Alapon

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাহ : দান সাদাকাহ এর বিকল্প নয়

ঈমানদার মুসলমানের জীবনে কুরবানী বা ঈদুল আযহার দিনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পশু জবাই করা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঈবাদাত। নবী ইবরাহীম আ.এর আত্ম ত্যাগের মহান নজরানা থেকে শুরু করে মুহাম্মদ সা. এর নবুয়াতী জীবনে মদীনার দশ বছর তিনি এ ইবাদাত পালন করেছেন। গোটা মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে এ হুকুম পালন করে আসছে। পশু কুরবানীর মাধ্যমে ঈমানদারগণ এ বিষয়টি স্মরণ করে ইবরাহীম আ. যেমন আল্লাহর হুকুমের সামনে আসলামতু লি রাব্বিল আলামীন বলে আত্মসমর্পণ করেছিলো-আমরাও আল্লাহর প্রভুত্বের সামনে নিজেদেরকে সেভাবে পেশ করছি। বর্তমান বৈশ্বিক মহামারীর সময়ে এ ইবাদাতকে নিয়ে প্রশ্ন এবং সন্দেহ সংশয়ের এক ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে : করোনাকালীন এ সময়ে কুরাবনী না করে কুরবানীর অর্থ দরিদ্র মানুষের মাঝে বিতরণ করে দিলে মানুষ বেশী উপকৃত হবে। কিছু কিছু মানুষ এ প্রপাগান্ডায় বুঝে হোক কিংবা না বুঝে হোক বিভ্রান্ত হচ্ছে। কুরবানীর মতো একটি মহিমাম্বিত ইবাদাতের বিকল্প কি আসলেই আছে? ইসলাম তো মানুষকে স্বাভাবিকভাবেই অসহায়, দরিদ্র পীড়িত মানুষের পাশে দাড়ানোর জন্য আদেশ দিয়েছে। একটি ইবাদাতকে বন্ধ করে কি ঐ সকল কল্যাণকর কাজ করতে হবে? মানবতার সেবা করা, অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানো, ইয়াতিমকে খাদ্য দান এটি ঈমানের অনিবার্য দাবী। এ কাজ সকল সময়, সকল যুগ এবং সকল প্রেক্ষাপটে একটি অতীব কল্যাণকর কাজ। এমনকি যারা এ কল্যাণকর কাজগুলো করে না তাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আখিরাতে অবিশ্বাসী১ বলে ঘোষণা করেছেন। ঈদুল আযহার দিনে পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী করার ইবাদাতকে হীন গণ্য করে তার বিকল্প ইবাদাতের কোনো সূযোগ ইসলাম দেয়নি। আজকের নিবন্ধে এ বিষয়টি আলোচনার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর গোলাম হিসেবে সৃষ্টিকুলের সকল কিছুর ওপরে সর্বোত্তম মর্যাদা দিয়ে। মানুষকে তিনি দুনিয়ায় করেছেন তাঁর প্রতিনিধি। প্রতিনিধিত্বের কাজ করতে গিয়ে তার মূল দায়িত্ব হবে আল্লাহর দাসত্ব বা গোলামী করা। দাসত্বের সরল অর্থ জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধগুলো পালন করা। আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ পালন করে কিভাবে তার জীবন পরিচালনা করবে এ জন্য আল্লাহ যুগে যুগে মানুষের মধ্য হতেই নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। নবীরা মানুষদেরকে আল্লাহর দাসত্বের আহ্বান জানিয়েছেন, তার নির্দেশিত পথে পরিচালনা করেছেন এবং সিরাতুল মুস্তাকিমের অনুসরণ ও অনুকরণে মানুষদের জীবন গড়ে তুলেছেন। এ কাজ করতে গিয়ে নবীগণ যেমন মানুষদের কাছ থেকে বাধা প্রতিবন্ধকতা এবং জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন একইভাবে আল্লাহ নিজেও তাদের কাছ থেকে পরীক্ষা নিয়েছেন। এক একজন নবীর জীবনে এক এক ধরনের পরীক্ষা কার্যকর হয়েছে। কাউকে কঠিন রোগ দিয়ে পরীক্ষা করেছেন, কাউকে সন্তান-সম্পদের ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করেছেন। কারো কারো জীবনে শাহাদাত ছিলো চূড়ান্ত পরীক্ষা। ইবরাহীম আ. এর জীবনে অনেকগুলো কঠিন পরীক্ষা এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নিজ সন্তানকে আল্লাহর রাহে কুরবানী করার পরীক্ষা। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘(হে মুহাম্মদ) আপনি বলে দিন, আমার রব নিশ্চিৎভাবে আমাকে সোজা পথ দেখিয়েছেন। একদম সঠিক নির্ভুল দীন। যার মধ্যে কোনো বক্রতা নেই-ইবরাহীমের পদ্ধতি। যাকে সে একাগ্রচিত্তে একমূখী হয়ে গ্রহণ করেছিলো এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না।২

এখানে প্রথম যে বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে : মুহাম্মদ সা.কে আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন তিনি মিল্লাতে ইবরাহীমীর ওপর প্রতিষ্ঠিত। মুহাম্মদ সা. এর দীন এবং নবী ইবরাহীমের দীন মূলত একই দীন। একইভাবে মুহাম্মদ সা.এর উম্মাতগণ মিল্লাতে ইবরাহীমীর ওপর প্রতিষ্ঠিত। যারা মিল্লাতে ইবরাহীমীর ওপর প্রতিষ্ঠিত তাদের পরিচয় হচ্ছে তারা মুসলিম। মুসলিম শব্দের আভিধানিক অর্থ আত্মসমর্পনকারী। যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দেন- তাদের জন্য আল্লাহর নির্দেশ ‘(হে নবী) আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমারা সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সমস্ত জগতের প্রভু আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। আর ঐ বিষয়ে আমাকে আদেশ করা হয়েছে। সুতরাং আমি হলাম প্রথম আত্মসমর্পনকারী।৩

অত্র আয়াতে نُسُكِ (নুসুক) শব্দটি বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। نُسُكِ (নুসুক) (নাসকিয়াতু) শব্দের বহুবচন। যার অর্থ হলো আল্লাহর নামে-আল্লাহর উদ্দেশ্যে জবেহ করা৪। নুসুক-এর ফারসী প্রতিশব্দ হচ্ছে কুরবানী। যার অভিধানিক অর্থ হচ্ছে কারো নৈকট্য লাভের জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করা, কুরবানী করা। শরীয়াতের পরিভাষায় আল্লাহর রাহে বান্দা নিজের ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, কামনা বাসনা, ভালোবাসা সব কিছু আল্লাহর জন্য করে নিয়ে প্রিয় বস্তুকে তাঁর জন্য উৎসর্গ করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইবরাহীম আ.-এর জীবনের কুরবানীগুলোর ব্যাপারে বলেন, ‘ স্মরণ করো- যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সে পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উৎড়ে গেলো। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে সকল মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করবো। ইবরাহীম বললো, আর আমার সন্তানদের ব্যাপারেও কি এই অঙ্গীকার? জবাব দিলেন, আমার এই অঙ্গীকার জালেমদের ব্যাপারে নয়।৫ ইবরাহীম আ. এর জীবনের প্রতিটি বিষয় মিল্লাতে ইবরাহীমী বা মুসলিমদের জন্য শিক্ষা,প্রশিক্ষণ, প্রেরণা এবং অনুকরণের এক অত্যুজ্জল নমুনা। তাঁর জীবনের কোনো অধ্যায়কে অবজ্ঞা করার, অবহেলা করার কিংবা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার কোনো সূযোগ নেই। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘ এখন কে ইবরাহীমের পদ্ধতিকে ঘৃণা করবে? হ্যা যে নিজেকে মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতায় আচ্ছন্ন করেছে সে ছাড়া আর কে এ কাজ করতে পারে? ইবরাহীমকে তো আমি দুনিয়ায় নিজের জন্য নির্বাচিত করেছিলাম আর আখিরাতে সে সৎ কর্মশীলদের মধ্যে গণ্য হবে।৬

ইবরাহীম আ.এর পদ্ধতি ছিলো, যখন তাকে বলা হয়েছে আত্মসমর্পন করো, তিনি বললেন, আমি আত্মসমর্পণ করলাম। তাঁর আত্মসমর্পন এবং আনুগত্যের মাত্রা কতটুকু ছিলো! যিনি নিজ সন্তানকে আল্লাহর রাহে কুরবানী করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘ পুত্র (ইসমাঈল) যখন তার সাথে কাজকর্ম করার উপযুক্ত বয়সে পৌঁছালো। তখন (একদিন-ইবরাহীম) তাকে বললো, হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি তোমাকে জবেহ করছি। এখন তুমি বলো, তুমি কি মনে করো? সে বললো হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম করা হয়েছে আপনি তাই করুন। আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারী হিসেবে পাবেন। শেষ পর্যন্ত যখন তারা দ’ুজন আনুগত্যের শির নত করে দিলো এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুর করে শুইয়ে দিলো এবং আমি আওয়াজ দিলাম, হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছো। আমি সৎ কর্মশীলদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চিৎভাবে এটি ছিলো একটি বড়ো পরীক্ষা। একটি বড়ো কুরবানীর বিনিময়ে আমি এ শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিলাম।৭ ইবরাহীম আ. এর এ কুরবানী শুধু তাঁর জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত ছিলো না। তার আনুগত্যের এ ধারা মিল্লাতে ইবরাহীমীর জন্য কিয়ামত পর্যন্ত অব্যহত থাকবে।

ইতঃপূর্বে সূরা বাকারার ১৬২ নং আয়াতের উদ্বৃতি দিয়ে নুসুক শব্দের যে আলোচনা করা হয়েছে তা যেমন শুধুমাত্র ইবরাহীম আ.-এর জন্য নির্ধারিত নয়, একইভাবে পশু কুরবানীর এ সিলসিলাও ইবরাহীম আ. পর্যন্ত থেমে থাকে নি। এই বিধান গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য অব্যহত আছে এবং অব্যহত থাকবে। রাসূল সা. ঈদুল আযহার দিনের এক খুতবায় বলেছেন, ‘ এই দিনের করণীয় হলো সালাত আদায় করা। এরপর নহর বা কুরবানী করা। যে সালাতের পর নহর(কুরবানী) করলো সে নহর(কুরবানী) পূর্ণ করলো এবং সে মুসলিমদের পন্থা অনুসরণ করলো। আর যে সালাতের আগে জবাই করলো সেটা তার গোস্তের প্রয়োজন পূরণ করবে। কিন্তু তা নুসুক হিসেবে গণ্য হবে না।৮ আব্দুল্লাাহ ইবনে আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দীন সম্পর্কে জানতে এসেছিল। ফিরে যাওয়ার সময় নবীজী তাকে ডাকলেন এবং বললেন-‘‘আমাকে ‘ইয়াওমুল আযহার’ আদেশ করা হয়েছে। (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) এ দিবসকে আল্লাহ এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। লোকটি বলল, আমার কাছে যদি শুধু পুত্রের দেওয়া একটি দুধের পশু থাকে আমি কি তা-ই কুরবানী করব? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, না, বরং তুমি সেদিন তোমার মাথার চুল কাটবে (মুন্ডাবে বা ছোট করবে) নখ কাটবে, মোচ কাটবে এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর নিকট তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে।৯ অর্থাৎ ঐ ব্যাক্তির কাছে আয়ের একমাত্র উৎস দুধেল পশু ব্যতীত আর কোনো পশু না থাকায় তাকে এ হুকুম দেয়া হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক হাদীসটির বক্তব্য হচ্ছে- রাসূলে মাকবুল সা.-কে কুরবানী করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তিনিও একইভাবে এ আদেশ তার উম্মাতদের জন্য দিয়ে গেছেন। যারা ঈদুল আযহার দিনে কুরবানী না করবে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সা. কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছেন, ‘ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও কুরবানী করল না (অর্থাৎ তার কুরবানী করার সংকল্প নেই) সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।১০

রাসূলুল্লাহ সা. শুধু নিজের জন্য কুরবানী করতেন না। তিনি গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য কুরবানী করতেন। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য একটি শিংবিশিষ্ট দুম্বা আনতে বললেন, যার পা কালো, পেটের চামড়া কালো এবং চোখ কালো। দুম্বা আনা হলে নবীজী বললেন, আয়েশা, আমাকে ছুরি দাও। এরপর বললেন, একটি পাথরে ঘষে ধারালো করে দাও। তিনি ধারালো করে দিলেন। এরপর তিনি ছুরি হাতে নিলেন এবং দুম্বাটিকে মাটিতে শোয়ালেন। এরপর বিসমিল্লাহ বলে জবাই করলেন এবং বললেন-‘ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মাদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন।১১ মুহাম্মদ সা. শুধু নিজেই কুরবানী করেন নি তার উম্মাতকে এই একই নির্দেশ দিয়ে গেছেন। হযরত যুনদুব রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন, ‘যার সামর্থ আছে সে যেন কুরবানী করে১২ অন্য একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে রাসূল সা. বলেছেন, কেউ যদি ঈদগাহে আসার পূর্বে পশু জবাই করে সে যেন (নামাজের পর) আরো একটি পশু জবাই করে। হযরত মিখনাব রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সা. দশ বছর মদীনায় ছিলেন। তিনি প্রতি বছর কুরবানী করেছেন।১৩ রাসূল সা. শুধু নিজের জীবদ্ধসায়ই কুরবানী করেন নি। তিনি আলী রা. কে এ ব্যাপারে অসিয়ত করে গেছেন। তাই তিনি প্রতি বছর নিজের কুরবানীর সাথে রাসূল সা. এর জন্যও কুরবানী করতেন।১৪

ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আওযায়ী, ইমাম ইবনে তাইমিয়া ঈদুল আযহার দিনের পশু কুরবানীকে ওয়াজিব বলেছেন। বর্তমান করোনাকালীন সময়ে কেউ কেউ কুরবানী না করে সে অর্থ দরিদ্রদের মাঝে বিতরণের কথা বলছেন। তারা মূলত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাতকে অস্বীকার করতে চাচ্ছেন। তাদের যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, কুরআনে এ বিষয়ে সরাসরি নির্দেশ নেই,এটি কোনো ফরজ বিধান নয়- তাই এ বছর কুরবানী না করে সে অর্থ দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করলে উত্তম হবে’। তারা ইমাম শাফেয়ীসহ অন্যান্য ইমামদের ফতওয়া কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এ যুক্তি তুলে ধরছেন। যে সকল ইমামগণ কুরবানীকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলেছেন, তারা কেউই এই ফতওয়া দেননি যে, কুরবানী না করলে কোনো গোণাহ নেই কিংবা এর বিকল্প কোনো ইবাদাতের কথাও তারা বলেন নি। রাসূল সা. এর মাধ্যমেই ইসলাম নামক অমীয় শান্তির বিধান আমরা পেয়েছি। তিনি যা বলেছেন, যেভাবে বলেছেন সেভাবে পালন করাই ঈমানের অনিবার্য দাবী। যে সকল ইমামগণ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলেছেন, তারা এটাকে এমন সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলেছেন, যা গুরুত্বের দিক দিয়ে অন্যান্য সুন্নাতের চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদার। ফিকহের মাসয়ালায় ওয়াজিব এবং সুন্নাতে মুয়াক্কাদা প্রায় কাছাকাছি। অতএব আমরা কেউ যেন ভিন্ন চিন্তা করতে গিয়ে গোণাহের কাজ করে না ফেলি এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

আমাদের একটি বিষয় ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। রাসূল সা. যে সকল বিষয়ে আদেশ দিয়েছেন, তা পালন করা আমাদের জন্য কতটুকু বাধ্যকর। আল্লাহ বলেন, ‘ রাসূল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন, তা গ্রহণ করো, যা থেকে নিষেধ করেন, তা হতে দূরে থাকো।১৫ আল্লাহ বলেন, ‘ তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, রাসূলের এবং তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করো না।১৬ রাসূল সা. কুরবানীর এ ইবাদাতের বিকল্প কোনো ইবাদাতের কথা বলেন নি। অভাবী ও দুস্থ মানুষকে সাহায্য করার জন্য কুরআনে অসংখ্য নির্দেশ এসেছে। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষকে ছোট মনের অধীকারী করে সৃষ্টি করা হয়েছে। বিপদ মুসিবতে পড়লেই সে ঘাবড়ে যায়।আর যেই সচ্ছলতার মূখ দেখে অমনি কৃপণতা করতে শুরু করে। তবে যারা সালাত আদায় করে (তারা এ দোষ হতে মুক্ত)..... যাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক আছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের।১৭ আল্লাহ মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, ‘তাদের সম্পদে অধিকার ছিলো প্রার্থী ও বঞ্চিতদের। দৃঢ় প্রত্যয় প্রদর্শনকারীদের জন্য পৃথিবীতে বহু নিদর্শন রয়েছ্’।১৮ হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যাক্তি মুমিনের পার্থিব দুঃখ কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামাতের দিন তার দুঃখ কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যাক্তি কোনো সঙ্কটাপন্ন ব্যাক্তির সঙ্কট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের সকল সঙ্কট নিরসন করে দিবেন। যে ব্যাক্তি কোনো মুসলিমের দোষত্রæটি গোপন রাখবে , আল্লাহ দুনিয়া আখিরাতে তার দোষ ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দাহর সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ সে তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে। ’১৯

কুরআন হাদীসে এভাবে অভাবী, অসহায় ও দুস্থ মানুষকে সাহায্য করার অসংখ্য নির্দেশ এসেছে। যার কোনোটিই কুরবানীর বিকল্প নয়। কুরবানীর ব্যাপারে হাদীসে অনেক কঠিন এবং কঠোর নির্দেশ থাকার পরেও যারা কুরবানীর বিকল্প কোনো কিছু খোঁজার চেষ্টা করছেন। তারা মূলত রাসুল সা. এর আদেশকে গুরুত্ব দিতে চান না। আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে, আমরা যেন হাদীস অস্বীকরাকারী অথবা অবজ্ঞাকারী হয়ে না হয়ে যাই। যারা ইমামগণের ফতোয়ার কথা বলছেন। তারা কি এমন কোনো তথ্য উপস্থাপন করতে পারবেন যে, ইমামগণ কুরবানী না করে তার বিকল্প দান সাদাকাহ কিংবা দরিদ্র মানুষকে খাদ্য খাওয়ানোর কথা বলেছেন। সুতরাং কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এর কোনো বিকল্প হতে পারে না। রাসূল সা. এর হাদীস, সাহাবায়ে আজমায়ীনদের কর্মপন্থা, তাবেয়ীদের জীবন এবং উম্মাহর দীর্ঘ ইতিহাস পরিক্রমায় এমন কোনো ঘটনা পাওয়া যায় না যে, তারা কোনো বিশেষ সঙ্কটকালীন সময়ে কুরবানী না করে সেই অর্থ ভিন্ন কোনো কাজে ব্যয় করেছেন। যারা কুরবানীর বিকল্প ব্যবস্থা অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন। তাদের জন্য নিম্মোক্ত হাদীসটি একটি কঠোর সতর্কবাণী হতে পারে। ‘সাবধান হয়ে যাও, আমার উম্মতের কিছু লোককে ধরে আনা হবে তাদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন আমি বলব, হে আমার রব! এরা তো আমার উম্মত। জবাবে আমাকে বলা হবে, তুমি জান না তোমার (ওফাতের) পরে এরা কত নতুন (হাদীছ) কথা তৈরী করেছিল। আমি তখন আল্লাহর সৎ বান্দা (ঈসার) মতো বলব, ‘যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম, ততদিন আমি ছিলাম তাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কিন্তু আমার পরে তুমিই তাদের সাক্ষী। তখন বলা হবে, তুমি এদের কাছ থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর, এরা (তোমার দ্বীন তথা কুরআন-সুন্নাহ থেকে) মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উল্টো পথে চলেছিল২০

আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে একমাত্র মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. এর দেখানো পথ এবং পন্থাকেই গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু রাসূলে মাকবুল সা. এর গোটা জীবনকালই মানবতার কল্যাণের জন্য ব্যয় হয়েছে। অতএব অসহায় মানুষের জন্য কুরবানীর বিকল্প অনুসন্ধান এক ধরনের ধৃষ্টতা। মদীনায় একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিলো। ঐ সময়ে রাসুল সা. কুরবানীর পশুর গোশত তিন দিনের বেশী সংরক্ষন না করা এবং দরিদ্র মানুষের মাঝে গোশত বিতরণের জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে দুর্ভিক্ষের অবসান হলে আবার রাসুল সা. বললেন এখন তোমার কুরবানীর পশুর গোশত খেতে পারো এবং সংরক্ষন করতে পারো। আজ যারা করোনার অজুহাতে কুরবানী না করে কুরবানীর অর্থ বিতরণের কথা বলছেন, তাদের জন্য বরং কল্যাণকর হবে সামর্থ্য থাকলে একটির পরিবর্তে দুটি পশু কুরবানী করে দরিদ্র মানুষের মাঝে বেশি বেশি গোশত বিতরণ করা।

ইসলামের কেনো বিষয়ে নিজস্ব কোনো মনগড়া মতবাদের যেমন সূযোগ নেই একইভাবে ইসলাম কোনো কট্টর পন্থাকেও সমর্থন করে না। ইসলাম সব সময় সহজ, অনুসরণযোগ্য, অনুকরণযোগ্য, মানবতার কল্যাণে এক মানবতাবাদী আদর্শের নাম। তবে এর অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে মুহাম্মদ সা. এর দেখানো পথ ও পন্থায়। মানুষকে সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ফায়ছালা গ্রহণ করতে হবে, তাহ’লে তারা সফলকাম হবে। ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়সালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের ইখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’২১

আল্লাহ বলেন, (হে নবী আপনি বলে দিন) আর এটাই আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এ পথেরই অনুসরণ করো। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করো না। অন্যথা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে ঠেলে দিবে । মূলত মর্যাদা তো কেবল তার জন্য রাসূলুল্লাহ সা.কে পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় অনুসরণ করে। মহান আল্লাহ বলেন, আর যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হয়, তবে তারা ঐ ব্যক্তিদের সঙ্গী হবে যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন; অর্থাৎ নবীগণ, সত্য সাধকগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলগণ। আর এরাই সর্বোত্তম সঙ্গী২২ পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধাচরণ করবে সে জাহান্নামে যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর সুপথ প্রকাশিত হওয়ার পর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং বিশ্বাসীগণের বিপরীত পথের অনুগামী হয়, তবে সে যাতে অভিনিবিষ্ট আমি তাকে তাতেই প্রত্যাবর্তিত করব ও তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব এবং এটা নিকৃষ্টতর প্রত্যাবর্তন স্থল২৩

কুরবানীর ব্যাপরে হাদীসে স্পষ্ট বক্তব্য আছে, রাসূলের সীরাতে সুষ্পষ্ট নির্দেশনা আছে, সাহাবীদের জীবনে এর আমল দিবলোকের মতো স্পষ্ট। এ নিয়ে ভিন্ন মত আবিস্কারের কোনো সূযোগ নেই। সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করার কোনো সূযোগ নেই। কোনো বিষয়ে রাসুল সা. এর স্পষ্ট বক্তব্য এবং আমল থাকলে কি করতে হবে তা কুরআনে নির্দেশিত হয়েছে। ‘মুমিনদের উক্তি তো এই, যখন তাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তারা বলবে, আমরা শোনলাম এবং মেনে নিলাম, আর তারাই সফলকাম। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হতে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম ২৪। রাসূল সা. এর আনুগত্যের বিষয়টি আমাদেরকে ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। কেননা রাসূল সা. এর আনুগত্যের মধ্যেই মুক্তি, এর বিকল্প পথে ক্ষতি ও অকল্যাণ। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. বলেছেন ‘আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করবে (সে নয়)। তারা বললেন, কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সেই অস্বীকার করে২৫। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত উম্মতের মধ্যে এই ইবাদত চলমান রয়েছে এবং প্রতিবছর ইসলামের ‘শিয়ার’রূপে (ইসলামের একটি প্রকাশ্য ও সম্মিলিতভাবে আদায়যোগ্য ইবাদত হিসাবে) তা গোটা মুসলিম উম্মাহ পালন করে আসছে। অতএব কেউ যদি মনে করে, কুরবানী ইবাদত নয় এবং ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে সে রাসূলের আনীত দীনকে পুরোপুরি পালন করলো?

তথ্যসূত্র
১. সূরা মাউন

২. সূরা আনআম : ১৬১

৩. সূরা আনআম : ১৬২-১৬৩

৪. লিসানুল আরাব ১৪/১২৭-১২৮

৫. সূরা বাকারা : ১২৪

৬. সূরা বাকারা : ১৩০

৭. সূরা সাফফাত : ১০২-১০৭

৮. বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, জামে তিরমিযি, সূনানে আন নাসায়ী, ইবনে হিব্বান

৯. মুসনাদে আহমদ ২/১৬৯; হাদীস ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৭৭৩, ৫৯১৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫

১০. মুসনাদে আহমদ ২/৩২১; মুস্তাদরাকে হাকেম ৪/২৩১, হাদীস ৭৬৩৯

১১. সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫৯১৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯২

১২. আবু দাউদ, তিরমিযি

১৩. তিরমিযি

১৪. মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৮৪৩, ১২৭৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৭

১৫. সূরা হাশর : ০৭

১৬. সূরা মুহাম্মদ : ৩৩

১৭. সূরা মাআরিজ : ১৯-২৫

১৮. সূরা যারিয়াত : ১৯-২০

১৯. মুসলিম ও তিরমিযি

২০. বুখারী হা/৪৩৭৯ ‘যেমন আমি প্রথম সৃষ্টি করেছিলাম’ অনুচ্ছেদ

২১. আহযাব : ৩৬

২২. নিসা : ৬৯

২৩. নিসা : ১১৫

২৪. সূরা নূর : ৫১-৫২)।

২৫. সহীহ আল বুখারী হা/৭২৮০
সাপ্তাহিক সোনার বাংলার 2020 সালের জুলাই মাসে ঈদুল আযহা সংখ্যায় প্রকাশিত

পঠিত : ২৯৪ বার

মন্তব্য: ০