Alapon

|| '৪৭ এর ভারত বিভাগ : কার লাভ, কার ক্ষতি ||


৩রা ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করি। আমার ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক কলীমুদ্দীন এ কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। সিনিয়র অধ্যাপকগণ সবাই তাঁর শিক্ষক। তাই তিনি আমাকে অন্যান্য অধ্যাপকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সিনিয়র অধ্যাপকদের মধ্যে আরবীর অধ্যাপক আবুল হোসাইন এবং ফারসি ও উর্দুর অধ্যাপক সাইয়েদ ইসহাক আহমদ ছাড়া বাকি সবাই হিন্দু। দু'তিন বছরের মধ্যে তারা সবাই রিটায়ার্ড হয়ে যাবার পর তাদের স্থানে মুসলিম অধ্যাপকগণ নিয়োগ পান।
১৯৪৭-এর পূর্বে অবিভক্ত ভারতবর্ষে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে নগণ্য সংখ্যক মানুষ সরকারি উচ্চপদে ছিলো। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি পেশা হিন্দুদের দখলেই ছিলো। মুসলমানদের সংখ্যা মোটেই উল্লেখযোগ্য ছিলো না। সামরিক বাহিনীতে মুসলমান ছিলো সবচেয়ে কম। রেল ও পুলিশ বিভাগেও একই অবস্থা বিরাজ করছিলো।

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বর্তমান বাংলাদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে স্বাধীন মর্যাদা লাভ করার পর সকল ময়দানে বাঙালি মুসলমানদের উন্নতির সূচনা হয়। প্রশাসনের উচ্চপদে বাঙালি মুসলমানদের অতি নগণ্য সংখ্যক থাকায় সচিব পদে অবাঙালি মুসলমান কর্মকর্তারা ভারত থেকে 'অপশান' দিয়ে ঢাকায় আসেন। এ জাতীয় পদে আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) এর লোকই নিয়োগ পেতো। জনাব নূরুন্নবী নামে একজন মাত্র বাঙালি মুসলমান ছিলেন যিনি সরাসরি নন, বিসিএস থেকে পদোন্নতি পেয়ে আইসিএস পদবি লাভ করেন। পুলিশ বিভাগে নিয়োজিত হিন্দুরা 'অপশান' দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ায় এদেশে বহু থানায় ৩ থেকে ৫ জনের বেশি পুলিশ কর্মচারী ছিলো না। জনগণের মধ্যে 'পাকিস্তানী' জজবা ব্যাপক না থাকলে ডাকাতরা ঐ সব থানার অস্ত্রশস্ত্র লুট করে নিয়ে যেতো। রেল বিভাগে মুসলমান কর্মকর্তা ও কর্মচারী এত অল্প ছিলো যে, হিন্দুরা চলে যাওয়ায় ভারত থেকে হিজরত করে আসা রেল কর্মকর্তা ও কর্মচারী এসে ঐ শূন্যস্থান পূরণ করেন।

১৯৪৯ সাল থেকেই আইসিএস পদমর্যাদায় সিএসপি (সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান) পদের বাঙালি মুসলমানের নিয়োগ শুরু হয়। পাকিস্তানের প্রথম সিএসপি পরীক্ষায় চট্টগ্রামের শফীউল আযম সারা পাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এমএ ক্লাসে আমার সহপাঠী কফীলুদ্দীন মাহমুদ, ফযলুর রাহমান, শামসুর রাহমান সহ ফজলুল হক মুসলিম হলে আমি জিএস থাকাকালে যিনি ভিপি ছিলেন, সে মুয়াজ্জম হুসাইন চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন সিএসপি অফিসার হন। প্রতি বছরই তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঢাকায় মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল ও আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং ছিলো। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোনো কলেজ ছিলো না। বাঙালি মুসলমান ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার এক-দু আঙুলে গোনার বেশি সংখ্যায় ছিলো না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও হাই স্কুলে মুসলমান শিক্ষকের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য ছিলো। সেনাবাহিনীতে দু'জনের বেশি বাঙালি মুসলমান কর্মকর্তা ছিলো না। সৈনিকদের সংখ্যাও নগণ্য ছিলো।

পাকিস্তান কায়েম হবার আগে ঢাকায় কোন হাইকোর্ট ছিলো না। কোলকাতা হাইকোর্টে পূর্ববঙ্গের মুসলমান এডভোকেট হাতেগোনা কয়েকজন ছিলেন মাত্র। শেরে বাংলা ফজলুল হক তাদেরই একজন। ব্যারিস্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী ছিলেন। ঢাকায় হাইকোর্ট শুরু হলে পূর্ববঙ্গের মুসলমান যারা ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে সিনিয়র ছিলেন তারা হাইকোর্টের এডভোকেট হবার সুযোগ পেলেন। ডিস্ট্রিক্ট কোর্টেও সর্বত্র হিন্দু এডভোকেটদেরই প্রাধান্য ছিলো। পশ্চিমবঙ্গের ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ ও ড. কামাল হোসেন মুসলমান হবার সুবাদেই তখনকার ঢাকা হাইকোর্টে এবং বর্তমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে উচ্চ মর্যাদার আসন পেয়েছেন। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট তো দূরের কথা ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ও মুনসিফ কোর্টেও বাঙালি। মুসলমান সামান্য কয়েকজন মাত্র ছিলেন।

যদি '৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম না হতো তাহলে বর্তমান বাংলাদেশ অবিভক্ত ভারতের একটি প্রদেশের মর্যাদাও পেতো না, অবিভক্ত বঙ্গদেশের অংশ হিসেবে গণ্য হতো। অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুপ্রধান ভারত রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলমানদের উন্নতির এ মহাসুযোগ কিভাবে হতো, যা বাংলাদেশে হয়েছে?

১৯৩৫-এর 'ভারত শাসন আইন' অনুযায়ী ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর ভারতের ৭ টি হিন্দুপ্রধান প্রদেশে মুসলমানদের সাথে প্রাদেশিক সরকার যে আচরণ করেছে, সে তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলেই ভারত বিভাগ (পাকিস্তান) আন্দোলন দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ভারতের যেসব প্রদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবার দাবি করা হয়নি ঐ সব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের মুসলমানরাও '৪৬-এর নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মুসলিম লীগের পক্ষে ভোট দিয়েছে।

এটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, বাঙালি মুসলমানরা পাঞ্জাব ও সিন্ধুর মুসলমানদের চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যায় পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছে। বাংলাদেশ ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ইংরেজের রাজনৈতিক গোলাম থাকাকালে হিন্দুদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক গোলামির কারণেই '৪৬-এর নির্বাচনে কংগ্রেসের পক্ষে শতকরা একজন মুসলমানও ভোট দেয়নি।
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে আজ যারা মেজর জেনারেল তাদের কয়জন অবিভক্ত ভারতের সেনাবাহিনীতে মেজর হতে পারতেন? বর্তমানে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার তারা কি কেউ এ পদের অধিকারী হতে পারতেন?

যারা সরকারের সচিব তাদের কয়জন এ ক্ষমতার অধিকারী হতেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান প্রফেসর ও রীডারদের যে বাহিনী দেশে বর্তমানে রয়েছে তারা অবিভক্ত ভারতে কি এ সব গৌরবের অধিকারী হতে সক্ষম হতেন? ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প কারখানায় বাঙালি মুসলমানদের যে অর্জন সম্ভব হয়েছে তা কি পাকিস্তান না হলে সম্ভব হতো? সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে এবং ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মুসলমান ব্যারিস্টার ও জাঁদরেল এডভোকেটদের সংখ্যা নিয়ে আমরা গৌরব বোধ করতে পারি। ভারত বিভাগ না হলে কি এটা সম্ভব হতো?

আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। বিগত ৩০ বছরে সর্বক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান যথেষ্ট উন্নতি করার সুযোগ পেয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নতি না হলেও বিরাট সংখ্যায় বাঙালি মুসলমান বৈষয়িক দিক দিয়ে লাভবান হয়েছে। বাঙালি মুসলমান প্রবাসে বিরাট সংখ্যায় যাওয়ায় লক্ষ লক্ষ পরিবার সচ্ছল হয়েছে।

'৪৭-এর ভারত বিভাগ কি ভুল ছিল? :
এটা সত্যিই বিস্ময়ের বিষয় যে, এক শ্রেণীর 'বাঙালি জাতীয়তাবাদী' ভারত বিভাগ ভুল ছিলো বলে দাবি করে। আমি ভেবে পাই না যে, এ সামান্য কথাটুকু তাদের মগজে কেন ঢুকে না যে, '৪৭-এ বিভাগ না হলে '৭১-এ স্বাধীন হওয়া কী করে সম্ভব হতো? এটা আরও বিস্ময়কর যে, কেউ '৪৭-এর কথা বললে এমন কিছু আইনজীবী এবং বুদ্ধিজীবীরাও বিরূপ মন্তব্য করেন, যারা মুসলমান হওয়ার কারণেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে হিজরত করে এদেশে চলে আসতে বাধ্য হন। এদেশে এসে তারা যে উন্নতি ও মর্যাদা লাভ করেছে তা কি ঐ দেশে সম্ভব হতো?

~অধ্যাপক গোলাম আজম ( রহঃ)

পঠিত : ৩৫১ বার

মন্তব্য: ০