Alapon

ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে সমাজকে......



এক সময় ছেলেপেলেরা মুরুব্বি কাউকে দেখলে কোনো ভুল কাজ করতো না। অন্যায় কাজ করতো না। তবে কেউ যদি আগে থেকেই কোনো অন্যায় কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকতো, তখন বড়োদের দেখলে তারা আড়ালে সরে যেতো।

যেমন সিগারেটের বিষয়টা-ই দেখুন, আমি আমার সমবয়সী এবং আমাদের অনেক বড়ো ভাই লেভেলের অনেক মানুষকে দেখেছি, যারা সিগারেট খেতে ঠিকই, কিন্তু কোনো মুরুব্বিকে বা সম্মানিত কোনো মানুষকে বা আলেম-ওলামা-শিক্ষকদেরকে দেখলে তারা তা লুকিয়ে ফেলতো। হাতটা পেছনে নিয়ে যেতো।

আমি আব্বা-আম্মার সাথে চলাচল করতে জীবনে কতো শতবার যে এই দৃশ্য দেখেছি যে, যেখানে একজন ইয়ং ছেলে খুব মজা করে সিগারেট ফু দিয়ে বেড়াচ্ছে। যখনই সামনে আমার আব্বা-আম্মা সামনে পড়েছে, তখনই সিগেরেটটা ফেলে দিয়ে কিংবা পেছনে নিয়ে সালাম দিয়েছে। একবার এলাকার দূর সম্পর্কের একজন মামা, তিনি সিগারেট টানা অবস্থায় হুট করে আব্বা সামনে পড়ে যায়। আব্বার সাথে আমিও ছিলাম। আব্বাকে দেখে অপ্রস্তুত অবস্থায় তিনি সিগারেট পকেটেই ঢুকিয়ে ফেলেছেন। জলন্ত সিগারেট । এটা নিয়ে আমি জীবনে বহুবার হেসেছি। মনে পড়লেই হাসি।

এবং কেউ যদি ইসলামি শরীয়তের আলোকে পর্দা না-ও করতো, দেখতাম গ্রামের মুরুব্বি, কিংবা কোনো আলিমকে দেখলে বা বাহিরে বের হলে মাথায় কাপড়টা বা ওড়নাটা অন্তত টেনে দিতো। বুকের ওপর তো সব সময়ই থাকতো। কারো মাথা যদি খালি থাকতো, মুরুব্বি টাইপের কেউ সেটা টেনে দিতো।

আমি কতো দেখেছি আমার আম্মা কতো মেয়েকে হাঁটা অবস্থায় তাঁদের মাথায় কাপড়টা টেনে দিয়েছেন। এতে ওই মেয়েগুলো ক্ষুব্ধ হয়নি। বরঞ্চ তারা একটু লজ্জা অনুভবই করেছে। কিন্তু এতে মাইন্ড করেনি। তারা শালীন পোশকই পরতো, তবে মুরুব্বিদের মধ্যে যেহেতু দ্বীনের প্রতি প্রীতি বেশি ছিলো, সে হিসেবে তারা চাইতো তাঁদের পর-প্রজন্ম যেনো শালীনতার সাথে শরয়ী পর্দাটাও করে। সে হিসেবে তাঁদের এসব কাজ বা নসীহত। এতে করে কেউ মাইন্ড করতো না। ক্ষুব্ধ হতো না।

এছাড়া আমরাও যখন সন্ধায় বাহিরে থাকতাম, তখন আমাদের বড়োরা আমাদেরকে বাহিরে দেখলে বকা দিতো। তারা আমার রক্ত সম্পর্কের কোনো আত্মীয়-স্বজন কেউই ছিলো না। তবুও।

পিচ্ছিকালে এলাকায় থাকতে চায়ের দোকানে টেলিভিশন চলতো। সপ্তাহিক বাংলা ছায়াছবি দেখাতো। আমরা কখনো দাঁড়ালে মুরুব্বিরা ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দিতো। আবার আমাদের চেয়ে একটু বড়ো যারা ছিলো, যুবক টাইপের, তারা ঠিকই দেখতাম দোকানে বসে থাকতো, কিন্তু মুরুব্বি বা সিনিয়র কাউকে সামনে পেলে বা এলে তারা ওঠে যেতো। চেয়ারটা খালি করে দিতো। সরে যেতো।

এভাবে অনেক কিছুই বলা যায়। বড়োদের মান্য করা, মর্যাদাবানদেরকে মর্যদা দেয়া, সামাজিক শৃঙ্ক্ষলা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল সবাই ছিলো। কাণ্ডজ্ঞান বলতে একটা কথা ছিলো। কথিত ব্যক্তিস্বাধীনতার জয়জয়কার ছিলো না । যে পাপ করতো, সে লুকিয়ে লুকিয়ে করতো। নিজের পরিসরে যা-ই করুক, কিন্তু একজন মুরুব্বিকে, সিনিয়র মানুষকে শ্রদ্ধা করতো। পাপ করলেও, ভুল করলেও সেসব একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় নির্দিষ্ট স্থানে করতো।

কিন্তু এখন পরিস্থিতে বদলেছে। এখন ছেলে সিগারেট টানলে, বাবাও কিছু বলতে পারে না। পেট-পিট বুক-নিতম্ভ দেখিয়ে একটা টগবগে যুবতি হেটে যায়, সমাজ-পরিবেশের ধার ধারেনা। এমন উগ্রতার বিরুদ্ধে বড়োরাও কিছু বলতেও পারে না। বলাটাও যেনো এক প্রকার পাপ ! অপরাধ।

পশ্চিমা-ভারতীয় কথিত ব্যক্তিত স্বাধীনতার জোয়ারে এখন ছেলেও বাবাকে ভালো-খারাপ, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে আর তেমন একটা কিছু বলতে পারে না। বললে বলে জীবন আমার, সিদ্ধান্ত আমার। মাই লাইফ মাই চুজ।

সমাজে এখন মুরুব্বিদের নাকের ঢগায় চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি। মাস্তানি। মাদকের কারবারি। রাত-বিরেতের গুণ্ডাবাজী। সন্ত্রাসী। ইজ্জতের ভয়ে, আত্মসম্মানের চিন্তায় কেউ কিছুই বলেনা। বলতে পারে না।

সোজা কথায় আগে বড়োদের শ্রদ্ধা করা হতো। ছোটদের স্নেহ করা হতো। একে অন্যকে মানতো-গোনতো। সমাজটাও তাই সুন্দর ছিলো। এখন আর মানা-মানি নেই। পশ্চিমা ব্যক্তিস্বাধীনতার জিগির তুলে এই জানা-মানার ভারসাম্যটা নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। সবাই এখন নিজ নিজ জায়গায় ছোটোখাটো স্বৈরাচার হিসেবে গড়ে ওঠছে। উঠতেছে......

এখন বড়োদের নাকের ঢগায় অনৈতিক কাজ কিংবা অপরাধ করে গেলেও তারা কিছুই বলতে সাহস পায় না। কেউ যদি একটু শাসায় সমাজের কথা চিন্তা করে, তখন পশ্চিমা লিবারেল চিন্তার দাসেরা খুব কিউট করে বলে ওঠে যে, “হ্যাঁ, আমিও এই সমস্ত কাজ পছন্দ করি না, কিংবা আমিও অশ্লীল পোশাক পছন্দ করি না। কিন্তু কেউ যদি তা করে কিংবা অশ্লীল পোশাক পরে, তাহলে আমি তাতে বাধা দেয়াটাকেও সমর্থন করি না। কারণ এটা তার ব্যক্তিগত পছন্দ।”

হ্যাঁ, এভাবে কিউট আর লিবারেল কথাবার্তা বলে অপরাধকে, অন্যায়কে, নোংরামিকে নরমালাইজ করা হয়। সহনীয় করা হয়। কিন্তু যারা বিবেকের তাড়ানায় ঈমানের দাবিতে প্রতিবাদ করে, তাদেরকেই পরবর্তীতে ইনিয়ে-বিনিয়ে অপরাধী বা দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এখানে একটা বিষয়, প্রতিবাদ করা, নসীহত করা, আর আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া এক বিষয় নয়। অপরিচিত কারো গায়ে প্রতিবাদের নামে হাত তোলাটাও আমি সঠিক মনে করি না। আবার সব জায়গায় নিজের তথাকথিত ব্যক্তি স্বাধীনতা ফলানোর পক্ষেও না। কারণ আমরা সামাজিক জীব। সমাজ নিয়ে আমাদের চলতে হয়। সামাজিক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করতে হয়।

যাহোক, আমি তো শুরুতে আমাদের মা-বাবাদের কথা বলেছি, তাঁদের প্রজন্মের কথা বলেছি, কিন্তু আমাদের প্রজন্মেরও অনেককে আমি নিজেও অনেক ভুল বা অন্যায়ের জন্য বকা দিয়েছি। বারণ করছি, দেখেছি অনেকেই তা মেনে নিয়েছে। যদিও কেউ কেউ গাড়ত্যাঁড়ামি করেছে কখনো কখনো। তবে তা বেয়াদবদির পর্যায়ে যায়নি খুব বেশি। কিন্তু এখন শহুরে শ্রেণি বা গ্রামের প্রজন্ম, যা-ই বলেবন না ক্যান; কারো মধ্যেই এই সহনশীলতা বা মানার মন-মানসিকতাটা নেই।

আমরা দেখেছি আমাদের থেকে ২/৪/৫ বছরের জুনিয়র ছেলেপেলেরাও আমাদেরকে দেখলে একটা কাজ করতে কয়েকবার ভাবতো। এই ভাবাটা শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয় আর ভালোবাসা থেকেই ছিলো। তবে এখন আর ভাবাভাবি নেই। কার চাইতে কে বেশি বেয়াদবি প্রদর্শন করতে পারে, এটাই যেনো হয়ে যাচ্ছে গর্বের বিষয়। অথচ এইভাবে কাউকে না মানলে, কাউকে শ্রদ্ধা না করলে, কারো আনুগত্য না করলে একটা সমাজ টিকে থাকে না। মানব সভ্যতার পতন খুব তরান্বিত হয় এইভাবে।

আমরা যদি এই বিষটা উপলব্ধি করতে পারি খুব দ্রুত, তাহলেই আমাদের জন্য মঙল। আর যদি দেরি করি উপলব্ধি করতে, তখন আর কিছুই করার থাকবে না। যখন বুঝবো বা উপলব্ধি করবো, তখন হাউকাউ করা ছাড়া কোনো উপায়-ই থাকবে না।

~রেদওয়ান রাওয়াহা
০২/০৬/২২ ইং

পঠিত : ২৯৬ বার

মন্তব্য: ০