Alapon

"আলিমরা কি সবকিছুকেই হারাম হারাম ফতোয়া দেয়?"



এখানে আমি একটা গল্প দিয়ে বিষয়টা শুরু করতে চাই। সেটা হচ্ছে —একটা টীমের বলাররা বা একজন বলার নিয়মিত নো-বল করে। ওয়াইড বল করে। এখন আম্পায়ারও প্রতিবারই নো-বল বলে তার ডিসিশন জানায়। তখন উক্ত প্লেয়ার আম্পায়ারের ওপর চেতে গিয়ে বা রাগ করে বলে যে— শুধু নো-বল নো-বল ডিসিশন দিয়ে (পড়ুন, শুধু হারাম হারাম ফতোয়া দিয়ে) দায়িত্ব শেষ করেন ক্যান? বিকল্প দেন না ক্যান? বিকল্প দেন। শুধু হারাম হারাম বলা ছাড়া (নো-বল সিদ্ধান্ত দেওয়া ছাড়া) আর কিছুই তো করেন না আপনারা বা আপনি।

উক্ত ভদ্র(!) প্লেয়ার এটা বুঝেতে চেষ্টা করেনা যে, আম্পায়ারের দায়িত্ব তাকে বা তার টীমকে বিকল্প দেওয়া নয়। আম্পায়ারের কাজ হচ্ছে যে খেলতে নেমেছে মাঠে, এরপর বল হাতে বল করতেছে, তা কী আইসিসির নিয়মানুযায়ী হচ্ছে নাকি হচ্ছে না— তা খেয়াল রাখা। তার বল নিয়ম অনুযায়ী হলে ভালো। না হলে আম্পায়ার নো-বলই দেবে। এটাই আম্পায়ারের মূল এবং নৈতিক দায়িত্ব! বরঞ্চ আম্প্যায়ার যদি মূল দায়িত্ব পালন না করে, নো-বল করার পরেও ডিসিশন না দেয়, তাহলেই বরং আম্পায়ারের সমালোচনা করা উচিৎ ছিলো। কিন্তু যে নিয়মিত নো-বল করতেছে, যে নিয়মিত নিয়ম লঙ্গন করতেছে, এটা ঠিক না করে সে দোষারোপের দলা নিক্ষেপ করতেছে আম্পায়ারের ওপর। চেততেছে দায়িত্বরত বিশেষজ্ঞগণের ওপর। অথচ তার বা তার টীমের উচিৎ ছিলো বল ঠিকমতো করা। ভুল শোধরানো বা শোধরানোর চেষ্টা করা।

হুবহু প্রায় একই কাহিনী দেখা যায় উম্মহর মাথার তাজ আলিমদের ব্যাপারে। কিছু কিছু মানুষ উম্মাহর মাথার তাজ আলিমদের বিরুদ্ধে ঢালাও একটা অভিযোগ করে, বিভিন্ন সময় তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ চর্চা করে বলে যে— "মোল্লারা সব কিছুতেই শুধু হারাম হারাম বলে বেড়ায়। বিকল্প দেয় না, বা এইরকম আরো নানবিধ কথাবার্তা।"

এখন উক্ত শ্রদ্ধেয় ভাই-বোনেদের নিকট আমার প্রশ্ন—
আলিমগণ হারাম ঘোষণা করবে না তো আপনি-আমি করবো? উম্মাহর মাথার তাজ আলিমগণই তো হারাম হলে হারাম ঘোষণা করবেন আর হালাল হলে হালাল বলবেন। আলিমরা হারাম ঘোষণা না করলে কে করবে?

হারামের বিকল্প দিতে পারেনা আলিমরা— যুক্তির খাতিরে মানলাম, কিন্তু হারামের বিকল্প দিতে না পারলে কি হারামকে হারাম বলবে না আলিমরা? আর সবকিছুর বিকল্প কি আসলেই হয়? আসলেই কি সবকিছুর বিকল্প আছে? হারামের বিকল্প স্রেফ হালালটাই। হারামের বিকল্প তো হারাম হতে পারে না।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরোধিতা করতে হলে কি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনেই ডুবে যেতে হবে? আলিমরা উম্মাহর শ্রেষ্ট সন্তান। তাঁরা উম্মাহর পথপ্রদর্শক। তাঁরা আমাদের আমজনতার ভুল হলে ভুলটা ধরিয়ে দিবেন। এটাই তো হওয়া উচিৎ। এখন ভুল ধরিয়ে দিলে কাউকে হিংসুক-বিদ্বেষী না ভেবে কি আমরা শুভাকাঙ্ক্ষী ভাবতে পারি না? ভুল ধরিয়ে দেওয়া আর মিথ্যাচার করা, চরিত্র হনন করা, বিদ্বেষ চর্চা করা কি এক? ভুলকে ভুল না বললে শরয়ী সমাধান হয় না বুঝলাম, কিন্তু ভুলকে ভুল না বলে কি ভুলকে ফুল বললে শরয়ী সমাধান হয়?

আমরা সকলেই ভুল করি। আমরা সকলেই অপূর্ণাঙ্গ। কিন্তু আমরা নিজের ভুলের জন্য, আমাদের নিজের অপূর্ণাঙ্গতার জন্যে কি দ্বীনকে বিকৃতি করবো?

আমরা আদম সন্তান। আমাদের ভুল হয়। পাপ হয়। অনেক সময় আমরা দ্বীন পালন করতে পারি না। সম্ভব হয় না। আমরা দ্বীন পালন করতে না পারি, কিন্তু দ্বীনকে বিকৃত করবো না। দ্বীন না পালনের অক্ষমতা-দুর্বলতা আল্লাহ ক্ষমা করতে পারেন চাইলে, কিন্তু বিকৃতির কাজকে ক্ষমা নয়। বিকৃতি করলে, আল্লাহর বিধান অস্বীকার করলে, হারামকে হালাল বলে চালিয়ে দিলে কখনো কখনো ঈমানও ভঙ্গ হতে পারে।

একজন মুসলিমের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ তাঁর ঈমান। আলিমরা আমাদের এই সম্পদেরই রক্ষণাবেক্ষণ করার কাজ করেন। এই কাজ করতে গেলে তাদের যে ভুল হয় না, বিষয়টা এমন নয়। তাদেরও কখনো কখনো ভুল হয়। কিন্তু তাঁদের মোটাদাগে ভালো কাজের পরিমাণই বেশি। ভুলের চেয়ে তাদের ফুলের পরিমাণই বেশি।

সর্বশেষ একটা বিষয় বলতে চাই, সেটা হচ্ছে বিকল্প দেয় না কেন আলিমরা—এ কথা যারা বলেন, তাঁরা আসলে এটা ভাবে না যে, আলিমদের হাতে এখন কোন ক্ষমতাটা আছে? আলিমরা বৈশ্বিকভাবেই বৈরিতার শিকার। আলিমরা বিকল্প দিতে পারে না, কিন্তু অন্তত আপনাকে এখনো কোনটা হালাল-কোনটা হারাম; এটা তো জানাতে পারতেছে। এরজন্যেও তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ।

আপনি যদি ইতিহাসের দিকে তাকান, দেখবেন — আজকের ইউরোপীয় সভ্যতাসহ অন্যান্য সবকিছুর ওপর যখন ইসলাম বিজয়ী ছিলো, তখন কিন্তু আলিমদের একটা আলাদা বড়ো মাপের মর্যদা ছিলো। সর্বশেষ অটোম্যান বা উপমহাদেশীয় মোগল আমলেও কিন্তু আলিমদের আলাদা কদর করা হতো। তাঁরা বিচারক ছিলো। সমাজের প্রভাবক শক্তি, নিয়ন্ত্রণক ব্যক্তি ছিলো। শাসকের নানান কাজে তাঁরা প্রভাব ফলাতে পারতো। কিন্তু এখন আজ শত বছেরর ওপর থেকে ইসলাম পরাজিত। ইসলামের ধারক-বাহক আলিমগণ সম্মানিত তো নয়-ই, সামাজিকভাবে কোথাও কোথাও অনেকটা নিগৃহিত। আবার নিগৃহীত না হলেও অবমূল্যায়িত। রাষ্ট্রীয়ভাবেও তাঁরা এই অঞ্চল-সহ সারা বিশ্বে চরম অবহেলিত। তবুও আলিমগণ উম্মাহর মুক্তির জন্যে মানবতার শান্তির জন্যে দিকে দিকে সংগ্রামী কেতনকে উড্ডীন করেছেন বহুবার। ঔপনিবেশিক বর্বর বৃটিশদের নাগপাশ থেকে মানুষদের স্বাধীনতার জন্যে আলিমগণ নিজেদের তপ্ত লহু বারংবার ঢেলে দিয়েছেন। ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলেছেন। জেলে গিয়েছেন। নির্বাসনে গিয়েছেন।

যেখানে আমাদের সাধারণ জনতা এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের ধারক-বাহকদের থেকে তাদের দর্শন মেনে তাদের সেবা দিয়ে রাজার হালে চলাফেরা করছে, বা করে যাচ্ছে; সেখানে আলিমগণ মসজিদ-মাদরাসার খিদমত করে সামান্য বেতন দিয়ে নিজে চলছে, নিজের পরিবারকে চালাচ্ছে। সাথে সাথে ইলমের নুরকেও প্রজ্জলিত করে রাখতেছেন। আমাকে আপনাকে দ্বীন-ঈমান শেখাচ্ছেন। তিনশত বছর থেকে এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের কাছে পুরোপুরিভাবে ইসলামের ক্ষমতা হারানোর পরেও যতোটুকুন ইসলাম টিকে আছে, আপনি যতোটুকুন দ্বীন জানছেন, ঠাণ্ডা মাথায় দেখবেন এর পেছেনে ওলামায়ে কেরামেরই ভূমিকা রয়েছে।

আজকে যারা চাইনিজ হোটেলে বসে বসে বা বাসে করে সিলেটে ট্যুর দিয়ে, কিংবা ট্রেনে করে দার্জিলিংয়ে সফর করে এরোপ্ল্যানে করে সুইজারল্যান্ড-নরওয়ে-গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভ্রমণ করে করে আলিমদের নির্মম সমালোচনা করছেন, তারা নিজেরাও কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই আলিমদের মাধ্যমেই দ্বীনের আলোটুকু পেয়েছেন।

আলিমরা এখন যেহেতু ক্ষমতাহীন, তাই তাঁরা যদি সবকিছুর কথিত বিকল্প থেকেও থাকে, তবুও তা দিতে সক্ষম নয়। কারণ তাঁরা আজ পরাজিত। কিন্তু তাঁদের দ্বীনকে রক্ষা করার, কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক তা বলার দায় আছে। দায়িত্ব আছে। তাঁরা স্রেফ তাঁদের বোধ-বিশ্বাসের আলোকে দায়টুকু দায়িত্বটুকুন পালন করে যাচ্ছেন। এটা আপনি ইচ্ছে হলে মানবেন, না-ইচ্ছে হলে মানবেন না, আপনি এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের কাছে মগজ বিকিয়ে দিয়ে এলিট ক্লাস নাগরিক বনে থাকবেন —কিন্তু এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের দাসত্ব করতে গিয়ে ওলামায়ে কেরামের নিষ্ঠুর সমালোচনা করবেন না। তাঁদের ভুলগুলো টেনে আপনার ভুলগুলোকে ফুল প্রমাণ করতে যাবেন না।

~রেদওয়ান রাওয়াহা
২৮.০৬.২২ ইং

পঠিত : ৫১৮ বার

মন্তব্য: ১

২০২২-০৬-২৯ ০৯:১৮

User
Md. Masud Rana

জাজাকাল্লাহ খাইরান

submit