতায় প্রভাবিত হয়ে শরীয়ার বিধানকে পরিবর্তন করতে পারে না। বাস্তবতা দিয়ে শরীয়াহকে বিচার করতে পারে না। কারণ বাস্তবতা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। আজ যেটা বাস্তব কাল সেটা কল্পনার বস্তুতেও পরিণত হতে পারে। ফিরাউন, নমরুদ এরাও এক সময়ের বাস্তবতা ছিল। কিন্তু আজকে তারা আমাদের জন্য অনেকটা রূপকথার গল্পের মত হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের শরীয়াহ অকাট্য, অপরিবর্তনীয় এবং অবিকৃত। কোন মানুষের ক্ষমতা কিংবা অধিকার নেই যেকোন বাহানায় এই শরীয়াহকে বিকৃত বা পরিবর্তন করার।

বর্তমান পাশ্চাত্য নানা ইজম এবং আন্দোলন অবশ্যই একেকটা বাস্তবতা। এটা আমাদের মানতেই হবে। তার মানে এই না যে, আমাদের সেগুলোর অনুসরণ করতে হবে। আমাদের নিজস্ব সভ্যতা, কর্মপদ্ধতি, চেতনা,স্ট্যান্ড ছেড়ে দিতে হবে। বরং উপরোক্ত দৃষ্টান্তসমূহ থেকে স্পষ্ট হয়, আমাদের শরীয়তের স্বতন্ত্রতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কোন পাশ্চাত্য প্রতিষ্ঠানকে প্রাইমারি মেনে সেটাকে সিদ্ধান্ত কিংবা চেতনার উৎস বানানো যাবে না। শরীয়তকে প্রাইমারী পর্যায়ে রেখে এসব বাস্তবতাকে জার্জ করতে হবে। শরীয়তকে চেতনার মানদণ্ড ও সবকিছুর নীতিনির্ধারক মেনে নিয়ে সেগুলোর মোকাবেলা করতে হবে। মুসলমানদের জন্য এটাই ফলদায়ক। সে যদি বাস্তবতার দোহাই দিয়ে শরীয়ার ব্যাপারে আপোষ করতে চায়, তাহলে এক সময় সে শরীয়াহ থেকে দূরে সড়ে আসবে এবং বাস্তবতার নোংরা জলাশয়ে ডুবে মরবে। আর যদি শরীয়ার আলোকে বাস্তবতার মোকাবেলা করে, তবে নিশ্চিতভাবেই আজকের নোংরা বাস্তবতাগুলো অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর মত কল্পকাহিনীতে পরিণত হবে ইনশাআল্লাহ।

এই সংকটের তালিকায় আরো কিছু অতি জটিল বিষয় রয়েছে। যেমন 'মাক্বাসিদে শরীয়াহ' তত্ত্বের অপব্যবহার। বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। আল্লাহ হায়াতে তাইয়্যিবাহ দান করলে বাকি সংকটগুলো নিয়েও লেখার চেষ্টা করব।


~সিফাত

পঠিত : ৪৮৮ বার

মন্তব্য: ০