Alapon

এক ইসলামে এতো দল-মত কেনো...?



আল্লাহ আমাদেরকে ভিন্নভাবে সৃষ্টি করেছেন, আমাদের মস্তিষ্ককে ভিন্নভাবে সৃষ্টি করেছেন। আমরা সবাই একভাবে চিন্তা করি না। একটি জিনিসকে একেকজন মানুষ একেকভাবে ব্যাখ্যা করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ধর্ম যে ব্যাপারেই বলুন না কেনো, দেখবেন সবার চিন্তা এক না। একই বিষয়ে একেকজন একেকভাবে চিন্তা করে।

একেক ধর্মের অনুসারী একেকটি বিষয়ে বিশ্বাস করে, তাদের বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য আছে; এমনকি যারা একই ধর্মের অনুসারী, তাদের মধ্যেও মতপার্থ্যক্য দেখা যায়। পূর্ববর্তী উম্মতের চেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত বেশি বিভক্ত হবে। এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যৎবাণী।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “ইহুদীরা ৭১ অথবা ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিলো; খ্রিস্টানরাও অনুরূপ দলে বিভক্ত হয়েছিলো। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে।” [জামে আত-তিরমিজি: ২৬৪০]

আমরা এই হাদীসের বাস্তবতা আমাদের সময়ে দেখতে পাই। এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের করণীয় কী? আমরা কী করবো?

ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের একেকটি মসজিদে হয়তো দুই-তিন মতের মানুষ নামাজ পড়ে। কিন্তু, আপনি যখন মসজিদে নববী, মসজিদুল হারামে নামাজ পড়বেন, আপনি দেখতে পাবেন তারচেয়ে বেশি দল-মতের মানুষ একসাথে নামাজ পড়ছে। ইউরোপ-অ্যামেরিকার মসজিদেও একই অবস্থা। ইউরোপ-অ্যামেরিকায় আরো কিছু দল আছে, যেটা পৃথিবীর অন্য কোথাও ঐভাবে পাওয়া যাবে না। তারা নিজেকে মুসলিম দাবি করে, কিন্তু হাদীস মানে না, তারা নিজেকে মুসলিম দাবী করে, কিন্তু নিজের মনমতো কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা করে; যার সাথে মুসলিম সভ্যতার আলেমদের মতের মিল নেই।

ফলে, যারা নতুন করে ইসলাম পালন শুরু করে, তাদের মনে এই প্রশ্নটি আসে- আমি কোন শায়খকে অনুসরণ করবো? কোন মাজহাব অনুসরণ করবো?

এগুলো নিয়েই আমরা আলোচনা করবো। আমরা কয়েকটি পয়েন্টে আমাদের বিষয়বস্তু সাজাবো।

১। প্রত্যেক ‘ইখতিলাফ’ আমাদেরকে ‘খিলাফ’ পর্যন্ত নিয়ে যায় না। ইখতিলাফ হলো মতপার্থক্য, আর খিলাফ হলো মতপার্থক্যের ফলে অন্যকে শত্রু মনে করা। ইসলামে অনেক মতপার্থক্য আছে, যেগুলো সহ্যসীমার মধ্যে, সেগুলোকে মেনে নিতে হয়। এটা সাহাবীদের মধ্যেও দেখা যায়।

সাহাবীরা ইসলামের অনেক ব্যাপারে মতপার্থক্য করেছেন। এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় পর্যন্ত সাহাবীরা কোনো কোনো ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। আল্লাহ এভাবেই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ কিছু ব্যাপারে একমত হবে, কিছু ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করবে।

বনু কুরাইযার অভিযানের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে বললেন:

“বনু কুরাইযায় না পৌঁছা পর্যন্ত কেউ আসরের নামাজ পড়বে না।”

একাংশ সাহাবী বনু কুরাইযায় পৌঁছার আগেই আসরের নামাজের সময় হয়ে গেলো। এখন তারা কী করবেন? সাহাবীদের মধ্যে দুই ভাগ হয়ে গেলো।

একভাগ সাহাবী বললেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথামতো বনু কুরাইযায় গিয়েই আসরের নামাজ পড়বো।

আরেকভাগ সাহাবী বললেন, আমরা এখনই নামাজ পড়বো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটা বলতে চাননি যে, সময় হলেও রাস্তায় নামাজ পড়ো না। তাঁর কথার উদ্দেশ্য ছিলো আমরা যেনো দ্রুত বনু কুরাইযায় পৌঁছাই।

একদল সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার আক্ষরিক অনুসরণ করেন, আরেকদল সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার প্রায়োগিক, উদ্দেশ্যের অনুসরণ করেন। একদল নামাজ পড়েন রাস্তায়, আরেকদল বনু কুরাইযায় পৌঁছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দুইদল পুরো বিষয়টি জানান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো দলের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি। [সহীহ বুখারী: ৪১১৯]

সাহাবীদের মধ্যকার এমন মতপার্থক্যকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিন্দা করেননি। মানুষের মধ্যে এমন মতপার্থক্য হবে ধরেই নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদলকে বলেননি ঠিক কিংবা আরেক দলকে ভুল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পরও সাহাবীরা বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য করেন। কিন্তু, তাঁদের মধ্যকার মতপার্থক্য তাঁদেরকে একজন থেকে আরেকজনকে বিচ্ছিন্ন করেনি, তারা একজন আরেকজনের শত্রুতে পরিণত হননি।
আমাদের মাজহাবগুলো মূলত সাহাবীদের মতামতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সরলভাবে বলা হয়ে থাকে, হানাফী মাজহাব আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ও শাফেয়ী মাজহাব আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতামত গ্রহণ করেছে। কথাটির মধ্যে সত্যতা আছে। তারমানে, এই মতপার্থক্যের উৎস সাহাবীদের থেকে। মাজহাব চতুষ্টয় কোনো না কোনোভাবে সাহাবীদের অনুসরণ করছে, সাহাবীদের অনুসরণের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহর অনুসরণ করছে।

একটি বিষয়ে মতপার্থক্য থাকবেই। একই বিষয়ে দুটো মত থাকা সত্ত্বেও দুটো মতই বৈধ হতে পারে। পূর্ববর্তী আলেমগণ বলতেন, সাহাবীদের মতপার্থক্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার। কেননা, সাহাবীরা মতপার্থক্য না করলে দেখা যেতো কোনো বিষয়ে শুধুমাত্র একটিই মত পাওয়া যেতো, যা অনুসরণ করা আমাদের জন্য কঠিন হতো। এরকম একটি কথা বলেন ইসলামের পঞ্চম খলিফা খ্যাত উমর ইবনুল আব্দুল আযিয রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম কাসিম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর রাহিমাহুল্লাহ। [আব্দিল বার, জামিউল বায়ানিল ইলম: ২/৮০, সুনানে আদ-দারিমী: ১/১৫১]

প্রত্যেক মতপার্থক্য খারাপ নয়। কিছু মতপার্থক্য আছে বলেই ইসলাম মেনে চলা আমাদের জন্য সহজ হয়েছে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু, আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য করেছেন বলে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে আলেমগণ সেগুলোর উদ্ধৃতি দিতে পারে।
যে ইসলামের ইতিহাস পড়েছে, সে জানে যে, প্রত্যেক আলেম কোনো না কোনো বিষয়ে অন্যের সাথে দ্বিমত করেছেন। প্রত্যেক আলেমের এমন কিছু মত আছে, যা বাকি আলেমগণ সমালোচনা করেছেন। ইমাম আন-নববী, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, ইমাম গাজালী, ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার (আল্লাহ সবার ওপর রহম করুন) জীবনী পড়লে দেখতে পাবেন যে, তাঁদের সবগুলো মত সবাই মেনে নেননি। তাঁদেরও কিছু শায মত পাওয়া যায়। তাই বলে, বাকিরা তাঁদেরকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলেননি।

তারা মুসলিম সভ্যতায় এতো প্রভাবশালী কেনো? কারণ, তারা প্রত্যেকেই এমন স্বতন্ত্র কিছু বলেছেন, যা অন্য কেউ করেনি। তারা কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা করেছেন, সেগুলো বুঝার চেষ্টা করেছেন। সেটা করতে গিয়ে তারা অনেক নতুন নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা তাঁদের পূর্বে কেউ দেয়নি। তাঁদের সেসব মত পরবর্তীতে অনেকেই গ্রহণ করেছে, কিছু মতের সমালোচনা হয়েছে। এটা সত্ত্বেও তারা মুসলিম সভ্যতার মহান ইমাম। তাঁদের সাথে পরবর্তীরা মতপার্থক্য করা সত্ত্বেও তাঁদের কিতাব পড়ে উপকৃত হয়েছে, অন্যকে পড়তে বলে।

এছাড়াও কিছু মতামত আছে, যেগুলো আমরা অপছন্দ করি। যেমন: কেউ বললো- ‘আমি হাদীস মানি না’। তাদেরকে কী করবেন? সামাজিকভাবে জীবনযাপন করতে গেলে তাদেরকেও সহ্য করতে হবে। আমরা এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলবো, লেখালেখি করবো; পাশাপাশি সেগুলোকে সহ্য করতে হবে। সহ্য করা মানে এই না যে সেগুলো মেনে নেয়া।
এর বাইরে কিছু মতামত আছে, যেগুলো আমরা সহ্য করতে পারবো না। সেটা হলো- যা সমাজের শান্তি নষ্ট করে, যা নিরীহ মানুষের রক্তপাত ঘটায়। এগুলোর ব্যাপারে আমরা সোচ্চার হবো। এগুলোকে সহ্য করা যাবে না। এর বাইরে যা আছে, সবকিছু সহনীয়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা অমুসলিমদেরকে মুসলিম ভূখণ্ডে বসবাস করে ইবাদাতের অনুমতি দিয়েছেন। ইহুদি-খ্রিস্টানকে দারুল ইসলামে বসবাস করে তাদেরকে ইবাদাতের অনুমতি আল্লাহ দিয়েছেন। এই ব্যাপারে কোনো মুসলিম আলেম দ্বিমত করেননি।
আপনার কী মনে হয়? আপনার মুসলিম ভাই/বোন, যে অন্য একটি মত সমর্থন করে, তাকে আপনি আপনার গ্রাম, উপজেলা, জেলায় বসবাস করতে দিবেন না? আল্লাহ যেখানে অমুসলিমদের অনুমতি দিয়েছেন, আপনি সেখানে আরেকজন মুসলিমকে সেই অনুমতি দিবেন না?

যে অনেক জ্ঞানী, তার সহ্যক্ষমতা অনেক বেশি। আর যার জ্ঞান কম, তার সহ্যক্ষমতাও কম। সে শুধুমাত্র তার দল ও তার মত নিয়ে পড়ে থাকে। অন্য মতকে সে সহ্য করতে পারেনা।

ছোটো জলাশয়ে সাধারণত রুই-কাতলা থাকে না। এসবে থাকে পুঁটিমাছ। পুঁটিমাছ খুব লাফায়, সবসসময় অস্থিরভাব তার মধ্যে থাকে। অথচ রুই-কাতলা এতো লাফায় না। তারা মাঝেমধ্যে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয়।

বাংলা ভাষার পণ্ডিত নীলরত্ন হালদার এরকম একটা দৃশ্যপট এঁকেছেন:
“অগাধ জলেতে চরে যে রোহিত মৎস্য, তাহার মনে কোনো বিকার নেই। কিন্তু সফরী অর্থাৎ পুঁটি মৎস্য এক গণ্ডুষপরিমিত জলেতে থাকিয়া অহংকারে ফরঙ্গ করে।” [নীলরত্ন হালদার, কবিতারত্নকর, পৃষ্ঠা ৬৫]

আরেকটি উদাহরণ দিলে বুঝা যাবে। মনে করুন আজ থেকে ৫০০ বছর আগের কথা। গ্রামের একজন ভেষজ ডাক্তার। তিনি সামান্য পড়াশোনা করেছেন, গ্রামেই চিকিৎসা করেন। তিনি একটি রোগের কথা শুনলেন, যে রোগের কথা জীবনে শুনেননি, এমনকি তার আশেপাশের কেউ শুনেনি। তিনি প্রথমেই বলতে পারেন- ‘এটা ভুয়া, এরকম রোগ বলতে কিছু নেই, আমি এতোদিন ধরে চিকিৎসা করি, আমি জানি না?’

তার দুনিয়া সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি মূলত তার গ্রামেই সীমাবদ্ধ। পৃথিবীর আরেক প্রান্তের সমস্যা, রোগ তার জানার কথা না। ফলে, হঠাৎ যখন তিনি সেই রোগের অথা জানতে পান, সাথে সাথে তার অজ্ঞতা থেকে মন্তব্য হাজির করেন।

ইসলাম সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেন, তাদের কারো কারো অবস্থা এরকম। তারা হয়তো সারাজীবন এক মতের স্বপক্ষে পড়ালেখা করেছেন। হুট করে তারা যখন অন্য মত দেখতে পান, তারা নিজেদের অজ্ঞতা ঢাকার জন্য বলেন, ‘ঐ মত ইসলাম সমর্থন করে না’। অথচ, তিনি যে মত সমর্থন করছেন, সেটা যেমন ইসলামের একটি মত, এর বাইরেও অন্য মত আছে। কিন্তু, তার অজ্ঞতার কারণে তিনি নিজের মতটাই ইসলাম, বাকি মত ইসলাম বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। এটা হলো তাদের অবস্থা, যারা অজ্ঞ।

অন্যদিকে, যারা সবগুলো মত নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাদের পড়াশোনার আলোকে হয়তো একটি মতকে উত্তম মনে করে মেনে চলেন। বাকি মতগুলোর যে অস্তিত্ব আছে, সেটা সম্পর্কে তারা জানেন। ফলে, ঐ মত সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলে তারা বলেন না- ‘ঐ মতটি বাতিল’।

ইসলামের সূচনা থেকে, সাহাবীদের আমল থেকে একেক বিষয়ে নানান মত দেখা যায়। এক বিষয়ে একাধিক মত থাকা মানে একটি মত বাদে বাকিগুলো বাতিল নয়।

২। ইসলাম কোনো দল-উপদলের নাম নয়। ইসলাম কোনো মতবাদের নাম নয়। মুসলিম কোনো ছোটো একটি দলের নাম নয়। মুসলিমরা বড়ো একটি উম্মত। মুসলিমরা আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত উম্মত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মুসলিম জামআতের ওপর আল্লাহর হাত প্রসারিত।

কেউ যদি বলে একমাত্র তার দলই জান্নাতে যাবে, বাকিরা জাহান্নামে যাবে; তাহলে সে ভুল বলছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি জান্নাতে দেখলাম আমার উম্মতের সংখ্যা এতো বেশি যে, দৃষ্টি যতোটুকু যায়, তারচেয়ে বেশি। জান্নাতে আমার উম্মাহর সংখ্যা হবে অন্যান্য উম্মাহর অর্ধেকের বেশি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এরকম অনেক ভবিষ্যৎবাণী আছে।
মেইনস্ট্রিম ইসলাম বা মূলধারার ইসলাম সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তারা নিরাপদ। এখন কেউ যদি এসে বলে, আমি ও আমার এই ৫০ জন অনুসারী জান্নাতে যাবো, বাকিরা জাহান্নামে, তাহলে বুঝতে হবে তার মতটি- কুরআনের বিরুদ্ধে, হাদীসের বিরুদ্ধে, এমনকি কমনসেন্সের বিরুদ্ধে।

কমনসেন্সের বিরুদ্ধে কেনো?
আমরা শেষ নবীর উম্মত। আমাদের পর আর কোনো নবী-রাসূল পৃথিবীতে আসবেন না। আল্লাহ তখনই পৃথিবীতে নবী-রাসূল প্রেরণ করেন, যখন বেশিরভাগ মানুষের আকীদা বিনষ্ট হয়, বেশিরভাগ মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে ভুল আকীদার অনুসরণ করে, আল্লাহ সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে।

আমাদের পর যেহেতু আল্লাহ কোনো নবী-রাসূল প্রেরণ করবেন না, সেহেতু আল্লাহ তাঁর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত ও মুসলিম জামআতকে সুরক্ষিত রাখবেন। সেই হিশেবে মুসলিম জামআত বিভ্রান্তিতে নিপতিত হবে না। মুসলিম জামআত মোটাদাগে এমন কিছু করবে না, যার ফলে পুরো মুসলিম জামআত জাহান্নামে যাবে।

কোনো ছোটো দল যদি বলে একমাত্র আমরা হকের ওপর আছি, তাহলে তাদের ধারণা ভুল। মুসলিম জামআত বা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামআত কোনো ছোট দলকে নিয়ে নয়। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামআতের আকীদা বিশুদ্ধ আকীদা। তারা কুরআন, সুন্নাহ, আল্লাহ, রাসূল, হাদীসে জীবরীলের ওপর ঈমান আনে। এর বাইরে যেসব মতপার্থক্য আছে, সেগুলোকে সহ্য করা যায়, এগুলো থাকবেই।

কেউ বলতে পারে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম কি বলেননি, ৭২ টি দল পথভ্রষ্ট হবে আর একটি দল সুপথপ্রাপ্ত হবে? তাহলে তো দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগই পথভ্রষ্ট, তাই না?

না। ৭২ দল মানে বেশিরভাগ মুসলিম নয়, আর ১ দল মানে কম মুসলিম নয়। ইমাম আস-সানআনী, ইমাম আশ-শাওকানীর (আল্লাহ উভয়কে রহম করুন) মতে, ৭২ দল মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নয়।

যেমন: ঢাকা শহরের একটি স্কুলে ১০০০ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ৮০০ জন ঢাকা শহরের স্থানীয়। বাকি ২০০ জন শিক্ষার্থী ৬৩ টি জেলার। কোনো জেলার ২ জন, কোনো জেলার ৩ জন, কোনো জেলার ৫ জন। এভাবে ৬৩ টি জেলা মিলিয়ে ২০০ জন শিক্ষার্থী এবং শুধুমাত্র ঢাকা জেলা মিলিয়ে ৮০০ জন শিক্ষার্থী।

তাহলে দেখা গেলো, ঐ স্কুলে ৬৪ টি জেলার মধ্যে এক ঢাকা জেলার যতো শিক্ষার্থী, বাকি ৬৩ টি জেলা মিলিয়েও এতো শিক্ষার্থী নন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসটি ইমাম আস-সানআনী রাহিমাহুল্লাহ ও ইমাম আশ-শাওকানী রাহিমাহুল্লাহ এভাবে ব্যাখ্যা করেন- ৭২ দল মানে বেশিরভাগ নয়, ১ দল মানে কমসংখ্যক নয়। যদি এমন হতো, প্রত্যেক দলের অনুসারী সংখ্যা সমান, তাহলে বুঝা যেতো যে, ৭২ দল মানে অনেক বেশি। আসলে, ৭২ দল মিলিয়ে যা হবে, সেটা মুসলিমদের মোট সংখ্যার তুলনায় ৫-১০% হবে। বাকি ৯০% বলা যায় সঠিক আকীদার ওপর প্রতিষ্ঠিত।

যে কেউ ইসলামের ৬ টি আরকান, ৫ টি স্তম্ভ মেনে নেয়, সে মুসলিম। জীবরাঈল আলাইহিস সালাম ইসলামের আরকান, স্তম্ভ শেখানো শেষে চলে যাবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে বলেন:
“তিনি জীবরাঈল। তোমাদের কাছে তিনি তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে এসেছিলেন।” [সহীহ মুসলিম: ১]

জীবরাঈল আলাইহিস সালাম যে বিষয়গুলো জিজ্ঞেস করেন, সেগুলো যে বিশ্বাস করে সে মুসলিম। তাকে আপনি ইসলাম থেকে বের করে দিতে পারেন না। এটাই হলো দ্বীন ইসলাম। এর বাইরে যা আছে, সেগুলো হলো বিস্তারিত ব্যাখ্যা। এসব ব্যাখ্যায় মতপার্থক্য থাকলে কেউ ইসলাম থেকে বাইরে চলে যায় না।

সাহাবীদের সময় থেকে মতপার্থক্য দেখা যায়। অনেকগুলো ফিক্বহী বিষয়ে সাহাবীরা নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য করেন। এমনকি আকীদার ব্যাপারেও সাহাবীরা মতপার্থক্য করেন। উম্মাহর জাগরণ কিভাবে হবে, রাজনীতি কিভাবে পরিচালিত হবে এসব ব্যাপারগুলো নিয়ে তো সাহাবীরা শত শত মতপার্থক্য করেছেন এমনকি পরস্পর যুদ্ধ করেছেন।

কে খিলাফতের যোগ্য হকদার এই ইস্যুতে সাহাবীরা যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু একজন আরেকজনকে বাতিল বলেননি, জাহান্নামী বলেননি। তারা দুনিয়া পরিচালনার ব্যাপারে দ্বিমত করেছেন, কিন্তু এখানে ধর্ম টেনে এনে বলেননি- ‘তুমি আমার সাথে দ্বিমত করেছো, তুমি জাহান্নামে যাবে’।

আপনার আশেপাশে যারা যেসব বিষয়ে দ্বিমত করছেন, এগুলো খুব ছোটোখাটো ইস্যু। এগুলোর ফলে তারা ঐ ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। যেমন: কেউ নামাজে রউফুল ইয়াদাঈন করলে সে ৭২ দলের অন্তর্ভুক্ত না, নামাজে বুকে বা নাভির নিচে হাত বাঁধলে সে জাহান্নামে যাবে না। এগুলো খুবই ছোটোখাটো ব্যাপার।

বর্তমান সময়ে এতো দল, এতো মতের কারণ কী? এটার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ইসলামের কিভাবে পুনর্জাগরণ করা যায়? এই প্রশ্নে একেকটি দল একেকভাবে চিন্তা করে?
কেউ বলে আমরা দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে দ্বীনের পুনর্জাগরণ করবো
কেউ বলে আমরা মানুষের আকীদা সংশোধনের মাধ্যমে দ্বীনের পুনর্জাগরণ করবো
কেউ বলে আমরা রাজনীতিতে সক্রিয় হবার মাধ্যমে দ্বীনের পুনর্জাগরণ করবো
কেউ বলে আমরা মানুষের আত্মার সংশোধনের মাধ্যমে দ্বীনের পুনর্জাগরণ করবো
আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, প্রত্যেকেই ইসলামের একটি সঠিক জিনিসের প্রতি জোরারোপ করে। তারা এমন না যে বাকিগুলোকে অগ্রাহ্য করে। যারা বলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে, নেতৃত্বদানের মাধ্যমে ইসলামের পুনর্জাগরণ করবে, তারা কিন্তু এটা বলে না যে আত্মার সংশোধন দরকার নেই। তারা শুধুমাত্র একটির তুলনায় আরেকটিকে প্রাধান্য দেয় এবং মনে করে ঐটাই সময়োপযোগী।

একেকটি দলের এই ধরনের প্রাধান্য দেয়াটা এক দলের সাথে অন্য দলের সহায়ক। তারা একদল আরেকদলের প্রতিযোগী নয়। কেউ রিক্সাওয়ালার কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছে, কেউ যাচ্ছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে, কেউ যাচ্ছে ধনীদের মাঝে, কেউ যাচ্ছে রাজনীতিবিদদের মাঝে। প্রত্যেকেই দ্বীন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে সেসব মানুষের কাছে যাচ্ছে, যারা দ্বীন মেনে চলতে আগ্রহী নয় বা অজ্ঞ। ফলে, মোটাদাগে তারা দ্বীনের খেদমত করছে। যে নামাজ পড়ে না, তাকে নামাজ পড়তে উৎসাহ দিচ্ছে, যে হারামে লিপ্ত, তাকে হালালের ব্যাপারে রাস্তা দেখাচ্ছে।

একেকটি দল একেকরকম প্রচেষ্টায়, ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য একেকরকম পদ্ধতিতে মানুষের কাছে যাচ্ছে। তারা যতোক্ষণ না একজন আরেকজনকে প্রতিযোগী ভাববে, ততোক্ষণ পর্যন্ত তারা ঠিক আছে।

আপনি এখন যে দল-মত সমর্থন করেন, চিন্তা করুন তো, আপনি কী কারণে সেটা সমর্থন করেন? আপনি নিশ্চয়ই কোনো আলেমের কথা পছন্দ করেন, যেকোনো ব্যাপারে তাঁর মতামত আপনাকে তুষ্ট করে। এটা কেনো করে সেটা কি আপনি চিন্তা করেছেন?
হয়তোবা আপনার মা-বাবা সেই দল সমর্থন করেন বা সেই আলেমকে পছন্দ করেন
আপনি ইসলাম শিখেছেন সেই আলেমের কাছে বা ইসলাম সম্পর্কে আপনার ভুল ধারণার অবসান ঘটিয়েছেন সেই আলেম অথবা ইসলাম নিয়ে গর্ব করা শিখিয়েছে সেই দল বা সেই আলেম। ফলে, আপনি তাকে পছন্দ করেন বা সেই দলকে সমর্থন করে।

এটা ঠিক আছে। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামআতের অনুসরণ করে এমন যেকোনো দলের সাথে আপনি নিজেকে সম্পৃক্ত করুন, উম্মাহর পুনর্জাগরণের চেষ্টা করুন, এতে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তখনই হয়, যখন আরেক দলের পদ্ধতির সাথে আপনার মতপার্থক্য থাকার কারণে তার পেছনে পড়ে থাকেন। যতোক্ষণ পর্যন্ত আরেক দল সহ্যসীমার মধ্যে দ্বীনের পুনর্জাগরণের চেষ্টা করে, যতোক্ষণ পর্যন্ত তারা কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি তাদের ব্যাপারে চুপ থাকেন, তাদেরকে তাদের কাজ করতে দিন। আপনি নিজে যে দলের সাথে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ মনে করেন, সেই দলের সাথে থাকুন।

সাহাবীদের মধ্যেও এসব ব্যাপারে মতপার্থক্য দেখা যায়। রাজনীতির ইস্যুতে সাহাবীরা যখন যুদ্ধে অবতীর্ণ হন, তখন কয়েকজন সাহাবী এগুলো এড়িয়ে ইলম চর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুম। তারা তাঁদের প্রায়োরিটি নির্ধারণে অন্যদের মতো ছিলেন না।

সেই সময় খিলাফত ছিলো, খলিফা ছিলেন। তারপরও যদি এতো মতপার্থক্য দেখা যায়, আমাদের সময় যেখানে খিলাফত নেই, সেহেতু এসব ব্যাপারে আরো বেশি মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক।

আপনার আশেপাশে যারা আছে, যারা ভিন্নমত পোষণ করে, তারাও ভালো মুসলিম। তাদের সাথে আপনার মতপার্থক্য না দেখে আগে দেখুন তাদের সাথে আপনার কী মিল খুঁজে পান। তাদের সাথে হয়তো ১০ টি ব্যাপারে দ্বিমত করেন, কিন্তু শতো শতো এমনকি হাজার হাজার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। আপনি দ্বিমতগুলো না দেখে একমতগুলো দেখুন। আমরা সবাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি, সবাই একই কুরআন পড়ি, সবাই এক কিবলামুখী হয়ে নামাজ পড়ি। এতোগুলো বড়ো বড়ো বিষয় আমাদেরকে একত্রিত করতে পারে না, ছোটোখাটো বিষয়গুলো আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে?

কেউ যদি বলে ‘আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে চাই রাসূলুল্লাহর সুন্নাহর আলোকে’ তাহলে সে আমার ভাই। তারা সাথে আমার একশোটি বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে, তবুও সে আমার শত্রু না; সে আমার ঘরের মানুষ। পরিবারে আমার ছোটো ভাইয়ের সাথে কতো বিষয়ে আমি দ্বিমত করি, তাই বলে কি তাকে ঘর থেকে বের করে দেই?

ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি ফিরকার জন্ম হয়। তাদের নাম খারেজী। আলী ও মুআবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মধ্যে একটি যুদ্ধ হয়, সিফফিনের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণ ছিলো রাজনীতি, ধর্ম না। এই যুদ্ধে যারা একদল আরেকদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তারা অন্য দলকে ‘কাফির’/’বাতিল’ মনে করতো না।

তৃতীয় দলটি এসে সাহাবীদের দুই দলকে কাফির মনে করা শুরু করে! তারা সাহাবিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নাহাওয়ান বসবাস শুরু করে। তারা মুসলিম জামআত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় খারেজী নামে পরিচিত।

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন খলিফা। খারেজীদের ব্যাপারে তিনি যেই অবস্থান নেন, সেটা আমাদের সবার মাথায় রাখা উচিত।

তিনি যখন জানতে পারেন, ঐ দলটি ভিন্ন আকীদা পোষণ করে, যা মুসলিম জামআতের বিপরীত, তখন তিনি তাদেরকে হত্যা করেননি। তিনি সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাদের মধ্যে পাঠান বিতর্কের জন্য। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস তাদের সাথে বিতর্ক করেন, ইসলামের মৌলিক আকীদা তুলে ধরেন, সাহাবীদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণ ব্যাখ্যা করেন, দ্বন্দ্ব নিরসনে সাহাবীদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন।

তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে ৪০০০ খারেজী তাঁর সাথে চলে আসে। তারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে যোগদান করে। কিন্তু, তাদের বড়ো একটি দল থেকে যায় পূর্বমতে।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এসে ঐ দলটির কথা বলেন, যারা পূর্বমতে অটল। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু খলিফা হিশেবে কী করবেন? তিনি এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করেন যা আমাদের জন্য আদর্শ। ভিন্নমতকে কিভাবে সহ্য করতে হয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেন।

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের ব্যাপারে বার্তা পাঠান: “তোমরা আমাদের ও অন্যদের কর্মনীতি দেখেছো। কাজেই, তোমরা যেখানে চাও সেখানে অবস্থান করো। উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক। আর তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এই অঙ্গীকার থাকলো যে, তোমরা অন্যায়ভাবে কারো রক্তপাত ঘটাবে না। ডকাতি, রাহাজানী করবে না ও যিম্মীদের ওপর অত্যাচার চালাবে না। যদি এর কোনোটিতে লিপ্ত হয়ে পড়ো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবো।” [আল্লামা ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৭/৫০৮]

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথা হলো- তাদেরকে বুঝানো সত্ত্বেও যদি তারা সঠিক আকীদায় ফিরে না আসে, তাহলে আর কী করা যায়? আমি তো তাদেরকে জোর করতে পারি না। তাদেরকে ততোক্ষণ পর্যন্ত সহ্য করা হবে, যতোক্ষণ তারা অন্যায়ভাবে রক্তপাত ঘটাবে না। যদি এমন বিশৃঙ্খলা করে, তাহলে আমরা তাদেরকে ছেড়ে কথা বলবো না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো, যুদ্ধ করবো।

অর্থাৎ, কেউ অন্যায় করলে, আমাদের দিকে তেড়ে আসলে তখন আর সহ্য করা হবে না। এর আগ পর্যন্ত তাদের সাথে দ্বিমত করবো, তাদের মতের সমালোচনা করবো, কিন্তু তাদেরকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করবো না।

পরবর্তীতে খারেজীরা যখন মুসলিমদের আক্রমণ করা শুরু করলো, তখন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। সাহাবীদের দল-মত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকে সহ্য করেন। কিন্তু, তাদের উগ্রবাদ, রক্তপাত সহ্য করেননি।
আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মুসলিম ইতিহাসের প্রায় সবগুলো দল পছন্দ করে। ৯৯% দল আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ভালোবাসে। এটা ছিলো ভিন্ন মতালম্বীদের সাথে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর অবস্থান।

সেখানে আপনি কিভাবে ভাবেন যে, আপনি ভিন্নমতের আরেকজনকে জোর করে আপনার মতে নিয়ে আসবেন? তাকে বাধ্য করবেন, শারীরিক নির্যাতন করবেন? আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু খলিফা হওয়া সত্ত্বেও এই কাজটি করেননি।

পারলে আপনি তার সাথে বিতর্ক করুন, যেমনটা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু করেছিলেন। বিতর্কের মাধ্যমে বুঝাতে পারলে তো আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভালোই। কিন্তু, বুঝাতে না পারলে তাকে তার অবস্থায় ছেড়ে দিন, তার সাথে সহনশীল আচরণ করুন, সহিংসতা নয়। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা থেকে আমরা এটাই শিখতে পারি।

[ আরিফুল ইসলাম। ডক্টর ইয়াসির ক্বাদির লেকচার অবলম্বনে (অনুবাদ)]

পঠিত : ১১০০ বার

মন্তব্য: ০