Alapon

বিয়ের ক্ষেত্রে দ্বীনদারিতা এবং কিছু কথা...



ইসলামে বিয়ের ক্ষেত্রে যেসব ক্রাইটেরিয়ার কথা বলেছে, তারমধ্যে অন্যতম হলো দ্বীনদারিতা। এটা এমন এক ক্রাইটেরিয়া, যার জন্য অন্যান্য সকল ক্রাইটেরিয়ার চেয়ে এটাকে প্রাধান্য দিতে হয়।

'দ্বীনদারিতা দেখে বিয়ে করা' এটা হলো থিওরি, বাস্তব জীবনে দ্বীনদারিতা বলতে আমরা কতোটুকু বুঝি সেটা বুঝা দরকার।

সাহাবী, সালাফদের যুগে দ্বীনদারিতার যে মাপকাঠি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিলো, একই মাপকাঠি কি আমাদের যুগে আছে? অবশ্যই না।

তখনকার সময়ে একজন পাত্র এবং একজন পাত্রী বাই ডিফল্ট যেরকম দ্বীনদার ছিলেন, সামাজিকভাবে মানুষজন দ্বীন সম্পর্কে যতোটা সচেতন ছিলো, এখনকার সময়ে তেমনটা নেই। তখন বেশিরভাগ ফরজ বিধান তো মেনে চলতোই, নফল আমলগুলো খুঁজে খুঁজে পালন করতো। এখন বেশিরভাগের অবস্থা- ফরজ নিয়েই টানাটানি।

যারা বিয়ে করতে যাবেন, তারা দ্বীনদার পাত্র বা দ্বীনদার পাত্রী দেখবেন। এটা স্বাভাবিক। তবে, অন্যের দ্বীনদারিতা দেখার পূর্বে নিজের দ্বীনদারিতা নিয়ে বোঝাপড়া দরকার।
দ্বীনদারিতা মাপার স্কেল ধরুন- ফরজ নামাজ পড়ে রোজা রাখে, পরিপূর্ণ পর্দা মেন্টেইন করে, হালাল ইনকাম করে, মিথ্যা কথা বলে না, নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করে, সুন্নাত মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে, মাঝেমধ্যে তাহাজ্জুদ পড়ে, সুন্নাত-নফল রোজা রাখে, বাসায় দ্বীনি পরিবেশ আছে, হারাম কোনো অভ্যাসের সাথে সম্পৃক্ত নয় ইত্যাদি।
এরকম কয়েকটি ক্যাটাগরিতে মার্কিং করে দ্বীনদারিতার স্কেল ধরা হলো ১০০।
এখন দেখুন আপনার স্কেল কতো।

আমাদের সামাজিক বাস্তবতা অনুযায়ী ১০০ তে ১০০ পাওয়া মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। হাজারে দুই-তিনজন হবে। বেশিরভাগের স্কেল হবে ৪০-৬০ এর মধ্যে। চল্লিশের নিচেও আছে, চল্লিশের উপরও আছে।

চল্লিশের নিচে যেমন- প্রতি শুক্রবারে জুমুআর নামাজ পড়ে, পর্দা মেনে চলে না, অনেকগুলো হারামের সাথে সম্পৃক্ত ইত্যাদি।

একজন ছেলের দ্বীনদারিতার স্কেল ধরে নিলাম চল্লিশ। এখন সে বিয়ে করবে। বিয়ের সময় যদি 'দ্বীনদার দেখে বিয়ে করুন' এই থিওরি ফলো করতে গিয়ে সে সত্তর, আশি স্কেলের একজন পাত্রী খুঁজে, তার সামাজিক অবস্থান এবং ইনকামের কারণে হয়তো পেয়ে যেতে পারে৷

কিন্তু, সেই মেয়েটির অবস্থা কেমন হবে?

যে মেয়েটি পরিপূর্ণ পর্দা করতো, বাসায় কোনো নন-মাহরাম আত্মীয় আসলে বের হতো না, কোথাও বের হলে নিকাব পরে বের হতো, নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তো, নফল রোজাও রাখতো।

সে যখন এমন একটি পরিবারে যাবে, যে পরিবার পর্দার ব্যাপারে স্ট্রিক্ট না, বিয়ের অনুষ্ঠানে সবাই সাজগোজ করে শাড়ি পরে যায়, আত্মীয়-স্বজন সবার সাথে হেসেখেলে কথা বলে, আজানের সময় টিভি দেখে, নামাজ পড়ার প্রতি তেমন আগ্রহ নেই, সবাই ঘুম থেকে উঠে সকাল আটটায়; চিন্তা করুন সেই পরিবেশে গিয়ে ঐ মেয়েটির অবস্থা কেমন হবে?

একটা জিনিস খুব ভালোভাবে মনে রাখা দরকার। যে মানুষ ২২-২৫ বছরে আল্লাহকে চিনেনি, রাসূলকে চিনেনি, বিয়ের পরদিন সে আল্লাহ ও রাসূলকে চেনা শুরু করবে এমন না। বিয়ে কোনো ম্যাজিক না৷ এরকম রেয়ার কেইস দু-চারটি থাকতে পারে৷ কিন্তু, বিয়ের আগে মানুষ যেমন থাকে, বিয়ের পরও তেমন থাকে৷ দ্বীনদারিতায় হালকা পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু, রাতারাতি সে নিজেকে বদলে ফেলতে পারে না।

এসব ক্ষেত্রে যে মেয়েটি বাবার ঘরে থাকতে দ্বীন মেনে চলার পূর্ণ স্বাধীনতা পেতো, সেই মেয়েটি স্বামীর ঘরে যাবার পর নিজেকে এলিয়েন ভাবা শুরু করবে। কারণ, ঐ পরিবারে তার মতো আর কাউকে পাবে না। তার এমন 'অতিরিক্ত' দ্বীনদারিতা তার স্বামী, স্বামীর পরিবার ও আত্মীয়দের জন্য বিতৃষ্ণার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। স্বামী যে পরিবেশে বড়ো হয়েছে, সেও চাইবে তার বন্ধুদের মতো তার স্ত্রীকে নিয়ে বিয়ে বাড়িতে সাজগোজ করে যেতে, তার শ্বাশুড়ি তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইবে নানান অপরিচিত আত্মীয়স্বজনের সাথে।
এগুলো এতো বিস্তারিত বলার কিছু নেই। যাস্ট চিন্তা করুন একজন মেয়ে দ্বীনি পরিবেশ থেকে শ্বশুর বাড়ির লিবারেল পরিবেশ পেলে কেমন হতে পারে।

অন্যদিকে একজন ছেলে আলেম, মাদ্রাসায় পড়েছে, দাওরা পাশ, ইফতা পাশ। তার পরিবারও আলেম পরিবার। সে অনেক দ্বীনদার, স্কেল আশি।

সে কোনো কারণে এমন এক মেয়েকে বিয়ে করলো, যে এতো দ্বীনদার না। কলেজে পড়েছে, ছেলে বন্ধু ছিলো-আছে, ফেসবুকে ছবি আছে, মাঝেমধ্যে নামাজ পড়ে, হিজাব পরে কিন্তু পর্দা করে না। ধরেন তার দ্বীনদারিতার স্কেল চল্লিশ।

সেই মেয়ে যখন এমন এক পরিবারে যাবে, যাদের ঘুম ভাঙ্গে ভোর চারটায়, যেই পরিবারের মেয়েরা সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুই-একবার বাইরে যায়, পর্দার ব্যাঘাত ঘটে বলে যারা সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে, সেই মেয়ের অবস্থা কেমন হবে?

স্বাভাবিকভাবেই সে হাসফাস করবে। তার কাছে পরিবেশটা দমবন্ধকর মনে হবে। এটার প্রভাব পড়বে তাদের সংসার জীবনে।

আলেম পরিবারে বড়ো হওয়া একজন আলেম যেমন দ্বীনদার পাত্রী খুঁজবেন, যে ধরনের স্কেলে দ্বীনদারিতা খুঁজবেন, একই স্কেল একজন জেনারেল শিক্ষিত যার দ্বীনদারিতার স্কেল চল্লিশের নিচে, সে খুঁজলে হবে না। কারণ, সে ঐরকম একজন দ্বীনদার মেয়ে তার পরিবারে এনে একোমোডেট করতে পারবে না। হতে পারে তার পরিবারে এসে সেই মেয়েটির দ্বীনদারিতার স্কেল আশি থেকে ষাট-পঞ্চাশে নেমে আসতে পারে।

এজন্য বিয়েতে অন্যের দ্বীনদারিতা দেখার আগে নিজের দ্বীনদারিতার স্কেল দেখতে হবে অতঃপর দ্বীনদার পাত্র-পাত্রী খুঁজতে হবে। বিয়ের পর আপনি যেমন রাতারাতি দ্বীনদার হতে পারবেন না, তেমনি সেই আশা ছেড়ে দেন আপনার পরিবারে যে আসবে সেও নিজেকে বদলে ফেলবে।

আপনি নিজে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন না, আপনি আশা করেন একজন তাহাজ্জুদগুজার স্ত্রী। এমন আশা করার নিয়ত হয়তো খারাপ না, কিন্তু সেই তাহাজ্জুদগুজার মেয়েটি আপনার পরিবারে এসে ফজরের ফরজ নামাজ পড়তে স্ট্রাগল করতে পারে।

বিয়ের আগে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল, হালাল-হারাম এগুলোর আলোকে দ্বীনদারিতার একটি স্কেল নির্ধারণ করুন। তারপর সেই স্কেলে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে মেপে অতঃপর একজন দ্বীনদার পাত্র-পাত্রী খুঁজুন।

শুধুমাত্র 'দ্বীনদার চাই' বললে হবে না। কেমন দ্বীনদার চান সেটাও বলতে হবে।
স্বামী-স্ত্রী দুজনের স্কেল পার্থক্য বিশের বেশি না হলে ভালো। একজন পয়তাল্লিশ, আরেকজন সর্বোচ্চ পয়ষট্টি, একজন পঞ্চাশ, আরেকজন ষাট; এমনটা হলে ঠিক আছে।
কথাগুলো সামাজিক অভিজ্ঞতাপ্রসূত পরামর্শ। এটা রিলিজিয়াস ভার্ডিক্ট না যে 'করতেই হবে' বা 'করা যাবে না'। এটাকে পরামর্শ হিশেবে নিতে পারেন। বাধ্যবাধকতা হিশেবে নয়।

প্রাসঙ্গিক:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবী আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু ও প্রখ্যাত তাবেয়ী সায়িদ ইবনুল মুসায়্যিব রাহিমাহাল্লাহর কাছে প্রস্তাব যায় খলিফার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ের। দুজনেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এই কারণে- সেই পরিবারে গেলে তাদের মেয়ের দ্বীনদারিতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
...
আরিফুল ইসলাম

পঠিত : ১০৭১ বার

মন্তব্য: ০