Alapon

ইসলাম পরিচিতি



বিংশ শতাব্দির শুরুটা ছিল মুসলিমদের জন্য খুবই হতাশাজনক। ইউরোপিয়ানরা পৃথিবীতে তাদের আগ্রাসন জোরদার করেছে, সাথে সাথে তারা জ্ঞান বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করে পৃথিবী শাসনের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। মুসলিম যুবকদের মধ্যে পশ্চিমা প্রীতি ও ইংরেজ প্রীতি বেড়ে যাচ্ছিল। মুসলিম শাসকদের একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারীর সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা মুসলিম যুবকদের মুসলিম শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলছিল।

এর মধ্যে ১ম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় খিলাফত পরাজিত হওয়ার সূত্র ধরে মুসলিমদের আশা ভরসার শেষ ঠিকানাও নিঃশেষ হয়ে যায়। ১৯২৩ সালে খিলাফত ভেঙ্গে দেওয়া হয়। সারা পৃথিবীতে মুসলিমরা এলাকাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিভক্ত হয়ে যায়। মুসলিম উম্মাহ বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

এদিকে রাশিয়ায় ১৯১৭ সালে কম্যুনিস্টদের বিপ্লব মুসলিম আদর্শবাদীদের কম্যুনিস্টদের দিকে ধাবিত করে। সব মিলিয়ে মুসলিম সমাজের অবস্থা ছিল হযবরল। মুসলিমরা নিশ্চিত হয়ে গেছে তত্ত্ব হিসেবে ইসলাম আর ফাংশনাল না। ইসলাম দিয়ে সমাজ রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব না।

মুসলিম যুবকদের কেউ পশ্চিমা পুঁজিবাদী সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। কেউ কম্যুনিস্টদের বাম বিপ্লবে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বাজে অবস্থায় ইসলামের স্বরূপ তুলে ধরে মুসলিমদের ইসলামের পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও সংগঠক সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী রহ.।

১৯৩২ সালে তিনি নিজেও যুবক। তাঁর তখন ২৯ বছর। তিনি ইসলাম বলতে কী বুঝায় ও ইসলামের সঠিক তত্ত্ব সবার সামনে উপস্থাপন করার জন্য একটি বই লিখেন 'রিসালায়ে দ্বীনিয়াত' নামে। বইটিতে তিনি ইসলামের স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। এই বইটি উপমহাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। পৃথিবীর সকল প্রধান ভাষাসহ প্রায় ২৩ টি ভাষায় বইটি অনুবাদ হয়।

বইটি সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখে আফগানিস্তানে। ১৯৬০ সালের পর থেকে আফগানিস্তানের মানুষ পার্শ্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে কম্যুনিস্ট হতে শুরু করে। এই বইটি তাদেরকে কম্যুনিজম থেকে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করে। আর এই বই নিয়ে আফগানিস্তান চষে বেড়িয়েছেন তৎকালীন কাবুল ভার্সিটির শিক্ষক ও পরবর্তিতে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট শহীদ বুরহান উদ্দিন রব্বানী।

বাংলায় 'রিসালায়ে দ্বীনিয়াত' বইটি অনুবাদ হয় 'ইসলাম পরিচিতি' নামে। অনুবাদ করেন সৈয়দ আব্দুল মান্নান। আন্তর্জাতিক দায়ি বিলাল ফিলিপ্স বলেছেন তাঁর ইসলামের দিকে আসার জন্য দুইটি বই ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে একটি হলো রিসালায়ে দ্বীনিয়াত।

বইটিকে মাওলানা মওদূদী রহ. ৭ টি চ্যাপ্টারে ভাগ করেছেন।

১ম অধ্যায়ের নাম 'ইসলাম'
এই অধ্যায়ে মাওলানা কেন ইসলাম নাম দেওয়া হয়েছে, ইসলামের অর্থ, এর তাৎপর্য আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি কুফর কী? কুফরের তাৎপর্য কী? এই আলোচনা করেছেন। অধ্যায়ের শেষে কুফর তথা ইসলামকে অস্বীকার করার কুফল ও ইসলামের কল্যাণ নিয়ে আলোচনা করেছেন।

২য় অধ্যায়ের নাম 'ঈমান ও আনুগত্য'
এই অধ্যায়ে তিনি প্রথমে আনুগত্যের জন্য জ্ঞান ও প্রত্যয়ের প্রয়োজন এটা নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেছেন, মানুষ ততোক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্য করতে পারে না, যতোক্ষণ না সে কতগুলো বিশেষ জ্ঞান লাভ করে এবং সে জ্ঞান প্রত্যয়ের সীমানায় পৌঁছে। সবার আগে মানুষের প্রয়োজন আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ণ প্রত্যয় লাভ। কেননা আল্লাহ আছেন, এ প্রত্যয় যদি তার না থাকলো, তা হলে কি করে সে তার প্রতি আনুগত্য পোষণ করবে?

এরপর তিনি ঈমানের পরিচয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এর ভিত্তিতে মানুষকে চারভাগে ভাগ করেছেন। এরপর তিনি জ্ঞানর্জনের মাধ্যম তথা ওহি নিয়ে নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ের শেষে তিনি ঈমান বিল গায়েবের আলোচনাও করেছেন।

৩য় অধ্যায়ের নাম নবুয়্যত
এখানে মাওলানা মওদূদী নবুয়্যত নিয়ে আলোচনা করেছেন। নবুয়্যতের মূলতত্ত্ব ও এর পরিচয় কথা বলেছেন। নবীর আনুগত্য ও তাদের ঈমানের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন। এরপর তিনি নবীদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচনা করেছেন। তাদের সাথে মানুষের বিভিন্ন আচরণেরও বর্ণনা দিয়েছেন। নবী হিসেবে মুহাম্মদ সা.-এর প্রমাণ ও নবুয়তের ভূমি হিসেবে আরবকে বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। সবশেষে মুহাম্মদ সা. যে শেষ নবী সে বিষয়ে আলোচনা করেন।

৪র্থ অধ্যায়ের নাম 'ঈমানের বিবরণ'
এখানে মাওলানা মূলত কালেমা তাইয়েবার তাৎপর্য উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে বলেন, এ কালেমা-ই হচ্ছে ইসলামের বুনিয়াদ-যা দিয়ে এক কাফের এক মুশরিক ও এক নাস্তিক থেকে মুসলিমের পার্থক্য নির্ধারিত হয়। এ কালেমার স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতি দ্বারা এক মানুষ ও অপর মানুষের মধ্যে বিপুল পার্থক্য রচিত হয়। এ কালেমার অনুসারীরা পরিণত হয় এক জাতিতে এবং অমান্যকারীরা হয় তাদের থেকে স্বতন্ত্র জাতি। এর অনুসারীরা দুনিয়া থেকে শুরু করে আখেরাতে পর্যন্ত উন্নতি, সাফল্য ও সম্মানের অধিকারী হয় এবং অমান্যকারীদের পরিণাম হচ্ছে ব্যর্থতা অপমান ও পতন। কালেমা তাইয়েবা সম্পর্কে একটি চমৎকার আলোচনা আছে এই অধ্যায়ে। সাথে ঈমানের অন্যান্য বিষয় যেমন রাসূল, কিতাব, ফেরেশতা, আখিরাত, তাকদির ইত্যাদি নিয়েও আচোলনা করেছেন মাওলানা মওদূদী।

৫ম অধ্যায়ের নাম 'ইবাদত'
এখানে মাওলানা ইবাদতের হাকিকত ও গুরুত্ব উল্লেখ করেন। সেই সাথে সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্ব ও জিহাদ নিয়ে আলোচনা করেন। জিহাদ ও জিহাদের পরিব্যপ্তি নিয়ে এখানে একটি সুন্দর আলোচনা রয়েছে।

৬ষ্ঠ অধ্যায়ের নাম 'দ্বীন ও শরিয়ত'
এখানে মাওলানা দারুণভাবে দ্বীন ও শরিয়তকে বুঝিয়েছেন। দ্বীন ও শরিয়তের পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। শরীয়ত জানাত মাধ্যম নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফিকাহ ও এর ডেবলেপমেন্ট নিয়ে কথা বলেছনে। সবশেষে তাসাউফ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফিকহ ও তাসাউফের মধ্যে সম্পর্ক সূচিত করেছেন।

৭ম ও শেষ অধ্যায়ের নাম 'শরীয়াতের বিধি-বিধান'
এই অধ্যায়ে মাওলানা দারুণভাবে শরিয়তে সবার অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। মাওলানা বলেন, শরীয়াত হচ্ছে একটি চিরন্তন বিধান। এর কানুন সমূহ কোন বিশেষ কওম ও কোন বিশেষ যুগের প্রচলিত রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের উপর গড়ে ওঠেনি, বরং যে প্রকৃতির ভিত্তিতে মানুষ সৃষ্ট হয়েছে, সেই প্রকৃতির নীতির বুনিয়াদেই গড়ে ওঠেছে এ শরীয়াত। এ স্বভাব-প্রকৃতি যখন সকল যুগে সকল অবস্থায় কায়েম রয়েছে, তখন এরই নীতির বুনিয়াদে গড়া আইনসমূহ ও সর্ব যুগে সর্ব অবস্থায় সমভাবে কায়েম থাকবে।

এই বইটি পড়লে ইসলামের ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান অল্পতেই গোছানোভাবে জানা সম্ভব। ইসলাম কী? কেন? কীভাবে? ও কী চায়? সব জানা সহজ হয়ে যাবে। যারা এখনো পড়েননি বইটি পড়ে দেখুন। আপনার দিগন্ত উন্মোচন হয়ে যাবে। ইসলামের ব্যাপারে জোরালো আস্থা তৈরি হবে।

#বুক_রিভিউ
বই : ইসলাম পরিচিতি
লেখক : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী
অনুবাদক : সৈয়দ আব্দুল মান্নান
প্রকাশনী : আধুনিক প্রকাশনী
পৃষ্ঠা : ১১১
মুদ্রিত মূল্য : ৬৫
জনরা : থিয়োলজি

পঠিত : ৩৮১ বার

মন্তব্য: ০