Alapon

কৌতূহল, মজা এবং ভয়াবহ বিপদ

শুয়ে শুয়ে মোবাইলের কন্টাক্ট লিষ্ট দেখছিলো রাফি।  পুরোনো বন্ধুদের নাম্বার দেখে দেখে মেসেজ করছিলো।  কাউকে আবার কলও দিচ্ছে, শাফিনের নাম্বার টা সামনে আসতেই কল দিলো। ক্রিং ক্রিং রিং হওয়ার পর অপরপ্রান্ত হতে ভেসে আসলো,
-হ্যালো, কে বলছেন?
রাফির সাথে সাথেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, দীর্ঘ ৫ বছর ওরা একসাথে ছিলো। খুব কাছের বন্ধু ছিলো একসময়। শহর পরিবর্তনের কারণে এখন দুইজন দুই শহরে। তাই বলে রাফি কে সে ভুলে যাবে? নাম্বার টাও মোবাইল থেকে মুছে ফেলবে?
একটু কষ্ট পেয়ে রাগ করে রাফি জবাব দিলো, আমি সদর থানার ওসি বলছি। শাফিন ভয় পেয়ে কল কেটে দিলো। রাফি এবার খুব মজা পেয়েছে। সে একা একাই হাসছে।


শাফিনকে আর কল না দিয়ে সে মোবাইলের কন্টাক্ট লিষ্টে চোখ রাখলো। তার সামনে একটি অপরিচিত নাম্বার ভেসে উঠে। নাম্বার টি দেখে কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। নাম্বারটি সে চিনতে পারছে না, কার নাম্বার এটি?
কোন নাম দিয়েও সেভ করে নি। কখন সেভ করল সেটাও মনে নাই। অনেকক্ষণ ভেবে একটি টেক্সট পাঠালো- কে আপনি?
কে জানতো এই একটি টেক্সট তার জন্য একদিন কাল হয়ে দাঁড়াবে। 


ফিরতি রিপ্লাই টেক্সট আসলো, আপনি কে?
পরিচয় না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো, কেমন অদ্ভুত মানুষ, ভাবছে রাফি। রাফিও আবার পাল্টা এসএমএস করলো আপনার নাম্বার টা আমার মোবাইলে কিভাবে আসছে জানি না। তাই পরিচয় জানতে চাচ্ছি। অপরপ্রান্ত হতে কোনভাবেই পরিচয় দিচ্ছে না। এভাবে এক মাস অনবরত মেসেজ চালাচালি হয় পরিচয় বের করার জন্য।
কিন্তু কেউ কারো পরিচয় পায় নি।


এতো টুকু পড়ে আপনাদের মনে হতে পারে এটা আবার কেমন গল্প হলো, আগামাথা কিছুই তো বুঝলাম না।  হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছেন। ঘটনা টা এতোটুকু হলে এই নিয়ে আজ কোন গল্প লেখাই হতো না। কিন্তু ঘটনা টা দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক দূর গড়ায়।


মাস খানেক পর রাফির মোবাইলে একটা কল আসে।
-হ্যালো, কে বলছেন?
আমি সদর থানার এস আই পংকজ পাল বলছি।
-ধুর মিয়া, এসব ভাব আমি শিখাই। আমার সাথে এসব করে লাভ নাই। এ বলে কল কেটে দেয় সে।
দুইদিন পর একই নাম্বার থেকে আবার কল আসে। একই পরিচয় দেয়। রাফি আবারও একই ভাবে ধমক দিয়ে কল কেটে দেয়। এভাবে তিনবার তাকে কল দেয়া হয় এবং তিনবারই তাকে একই কথা বলা হয়। শেষ বার মোবাইলের অপরপ্রান্ত হতে তাকে বলা হয়- তুমি একটি মেয়েকে অপহরণ করেছো, সাথে একটি হিন্দু ছেলেও আছে। এই কথা শুনে তো রাফি হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। সে মজা ভাবে তার সাথে কেউ চরম পর্যায়ের মজা করছে। তাই সে একটু ধমকের সুরে বলে- হ্যাঁ, তাই তো। আমি মেয়ে টা অপহরণ করিনি শুধু, তাকে আমার রুমে লুকিয়ে রেখেছি, পারলে তুই এসে নিয়ে যা এস আই'এর বাচ্চা। এ বলে কলের অপরপ্রান্তের লোকটিকে সে কথা বলতে না দিয়েই লাইন টি কেটে দেয়। সে ভাবে শাফিনের সাথে কিছুদিন আগে আমি এমন করেছিলাম, হয়তো সে-ই আমার সাথে এমন করছে। কিন্তু আসল কাহিনী তা ছিলো না। কারো মজা করা ভেবে বিষয় টা কে এভাবে উড়িয়ে দেয়া টা যে তার জন্য কত ভয়াবহ বিপদ হয়ে আসতেছে, তা সে কল্পনাও করতে পারে নি।


রাফি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বসে বসে গল্প করছে তার খুব কাছের বন্ধু মাহিনের সাথে। হরেক রকম টপিক নিয়ে গল্প হচ্ছে দু'জনের মাঝে। কিন্তু একবারও রাফি তার সাথে ঘটে যাওয়া গত কিছুদিনের ঘটনা গুলো মাহিন কে বলে নি। হয়তো সে নিজেও ব্যাপার টাকে পাত্তা দেয় নি। তাই বলার প্রয়োজন মনে করে নি। তাদের কথার মাঝখানে মাহিনের মোবাইলে একটা কল আসে। কিছুক্ষণ কথা হয়, তাদের কথার সারমর্ম ছিলো এমন- নিকটস্থ থানা থেকে তাকে কল দেয়া হয়। জরুরী বিষয়ে ওসি সাহেব মাহিনের সাথে আলাপ করতে চায়। কালই একবার থানা থেকে ঘুরে আসতে অনুরোধ করলো কলদাতা এস আই জসিম সাহেব। মাহিনের কপালে চিন্তার ভাজ। আমি তো কোন অপরাধ করি নি কিংবা কোন অপরাধীর সাথেও আমার সম্পর্ক নাই। কিছু ভেবে পাচ্ছে না সে, কেনইবা তাকে থানায় ডাকা হবে। যাই হোক সে যেহেতু কোন অপরাধ করেনি তাহলে তার ভয় কিসের। পরদিন সে থানায় যায়। যাওয়ার পথে রাফি কে সাথে করে নিয়ে যায়। থানার ওসি'র সাথে ঘন্টা খানেক কথা হলো তাদের। ওসি'র কথা গুলো শুনে দুইজনই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পাথর হয়ে বসে আছে দুইজন। কারো মুখ থেকে কোন কথাই বের হচ্ছিলো না মিনিট তিনেক। মাথায় যেন তাদের আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।


ওসি সাহেবের কথা গুলো ছিলো এমন-
লোকাল থানায় একটি অপহরণের জিডি হয়। রাফির পাশের গ্রামের একটি হিন্দু ছেলে একজন মুসলিম মেয়ে কে নিয়ে পালিয়ে যায়। মেয়েটির পিতা থানায় জিডি করে। হিন্দু ছেলেটির নাম্বার ট্রাকিং করে জানা যায় সে সর্বশেষ রাফির নাম্বারের সাথে অনেক গুলো মেসেজ আদান-প্রদান করে। পুলিশ রাফির নাম্বার টি নিয়ে কয়েকবার এসআই পরিচয় দিয়ে কল দেয়। কিন্তু রাফি উল্টা-পাল্টা বলে কল কেটে দিতো। সর্বশেষ কলে রাফি স্বীকারও করে তার কাছে মেয়ে টি আছে। পুলিশ রাফির নাম্বার ট্র‍্যাকিং করে জানতে পারে সে এই থানার পাশেই আছে। রাফি যেহেতু আগে একবার পুলিশ কে পাত্তা দেয়নি তাই পুলিশ ওর নাম্বার ট্র‍্যাক করে দেখে সে সর্বাধিক কথা বলে মাহিনের সাথে। ওখান থেকে মাহিনের নাম্বার নিয়ে পুলিশ তাকে কল করে। আর এই বিষয়ে বিস্তারিত তদন্তের স্বার্থে মাহিনকে থানায় ডাকা হয়েছে।


সৌভাগ্য বলি আর দুর্ভাগ্য বলি মাহিন থানায় আসার সময় সাথে করে রাফি কেও নিয়ে আসে। যদিও ওসি থেকে ঘটনা শোনার আগ পর্যন্ত মাহিন কিছুই জানতো না।
রাফির এখন সব কিছু মনে পড়ছে। তার মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবুও সে ঘামাচ্ছে। ঘটনার আকস্মিকতায় যে বুঝে উঠতে পারে না সে কি করবে। তার চিন্তায় ছেদ টানে ওসি সাহেব। জিজ্ঞেস করে সত্য করে বলো তুমি কি কি জানো? মেয়ে টা কোথায় আছে? রাফি ওসি সাহেব কে আপ্রান চেষ্টা করে বুঝাতে থাকে আমি শুধুমাত্র কৌতূহলবশতঃ ঐ নাম্বার টায় মেসেজ দিয়েছিলাম, আমি ওকে চিনি না। আর এসআই'এর কল কে আমার কোন এক বন্ধু মজা করছে ভেবে গুরুত্ব দেই নি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি কিভাবে এতো কাহিনী হয়ে গেলো।


ওসি সাহেব রাফির এবং মাহিনের বিস্তারিত ঠিকানা নিলো। পরিবারের সবার নাম্বার নিয়ে লোকাল থানায় ডাকলেই তদন্তের স্বার্থে হাজির হওয়ার মুচলেকা দিয়ে তার পুলিশে চাকরিরত মামার জিম্মায় ছেড়ে দেয়। কিন্তু এই ওসি সাহেবের মতো লোকাল থানার সেই এসআই পংকজ পাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। সে পরদিন রাফি কে সদর থানায় ডাকে। কিন্তু রাফি ভয় পেয়ে যায়। সবাই তাকে থানায় যেতে বারণ করে। এদিকে পংকজ পাল রাফির পরিবার কে হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করে। তখনো জিডিতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু পুলিশ আর বেশিদিন অপেক্ষা করে নি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় মামলা করে দেয় সেই হিন্দু ছেলেটি সহ ৪ জনের নামে। রাফি তাদের মধ্যে অন্যতম।  যে মামলা কে অনেকেই হত্যা মামলার চেয়েও কঠিন বলে থাকেন। সেদিন থেকে রাফি লাপাত্তা। কেউ জানে না রাফি আজ কোথায় আছে।
কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারে না তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেয়া হবে কিনা। হয়তো অযুত স্বপ্নে বিভোর হয়ে আর পথ চলা হবে না আর। পলাতক আসামীর তকমা মাথায় নিয়ে ফেরারি হয়েই দিন কাটবে রাফির।

পঠিত : ৮১৩ বার

মন্তব্য: ০