Alapon

বাংলাদেশী বীর সাইফুল আযমের গল্পগাঁথা



বাংলায় বীরের অভাব। এরমধ্যে আমার দেখা অন্যতম বাঙালি বীর হলেন বৈমানিক সাইফুল আযম। গত ১৪ জুন ছিল এই মহান বীরের ২য় মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬৫ সালে যুদ্ধে তিনি ভারতীয় বিমানবাহিনীকে নাজেহাল করে প্রথমে আলোচনায় আসেন।

এরপর ১৯৬৭ সালে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জর্ডান এই বীরকে হায়ার করে পাকিস্তান থেকে। সে যুদ্ধে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজয় হয় আরব দেশগুলোর। সেই ভরাডুবির মধ্যেও ব্যক্তিগতভাবে জয়ী হন সাইফুল আযম। একাই ইসরাঈলী বিমানবাহিনীকে নাজেহাল করেন। এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসরাঈলি বিমান ভূপাতিত করার রেকর্ডও তার। এই যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তিনি লিভিং ঈগল উপাধি পান।

১৯৭১ সালে তিনি নিজ বাহিনী অর্থাৎ পাকিস্তান বাহিনীর প্রতি অনুগত ছিলেন। গাদ্দারি করেন নি।৭২ সালে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর নিয়মানুযায়ী অবসর নেন। তারপর বিএনপিতে যোগ দেন। পাবনা থেকে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন।

তিনি ১৯৪১ সালে তৎকালীন পাবনা জেলার খগড়বাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পর ১৯৫৬ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান যান। ১৯৬০ সালে তিনি পাকিস্তান জিডি পাইলট ব্রাঞ্চের একজন পাইলট হন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল ফখরুল আজম (মেয়াদ ২০০২-২০০৭) তাঁর ভাই।

১৯৬৭ সালের জুনের ৫ তারিখ। ছয় দিনব্যাপী আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেদিন। চারটি ইসরাইলি জঙ্গী বিমান ধেয়ে আসছে জর্ডানের মাফরাক বিমান ঘাঁটির দিকে। কিছুক্ষণ আগেই আকাশ থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে গোটা মিশরীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধ-সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। এবার জর্ডানের ছোট্ট বিমান বাহিনীর উপর আক্রমণ করার জন্য ধেয়ে আসছে ইসরাইলি বিমানগুলো।

ঠিক ঐ মুহূর্তে ইসরাইলি সুপারসনিক ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ জঙ্গী বিমানগুলো আরবীয় আকাশে খুব আতঙ্কের নাম। প্রচণ্ড গতি আর বিধ্বংসী ক্ষমতা নিয়ে সেগুলো উড়িয়ে দিতে পারে আকাশপথের যে কোনো বাধা অথবা ভূমিতে অবস্থানকারী যে কোনো লক্ষ্যবস্তুকে। তবু তাদের পথ রোধ করতে মাফরাক বিমান ঘাঁটি থেকে বুক চিতিয়ে আকাশে ডানা মেললো চারটি ‘হকার হান্টার’ জঙ্গী বিমান। শক্তির দিক থেকে ইসরাইলি বিমানের কাছে সেগুলো কিছুই নয়। মুহূর্তেই উড়ে যেতে পারে এক আঘাতে।

কিন্তু জর্ডানের অকুতোভয় মুসলিম বাহিনীর সদস্যরা শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললো। জর্ডানের একটি হকার হান্টারে পাইলটের সিটে বসে আছেন অকুতোভয় এক যুবক, এই পাল্টা প্রতিরোধের মূল অধিনায়ক। তিনি আর কেউ নন। আমাদের সাইফুল আযম। সেই হকার হান্টার থেকেই সে তিনি নির্ভুল নিশানায় ঘায়েল করলেন দুই ইসরাইলি সেনাকে। ঐ মুহূর্তে কল্পনাতীত এক কাণ্ডও ঘটালেন, অব্যর্থ আঘাতে ভূপাতিত করে ফেললেন একটি ইসরাইলি ‘সুপার মিস্টেরে’। আরেক আঘাতে প্রায় অকেজো করে দিলেন তাদের আরেকটি জঙ্গী বিমান, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সেটি ফিরে গেল ইসরাইলি সীমানায়। চারটি হকার হান্টারের প্রতিরোধের মুখে পড়ে ব্যর্থ হলো অত্যাধুনিক ইসরাইলি বিমানগুলো।

দু'দিন পরই ইরাকি বাহিনী কর্তৃক খবর আসে ইসরাঈল হামলা করতে যাচ্ছে ইরাকে। সাহায্য প্রয়োজন জর্ডান থেকে। সাইফুল আযমকে অধিনায়ক করে জর্ডান ৪ জন এয়ার ফাইটারকে পাঠায় ইরাককে সাহায্য করার জন্য।

জুন ৭, ১৯৬৭ সাল। ইরাকী দলের সামনে ছিল ইসরাইলের চারটি ‘ভেটোর বোম্বার’ ও দু’টি ‘মিরেজ থ্রিসি’ জঙ্গী বিমান। এগুলো আক্রমণ করতে এসেছিল ইরাকের ‘এইচ-থ্রি’ বিমানঘাঁটির উপরে। আকাশযুদ্ধে ইরাকি দল শুরু থেকেই শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলল। একটি ‘মিরেজ থ্রিসি’ বিমানে ছিলেন ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গিডিওন দ্রোর। দ্রোরের গুলিতে নিহত হন আজমের উইংম্যান। তার হামলায় ভূপাতিত হয় দুটি ইরাকি বিমান। পরক্ষণেই এর জবাব দেন আজম। তার অব্যর্থ টার্গেটে পরিণত হয় দ্রোরের ‘মিরেজ থ্রিসি’। সে আঘাতের পর বাঁচার যখন আর উপায় নেই তখন ক্যাপ্টেন দ্রোর তার বিমান থেকে ইজেক্ট করে ধরা দেন, আটক হন যুদ্ধবন্দী হিসেবে সাইফুল আযমের কাছে।

এদিকে চারটি ‘ভেটোর’ বোমারু বিমানের সামনেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় আজমের হকার হান্টার। ঈগলের সুতীক্ষ্ণ নজরের মতো আযমের নির্ভুল নিশানায় ধ্বংস হয় একটি ভেটোর বিমান। সেটিতে থাকা ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গোলান নিরাপদে ইজেক্ট করে ধরা দেন যুদ্ধবন্দী হিসেবে। জর্ডানের মতো এখানেও ব্যর্থ হয় ইসরাইলি বিমান দল। দুজন মূল্যবান যুদ্ধবন্দীর বিনিময়ে ইসরাইলের হাতে আটক জর্ডান ও ইরাকের সহস্রাধিক সৈন্যকে মুক্ত করা হয়।

সাইফুল আযম ভারতের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তাকে সাময়িক ভাবে সারাগোধাতে অবস্থিত ১৭ স্কোয়াড্রন এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আযম এ সময় এফ-৮৬ স্যাবর জেট বিমান এর পাইলট হিসেবে প্রধানত পদাতিক সহায়ক মিশন পরিচালনা করতেন। ১৯৬৫ সালের ১৯ এ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত চাবিন্দা ট্যাংক যুদ্ধে অংশ নেন তিনি এবং বিমান থেকে রকেট ও গোলা বর্ষন করে একাধিক ভারতিয় ট্যাংককে ধ্বংস ও অকার্যকর করেন। এসময় চারটি ভারতিয় ”Gnat” জঙ্গি বিমান তাদের উপর আক্রমন করে। সাধারন ভাবে বিমান থেকে ভুমিতে যুদ্ধের উপযোগি অস্ত্র সজ্জিত থাকায় এসময় পাকিস্তানি বিমানগুলির পালিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ফ্লাইট লেফটেনান্ট সাইফুল আযম রুখে দাড়ান এবং বিমান যুদ্ধ বা ডগ ফাইটে একটি ভারতিয় ”Gnat” জঙ্গি বিমান ভুপাতিত করেন। সে বিমান থেকে ফ্লাইট অফিসার বিজয় মায়াদেবকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করেন তিনি। আকাশপথের মুখোমুখি যুদ্ধে ‘Gnat’ বিমানকে পর্যুদস্ত করা সে সময় এক বিরল ঘটনা ছিল। এই কৃতিত্বের জন্য তাকে পাকিস্তানে ”সিতারা-ই-জুরাত” পদকে ভুষিত করা হয়। এটি পাকিস্তানের তৃতীয় সামরিক বীরত্বের খেতাব।


তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের কাছ থেকে ‘সিতারা-ই-জুরাত’ পদক গ্রহণ করেন সাইফুল আজম। সাইফুল আযম ছিলেন মূলত পাকিস্তানের এয়ার ফাইটার ছিলেন। ভারতের সাথে বীরত্ব নিয়ে যুদ্ধ করার কারণে তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেন। তখন জর্ডান পাকিস্তানের কাছে আযমসহ কিছু এয়ার ফাইটার চায় যারা ইসরাঈলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার সাইফুল আযমকে জর্ডানে পাঠায়। সাইফুল তার মর্যাদা রেখেছেন। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন।

সাইফুল আযম চারটি দেশের বিমান বাহিনীতে কাজ করেছেন
১- পাকিস্তান
২- জর্ডান
৩- ইরাক
৪- বাংলাদেশ।

তিনি দুটি দেশের বিরুদ্ধে লড়েছেন
১- ভারত
২- ইসরাঈল

সাইফুল আযম মোট চারটি ইসরাঈলী বিমান ভূপাতিত করেন। এটা একজন এয়ার ফাইটারের জন্য সর্বোচ্চ রেকর্ড। সাইফুল আযম ১৯৬৯ সালে আবার পাকিস্তানে ফেরত আসেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানে ছিলেন। সেসময় বাঙ্গালিদের গ্রাউন্ডেড করে রাখা হয়। যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানে ছুটি কাটান। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে অবসর নেন।

অবসর নেয়ার পর তিনি রাজনীতিতে আসেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দেন। ১৯৯১ সালে পাবনা-৩ আসন থেকে পঞ্চম জাতীয় সংসদে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

সম্মাননা
১- সিতারা-ই-জুরাত, পাকিস্তান
২- অর্ডার অব ইসতিকলাল, জর্ডান
৩- নুত আল সুজাত, ইরাক
৪- লিভিং ঈগল, আমেরিকা

যেসব এয়ার ফাইটার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাদের লিভিং ঈগল উপাধি দেয়া হয়। পৃথিবীতে মাত্র ২২ জন লিভিং ঈগলের একজন হলেন সাইফুল আযম।

তথ্যসূত্র
১- পাকিস্তান এয়ার ফোর্স
২- আল আরাবিয়্যা নিউজ
৩- ডিফেন্স টক
৪- মিলিটারি হিস্ট্রি নাও (MHN)

পঠিত : ২৭৫ বার

মন্তব্য: ০