Alapon

সেক্যুলারিস্টদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা এদেশের বেশিরভাগ মানুষের সংস্কৃতিকে আন্ডারমাইন করে



বাংলাদেশের সেক্যুলারিস্টদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো তারা এদেশের বেশিরভাগ মানুষের সংস্কৃতিকে আন্ডারমাইন করে এমন এক সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চায়, যে সংস্কৃতি সর্বসাকুল্যে এদেশের ৫% মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে। তারা ধর্মহীন সংস্কৃতির কথা বললে না হয় মানা যেতো যে, তারা তাদের কথাবার্তায় সৎ। না, তারা বরং ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত এমন কিছুকে সংস্কৃতি মানতে নারাজ।

অথচ সংস্কৃতির সবচেয়ে ন্যারো এবং ব্রড সংজ্ঞাগুলো পড়েন, তাহলে দেখতে পাবেন যে সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান মানুষের ধর্ম, বিশ্বাস। মানুষ তার ধর্ম-বিশ্বাস থেকে যা করে সেটা সংস্কৃতির অংশ।

মুসলিমরা নামাজ পড়ে, ধর্মীয় বিধিনিষেধ মোতাবেক পোশাক পরে, তাদের খাবার, কথা বলার সময় শব্দচয়ন, দৈনিক পাঁচবার মসজিদ থেকে ভেসে আসা আযান এগুলো মুসলিম সংস্কৃতির অংশ। মুসলিমরা এগুলো করে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে। কিন্তু, আপনি স্রেফ সংস্কৃতির জায়গা থেকে দেখলে এগুলোকে মুসলিম সংস্কৃতি হিশেবে, এদেশের বেশিরভাগ মানুষের সংস্কৃতি হিশেবে স্বীকার করতে হবে। কিন্তু, এদেশের সেক্যুলাররা হয় সংস্কৃতির সংজ্ঞা জানে না, নতুবা তারা এমন এক সংস্কৃতি দেখতে চায়, যার সাথে মুসলিমদের সম্পর্ক নেই৷ ফলে, মুসলিম সংস্কৃতি সংক্রান্ত যা যা আছে, তারা সেগুলো অস্বীকার করে। তাদের মাপকাঠিতে যাত্রাগান, পালাগান, মঙ্গল শোভাযাত্রা, ছায়ানটের গান এগুলোই সংস্কৃতি। এর বাইরে যা আছে তা 'অপসংস্কৃতি'!

সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো যে কয়েকটি কারণে গঠিত হয়, তার অন্যতম হলো মানুষের বিশ্বাস। এটার জন্য দেখবেন ভারতের সংস্কৃতি, আরবের সংস্কৃতি, আমেরিকার সংস্কৃতি এক না। ভারতের একেকটি পরিবারের সংস্কৃতি এক না। কারণ, তাদের বিশ্বাসগত পার্থক্য।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে যারা সংস্কৃতি-সংস্কৃতি যিকির তুলে, তারা চাইতো ইসলামের বাইরে গিয়ে এমনকিছু গড়ে তুলতে। সরাসরি যদি বলতো ইসলামের বাইরে যাচ্ছে, তখন মানুষ সেটা মেনে নিতো না। ফলে, 'ধর্ম' শব্দ না বলে তারা শুধু 'সংস্কৃতি' বলতো। অথচ সংস্কৃতির মৌলিক উপাদানই তারা অস্বীকার করে।

মানুষ যে সংস্কৃতি পালন করে, সেটা তারা অস্বীকার করে। এজন্য তারা যে সংস্কৃতির বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলো, বাংলাদেশের মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ছবির এই প্রবন্ধে লেখক সেই হাহাকারের কথা ব্যক্ত করেছেন।

বাংলাদেশে যারা সংস্কৃতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার, তাদের আইডিওলজিকাল একটা মিল আছে। তাদের সবাই রবীন্দ্র ভক্ত। ফলে, যে জিনিসকে তারা সংস্কৃতি বলতে চায়, সেটার উপাদান খুঁজতে থাকে রবীন্দ্র সাহিত্যে। যার কারণে, তাদের সাংস্কৃতিক বহিঃপ্রকাশ পৌত্তলিক সংস্কৃতিতেই সীমাবদ্ধ। যেমন: মঙ্গল শোভাযাত্রা, মৃতের স্মরণে প্রদীপ জ্বালানো, স্মৃতি রক্ষার্থে ভাস্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি। অথচ এগুলো মুসলিমরা মনেপ্রাণে ঘৃণা করে।
মুসলিমরা রবীন্দ্রনাথ পড়তে পারে, তাকে একজন বড়ো মাপের সাহিত্যিক হিশেবে স্বীকৃতি দিতে পারে। যার যেমন গুণ, সেই গুণের স্বীকৃতি তার প্রাপ্য। কিন্তু, মুসলিমরা রবীন্দ্রনাথকে ঔন করতে পারেনি, পারবেও না। কেননা, মুসলিমদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আছে, স্বতন্ত্র বিশ্বাস আছে। মুসলিমের স্বতন্ত্র সংস্কৃতিকে আঘাত করতে পারে, এমন সবকিছু মুসলিমরা পরিত্যাগ করে।

রবীন্দ্র সাহিত্যে যে সমাজচিত্র ফুটে উঠে, যে ধরনের আচার ফুটে উঠে, সেটার সাথে একজন মুসলিম নিজেকে কানেক্ট করতে পারে না। কারণ, সে দেখে তার মা সকালবেলা পূজো দেয় না, মন্দিরে যায় না, তার ঘরে সেই খাবার রান্না হয় না যা রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসে রান্না হয়, তার বিয়ের সংস্কৃতির সাথে সাহিত্যের মিলই নেই। কবির কোনো একটি লাইন পড়ে মুগ্ধ হওয়া সহজ, কিন্তু কবির সৃষ্ট কাল্পনিক সমাজচিত্রকে 'আপন' ভাবা সহজ না। এজন্য দেখবেন একজন মুসলিম, যে কিনা ইসলামকে ঔন করে, সে রবীন্দ্র সাহিত্য পড়লেও রবীন্দ্র সংস্কৃতি গ্রহণ করে না। অন্যদিকে, যারা শুধুমাত্র সংস্কৃতির কথা বলে, তারা রবীন্দ্র সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্র সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে।

মুসলিম সমাজের পাপী ব্যক্তিটি পর্যন্ত সকাল শুরু করে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে। যেকোনো ক্যাসেটের দোকান, কাপড়ের দোকানে গেলে দেখতে পাবেন সকালবেলা তারা কুরআন তেলাওয়াত বাজায়। কিন্তু, রবীন্দ্র সংস্কৃতির একজন ভক্তের সকাল শুরু হয় রবীন্দ্র সংগীত শুনে। যেটা মুসলিম সমাজের কেউ করে না। হয়তো এসব বিষয় উপলব্ধি করে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বকারী কবি আল মাহমুদ রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশে 'নিস্ফলা' বলে উল্লেখ করেছেন। আল মাহমুদের কবিতা:

"শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা
আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি
নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না
আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিষ্ফলা, ঠাকুর!"

বাংলাদেশের মানুষ ধর্মহীন (পৌত্তলিক বলা যায়) সংস্কৃতিকে যে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেটা প্রমাণিত। 'সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা হেরে যাচ্ছি কেন' প্রবন্ধের মাধ্যমে আনিসুল হকেরা বিষয়টি স্বীকার করলেন। বাংলাদেশের মানুষজন যে তাদের আরোপিত, কৃত্রিম, শান্তিনিকেতনী সংস্কৃতিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেটার দলীল হয়ে থাকবে তার এই প্রবন্ধ।

-----
আরিফুল ইসলাম
১৬ জুন ২০২২

পঠিত : ৫১৩ বার

মন্তব্য: ০