Alapon

দুর্যোগ ও বিপর্যয়ে সাহায্য করতে গিয়ে পাপাচার করবেন না...



মানুষ এতোটা জাহিল হতে পারে, পাঁচ বছর আগে কল্পনাও করতে পারিনি। বন্যায় মানুষ মরছে, বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্বল সব ভেসে যাচ্ছে, পিতা-মাতা সন্তানহারা হচ্ছে, সন্তানেরা পিতা-মাতাকে হারাচ্ছে, ঠিক এমন সময়ে একদল জাহিল ঠিক করল— ‘আমরা বন্যার্তদের সাহায্য করতে চাই!’

‘কিভাবে?’

‘আমরা কনসার্টের আয়োজন করব। কনসার্ট দেখতে মানুষ টিকিট কিনবে। সেই অর্থ দিয়ে আমরা বন্যার্তদের সাহায্য করব।’

এরা ভুলে গেছে, ‘জলে ও স্থলের যাবতীয় বিপর্যয় মানুষের দু'হাতের অর্জন।’ মানুষ নিজের কৃতকর্মের মাধ্যমেই দুনিয়াতে বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রশ্ন হতে পারে, ‘বন্যা মানুষের কোন কৃতকর্মের মাধ্যমে হচ্ছে?’

‘বন্যা কেন, দুনিয়ার সকল বিপর্যয় মানুষের তৈরি। আমরা যেটাকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলছি, জলোচ্ছাস, ঘূর্নিঝড়, বন্যা, ঝড় বলছি— এসব কিছুর জন্য দায়ী মানুষের কাজ। মানুষ গাছ কেটে সাবাড় করছে, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও স্থাপনা নির্মান, বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ করছে। নদীর জলপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। বাধ নির্মান করছে, পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর চরম জুলুম চালাচ্ছে। ফলে বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে।

একইসাথে মানুষ গুনাহের কাজ করছে। এটাও এসব দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। মানুষ ব্যাপকভাবে গুনাহে লিপ্ত হচ্ছে। অশ্লীলতা, হানাহানি, খুন-ধর্ষণ, জুলুম-অত্যাচারে সমাজ ভরে গেছে। এমন সময়ে আল্লাহ মানুষকে শায়েস্তা করতে দুর্যোগ ও বিপর্যয় দিয়ে থাকেন। এটা মানুষের কৃতকর্মের জন্যই হচ্ছে কারণ, মানুষ এসব না করলে আল্লাহ বিপর্যয় দিতেন না। এভাবে পাপাচারে ডুবে থাকা জনপদে আল্লাহ মানুষের জীবনে বিপর্যয় দেন, যাতে সে আল্লাহর ক্ষমতা, শক্তি ও ক্রোধ উপলদ্ধি করতে পারে। তাকে ভয় করতে শিখে। তার নিকটবর্তী হতে পারে।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, মানুষের পাপাচার এসব দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলেও, সমাজের জাহিল, মূর্খ ও অজ্ঞ লোকেরা আরও জাহেলি কাজে লিপ্ত হচ্ছে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তকে সাহায্য করতে! কত বড় জাহিল হলে মানুষ এমন করতে পারে, আমি ভাবতেও পারছিনা।

কনসার্ট করবে, হাজারও মানুষ গুনাহ করবে, নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা, বাদ্য-বাজনা হবে। এসবের বিনিময়ে যে অর্থ উপার্জন হবে, তা দিয়ে দুর্যোগগ্রস্ত মানুষের সেবা করবে। বিস্ময়করভাবে জাহিল হয়ে গেছে এরা। বুঝতেই পারছে না, অনুভবই করতে পারছেনা, জনপদের মানুষের পাপাচার দুর্যোগের অন্যতম কারণ! কত দুর্ভাগা ও মূর্খ হলে মানুষ এমন কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্যোগগ্রস্তদের সাহায্য করতে চায়!

যেসব সেলিব্রেটি গায়ক, নায়ক, নৃত্যশিল্পী এসব কনসার্ট ও সিনেমা দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করছে, তারা চাইলে এসব না করেও ফান্ড রেইজিং করতে পারে। অবশ্যই সমাজের একটা শ্রেণির কাছে তারা প্রিয়। ফলে, দুর্যোগগ্রস্ত মানুষের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত করার প্রয়োজন নেই। পাপাচারে লিপ্ত না করিয়েও এই উদ্দেশ্য অর্জন হতে পারে। কিন্তু না, তারা কনসার্ট আয়োজন করে জনপদের বৃহৎ অংশ তরুণদের পাপাচারে লিপ্ত করবে!

এই কনসার্টগুলো হচ্ছে মূলতঃ ঢাকা কেন্দ্রিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী মাসগুলোতে ঢাকাতেও বন্যা হতে পারে। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই, তিনি যেন ঢাকাবাসীকে রক্ষা করেন। যে সময়ে প্রতিটা জনপদের মানুষের উচিত, আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে কান্নাকাটি করা, তাওবা করা, ঠিক সে সময়ে এসে গান-বাজনা হবে! আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন— ঢাকাতে কোনো দুর্যোগ ও বিপর্যয় হলে তার একটা কারণ হবে এইসব কনসার্ট ও পাপাচারের আয়োজন।

আমি জানি, বস্তুবাদী ও আধ্যাত্মিকতা বিবর্জিত মানুষগুলোর কাছে আমার এসব আলাপ হাস্যকর মনে হবে, কিন্তু আল্লাহর শপথ, মানব ইতিহাসের বহু জনপদ দুর্যোগ ও বিপর্যয়ে পড়ার অন্যতম কারণ ছিল, প্রধান কারণ ছিল— পাপাচার। আল্লাহর অবাধ্যতা। তখন কিন্তু মানুষ গাছ কাটতো না, নদীপ্রবাহে বাধা দিতোনা, পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর সেভাবে অত্যাচারও করত না। কিন্তু তারপরও বিপর্যয় ও দুর্যোগ এসে জনপদগুলো ধ্বংস হয়েছে। মানুষ পরিবেশ ধ্বংস না করা সত্ত্বেও, বনাঞ্চলের হার বেশি থাকা সত্ত্বেও কেন এমন হতো? পাপাচার! জনপদের মানুষগুলোর পাপাচার এতোই বেড়ে গিয়েছিল, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়াতেই শিক্ষা দিতে চেয়েছেন।

অনেকে প্রশ্ন করবেন, সমাজের প্রত্যেকটা মানুষ তো পাপাচার করেনা, কিন্তু দুর্যোগ ও বিপর্যয় তো সবার উপরই আসে। বর্তমানের বন্যায় তো নামাজি ও দ্বীনদার ব্যক্তিরাও ভুক্তভোগী। তাদের উপর বিপর্যয় আসল কেন? উত্তর হল, তারা সমাজের মানুষকে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ পর্যাপ্ত পরিমাণে করতে পারেনি। সমাজ পরিবর্তনে, পাপাচার নির্মূলে তাদের যে কর্মসূচি গ্রহণের দরকার ছিল, তারা সেটা করেনি। ফলে আল্লাহ তাদেরকেও নিজের আজাবের মধ্যে শামিল করেছেন।

এরপরও প্রশ্ন হতে পারে, যারা সৎ কাজের আদেশ দিয়েছেন, অসৎ কাজে নিষেধ করেছেন— তারাও তো দুর্যোগ ও বিপর্যয়ে আছেন। এটার হিকমাহ কি? এটার হিকমাহ হল, তারা দুনিয়াতে আল্লাহর মাধ্যমে পরীক্ষিত হচ্ছেন। তারা বিপর্যয়েও আল্লাহকে স্মরণ রাখেন কিনা। এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সমাজের সৎপথে থাকা মানুষগুলো দুনিয়ার বিপর্যয় সহ্য করছে, কষ্ট করছে, এসবের বিনিময়ে তাদের জীবনের জানা-অজানা গুনাহগুলো মাফ হচ্ছে। আর দুনিয়ায় বিপর্যয়ে আল্লাহকে ভুলে না যাওয়ায়, সবর করায় আখিরাতেও তারা পুরস্কৃত হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে— মুমিন ও মুত্তাকি মানুষ দুনিয়াবি বিপর্যয়েও লাভবান থাকে, আবার বিপর্যয় না থাকলেও লাভবান থাকে। মুমিন ও মুত্তাকিরা এভাবে সব সময় বিজয়ী হয়। সুতরাং, এমন প্রশ্ন করার সুযোগ নেই, আল্লাহ তাদেরকে কেন শাস্তি দিচ্ছেন, যারা তার ইবাদত করে? আসলে আল্লাহ তাদেরকে বিপর্যয়ের মাধ্যমেও লাভবান করছেন।

যাহোক, আমার মূল বার্তা হল, দুর্যোগে সাহায্য করতে কোনো কনসার্ট ও পাপাচারের আয়োজন করবেন না। যার যার অবস্থান থেকে সাহায্য করতে থাকুন। যেয়াব সেলিব্রেটি গায়ক, গায়িকা, নায়ক, নায়িকা সারাজীবন গুনাহ করেছেন এবং এই দুর্যোগে ভালো কিছু করতে আগ্রহী তারাও ভেবে দেখুন, ভালো কিছু করতে গিয়ে আপনারা মানুষকে পাপাচারেই ঠেলে দিচ্ছেন, অথচ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হল পাপাচার! আপনারা চাইলেই তো নিজের পরিচিতি ব্যবহার করে বিশাল অঙ্কের সাহায্যের ব্যবস্থা করতে পারেন। তাহলে কেন মানুষকে পাপাচারে ঠেলে দেয়া? আমি আল্লাহর কাছে আপনাদের জন্য, নিজের জন্য ক্ষমা রহমের ভিখারী। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন। তার রহমের চাদরে আবৃত করুন। আমিন।

— মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ

পঠিত : ৩২০ বার

মন্তব্য: ০