Alapon

কর্ণাটকের বিপ্লবী মুসকান বিশ্ববাসীকে যে বার্তা দিলো।

গত ক’মাস আগে ভারতের কর্নাটকের উদুপির একটি কলেজে হিজাব পরে ক্লাসে আসতে নিষেধাজ্ঞা জারিকে কেন্দ্র করে বিতর্কের শুরু হয়। ভারতের এহেন কর্মকান্ড উগ্রহিন্দুত্বাবাদের ছোট্ট বহিঃপ্রকাশ মাত্র। হিজাব বিরোধী তৎপরতা ভারতের একার নয় আবার এটা নতুন কোনো ইস্যুও নয়। ২০১৪ সালে ফ্রান্সে স্কুল ও সরকারী অফিসে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয় কিন্তু জনরোষের মুখে তারা সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালে জার্মানির সবচেয়ে ঘণবসতিপূর্ণ রাজ্য নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়ার কর্তৃপক্ষ রাজ্যের সব স্কুলে ১৪ বছরের কম বয়সি মেয়েদের জন্য স্কুলে হিজাব নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছে৷ অস্ট্রিয়ায় ছাত্রীদের হিজাব পরা বন্ধ করতে পায়তারা করা হচ্ছে। ফ্রান্স ইউরোপের প্রথম দেশ, যেখানে বোরকা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। ফ্রান্সে ৫০ লাখ মুসলমানের বাস। ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল এই আইন কার্যকর হয়। বোরকা বা নেকাব পড়লে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে। ইতালির বেশ কয়েকটি শহরে নেকাব নিষিদ্ধ। উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর নোভারা কর্তৃপক্ষ সেখানে আইন করে বোরকা নিষিদ্ধ করেছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এশিয়ার মুসলিমপ্রধান দেশ তাজিকিস্তান বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করে। আফ্রিকার ৯৯ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বীর দেশ মরক্কোতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বোরকার উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১১ সালের জুলাইয়ে বেলজিয়ামেও নেকাব নিষিদ্ধ হয়। অর্থাৎ কোনও নারী তার পুরো মুখ কাপড়ে ঢেকে রাখতে পারবে না। নেদারল্যান্ডসে ২০১৫ সালে আইন করে বোরকা নিষিদ্ধ করা হয়। বিশেষ করে জনসমক্ষে অর্থাৎ স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদির মতো জায়গায বোরকা ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইনটি কার্যকর হয় ২০১৯ সালের ১ আগস্ট। এদিকে পুরো স্পেনে নয়, শুধু বার্সেলোনা শহর কর্তৃপক্ষ সেখানে বোরকা নিষিদ্ধ করেছে। ২০১৩ সালে সুইজারল্যান্ডের ইতালিয় ভাষাভাষীদের এলাকা টিসিনোতে বোরকা নিষিদ্ধের ওপর ভোট হয়। নিষিদ্ধ করার পক্ষে পড়ে ৬৫ শতাংশ ভোট। এরপর ২৬টি শহরে বোরকা নিষিদ্ধ হয়। কেউ জনসমক্ষে বোরকা পড়লে ৯ হাজার ২০০ ইউরো পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে তার। ২০১৯ সালের ৫ জুন গণজমায়েতের স্থান, গণপরিবহন ও সরকারি অফিস-আদালতে নেকাব নিষিদ্ধ করে তিউনিসিয়া সরকার। বিশ্ব ব্যাপী হিজাব ও নেকাব বিরোধী এই অপতৎপরতা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে নয় বরং ইসলামি সংস্কৃতি রুখে দিতেই তাদের এই হীনকান্ড। মুসলমানদের বিরুদ্ধে একক কোনো গোষ্ঠী নয় বরং সকল ইসলাম বিদ্বেষী গোষ্ঠী একত্রে তৎপর হয়ে উঠেছে। যা ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিশ্ব বাসীর অবলোকিত হয়।
একজন মানুষ কি পোশাক পরবে সেটা তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং মৌলিক অধিকার বটে। ইসলামে পর্দা করা ফরজ। সেই ফরজ পালন করতে গিয়েই মুসলিম নারীদেরকে হিজাব-নিকাব পরতে হয়। কিন্তু আফসোস আজ সভ্যতার স্বর্ণযুগে মানুষের ধর্ম পালনে বাঁধা সুষ্টি করা হয়। হিজাব বিরোধী এই কান্ড জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরে গৃহীত "The Universal Declaration of Human Rights" এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের "The Universal Declaration of Human Rights" এই ঘোষণাপত্রে মোট ৩০টি ধারা রয়েছে। এরমধ্যে "ধারা ২"-এ বলা হয়েছে- "এ ঘোষণায় উল্লেখিত স্বাধীনতা এবং অধিকারসমূহে গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষা, ভাষা, রাজনৈতিক বা অন্যবিধ মতামত, জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, জন্ম, সম্পত্তি বা অন্য কোন মর্যাদা নির্বিশেষে প্রত্যেকেরই সমান অধিকার থাকবে। কোন দেশ বা ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সীমানাগত বা আন্তর্জাতিক মর্যাদার ভিত্তিতে তার কোন অধিবাসীর প্রতি কোনরূপ বৈষম্য করা হবেনা; সে দেশ বা ভূখণ্ড স্বাধীনই হোক, হোক অছিভূক্ত, অস্বায়ত্বশাসিত কিংবা সার্বভৌমত্বের অন্য কোন সীমাবদ্ধতায় বিরাজমান।" এবং "ধারা ১৮"-তে বলা হয়েছে- "প্রত্যেকেরই ধর্ম, বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতায় অধিকার রয়েছে। এ অধিকারের সঙ্গে ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তনের অধিকার এবং এই সঙ্গে, প্রকাশ্যে বা একান্তে, একা বা অন্যের সঙ্গে মিলিতভাবে, শিক্ষাদান, অনুশীলন, উপাসনা বা আচারব্রত পালনের মাধ্যমে ধর্ম বা বিশ্বাস ব্যক্ত করার অধিকারও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।" বারবার জাতিসংঘের এই আইন বহির্ভুত কাজ করা হলেও উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। বিশ্ব ব্যাপী কাফেররা মুসলমানদের ধর্মীয় বিধান হিজাব-নিকাবের মধ্যে জঙ্গীবাদের গন্ধ খোঁজে। কিন্তু পৃথিবীতে এযাবত কালে যত গুলো বড় বড় সন্ত্রাসী কর্ককান্ড ঘটেছিলো তার প্রায় সবকটিই অমুসলিমদের দ্বারা সংগঠিত হয়। তবুও ইসলাম বিদ্বেষী চিন্তা কাফেরদের ঘুমকে হারাম করে দিচ্ছে। জাতি সংঘের গৃহিত সীদ্ধান্ত গুলো কাগজে কলমে সুস্পষ্ট থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ খুব একটা নেই । আবার নেই বললেই ভুল হবে কেননা তারা মুসলিম ব্যতিত অন্য সকল ধর্মের ও নাস্তিকদের সুরক্ষা দানে সদা তৎপর।

সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় ভারতের কর্ণাটকের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এই ভিডিওতে দেখা যায়, কর্ণাটকের একটি কলেজ চত্বরে হিজাব পরা এক ছাত্রী হাঁটছেন। এ সময় গেরুয়া ওড়না পরা একদল তরুণ তাকে ঘিরে হিজাববিরোধী স্লোগান দেন এবং হেনস্তা করেন। শত শত তরুণের সামনে একাই প্রতিবাদ জানান। এই ঘটনা ঘটেছে কর্ণাটকের মান্দিয়া প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই তরুণী স্কুটার পার্কিংয়ে রেখে কলেজ ভবনের দিকে হাঁটছে। এ সময় গেরুয়া ওড়না পরা একদল তরুণ ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দেয় এবং তার দিকে এগিয়ে যায়। পাল্টা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেওয়ার সময় এই তরুণীকে ভীত দেখা যায়নি। ওই সময় হাত উপরে তুলে আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে দেখা যায় তাকে। পরে কলেজের প্রিন্সিপাল এবং অন্যান্য শিক্ষকরা তাকে সরিয়ে নেন। উক্ত ঘটনার পর বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিউজ চ্যানেল গুলো মুসকানের সাক্ষাতকার নিলে সেখানেও মুসকান দৃঢ় কণ্ঠে ভারতীয় উগ্র হিন্দুত্বাবাদের বিরোধীতা করে এবং অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে আহবান জানায়। মুসকানের ভিডিও ভাইরাল হলে সারা বিশ্বের মুসলমানগণ জেগে ওঠে। বিভিন্ন দেশের সংগঠন সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দেয়। এমনকি ভারতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী অনেক হিন্দু ব্যক্তিবর্গ উক্ত ঘটনার নিন্দা জানায়। মুসকানের বিপ্লবী প্রতিবাদে সারা বিশ্বে সে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় এবং একাধারে বিশ্ববাসীকে এক সুস্পষ্ট বার্তা দেয়। এক মুসকানের প্রতিবাদে বিশ্ব ব্যাপী সাড়া জেগেছে। সুতরাং পৃথিবীর সকল মুসকান জেগে উঠলে ইসলাম বিদ্বেষী জনগোষ্ঠীর অবস্থা কত নাজুক হবে তা খুবই স্পষ্ট। মুসলমানদের বিপ্লবী চেতনার প্রকাশিত ধ্বনিরূপ ‘’ লিল্লাহে তাকবির-আল্লাহু আকবার”। যুগে যুগে কাফির মুশরিকের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে মুসলমানদের ঐতিহাসিক অস্ত্র ছিলো তাকবির ধ্বনি। এই ধ্বনিতে ভুবন কাঁপে, কাঁপে বাতিলে হৃদয়। তাকবিরের তাৎপর্য হলো তাওহিদের চেতনায় সর্বদা উজ্জীবিত থাকা এবং শিরকের পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত তাওহিদের শিক্ষায় উদ্ভাসিত ঈমানী জীবন গঠনের লক্ষ্যে সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করা। কারণ দ্বীন-ধর্ম ও আমল আখলাক সবকিছুর মূল হল, নির্ভেজাল তাওহিদ। এই বিশ্বাসে খুঁত থাকলে পর্বতসম আমলেরও কোনো মূল্য নেই। তাকবিরে মূল কথা হল তার বড়ত্ব প্রকাশ করা। মুসলিম কোনো সাধারণ ধর্ম গোষ্ঠী নয়; মুসলিম হলো স্রষ্টার মনোনিত ধর্মগোষ্ঠী। মুসলমানগণ সংখ্যাধিক্যের ফলে জয় লাভে অভ্যস্ত নয় বরং ইমানী চেতনায় বিজয় চিনিয়ে আনতে অভ্যস্ত। মুসলমানগণ তাদের বদর যুদ্ধে মাত্র ৩১৩জন সৈনিক নিয়ে ১০০০ কাফের সৈনিককে কুপেকাত করে বিজয় লাভ করে। ওহুদ যুদ্ধে ৭০০ সৈন্য নিয়ে ৩০০০ কাফের সেনাকে পরাজিত করে। আন্দালুসিয়ার প্রান্তরে তারিকের পুত্র জিয়াদ সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে লক্ষাধিককে পরাজিত করে আন্দালুসিয়ায় বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। সুলতান মাহমুদ নুরুদ্দিন জিনকি ও তার পথ ধরে সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবি বিশাল ক্রুসেড বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। মুসলমান ভীতুর জাত নয় বরং মাথা উচু করে দাঁড়াবার জাতি। মুসলিম সর্বস্ব হারাতে রাজি তবুও ইসলামের পতাকার মান ম্লান হতে দিতে রাজি না। আজকের মুসকান আবারো বিশ্ববাসীকে মুসলমানদের বিপ্লবীরূপ দেখিয়ে দিয়েছে। মুসলমান সিংহের জাতি। মুসলমান গর্জে উঠলে তাদের রুখবার কেউ থাকে না। মুসলমানদের জিহাদের বোধ হলো, হয় জয় লাভ করবো নয়তো শহীদ হবো। পিছপা হবার কোনো ইতিহাস মুসলমানদের নেই। মুসলিম উম্মাহ কখনো কাফেরদের শক্তির দ্বারা পরাজিত হয় না। মুসকানের মাঝে আমি আজ শহীদ ওমর মুখতারের চেতনা দেখতে পাই। লেবাননের বীর শহীদ ওমর মুখতারের সেই অমীয় বক্তব্য ‘আমরা কলোনী মুক্ত করবো নয়তো শহীদ হবো’। সেদিন ইতালির মুসোলোনী কর্তৃক শত লোভ-লালসার প্রস্তাব ওমর মুখতারকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ওমর মুখতারের বক্তব্য ছিল, আমার শাহাদাত উম্মাহর জন্য শিক্ষা হবে যে, মুসলিম ফাঁসির কাষ্ঠ বরণ করবে তবুও বাতিলের সাথে আপস করবে না। মুসলমান বাসর রাতে বউকে ঘরে রেখে যুদ্ধে যাওয়া জাতি। মুসলমানদেরকে আজ তাদের সেই হারানো ঐতিহ্যকে ধারণ করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে স্বগৌরব। মুসলমান ঘুরে দাড়ালে জয় অবশ্যম্ভাবী। লিল্লাহে তাকবির-আল্লাহু আকবার।


লেখক,
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পঠিত : ৪০৭ বার

মন্তব্য: ০