Alapon

গণতন্ত্র : ইসলামী দৃষ্টিকোণ



বুকরিভিউ
-হোসাইন শাকিল

গণতন্ত্র নিয়ে অনেক কথা, অনেক মত। আমাদের জানার বিষয় হচ্ছে গণতন্ত্র বিষয়ে ইসলামের কি অবস্থান? কারো কথা হচ্ছে গণতন্ত্র আব্রাহাম লিংকনের ধর্ম, এটা পশ্চিমাদের টোপ, ওদের কুফরপূর্ণ ফাঁদ, আমরা ওদের জিনিস মানতে পারি না, কেননা ‘যে যেই জাতিকে অনুসরণ করে সে সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে’। আবার কারো কথা হচ্ছে গণতন্ত্র মানতে সমস্যা নেই, গণতন্ত্র মানলেই আমরা ওদের কুফর মেনে নিচ্ছি তা নয়, আমরা ভালোটা নিচ্ছি শুধু।
.
যেকোনো আলোচনায় ঢোকার পূর্বে কিছু মূলনীতি জানিয়ে রাখাটা আবশ্যক। আল্লাহর দীনের কিছু বিষয় ছাওয়াবিত বা অকাট্য ও অপরিবর্তনীয়, এগুলোর সময়ের সাথে সাথে কোনোপ্রকার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্ভব নয়; কিন্তু দীনের অন্যান্য অনেক শাখাগত বিষয়ই এমন যে, এগুলোর মূলভিত্তি পরিবর্তনীয়তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সময়, অবস্থা, পরিবেশ-পরিস্থিতি পরিবর্তনের সাথে সাথে (সেই পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই সময়ের বিবর্তনের ফলে ঘটুক কিংবা কখনো কখনো আকস্মিক ও মানবীয় জোরজবরদস্তি কিংবা অন্যভাবে ঘটুক) তাতে পরিবর্তন আসতে পারে। রাজনীতি বা সিয়াসতের বিষয়টা এই দুইয়ের সমন্বয়। রাষ্ট্রনীতি বা সিয়াসতের মাঝে আল্লাহর হাকিমিয়্যাত, তাঁর ও তাঁর রাসূলের পূর্ণ কর্তৃত্ব, পরামর্শভিত্তিক সরকারযন্ত্র ইত্যাদি অপরিবর্তনীয়; সময় যতই পরিবর্তন হোক ইসলামী রাষ্ট্রে এগুলোর কোনোপ্রকার পরিবর্তন পরিবর্ধন সম্ভব নয়। কিন্তু যেক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দলীল অর্থাৎ, আল্লাহ ও রাসূলের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই, কিংবা নির্দিষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিধানের প্রয়োগ কেমন হবে, পরামর্শের ‘ধরণ’ কেমন হবে ইত্যাদি নানা বিষয় পরিবর্তনীয়; সঠিক মূলনীতি ও মানদণ্ডের অধীনে এগুলোতে পরিবর্তন আসতে পারে।
.
গণতন্ত্র মানে জনগণের শাসনতন্ত্রকে দু’দিক থেকে বিবেচনা করা সম্ভব। দার্শনিক দিক থেকে ব্যবহারিক ও পদ্ধতিগত দিক থেকে। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্র মানে হচ্ছে এমন মানুষদের বা শাসনভার অর্পণ করা যারা স্বয়ংসম্পূর্ণ, যারা ‘প্রায় ঈশ্বর’, যারা কোনোপ্রকার জবাবদিহিতার অন্তর্ভুক্ত নয়, কোনো ধর্ম, স্রষ্টা, কোনো রাজা কারো কাছেই মানুষ জবাবদিহিতা করবে না। এই মানুষই হচ্ছে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যার চূড়ান্ত মাপকাঠি, তার ইচ্ছা-আকাঙ্খানুযায়ীই সকল কিছু আবর্তিত হবে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের মতের পরিবর্তন হবে, সাথে সাথে রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতাও পরিবর্তিত হবে। মানুষের এ ধরণের ধারণার মূলভিত্তি হিউম্যানিজম ও এম্পেরিসিজম এবং এ দুই ভিত্তি থেকে গড়ে ওঠা জ্ঞানের নানা শাখা মানুষসম্পর্কিত এ ধারণাকেই মজবুত করে গিয়েছে একের পর এক। এ ধরণের মানুষের মূল পরিচয় তার ‘মানবীয়’ গুণ, ধর্ম-জাত-পাত কোনো কিছুই নয়। এ ধরণের মানুষ কোনো সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে জন্মায় না। ধর্ম থেকে শুরু করে নানানপ্রকার ধারণার সবকিছুই মানুষের ওপর আপতিত। নিত্য, সত্য ও পরম বলতে কিছুই নেই। সবই পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনশীলতাই হচ্ছে জগতের সত্য, অন্য সকল কিছুই এর সাথে সম্পর্কিত। আর তাই ধর্মও পরম সত্য নয়। মানুষ ইচ্ছা করলে ধর্ম ব্যক্তিগত জীবনে মানতেও পারে, নাও মানতে পারে। রাষ্ট্রের কাজ এই ‘মানুষ’-কে ও তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও স্বাধীনতা রক্ষা করা, তারা প্রত্যেকেই যাতে নিজ নিজ ইচ্ছা ও খাহেশাত মোতাবেক কাজ করতে পারে সেটা সুনিশ্চিত করা। কোনো ধর্ম, কোনো মতবাদ, কোনো গীর্জা, কোনো পোপ, কোনো ধনী ব্যক্তি, কোনো ভূস্বামী, কোনো স্বৈরাচারী কেউই তাকে নির্দিষ্ট কোনো কিছুর প্রতি আবদ্ধ করতে পারবে না। প্রত্যেকে স্বাধীন থাকবে এবং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করবে। রাষ্ট্রে মানুষের সমান অধিকার থাকবে। রাষ্ট্রে কোনো ধর্ম থাকবে না, থাকবে না কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর দৌরাত্ম। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব থাকবে এই প্রকার স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষেরই। মানুষ যাকে ইচ্ছা ক্ষমতায় বসাবে, যাকে ইচ্ছা নামাবে। এই হচ্ছে দার্শনিক গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের সাথে দার্শনিকভাবে মানবতাবাদ, উদারনৈতিকতাবাদ, বর্তমানবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা জড়িত। গণতন্ত্র এ কারণে এসব মতবাদের পরে এসেছে, সামগ্রিক একটা ছাতা হিসেবে।
.
মানুষ সম্পর্কিত এ ধারণা এবং গণতন্ত্রের সাথে দার্শনিকভাবে যুক্ত সকল তত্ত্ব আদতেই ইসলামের সাথে কঠিনভাবে সাংঘর্ষিক। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনেকে দার্শনিক তত্ত্ব বাদে গণতন্ত্র মানার কথা বলেন। তারা ওত ওত দার্শনিক বাদ-বিবাদ ব্যতিরেকে স্বৈরাচারমুক্ত ও জোরজবরদস্তিমূলক রাষ্ট্রের বিপক্ষে মানুষের অধিকার রক্ষার ও জনগণের মতামতকেন্দ্রিক নীতির ক্ষেত্রে গণতন্ত্র মানার কথা বলেন।
.
এখানেই হয়েছে সমস্যাটা। অনেকে গণতন্ত্রকে ওইসব দার্শনিক মত ব্যতিরেকে মানতেই পারে না। এই কারণে তারা যখনই শোনেন কোনো ইসলামপন্থী গণতন্ত্রের কথা বলছে তারা বিষয়টাকে ভালোভাবে দেখতে পারেন না। বিভিন্ন তাত্ত্বিক যুক্তির পাশাপাশি তারা বাস্তবিকভাবে বিভিন্ন ইসলামী গণতান্ত্রিক দলগুলোর ক্রমাগত ব্যর্থতার ফিরিস্তি দিয়েও দলীল পেশ করে থাকেন।
.
আসলে আমরা মানুষ প্রসঙ্গ, পরিবেশ ও পরিস্থিতির মাঝেই বসবাস করি। আগেকার লোকেরাও এর মাঝেই বসবাস করতেন। ফরাসী বিপ্লবের আগে লিবারেলিজমের দার্শনিক প্রবক্তারা এমন সময় দেখেছেন যেখানে মানুষের অধিকার পুরোপুরি ভূলন্ঠিত হত, মানুষ মানুষ হিসেবে ন্যায্য অধিকার মোটেও পেত না, মানুষকে মনে হত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতের পুতুল, তাদের ক্রীতদাস। এমতাবস্থায় চিন্তকরা অনেকটা বাধ্য হয়েছেন এমন দর্শন পেশ করতে যা মানুষকে চিন্তার দিক থেকেই মুক্ত ও স্বাধীনতার পরশ দেবে। মানুষ যাতে চিন্তার দিক থেকেই একেবারে মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু তারা এর বিপরীত দিকটি ভাবেননি। কারণ তারা পরিস্থিতির চাপে পড়েছিলেন। ফলে সমস্যাটিকে বর্তমান উদ্ভূত নানা পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক চাপ থেকে মুক্ত হয়ে সত্য অনুসন্ধান দ্বারা প্রবৃত্ত হয়ে ভাবেননি। তাদের মাথায় ছিলো পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া যায়। তাদের সেইসময়ের বিভ্রান্তি পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে আরও বিস্তৃত হয়েছে এবং সত্য থেকে তার দূরত্বও ততই বৃদ্ধি পেয়েছে।
.
যেসকল ইসলামপন্থী দর্শনবিমুক্ত গণতন্ত্রের কথা বলেন তারাও এমন অবস্থায় এসব কথা বলেছেন যখন তারা চারিদিকে দেখেছেন নব সভ্যতার উত্থান এবং আরেকদিকে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতা। তারা দেখেছেন কীভাবে ‘ধর্মীয় রাষ্ট্র’ এর বিপক্ষে অভিযোগের বাণ ছোঁড়া হচ্ছিলো। তাই তারাও অনেকটা বাধ্য হয়েছেন গণতন্ত্রের ব্যবহারিক দিকগুলোর সাথে ইসলামের সাদৃশ্য প্রদর্শনের।
.
এ কারণে সত্যানুসন্ধানীর চিন্তাকে বিশুদ্ধ করার অন্যতম উপায় হচ্ছে যেকোনো সমস্যাকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেবার নিয়্যাতে নয় বরং এর প্রকৃত সমস্যা, এর ধরণের দিক থেকে সমাধানের ব্যাপারে চিন্তা করা। পরিস্থিতিও অবশ্যই দেখতে হবে, তবে সেটা যাতে মূল কনসার্ন না হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে সমাধান বিগড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
.
ইসলামপন্থীদের মাঝে গণতন্ত্র বিষয়ে নানারুপ প্রান্তিকতার মাঝে প্রিয় আলিম শায়খ ড. আহমদ আলীর রচিত এই বইটি উপকার দেবে। উনি এখানে নির্মোহভাবে গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করেছেন। সাদৃশ্য দেখিয়েছেন, বৈসাদৃশ্যও দেখিয়েছেন। দার্শনিকভাবে গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই, তবে ব্যবহারিক দিক থেকে গণতন্ত্রের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের মূলনীতির বেশ সাদৃশ্য আছে। যারা গণতন্ত্রের কথা বলেন তারা আসলে ব্যবহারিক দিক থেকে ইসলামের সাদৃশ্যের কথাই তুলে ধরেন, স্বৈরাচারী শাসন এবং ভিন্ন ধর্ম ও গোষ্ঠীর লোকদের ওপর নির্বিচার যুলুমভিত্তিক সরকারযন্ত্রের বিপরীতে। তারা কখনোই আল্লাহর আইন ও কর্তৃত্ব বাতিলকরণ, মানুষকে আল্লাহর স্থানে বসানো, মানুষের খেয়ালখুশি মোতাবেক আল্লাহর আইন পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে গণতন্ত্র অবলম্বনের কথা বলেন না। তারা এমন জনগণের কথা বলেন যারা আল্লাহকে নিজেদের রব বলে মেনে নিয়েছে, যারা ইসলামকে দীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে, সেই জনগণের মাঝে জনগণের রায় অনুযায়ী সরকার হবে, তাদের অসন্তোষে কেউ জোর করে ক্ষমতা দখল করে নেবে না, সেই রাষ্ট্রে ন্যায় থাকবে, ইনসাফ থাকবে, জনগণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, বিচারবিভাগ স্বাধীন থাকবে, ধর্ম ও গোষ্ঠীর উর্ধ্বে সেখানে ন্যায়বিচার প্রাধান্য পাবে, সেখানে রাষ্ট্রনায়ক বা খলীফা জনগণের প্রতিনিধি হবে তাদের ওপর কাঠাল ভেঙ্গে খাওয়া স্বৈরাচারী নয়, সেখানে খলীফা নিজের ইচ্ছামত নয় বরং যোগ্যদের সাথে পরামর্শ মোতাবেক কার্য সম্পাদন করবেন। এমন হলে গণতন্ত্র স্বয়ং মন্দ কিছু নয়। এর বাহিরে হলে সেটা মন্দ। আর ইসলামপন্থীরা প্রথমোক্ত গণতন্ত্রের কথাই বলেন, দ্বিতীয়োক্ত গণতন্ত্রের নয়। মাওলানা মওদূদী, শায়খ আল্লামা ড. ইউসুফ কারযাবীরা এসব কথা অত্যন্ত স্পষ্ট করে বারংবার বলেছেন।
.
এ কারণে কুফরী দর্শনমুক্ত হয়ে গণতন্ত্রকে রাজনৈতিক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করলে সে মহাপাপী হচ্ছে না, সে ইসলামের সাথে আরেক জীবনদর্শনে বিশ্বাস স্থাপন করছে না এবং গণতন্ত্রকে সর্বক্ষেত্রে ওইসকল দর্শনযুক্ত ভেবে পুরোপুরি বর্জনের শ্লোগান দেবারও দরকার পড়ছে না। বইটি পড়লে আশা করি এসব বিষয় পরিষ্কার হয়ে যাবে।
.
ইসলামী পুনর্জাগরণের আর বেশি দেরী নেই ইনশাআল্লাহ। পুনর্জাগরণ অবশ্য মোটেও সহজ কাজ নয়, অত্যন্ত কঠিন, বিশেষত এ যুগে। পুনর্জাগরণের এ সময়ে প্রান্তিকতামুক্ত হয়ে আচরণগত ভারসাম্যের জন্য প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান এবং জ্ঞানগত পরিশুদ্ধি ও পরিমিতিবোধ। উম্মাহ জ্ঞানগত পরিশুদ্ধি, পরিমিতিবোধ ও মধ্যপন্থার সাথে এই পথে যত আগুয়ান হবে আশা করা যায় সে ততই অগ্রসর হতে থাকবে। আল্লাহই তাওফীকদাতা।

পঠিত : ৪৭৯ বার

মন্তব্য: ০