Alapon

মা-বোনদের উদ্দেশ্যে সাঈয়েদ মওদূদী রহি.



যে সমস্ত নারীগণ স্বেচ্ছায় দ্বীন-ইসলামকে গ্রহণ করবেন, তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে মওদূদী রহিমাহুল্লাহ কিছু নসীহা পেশ করেছেন। বা কাজ বাতলে দিয়েছেন। সেগুলো হচ্ছে-

প্রথম কাজ :
প্রথম কাজ হচ্ছে এই যে, আপনাদের জীবনকে ইসলামের ছাঁচে ঢালাই করুন। জাহেলিয়াতের প্রত্যেকটি বস্তুকে নিজেদের মধ্য থেকে খুঁটে খুঁটে বের করে দিন। ইসলাম ও জাহেলিয়াতের বিভিন্ন বিষয়কে পৃথক করার ক্ষমতা নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করুন। অতঃপর নিজেদের জীবন ক্ষেত্র পর্যালোচনা করুন এবং নিরপেক্ষ বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখুন যে, সেখানে জাহেলিয়াতের কোন প্রভাব অবশিষ্ট আছে কিনা ? এ ধরনের যাবতীয় প্রভাব থেকে নিজেদের জীবন ক্ষেত্রকে মুক্ত করুন এবং নিজেদের চিন্তা, সামাজিকতা, চরিত্র এবং সমগ্র কর্মপদ্ধতিকে ইসলামের অনুগত করুন।

দ্বিতীয় কাজ :
দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে এই যে, আপনাদের গৃহের পরিবেশ সংশোধন করুন। এ পরিবেশে পুরাতন জাহেলিয়াতের যেসব রীতির প্রচলন আছে সেগুলোও দূরে নিক্ষেপ করুন এবং ইংরেজ শাসনামলে আধুনিক যুগের জাহেলিয়াতের যেসব প্রভাব আমাদের গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে সেগুলোকেও খতম করুন। বর্তমানে আমাদের গৃহে নতুন ও পুরাতন জাহেলিয়াতের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটেছে। একদিকে 'প্রগতিবাদী চিন্তা' আমাদের মুসলিম নারীদেরকে ফিরিংগীয়ানা চাল-চলনে উদ্বুদ্ধ করেছে আর অন্যদিকে এ প্রগতিবাদী চিন্তার সাথে সাথে পুরাতন যুগের জাহিলী চিন্তা, শিরকী আকীদা-বিশ্বাস ও অনৈসলামী রীতিনীতিও আমাদের সমাজে পুরাদস্তুর চালু আছে।

বর্তমানে যেসব মহিলার মনে ঈমানী দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত হবে তাদের পুরাতন জাহেলিয়াতের রীতিনীতি, চিন্তা-ধারণাকে নিজেদের গৃহাভ্যন্তর থেকে বাছাই করে করে দূরে নিক্ষেপ করতে হবে এবং এই সংগে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিলেতি সভ্যতার অন্ধ-অনুসৃতির ফলে অন্দর মহলে আধুনিক যুগের জাহেলিয়াতের যে প্রদর্শনী শুরু হয়েছে সেগুলোকেও সমূলে উৎখাত করতে হবে।

তৃতীয় কাজ :
নিজেদের সন্তানদেরকে ইসলামী পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করা হচ্ছে আপনাদের তৃতীয় কাজ। আমাদের নয়া বংশধরদের দুর্ভাগ্য যে, গৃহের অংগনে কুরআনের ধ্বনি কোনদিন তাদের কানে পৌঁছে না এবং কোনদিন তারা নিজেদের গৃহে লোককে সালাত আদায় করতেও দেখে না। এদিক দিয়ে আমরা অবশ্য সৌভাগ্যের অধিকারী ছিলাম। ছেলেবেলায় আমরা নিজেদের গৃহে কুরআনের আওয়াযও শুনেছি এবং বড়দেরকে সালাত আদায় করতেও দেখেছি। আমাদের চার পাশে দ্বীনের কিছু না কিছু চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল।

কিন্তু আমাদের বর্তমান বংশধররা এদিক দিয়ে দুর্ভাগ্যের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। তারা গৃহের এমন পরিবেশে লালিত হচ্ছে যেখানে না কুরআনের আওয়াজ কখনো ধ্বনিত হয়, না সালাতের চিত্র কখনো দৃশ্যপটে ফুটে ওঠে। যদি আমাদের গৃহের এ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে এবং আমাদের নতুন বংশধররা এভাবে ভ্রান্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে তাহলে অদূর ভবিষ্যতে যখন তারা নিজেরাই নিজেদের জীবন পরিচালনা করবে তখন হয়তো ইসলামের নাম নিশানাও অবশিষ্ট থাকবে না।

আপনারা এখন এ পরিস্থিতির অবসান করুন। গৃহের পরিবেশে প্রতিদিনকার উঠা-বসা, চলা-ফেরায় ও জীবনের বিভিন্ন কর্মে ইসলামকে উপস্থাপিত করার এবং আমাদের শিশু-কিশোরদের সামনে তাকে সচল ও সক্রিয় বস্তু হিসেবে দৃশ্যমান করার চিন্তা করুন। ছেলেরা তাকে দেখবে তার স্বাদ গ্রহণ করবে এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হবে। তাদের কানে কুরআনের আওয়ায বারংবার ধ্বনিত হবে। স্বগৃহে তারা প্রতিদিন পাঁচবার সালাতের দৃশ্য অবলোকন করবে।

অতঃপর স্বাভাবিকভাবে তারা বড়দের অনুকরণ করবে এবং তাদেরকে সালাত আদায় করতে দেখে নিজেরাও সালাত আদায় করবে। তারা তাওহীদের পয়গাম শুনবে, তারা রাজনীতির বিষয়বস্তু অনুধাবন করবে। ইসলামের চিত্র তাদের হৃদয়পটে খোদিত হবে। তাদের অভ্যাস সংশোধিত হবে। তাদের মধ্যে ইসলামী রুচিবোধ সৃষ্টি হবে। নতুন বংশধরদের জন্যে আমাদের এসব কিছুর প্রয়োজন। কাজেই যেসব মহিলা ইসলামকে জেনে বুঝে গ্রহণ করবেন এ প্রয়োজন পূরণ করার জন্যে তাদেরকে নিজেদের ক্রোড় ও গৃহকে মুসলমানে পরিণত করতে হবে।

চতুর্থ কাজ :
আপনাদের চতুর্থ কাজ হচ্ছে এই যে, আপনারা পরিবারের পুরুষদের ওপর প্রভাব বিস্তার করুন। স্বামী, পুত্র, পিতা ও ভ্রাতাদেরকে ইসলামী জীবন যাপনের জন্যে আহ্বান করুন। জানি না মেয়েরা কী কারণে এ ভুল ধারণা পোষণ করে যে, তারা পুরুষদেরকে প্রভাবিত করতে পারে না। অথচ প্রকৃতপক্ষে মেয়েরা পুরুষদের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে। মুসলমান মেয়েরা যদি একথা বলতে শুরু করে যে, তারা হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও হযরত আবু বকর (রা)-এর চেহারা পছন্দ করে, কিন্তু চার্চিল ও ট্রম্যানের চেহারা পছন্দ করে না, তাহলে দেখবেন মুসলমান যুবকদের চেহারা দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।
মুসলমান মেয়েরা যদি বলতে শুরু করে যে, 'কালো' সাহেবদের জীবনধারা তারা পছন্দ করে না বরং সালাত, সওম, পরহেযগারী, সচ্চরিত্রতা, আল্লাহভীতি, ইসলামী আদব-কায়দা ও ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি প্রকাশ যে জীবনে সুস্পষ্ট এমন ইসলামী জীবনকেই তারা ভালবাসে তাহলে আপনাদের চোখের সামনেই পুরুষদের জীবনে পরিবর্তন দেখা দেবে।
মুসলমান স্ত্রীরা যদি স্বামীকে পরিষ্কাভাবে বলে দেয় যে, হারাম পথে উপার্জিত অর্থে সজ্জিত ড্রইং রুম তারা পছন্দ করে না, ঘুষের টাকায় বিলাস বহুল জীবন যাপন করতে তারা প্রস্তুত নয় বরং হালাল পথে উপার্জিত সীমিত অর্থে নুনভাত খেয়ে ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরে বসবাসই তাদের নিকট অধিকতর প্রিয়, তাহলে হারাম উপায়ে অর্থোপার্জনের বিভিন্ন কারণ অংকুরেই বিনষ্ট হবে এবং বহু প্রচলিত অসৎবৃত্তি ও অন্যায়ের মূলোৎপাটিত হবে। অনুরূপভাবে যে সকল বোন ইসলামকে নিজেদের দ্বীন হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন তাঁরা সবাই যদি পরিবেশ ও পরিস্থিতি সংশোধনে আত্মনিয়োগ করেন, তাহলে তারা নিজেদের আত্মীয় পরিজন পরিবারের ব্যক্তিগত ও বাইরের পরিচিত পরিবারসমূহকেও বিভিন্ন ত্রুটি ও অন্যায় থেকে রক্ষা করতে এবং নতুন ও পুরাতন জাহেলিয়াত থেকে পবিত্র করতে পারেন। আপনাদের নিকট মহান কর্তব্যের ডাক এসে গেছে।

আপনাদের আত্মীয়-পরিজন ও পরিচিতজনদের সামনে নরম ও মিষ্ট ভাষায় জাহেলিয়াতের বিভিন্ন পদ্ধতির সমালোচনা করুন। ইসলামের নির্দেশাবলী তাদেরকে বুঝান। ইসলামের বিধি-নিষেধ ও হালাল-হারাম সম্পর্কে তাদেরকে অবগত করুন এবং নিজেরাও ইসলামের বিধি-নিষেধ ও হালাল-হারাম মেনে তাদের সামনে নিজেদের যথার্থ আদর্শ পেশ করুন। এভাবে অগ্রসর হলে আমাদের সমাজের সম্পূর্ণ কাঠামোটাই পরিবর্তিত হতে পারে।

~মাওলানা মওদূদী : বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি

পঠিত : ৩০৮ বার

মন্তব্য: ০