Alapon

রাসূল প্রেমিক- ﷺ হযরত তালহা ইবনে বা'রা...



তালহা ইবনে বা'রা। তেরো বছরের এক আনসার বালক।পরিবারের সাথে মদীনা মুনাওয়ারার পাশ ঘিরে অবস্থিত কু'বাতে থাকতেন তিনি। শৈশবে রাসূলের মদীনায় আগমন ছিল তার জন্য অতি আনন্দ, উৎসাহ ও উৎফুল্লতার কারণ।মদীনায় হিজরতের সময় কু'বাতে যখন রাসূলের কাফেলা থেমেছিল, তখন তার সমবয়সী অসংখ্য শিশু কিশোরের মতো কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখার সৌভাগ্য হয় তার।

সেদিন রাসূলকে দেখে; স্নিগ্ধ আনন্দের ঢেউ বয়ে গেছে তার হৃদয়ে। ইসলামের প্রতি তার অন্তর উদগ্রীব হয়ে উঠেছে ভীষণ। যেন তার সকল প্রশান্তি ডুবে আছে রাসূলের আনুগত্যে।
সাহাবাদের সঙ্গী হয়ে, মানুষকে সত্য দীনের পথে আহ্বান করতে মন চায় তার।
হৃদয়ের এই স্বচ্ছ ইচ্ছেটা মা-বাবাকে বললেন তিনি। তারা আপাততঃ সেসব থেকে সরে থাকতে বলেন তাকে।আর মানুষের মাঝে রাসূলের বাণী সমুজ্জল ও স্পষ্ট হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে বলেন তাকে।

কিন্তু তালহার অন্তর এতই উৎসুক, অপেক্ষাতে যেন তার হৃদয় অপ্রসন্ন হয়ে আসছে বারবার।

হঠাৎ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান তিনি। যে মা-বাবা তাকে আগলে রেখেছে, আদর যত্নে গড়ে তুলেছেন এতোদিনে।যাদের ভালোবাসায় আচ্ছাদিত সবসময়, তিনি কি তাদের অনুসরণ করবেন, নাকি রাসূলের অনুসরণ করবেন?

এসব দ্বন্দ্ব একপাশে রেখে, নব ধর্মের আলিঙ্গনে এগিয়ে যান তিনি। ধীরেধীরে রাসূলের কাছাকাছি যান। ইসলাম কবুলের আশা ব্যক্ত করেন।

রাসূল তাকে বাইয়াতের জন্য তোমার হাত প্রসারিত করতে বলেন।
তারপর পরিবার সম্পর্কে জানতে চান তার কাছে। কুন্ঠিত হৃদয়ে মা-বাবার মুশরিকির কথা বলেন রাসূলকে।

রাসূল তাকে বলেন, তুমি কি তোমার পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবে?
তখনই তালহার হৃদয়ে মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা উথলে উঠলো।

তিনি বলেন, না। তা তো পারা যাবে না। এ-বলে রাসূলের ﷺ মজলিস থেকে চলে গেলেন তিনি। নবিজী ﷺ তাকে ছেড়ে দিলেন। এবং ইসলামের প্রতি তালহার আবেগ ও তার হৃদয়ে যে ঈমানের বীজ বপন হচ্ছে তা বুঝতে পারলেন।

মদীনার অধিকাংশ লোকেরা ধীরধীরে রাসূলের ﷺ হাতে বাইয়াত গ্রহণ করছে, তা দেখে তালহার আগ্রহ আর উদ্দীপনা বাড়ছে আরো। সে যে রাসূলের ﷺ নাগাল থেকে এসে গেল; বাইয়াত গ্রহণ না করে।বারবার তা মনে পড়ছে তার।
দ্বিতীয় দিন সে আবারও রাসূলের দরবারে গেল।
রাসূল সাঃ বললে, কি জন্য হাত বাড়ালে?

বলল, ইসলাম গ্রহণ করতে চাই।

রাসূলﷺবললেন, পরিবারের সাথে সম্পর্কে ছিন্ন করতে পারবে?

তালহার হৃদয়ে পুনরায় ভালোবাসা উথলে উঠল পরিবারের জন্য। আস্তে করে উঠে চলে গেল সে।

কয়েকদিন পর আবারও রাসূলের ﷺ দরবারে গেল সে।এবার দৃঢ় সংকল্প করল যে, ইসলাম গ্রহণ এবার করবেই। তারপর রাসূল ﷺ তাকে বাইয়াতের জন্য হাত বাড়াতে বললেন, তিনি সহৃদয়ে ও আনন্দচিত্তে তার হাত বাড়ালো।

তারপর তাকে রাসূল ﷺ বললেন, "হে তালহা, ইসলাম ধর্মে সম্পর্ক ছিন্ন করাটা নেয়। তবে আমি চাই যে, দীনের প্রতিষ্ঠান যেন তোমার মাঝে কোন সন্দেহ না থাকে। রাসূলের হাতে বাইয়াত গ্রহণে যারপরনাই খুশি হলেন তালহা রাঃ। রাসূলের ﷺ সান্নিধ্যে আসতে লাগলেন প্রতিদিনই। নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে লাগলেন নবীজিকে ﷺ। তার হৃদয়ে ঈমানের এক বিষ্ময়কর ফুল ফুটে উঠল।

দিনের পালাবদলে তালহার হৃদয়ে বাড়ছে ঈমানের তেজ। প্রতিটি কাজে রাসূলের অনুসরণ করতে চেষ্টা করছে সে। মা-বাবার চেয়েও রাসূলের প্রতি ভালোবাসা ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

একদিন রাসূলের কাছাকাছি এসে তাঁর দিকে ঝুঁকলেন হালকা, তারপর রাসূলের শরীরের সাথে মৃদুভাবে লেগে থাকল।রাসূলের হাত ও পা মোবারকে চুমু এঁটে দিল সহৃদয়ে।

‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমাকে যে আদেশ করবেন, সে আদেশ আমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করবো। ’ নওজোয়ান তালহার চেহারায় আনুগত্যের দীপ্তরেখা দেখে রাসুল (সা.) মুচকি হেসে বলেন, ‘আমি যদি বলি, তাহলে তুমি তোমার বাবা বারাকেও হত্যা করবে?তালহা আর দেরী না করে সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন ;রাসূলের ﷺ আদেশ পালনে।

রাসূল ﷺ তার ঈমানী শক্তি এবং তাঁর প্রতি অগাধ ভালোবাসা দেখে যারপরনাই খুশি হলেন।তারপর এক সাহাবীকে তালহাকে ফিরিয়ে আনতে বললেন। সাহাবী দ্রুত গিয়ে তাকে ডেকে আনলেন।

রাসূল ﷺ তালহাকে দেখে মুচকি হাসলেন। আগলে ধরলেন তাকে এবং তার দেহটি স্নিগ্ধ নাড়া দিলেন। তারপর বললেন, হে তালহা! আমি কি তোমাকে বলিনি যে, আমাকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পাঠাননি।

কিছুদিন পর তালহার পরিবারও ইসলাম কবুল করেন। তাদের ইসলাম কবুলে তালহা আনন্দিত হয় খুব। সকাল সন্ধ্যায় রাসূলের দরবারে যেতে থাকেন তিনি। কু'বা থেকে মদীনার এই দৈনন্দিন যাত্রা তার কাছে যেন কিছুই না। গভীর ভালোবাসা ও হৃদয়ের অনিন্দ্য আনন্দে রাসূল ﷺ এর দরবারে ছুটে যান তিনি।

ইসলাম কবুলের কয়েকমাস পর তালহা রাঃ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন।পুরো শরীর ব্যথা হয়ে যার তার ।বিছানায় লেগে থাকা ছাড়া উপায় নেয় যেন।এ-কারণে রাসূলের দরবারে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

একদিন মজলিসে তাকে দেখতে না পেয়ে, রাসূল ﷺ জিগ্যেস করলেন তার ব্যাপারে। সাহাবারা তার তীব্র অসুস্থতার কথা বললেন।

এ-শুনে রাসূল ﷺ সাহাবায়ে কেরামের একটি দল নিয়ে কু'বা থেকে মদীনার দীর্ঘ এই পথ পাড়ি দিয়ে, তালহার ঘরে যান তাকে দেখতে।

তীব্র যন্ত্রনার কারণে রাসূলের আগমন সম্পর্কে জানতে পারেনি সে।তাকে দেখে রাসূল ﷺ এর অন্তর নরম হয়ে গেল।তার চেহারায় দেখতে পেলেন মৃত্যু সংকেত।অতঃপর তার সামনে থেকে উঠে, তার জন্য দোয়া করলেন তিনি।

এবং তার পরিবারকে বললেন,আমি দেখতে পাচ্ছি ত্বালহার মৃত্যু আসন্ন। কাজেই তোমরা আমাকে তার অবস্থা সম্পর্কে জানাবে এবং তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা দ্রুত করবে।
এরপর রাসূল ﷺ গভীর অন্ধকার রাতে মদীনায় ফিরে গেলেন।

সেদিন মাঝরাতে তালহার হুশ ফিরল। চেতন হয়েই রাসূল ﷺ তাকে দেখতে এসেছিলেন কিনা জানতে চাইলেন।তারা বলল, তিনি এসেছিলেন এবং তোমার জন্য দোয়াও করলেন। এবং আমাদের বলল, তোমার অবস্থা সম্পর্কে আমাকে অবগত করবে।

এটা শুনে অত্যন্ত খুশি হয়ে যান তিনি। এবং তার মা-বাবাকে বলল, আমার অবস্থা আশংকাজনক, তেমন ভালো লাগছে না। যখন আমার মৃত্যু হয়ে যাবে, তখন তোমরা রাসুল ﷺ-কে আমার মৃত্যুর সংবাদ দিবে না। কারণ রাত হয়ে এসেছে। পথে ইহুদিদের বস্তি রয়েছে। হতে পারে তারা আল্লাহর রাসুলকে কষ্ট দিতে পারে। তাই আমার মৃত্যু হয়ে যাওয়ার পর তোমরা নিজেরাই আমাকে কাফন-দাফন দিয়ে দেবে।

অতঃপর বললেন, আমার পক্ষ থেকে সালাম পাঠাবে রাসূল ﷺ কে। আর তিনি যেন আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

কিছুক্ষণ পরেই তিনি আল্লাহর পরশে চলে যান। তার পরিবার তার জন্য কানতে লাগলেন অঝোরে।তারা কবর খনন করলেন। তাকে সেখানে দাফন করলেন। তার কথামতো তারা রাসূল ﷺ কে জানাননি মৃত্যু সংবাদ। যেহেতু মদীনা থাকে কু'বাতে আসার পরিবেশ অনুকূলে ছিল না তেমন।

ঐ দিন ফজরের পর, তালহা রাঃ এর এক নিকটস্থ আত্মীয় রাসূল ﷺ কে তার মৃত্যু সংবাদ দিলেন। রাসূল ﷺ এর হৃদয়ে তার প্রতি দয়া উথলে উঠল এবং তার জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর তিনি সাহাবাদের একটি দল নিয়ে তালহা রাঃ এর কবরস্থানে গেলেন।রাসূল ﷺ তার জন্য দোয়া করলেন।

রাসুল (সা.) দোয়ার মধ্যে বলেন, যা অন্য কারো জন্য কখনো বলেননি তিনি ‘হে আল্লাহ! তোমার সঙ্গে যেন তালহার সাক্ষাৎ এমন হয় যে, তাকে দেখে তুমি হাসবে আর তোমাকে দেখে সে হাসবে।’

আল্লাহ তা'য়ালা এই প্রেমিক সাহাবার প্রতি রহম করুক। রাসূল ﷺ এর প্রতি যার ভালোবাসা ছিল অগাধ।আল্লাহ তাআলা তার কবরে শান্তির ফল্গুধারা বর্ষণ করুন। করুণার স্নিগ্ধ চাদরে তাকে আবৃত করুন।

পঠিত : ১৯৮২ বার

মন্তব্য: ০