Alapon

নবিজীর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্য মিছিল করতে হবে কেনো? কেউ তাঁকে নিয়ে কটুক্তি করলে আন্দোলন করতে হবে কেনো?



রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় হিজরতের পর আবু আইয়ূব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাড়িতে থাকেন। দুতলা বাড়ির উপর তলায় থাকতেন আবু আইয়ূব আনসারী ও উম্মে আইয়ূব আনসারী, নিচতলায় থাকতেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
হঠাৎ একদিন আবু আইয়ূব আনসারীর মনে পড়লো, 'আরে কী ব্যাপার! আমরা থাকছি উপরতলায় আর রাসূল থাকছেন নিচতলায়? আমাদের পা-শরীর রাসূলের ওপর? এ কেমন কথা!?'
পরদিন তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গিয়ে বললেন, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি উপরের তলায় চলে যান, আমরা নিচতলায় থাকবো'।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বুঝালেন যে, তিনি নিচতলায়ই থাকবেন। বিভিন্ন সময় মানুষজন তাঁর কাছে আসে, তাদের সাথে দেখা করতে হলে নিচতলায় থাকাটা তাঁর জন্য সুবিধা।
আবু আইয়ূব চলে গেলেন। পরদিন আবার এসে আবদার করলেন, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি উপরের তলায় চলে যান। আপনাকে নিচে রেখে আমরা উপরে থাকবো, এটা আমাদের জন্য অস্বস্তিকর। আমাদের মন মানছে না'।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রতি সাহাবীর অগাধ ভালোবাসা বুঝতে পারলেন। তিনি প্রথমে উপরের তলায় যেতে আপত্তি জানালেও সাহাবীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখে উপরের তলায় চলে যান, আবু আইয়ূব আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে নিচতলায় থাকেন।
এই ঘটনায় দেখুন ভালোবাসা প্রকাশের অনুভূতিটা কেমন। রাসূলকে ভালোবাসতে হলে নিচতলায় থাকতে হবে, রাসূলকে উপরের তলায় রাখতে হবে এটা কোনো 'বিধান' ছিলো না। এটা কুরআন-সুন্নাহর কোনো নির্দেশ ছিলো না। উল্টো দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সুবিধার জন্য নিচে থাকতে চান, কিন্তু আবু আইয়ূব আনসারীর ভালোবাসা প্রকাশের অনুভূতিকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরের তলায় বসবাস করেন।
আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এক দর্জির বাড়ি দাওয়াত খেতে যান। তিনি দেখতে পান নবিজী বেছে বেছে লাউ খাচ্ছেন।
আনাস ইবনে মালিক ঠিক করলেন, লাউ যেহেতু নবিজীর প্রিয়, সেহেতু লাউ আমারও প্রিয়। নবিজী কিন্তু তাঁকে লাউ খাওয়ার ফযিলত বলেননি, লাউ খেতে নির্দেশ দেননি। নবিজীর প্রতি ভালোবাসা স্বরূপ ঐদিন থেকে আনাস ইবনে মালিক তাঁর পছন্দের খাদ্যতালিকায় লাউয়ের স্থান দেন।
মালিক ইবনে আনাস রাহিমাহুল্লাহ, যাকে সংক্ষেপে 'ইমাম মালিক' নামে আমরা চিনি। তিনি মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন, মদীনায় বেড়ে ওঠেন। মদীনা শহরে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শায়িত। মালিক ইবনে আনাস বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া মদীনা শহরের বাইরে যেতেন না।
মালিক ইবনে আনাসের ব্যাপারে প্রসিদ্ধ আছে, তিনি মদীনার ভেতরে কোনো বাহন চড়তেন না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করতেন, যে শহরে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শুয়ে আছেন, সে শহরে তিনি কিভাবে বাহনে চড়ে বেড়াবেন?
কুররা ইবনে ইয়াস রাদিয়াল্লাহু আনহু যেদিন নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাছে বাইয়াত নিতে যান, সেদিন দেখতে পান নবিজীর জামার বোতামগুলো খোলা। ব্যাস, ঐদিন থেকে তিনি সারাজীবন যতো জামা পরেন, সবসময় জামার বোতাম খোলা রাখতেন; শীত হোক গ্রীষ্ম হোক।
উহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু দুজানা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বিশেষ তরবারি প্রদান করেন। তিনি আশা করেন, আবু দুজানা এই তরবারিটির হক আদায় করতে পারবে।
দেখা যায় যে আবু দুজানা রাদিয়াল্লাহু আনহু এই তরবারি পেয়ে যুদ্ধের ময়দানে 'কচুকাটা' শুরু করেন। বেশ কয়েকজনকে হত্যা করেন। তিনি রাসূলের দেয়া তরবারিটির হক আদায় করতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন।
একসময় তাঁর সামনে পড়ে হিন্দ বিনতে উতবা, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী, যে কিনা পরবর্তীতে হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহুর অঙ্গচ্ছেদ করে।
আবু দুজানা তাঁর তরবারি দিয়ে সবাইকে হত্যা করলেও হিন্দ বিনতে উতবাকে হত্যা করেননি! হিন্দ বিনতে উতবাকে হত্যা করেননি কেনো?
তার কারণ হলো, তিনি মনে করেন- যে তরবারি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে দিয়েছেন, সেই তরবারি দিয়ে কোনো নারীকে হত্যা করে তরবারির 'অপমান' করে লাভ নেই।
তাঁর সামনে সুযোগ ছিলো তরবারি দিয়ে নারীদের আঘাত করার। কিন্তু, তিনি তা করেননি। রাসূলের দেয়া তরবারি দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে আসা নারীকে হত্যা করা যাবে না এমন কোনো কথা কুরআনে নেই, রাসূলও বলেননি। তারপরও তিনি এটা কেনো করেন? রাসূলের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিশেবে তাঁর দেয়া তরবারির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন, সেটাকে তিনি এতো মর্যাদান মনে করেন, যে মর্যাদার কথা স্বয়ং রাসুল তাঁকে বলেননি।
আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলের ইন্তেকালের পর তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র জমানো শুরু করেন। রাসূলের লাঠি, রাসূলের জামা, চাদর তিনি নিজের সংগ্রহশালায় রাখেন।
মজার ব্যাপার হলো, তিনি তাঁর মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত করে যান, তাঁকে দাফন করার সময় রাসূলের ব্যবহৃত লাঠি যেন তাঁর কবরে রেখে দাফন করা হয়। তাবেয়ীগণ তাঁর অসিয়তমতো তাঁকে দাফন করার সময় রাসূলের ব্যবহৃত লাঠি তাঁর কবরে রাখেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলের হুবহু অনুসরণ করতে চাইতেন। হজ্জের সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে বিশ্রাম নিতেন, তিনিও সেখানে বিশ্রাম নেন, রাসূল যেভাবে মেহেদি মাখতেন, তিনিও সেভাবে মেহেদি মাখেন। রাসূলের অনুসরণ করতে গিয়ে তিনি পশমবিহীন জুতো পরেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের জীবনী পড়লে এরকম অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যায় যা দেখে তাবেয়ী এবং কোনো কোনো সাহাবী অবাক হন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু আযান দেয়া বন্ধ করে দেন। বিশেষ কয়েকটি অকেশনে তিনি ৩-৪ বার আযান দেন। তিনি মদীনা ছেড়ে চলে যান। কারণ মদীনায় বসবাস করলে, আযান দিতে গেলে তাঁর রাসূলের কথা এতো বেশি মনে পড়ে, তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। এমন ভালোবাসা সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর খুব কষ্ট হতো।
প্রশ্ন হলো, কবরের মধ্যে রাসূলের ব্যবহৃত লাঠি নিয়ে গেলে উপকার পাওয়া যাবে এই ব্যাপারে কুরআনের কোনো আয়াত বা 'সহীহ হাদীস' আছে? নেই।
রাসূলের ইন্তেকাল হলে বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু মদীনা ছেড়ে চলে যাবেন, আযান দেয়া বন্ধ করবেন এমনটা কি রাসূলুল্লাহ তাঁকে বলেন? কুরআন-হাদীসে এমন নির্দেশনা আছে? নেই।
রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে কবিতা লিখতে হবে, এমনটা কি রাসূল বলেছেন? বলেননি।
তবুও হাসসান বিন সাবিত, কা'ব বিন যুহাইর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা রাসূলের শানে কবিতা লিখেন। তারা স্ব-উদ্যোগী হয়ে লিখেন, রাসূল তাঁদেরকে নির্দেশ দেননি।
উপরের সবগুলো ঘটনার মধ্যে একটি মিল আছে। সেটা হলো- ভালোবাসা প্রকাশ। একেকজন সাহাবী রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য একেকটি মাধ্যম ব্যবহার করেন। ভালোবাসা প্রকাশের একটাই মাধ্যম হতে হবে এমন না। সবাই রাসূলের প্রতি দুরূদ পড়তেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা প্রকাশ শুধু দুরূদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি।
সাহাবীদের সৌভাগ্য যে, তারা রাসূলকে পেয়েছেন। আমরা সেই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।
আমাদের সময় আমরা যে যেভাবে পারি সেভাবে রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করবো। মালিক ইবনে আনাস তথা 'ইমাম মালিক' রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্য দেখেননি, 'আমি যে মদীনার মাটিতে বাহনে চড়বো না, এটা কি কুরআন-হাদীসে আছে?' তারপরও তিনি বাহনে চড়েননি। কারণ, এটা বিধান-দলীলের সাথে সম্পৃক্ত নয়, এটা আবেগের সাথে সম্পৃক্ত।
সাহাবী, তাবেয়ী এবং পরবর্তী প্রজন্ম রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনে শার'ঈ নির্দেশনায় এদিক-সেদিক করেননি। তারা দুই রাকআত সুন্নাত নামাজ তিন, চার রাকআত পড়েননি। শার'ঈ দিকটা যেমন একেবারে যথাযথভাবে অনুসরণের চেষ্টা করেছেন, তেমনি বিভিন্নভাবে ভালোবাসার আবেগ প্রকাশ করেছেন।
শার'ঈ দিক এদিক-সেদিক না করে ভালোবাসার আবেগ প্রকাশে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যুগ যুগ ধরে আশিকে রাসূলগণ এভাবেই রাসূলের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়েছেন। কেউ তার বই উৎসর্গ করেছেন, কেউ তার সন্তানের নাম রেখেছেন, কেউ তাঁর জন্য কবিতা লিখেছেন, কেউ কুরবানি করার সময় রাসূলের 'পক্ষে' (On behalf) কুরবানি করেছেন।
এই যে আমাদের সময় রাসুলের ভালোবাসা প্রকাশে মিছিল হচ্ছে, রাসূলের অপমানের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হচ্ছে এগুলো হলো রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের একেকটি মাধ্যম।
ভালোবাসা প্রদর্শনের কথা যখন আসবে, তখন কেউ এই যুক্তি দিলে হবে না 'এগুলো কি সাহাবী/সালাফগণ করেছেন?'
সাহাবীগণ রাসূলপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মিছিল করেননি মানে এই না যে, আমরাও করবো না। তারা তো ভালোবাসা প্রকাশে একেক মাধ্যম অবলম্বন করেছেন, তাদের কাছে তো রাসূল ছিলেন; আমাদের সুযোগ নেই। তবে, সাহাবীগণ আমাদেরকে দেখিয়ে যান, 'দেখো রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনে ঠিক এই এই কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে, এমনটা নয়। দেখো না আমরা কতোভাবে রাসূলের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করেছি'।
ঠিক এই জায়গায় সাহাবীগণ আমাদের আদর্শ। তাদের ভালোবাসা প্রকাশের বৈচিত্র্যময় আচরণ দেখে আমরা উদ্বুদ্ধ হই। আমরা আমাদের যার যার জায়গা থেকে সাধ্যমতো যেভাবে পারি তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করবো।
-----
আরিফুল ইসলাম
১০ জুন ২০২২

পঠিত : ৩৭৯ বার

মন্তব্য: ০