Alapon

রুকন শপথের তাৎপর্য



যে শপথের মাধ্যমে রুকনগণ জামায়াতের নিকট বাইয়াত (শপথবদ্ধ) হন। এর সার্বিক তাৎপর্য অনুধাবন করার উদ্দেশ্যে এর বিশ্লেষণ করার গুরুত্ব অপরিসীম।

একজন রুকন যেভাবে শপথ করেন,
//বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আমি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর গঠনতন্ত্রে বর্ণিত আকীদা উহার ব্যাখ্যাসহকারে ভালভাবে বুঝিয়া লওয়ার পর আল্লাহ রাব্বল আলামীনকে সাক্ষী রাখিয়া পূর্ণ দায়িত্ববোধের সহিত সাক্ষ্য দিতেছি যে,

১। এক ও লা-শারীক আল্লাহ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহার বান্দাহ ও রাসূল।
আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা-শারিকালাহু ওয়াশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।

২। আমি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উহার ব্যাখ্যাসহকারে ভালভাবে বুঝিয়া লওয়ার পর অঙ্গীকার করিতেছি যে, দুনিয়ায় সামগ্রিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতির কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রদর্শিত দ্বীন কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জন করাই আমার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্য হাসিলের প্রচেষ্টা চালাইবার জন্য আমি খালিসভাবে জামায়াতে ইসলামীতে শামিল হইতেছি।

৩। আমি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর গঠনতন্ত্র বুঝিয়া লওয়ার পর ওয়াদা করিতেছি যে,
আমি এই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জামায়াতের নিয়ম-শৃংখলা পূর্ণরূপে মানিয়া চলিব।
সর্বদাই শরীয়ত নির্ধারিত ফরয-ওয়াজিবসমূহ রীতিমত আদায় করিব এবং কবীরা গুনাহসমূহ হইতে বিরত থাকিব।
আল্লাহর নাফরমানীর পর্যায়ে পড়ে উপার্জনের এমন কোন উপায় গ্রহণ করিব না।
এমন কোন পার্টি বা প্রতিষ্ঠানের সহিত সম্পর্ক রাখিব না, যাহার মূলনীতি এবং উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য জামায়াতে ইসলামীর আকীদা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কর্মনীতির পরিপন্থী।
"ইন্নাস সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।"
আল্লাহ আমাকে এই ওয়াদা পালনের তওফীক দান করুন। আমীন।//

শপথ বাক্য শুরু করার পূর্বে ভূমিকায় বলতে হয়
“আমি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর গঠনতন্ত্রে বর্ণিত আকীদা উহার ব্যাখ্যা সহকারে ভালোভাবে বুঝিয়া লওয়ার পর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে সাক্ষী রাখিয়া পূর্ণ দায়িত্ববোধের সহিত সাক্ষ্য দিতেছি,

এ ভুমিকায় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে।
প্রথমত আকিদা তথা কালেমায়ে তাইয়েবার যে ব্যাখ্যা জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রে দেয়া হয়েছে সে ব্যাখ্যা ভালোভাবে বুঝে নিয়ে কালেমাকে কবুল করার কথা স্বীকার করা হয়েছে। আর কালেমাই হলো জামায়াতে ইসলামীর মৌলিক আকীদা।
দ্বিতীয়ত আল্লাহ তায়ালাকে সাক্ষী রেখে শপথ নেয়া হচ্ছে।
তৃতীয়ত পূর্ণ দায়িত্ববোধের সাথে কালেমায়ে শাহাদাতের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। আল্লাহকে সাক্ষী রেখে কোন ঘোষণা দিতে হলে পূর্ণ দায়িত্ববোধের সাথে দেওয়ার চেতনা থাকাই স্বাভাবিক।

শপথের ১ম বক্তব্য
أشهد أن لا اله الا الله وحده لاشريك له وأشهد أن محمدا عبده ورسوله
এ কালেমায়ে শাহাদাতের মধ্যে জামায়াতের গঠনতন্ত্রে কালেমায়ে তাইয়েবার যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তারই সারকথা রয়েছে। এভাবে কালেমাকে কবুল করার মর্ম অত্যন্ত গভীর। যিনি এ ঘোষণা দিচ্ছেন তিনি এ কথাই বুঝাতে চান যে মুসলিম সমাজে প্রচলিত ও না বুঝে উচ্চারিত মন্ত্রের মতো কালেমাকে তিনি গ্রহণ করছেন না। এ কালেমা দ্বারা যে বিস্তারিত আকীদা কুরআন ও সুন্নাহ হতে বুঝানো হয়েছে সে ব্যাখ্যাই তিনি মনে প্রাণে কবুল করেছেন।

বস্তুতঃ যিনি এ ব্যাখ্যা মেনে নেন তিনিই বিশুদ্ধ তাওহীদের আকীদা বুঝে নিতে সক্ষম হন। এ ব্যাখ্যা ছাড়া শিরকের খপ্পর থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। শিরক এমন সূক্ষ্ম ফেতনা যে বহু মুখলিস দ্বীনদার লোকও শিরকে খফী বা পরোক্ষ ও গোপন ধরনের শিরক থেকে বেঁচে থাকতে সক্ষম হন না। অথচ শিরক এমন এক মারাত্মক অপরাধ যা সমস্ত নেক আমলকে বরবাদ করে দেয়। শিরক থেকে বেঁচে থাকতে হলে জামায়াতের গঠনতন্ত্রে বর্ণিত কালেমার ব্যাখ্যা মাঝে মাঝে নতুন করে বুঝে নিয়ে ঈমানকে তাজা করতে থাকা উচিত।

তাওহীদের বিপরীতই হলো শিরক। তাই শিরক সম্বন্ধে সঠিক ধারণা না থাকলে খাঁটি তাওহীদ সম্পর্কেও বিশুদ্ধ ধারণা জন্মাতে পারে না। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে কালেমার দ্বিতীয়াংশের যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা বুঝে না নিলে রাসূল সা.এর প্রতি ঈমান আনার তাৎপর্যই স্পষ্ট হতে পারে না। ইসলামে নবীর যে মর্যাদা তা আর কোন মানুষকে কোনভাবেই যে দেয়া চলে না এবং সকল বিষয়েই একমাত্র রাসূলই যে দ্বীনের ব্যাপারে একমাত্র উসওয়ায়ে হাসানা সে আকীদা মযবুত করার জন্যই ঐ ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন।

এ থেকে বুঝা গেল যে শপথনামার প্রথম দফাটি আকীদার সাথে সম্পর্কিত। আর আকীদাই যেহেতু ঈমানের ভিত্তি সেহেতু আকীদা সঠিক না হলে আমলের কোন মূল্য থাকে না । জামায়াতে ইসলামীর নিকট আকীদার এত গুরুত্ব থাকার কারণেই কালেমার বিস্তারিত ব্যাখ্যার উপর এত জোর দেয়া হয়েছে।

শপথের ২য় বক্তব্য
রুকনিয়াতের শপথ গ্রহণকারী দ্বিতীয় দফায় ঘোষণা করেন যে, জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা, তা-ই তার জীবনের উদ্দেশ্য। তিনি দুনিয়ার কোনো স্বার্থ হাসিলের নিয়তে জামায়াতে শামিল হচ্ছেন না বরং দ্বীন কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জন করাকেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করছেন।

এ দফায় তিনি জামায়াতকে নিশ্চয়তা দান করছেন যে তিনি আখিরাতের কামিয়াবীর লক্ষ্যবিন্দুকে সামনে রেখেই এ পথে এসেছেন। জামায়াত থেকে কিছু নেবার জন্য তিনি আসছেন না বরং তার সবকিছু জামায়াতের মাধ্যমে আল্লাহর হাতে তুলে দেবার নিয়তেই তিনি রুকনিয়াতের বাইয়াত কবুল করেছেন।

শপথের এই অংশে পূর্ণ নিঃস্বার্থতার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শপথের এ দফাটির গুরুত্ব যারা ভুলে যান তারাই নানা অজুহাতে রুকনিয়াতের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেন। জামায়াতের মাধ্যমে কোন বিশেষ সুযোগ বা মর্যাদা না পেলে কোন দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হলে, কোন দায়িত্বশীলের কাছ থেকে আশানুরূপ ভালো ব্যবহার না পেলে, কোন বিষয়ে তার মতামত গৃহীত না হলে যদি কোন রুকন নিষ্ক্রিয় হয়ে যান বা মনক্ষুন্ন হয়ে কাজে ঢিলা হয়ে যান তাহলে এটাই প্রমাণ হয়ে যে তার শপথের দ্বিতীয় দফাটি তিনি ভুলে গেছেন। যদি আল্লাহর সন্তুষ্টিই একমাত্র উদ্দেশ্য হয় তাহলে কোন কারণেই রুকনিয়াতের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা চলে না।

শপথের ৩য় বক্তব্য
শপথের এ বক্তব্যটি হলো জামায়াতের গঠনতন্ত্র আন্তরিকতার সাথে মেনে চলার এবং জামায়াতের নিয়ম-শৃংখলার পূর্ণ আনুগত্যের ওয়াদা। গঠনতন্ত্রের ৭ নং ধারায় রুকন হবার যে শর্তাবলীর উল্লেখ রয়েছে তা পালন করার স্বীকৃতিই এ দফাটির উদ্দেশ্য। এ দফাটির ওয়াদা পূরণ করতে হলে গঠনতন্ত্রের ৯ নং ধারায় রুকনের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং ১০ নং ধারায় মহিলা রুকনদের বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্যের যে তালিকা দেয়া আছে সে দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। এ দফার ওয়াদা যথাযথরূপে পালন করতে হলে মাঝে মাঝে এ কয়েকটি ধারা মনের মধ্যে তাজা করে নেয়া প্রয়োজন।

শপথনামার আসল কথা শপথনামার শেষাংশে সূরা আল আনয়ামের ১৬২নং আয়াতটি তেলাওয়াত করতে হয় যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়লার নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করা হয়। আল্লাহ পাক স্বয়ং এভাবে আত্মসমর্পণ করার জন্য রাসূল (স.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন। সত্যিকার চেতনা ও অনুভূতি নিয়ে এ আয়াতটি তেলাওয়াত করা হলে নিজের পূর্ণ সত্তাকে মহান ও মেহেরবান মনিবের নিকট সোপর্দ করার এমন এক অনাবিল তৃপ্তি অনুভূত হয় যা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আল্লাহর খাঁটি বান্দাহর জন্য এর চেয়ে বড় তৃপ্তি আর কিছুই হতে পারে না।

তার সন্তোষের কামনা নিয়ে তার মর্জির নিকট নিজের সব চাওয়া-পাওয়ার বাসনা কুরবান করার চাইতে বড় পাওয়া আর কী-ই বা হতে পারে! আল্লাহর সাথে এ সম্পর্ক ব্যক্তিগত নিজস্ব অনুভূতির ব্যাপার। সূফীদের পরিভাষায় এ অনুভূতির নামই 'ফানাফিল্লাহ'। শপথনামাটির এ বিশ্লেষণ থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে যিনি রুকনিয়াতের শপথ নেন তিনি

প্রথমত আল্লাহ তায়ালাকে সাক্ষী রেখে পূর্ণ দায়িত্ববোধের সাথে কালেমায়ে শাহাদাতের মাধ্যমে তাওহীদ ও রিসালতের সঠিক ইসলামী আকীদা কবুল করার কথা ঘোষণা করেন।
দ্বিতীয়ত আল্লাহর দ্বীনকে কায়েমের সর্বাত্মক চেষ্টা করার মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই তিনি জামায়াতে ইসলামীর রুকনিয়াত কবুল করলেন।
তৃতীয়ত এ পথে সুশৃংখলভাবে চলার লক্ষ্যে জামায়াতের গঠনতন্ত্র মোতাবেক সংগঠনের পূর্ণ আনুগত্য করার ওয়াদাই তিনি করলেন।
চতুর্থত "ইন্নাস সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।" বলে তিনি নিজের জান-মালসহ সমগ্র সত্তাকে আল্লাহর মর্জির নিকট সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন।

আপনারা যারা এখনো জামায়াতের রুকন হননি আপনাদেরকে রুকন হওয়ার জন্য উদাত্ত আহবান করছি। আসুন আমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য শপথ নিই। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাই।

#গণসংযোগ_পক্ষ

পঠিত : ৩২০০ বার

মন্তব্য: ০