Alapon

সাংবাদিকদের আত্মঅহংকারের সুযোগ আছে...?



মেধাবী, পরিশ্রমী সাংবাদিক, নাম 'হ' আদ্যক্ষরে। ইসলামের বিষয়ে তাঁর বেশ জ্ঞান, নিয়মিত পড়াশোনা করতেন। দেশের নামকরা পত্রিকায় কাজ করেছেন। কয়েক মাস আগে তাঁকে সিলেটের এক মাজারে প্রায় বিবস্ত্র অবস্থায় দেখা যায়। তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। মানসিক অসুস্থতা বাড়লে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে পথ থেকে পথ ধরে গন্তব্যহীন হাঁটেন। 'ম' আদ্যক্ষরের জ্যেষ্ঠ এক সাংবাদিক, একসময় খুব ডাকসাইটে ছিলেন। প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন।

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি মানসিক অসুস্থতার শিকার হন। বছর দশেক আগে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে কাউকে দেখতেই নিজের আগেকার পদবি বলতেন, কারো কারো কাছ থেকে শুধু এক, দুই টাকা চাইতেন খুব লজ্জানির্ভর উচ্চারণে। দৈনিক মানবজমিন তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল। তিনি এখন সম্ভবত বেঁচে নেই। 'আ' আদ্যক্ষরের ঝানু এক সাংবাদিক, দৈনিক বাংলার প্রকাশনা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বন্ধ হয়ে গেলে আর কোথাও চাকরি পাননি।

শেষ জীবনটা তাঁর কাটে চরম অনটন, গ্লানি, হতাশার ভেতর। মৃত্যুর বছর কয়েক আগে থেকে বিছানায় শুয়ে তিনি অতীতের সম্মানজনক পদে চাকরি করা নিয়ে বিলাপ করতেন একা একা। এটা তাঁর স্ত্রীর কাছে শুনেছিলাম। মাত্র কয়েক বছর আগেও প্রথম সারির 'আ' আদ্যক্ষরের' জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক পদে ছিলেন। ওই দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর তিনি আর কোথাও চাকরি নেননি। এখন তাঁর হাতে অন্যকে চাকরি দেয়ার সুযোগ নেই। খুব কম সাংবাদিকই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। যখন চাকরি দেয়ার সুযোগ ছিল; তখন তাঁর কার্যালয়, মুঠোফোন সেটে 'শুভাকাঙ্ক্ষী সাংবাদিকদের' খুব চাপ থাকতো।

তাঁর মতো জ্যেষ্ঠ, দেশবরেণ্য অনেক সাংবাদিক শেষ বয়সে চাকরি না থাকা, অবসরে থাকায় একসময়ের 'শুভাকাঙ্ক্ষীরা' যোগাযোগ রাখেননি। জীবনের নির্মম নিয়মে জীবন থেকে তাঁরা ছুটি নেন নিরবে। মৃত্যুর পর সাবেক সহকর্মী, সাংবাদিক নেতারা শোকবার্তা দিলেও তাঁদেরকে মনে রেখেছেন খুব কমজনই। সাংবাদিকতা একধরনের সাতসাড়াতাড়ির সাহিত্য হলেও পেশা হিসেবে এর ট্রাজেডি হচ্ছে, আলোচিত সাংবাদিকরা চোখের আড়াল হলে, বা মৃত্যুর পর তাঁদেরকে মনে রাখা হয় না। যেভাবে কবি, সাহিত্যিকরা লোকান্তরিত হওয়ার পরও কাল থেকে কালান্তরে স্মরণে, আলোচনায় থাকেন।

'আ' আদ্যক্ষরের এক সাংবাদিক, যাঁর জন্মজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ছোট বাক্যে, সহজ শব্দে তিনি প্রতিবেদনের অসাধারণ মুখবন্ধ (ইন্ট্রু) লেখেন, যা অবশ্যই শিক্ষণীয়। জনকণ্ঠ, আমার দেশসহ পাঠকনন্দিত পত্রিকায় শীর্ষপদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতো সাংবাদিকরা কোথাও দায়িত্ব পালন করলে সেই প্রতিষ্ঠান ঋদ্ধ হয়। অথচ তিনি বিএনপির সমর্থক হওয়ায় দীর্ঘ বছর ধরে বেকার। তাঁর প্রজ্ঞা, অর্জন ও পেশাদারত্ব বিবেচ্য নয় দলবাজির সংস্কৃতির কাছে।

বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগ, বাম সমর্থকরা; আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপি, জামায়াত সমর্থক সাংবাদিকরা (সবাই নন) চাকরিহীন থাকবেন, এটা অলিখিত আরেক নির্লজ্জ সত্য। কয়েকজনের আত্মঅহংকারের জোরে কথিত এ 'সংস্কৃতি' পাল্টানো অসম্ভব। নব্বইয়ের দশকের ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, জনকণ্ঠের মতো সাড়া জাগানিয়া পত্রিকার অনেকেই শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতায় টিকতে পারেননি। ছাঁটাইয়ে পড়ে, প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জীবন টিকিয়ে রাখার দায়ে তাঁরা সাংবাদিকতা ছাড়তে বাধ্য হন।

এ দেশের বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, বা শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। আজ প্রচারসংখ্যা, দর্শক জরিপে শীর্ষে থাকা সংবাদমাধ্যমের চাঞ্চল্য জাগানিয়া সাংবাদিকও তাই আগামীকাল বেকার হয়ে যেতে পারেন। কোনো প্রতিষ্ঠানে রাতেও সবচেয়ে প্রভাবশালী সাংবাদিক পরদিন সকালে বেকার হয়ে যেতে পারেন। এ দেশের মালিকপক্ষ খুব কম সাংবাদিককেই তার প্রতিষ্ঠানের জন্য অনিবার্য মনে করেন। শফিক রেহমানের মতো সম্পাদকের শূন্যতা 'শ' আদ্যক্ষরের একজনকে (যিনি অভিনেত্রী রোজিনার সাংঘাতিক ভক্ত) দিয়ে 'পূরণ' হয় বলেও মনে করে মালিকপক্ষ!

জীবন, চারপাশের বাস্তবতা কখন কার সঙ্গে কী খেলা করে, তা আগেভাগে কেউ বলতে পারেন না। 'ম' আদ্যক্ষরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্যের শেষ জীবন কেটেছে ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে কারাবন্দির মতো। ওই ফ্ল্যাট দখলের লোভে তাঁর আপন ভাতিজা এমন বর্বর অন্যায় করেন। 'শ' আদ্যক্ষরের পাঠকনন্দিত দুই লেখকের শেষ জীবন কেটেছে মানবেতর অবস্থায়। তাঁদের সন্তান বাবার খোঁজ নেননি। অথচ তাঁরা প্রতিষ্ঠিত। একজনের ছেলে পশ্চিমা দেশের চিকিৎসক, আরেকজনের ছেলে মন্ত্রী।

- হাসান শান্তনু

পঠিত : ৮৫৭ বার

মন্তব্য: ০